বেকেনবাওয়ারের ইতিহাস
১৯৮৪ সালে ফিফা ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপের জন্য ইতালিকে মনোনীত করে। বিশ্বকাপ আয়োজনে ইতালির সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। সে সময়ের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও অন্যান্য ব্যাপার বিবেচনা করে সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে উঠেছিল বিশ্বকাপ আয়োজনের অন্যতম দাবিদার। ১৯৮০ সালে অলিম্পিক গেমস আয়োজনের অভিজ্ঞতা থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের আবেদন করে। ১৯৮৪ সালের ১৯ মে ফিফা কংগ্রেসে এক ভোটাভুটিতে ১১-৫ ব্যবধানে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইতালির কাছে হেরে যায়। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন অন্যতম শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও বেশ কিছু রাজনৈতিক ব্যাপারস্যাপার বিশ্বকাপ আয়োজনে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে কাজ করে। এর আগে ইতালি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ’৯০-এর বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য আবেদন করে ইংল্যান্ড, গ্রিস ও ফ্রান্স। পরে ইংল্যান্ড, গ্রিস ও ফ্রান্স বিশ্বকাপ আয়োজনের লড়াই থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিলে ইতালি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ভোটাভুটি হয়।
তবে ১৯৯০ সালের ইতালি বিশ্বকাপকে খেলার মান ও দর্শকদের উপভোগের দিক দিয়ে নিকৃষ্টতম বিশ্বকাপ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এর যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে ’৯০-এর বিশ্বকাপেই সবচেয়ে কম গোল হয়েছে, দলগুলোর মধ্যে দেখা গেছে অসম্ভব বাজে রকমের রক্ষণাত্মক মানসিকতা এবং ছিল লাল-হলুদ কার্ডের ছড়াছড়ি। সব মিলিয়ে দর্শকেরা একেবারেই এ বিশ্বকাপ উপভোগ করতে পারেনি।
আগেই বলা হয়েছে, বিশ্বকাপে এর আগে ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপের মতো গোল-খরা আর কখনই দেখেনি বিশ্ব। সেমিফাইনালে ইতালি, ইংল্যান্ড, জার্মানি ও আর্জেন্টিনার মতো দেশগুলো উঠলেও দুটি সেমিফাইনালই নিষ্পত্তি হয়েছে টাইব্রেকারে। ফাইনালে আর্জেন্টিনার পীড়াদায়ক রক্ষণাত্মক ফুটবল সবার মধ্যে বিরক্তিরই উদ্রেক করেছিল। বিশ্বকাপ ফুটবল ইতিহাসের নিকৃষ্টতম ও বিতর্কিত রেফারিং ইতালি বিশ্বকাপকে করেছিল কলুষিত।
ফাইনালে আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা আজও ভুলে যেতে পারেনি মেক্সিকোর রেফারি কোডেশাল মেন্ডেজের সেই বিতর্কিত পেনাল্টির সিদ্ধান্তটি। যেই পেনাল্টি গোলেই আর্জেন্টিনাকে ১-০ গোলে হারিয়ে পশ্চিম জার্মানি জয় করে ’৯০-এর বিশ্বকাপের শিরোপা।
পুরো ’৯০-এর বিশ্বকাপ দৃষ্টিনন্দন ফুটবলের অভাবে ম্রিয়মাণ থাকলেও এ প্রতিযোগিতায় আশ্চর্য ব্যতিক্রম ছিল লোথার ম্যাথিয়াস, ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যান আর রুডি ফোলারের জার্মানি। ১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের কোচিংয়ে জার্মানি ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপে দারুণ গতিশীল ও ছকবদ্ধ ফুটবল উপহার দেয়। ’৯০-এর বিশ্বকাপে শিরোপা জয়ে জার্মানির মতো সংঘবদ্ধ আর কোনো দলকেই মনে হয়নি।
১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা প্রতিযোগিতা উদ্বোধনী ম্যাচেই ১-০ গোলে হেরে যায় আফ্রিকার প্রতিনিধি ক্যামেরুনের কাছে। ’৯০-এর বিশ্বকাপের বিস্ময় ক্যামেরুন এই প্রতিযোগিতার কোয়ার্টার ফাইনালে খেলে সবাইকে চমকে দেয়। কোয়ার্টার ফাইনালে বিতর্কিত রেফারিংয়ের শিকার না হলে তাদের সেমিফাইনালেই দেখা যেত। সেই ম্যাচে দুবার এগিয়ে গিয়েও রেফারির দেওয়া দুটি পেনাল্টি গোলে ইংল্যান্ডের কাছে ৩-২ গোলে হেরে যায় ক্যামেরুন।
স্বাগতিক ইতালি শক্তিশালী দল নিয়ে মোটামুটি ভালোভাবেই সেমিফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে এক গোলে এগিয়ে গেলেও পরবর্তীকালে গোল খেয়ে টাইব্রেকারে হেরে যায়। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে অবশ্য ইংল্যান্ডকে ২-১ গোলে হারিয়ে ইতালি ’৯০-এর বিশ্বকাপে তৃতীয় স্থান অর্জন করে।
১৯৯০ সালের বিশ্বকাপ অবশ্য স্মরণীয় হয়ে আছে কয়েকজন খেলোয়াড়ের অনন্য নৈপুণ্যের কারণে। প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় ম্যাচে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার নিয়মিত গোলরক্ষক পম্পিডোর হাত ভেঙে গেলে পুরো বিশ্বকাপেই আর্জেন্টিনার গোলবার আগলান তরুণ গোলরক্ষক সার্জিও গয়কোচিয়া। পরে কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমিফাইনালে দুটো করে পেনাল্টি ঠেকিয়ে গয়কোচিয়া আর্জেন্টিনাকে নিয়ে যান ফাইনালে। আরেক আর্জেন্টাইন ক্লদিও ক্যানিজিয়া ছিলেন ’৯০-এর বিশ্বকাপের উজ্জ্বল নক্ষত্র। দ্বিতীয় রাউন্ডে একমাত্র সফল আক্রমণ থেকে ম্যারাডোনার বাড়ানো বলে ব্রাজিলের বিপক্ষে একটি সুযোগ সন্ধানী গোলের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন ক্যানিজিয়া। সেমিফাইনালে ইতালির বিপক্ষে আর্জেন্টিনার সমতাসূচক গোলটিও আসে তাঁরই পা থেকে। ইতালির রবার্তো ব্যাজ্জিও ’৯০-এর বিশ্বকাপে নিজেকে ইতালি দলের অন্যতম ভরসায় পরিণত করেন। একই দলের গোলরক্ষক ওয়াল্টার জেঙ্গা পুরো বিশ্বকাপে গোল হজম করেছিলেন মাত্র দুটি। বিশ্বকাপে দীর্ঘসময় অপরাজিত থাকার অনন্য রেকর্ডটিও তাঁর। আরেক ‘আজ্জুরি’ পাওলো মালদিনি এ বিশ্বকাপেই প্রমাণ করে দেন, ইতালির ফুটবল ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হওয়ার সব গুণাবলি তাঁর রয়েছে। আফ্রিকার ‘অদম্য সিংহ’ ক্যামেরুনের ৩৮ বছর বয়স্ক রজার মিলা সঠিক সময়ে চারটি গোল করে দলের সাফল্যে সবচেয়ে বড় অবদান রাখেন। গোল করার পর কর্নার পতাকার কাছে গিয়ে কোমর দুলিয়ে তাঁর অনন্য নৃত্য আজও মনে রেখেছেন ফুটবলামোদীরা। জার্মানির ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যান, গোলরক্ষক বেডে ইলগনার, যুগোস্লাভিয়ার ড্রাগন স্টইকোভিচ, চেকোস্লোভাকিয়ার আন্দ্রে স্কুরভি, রুমানিয়ার জর্জ হ্যাজি, ক্যামেরুনের ওমাম বিইক, কানা বিইক, ম্যাকানাকি, ইংল্যান্ডের পল গ্যাসকোয়েন, ডেভিড প্ল্যাট প্রমুখ খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত ক্যারিশমার কারণেই স্মরণীয় হয়ে আছে ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপ।
১৯৯০ সালের বিশ্বকাপের দুজন ‘ফ্লপ’ তারকাও ছিলেন। তাঁরা হলেন নেদারল্যান্ডের রুড খুলিত ও মার্কো ভ্যান বাস্তেন। ১৯৮৮ সালের ইউরো চ্যাম্পিয়ন নেদারল্যান্ডের এই দুই তারকাকে নিয়ে বিশ্বকাপের আগ থেকেই অনেক আলোচনা হয়। অনেকেই ভবিষ্যদ্বাণী করেন, এই দুই তারকার ওপর ভর করেই নেদারল্যান্ড বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হবে। কিন্তু আদতে পুরো বিশ্বকাপেই খুলিতের একমাত্র কাজ ছিল, মাথাভর্তি অদ্ভুত-দর্শন চুল নাচিয়ে মাঠময় দৌড়িয়ে বেড়ানো আর বাস্তেন বিশ্বকাপে কেন যেন ছিলেন একেবারই নিষ্প্রভ। অথচ এ দুজনকেই নেদারল্যান্ডের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা তারকা বলা হয়ে থাকে। খুলিত ও বাস্তেন ছাড়াও রোনাল্ড কোয়েম্যান, রাইকার্ডের নেদারল্যান্ড ইতিহাসের অন্যতম সেরা দল নিয়ে খেলতে এলেও ’৯০-এর বিশ্বকাপে কিছুই করতে পারেনি। তবে রাইকার্ডকে মনে রাখতে হবে অন্য একটি কারণে। বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে জার্মানির বিপক্ষে ম্যাচে রাইকার্ড জার্মানির রুডি ফোলারের সঙ্গে এক ‘থুথু ছোড়াছুড়ি’ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। একটি সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ দুজন দুজনের দিকে রীতিমতো গলা খাঁকারি দিয়ে থুথু ছুড়তে থাকেন। বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আছে এ ঘটনাটি। খেলায় আন্দ্রেস ব্রেইমে ও ক্লিন্সম্যানের দেওয়া দুই গোলে জার্মানি ২-১ গোলে নেদারল্যান্ডকে পরাজিত করে।
এত কথার ভিড়ে হারিয়েই গিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার ডিয়েগো ম্যারাডোনা। ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই এসে যায় ডিয়েগো ম্যারাডোনার নাম। পায়ের পাতায় ইনজুরি নিয়ে পুরো বিশ্বকাপে দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন ম্যারাডোনা। দ্বিতীয় রাউন্ডে ব্রাজিলের বিপক্ষে চমত্কারভাবে ক্লদিও ক্যানিজিয়াকে গোলের জন্য বল বানিয়ে দেন ম্যারাডোনা। সেদিন সেই ম্যাচে ওই একবারই ম্যারাডোনা ব্রাজিলীয় রক্ষণভাগের পাহারা ছেড়ে বেরিয়ে আসেন স্বমহিমায়। একটি বলকেই নিশ্চিত গোলের সুযোগে পরিণত করেন ম্যারাডোনা। ক্যানিজিয়ার সেই গোলটিতেই বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিশ্চিত হয়ে যায় ব্রাজিলের।
ফাইনালে মেক্সিকান রেফারি কোডেশাল মেন্ডেজের পেনাল্টি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে গিয়ে হলুদ কার্ডের খড়গ পড়ে তাঁর ওপর। ফাইনালে হেরে যাওয়ার পর ফিফা সভাপতি জোয়াও হ্যাভালাঞ্জের সঙ্গে হাত না মিলিয়ে সবাইকে অবাক করে দেয়। এর পরেই ম্যারাডোনার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদার দৃশ্য আজও দাগ কাটে বিশ্বের কোটি কোটি ফুটবল ভক্তদের মনে।
১৯৯০ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে জার্মানি ও আর্জেন্টিনার মধ্যকার খেলাটিকে বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসের নিকৃষ্টতম ফাইনাল হিসেবে অভিহিত করা হয়। হলুদ কার্ডজনিত কারণে আর্জেন্টিনার পক্ষে সেদিন খেলতে পারেননি ’৯০-এর বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার মূল গোল মেশিন হিসেবে পরিচিত ক্লদিও ক্যানিজিয়া। সে কারণেই হয়তো আর্জেন্টাইন কোচ কার্লোস বিলার্দো পুরো ম্যাচেই রক্ষণাত্মক কৌশল গ্রহণ করেন। পুরো খেলায় আর্জেন্টিনার কমপক্ষে আটজন খেলোয়াড় দৃষ্টিকটুভাবে রক্ষণসীমানায় দাঁড়িয়ে থেকে জার্মান আক্রমণ ঠেকাতে থাকেন। গোটা ম্যাচে আর্জেন্টিনাকে একটি আক্রমণও করতে দেখা যায়নি, যার মাধ্যমে গোল হতে পারত। খেলা শেষ হওয়ার ১০ মিনিট আগে একটি জার্মান আক্রমণ থেকে বিদ্যুত্গতিতে আর্জেন্টিনার বক্সে বল নিয়ে ঢুকে যেতে থাকেন ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যান। আর্জেন্টিনার ডিফেন্ডার রবার্তো সেনসিনি ক্লিন্সম্যানকে বাধা দেন। এ সময় ক্লিন্সম্যান ডাইভ দিয়ে পেনাল্টি বক্সের মধ্যে পড়ে গেলে মেক্সিকান রেফারি কোডেশাল মেন্ডেজ পেনাল্টির নির্দেশ দেন। পেনাল্টি থেকে গোল করেন জার্মানির আন্দ্রেস ব্রেইমে। ম্যাচে আর্জেন্টিনা লাল কার্ডজনিত কারণে শেষ পাঁচ মিনিট খেলে নয়জন খেলোয়াড় নিয়ে।
শেষ পর্যন্ত বিশ্লেষকদের ধারণামতো বিশ্বকাপের শিরোপা ওঠে জার্মানির হাতে। কিন্তু ফাইনালে রেফারির বিতর্কিত কর্মকাণ্ড কিছুটা হলেও কালিমালিপ্ত করে জার্মানির এ সাফল্য। লোথার ম্যাথিয়াস তৃতীয় জার্মান অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বকাপের ট্রফিতে চুমু খান। অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বকাপ জয়ের পর কোচ হিসেবেও বিশ্বকাপ জয়ের অনন্য গৌরবের অধিকারী হন ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার।
তবে ১৯৯০ সালের ইতালি বিশ্বকাপকে খেলার মান ও দর্শকদের উপভোগের দিক দিয়ে নিকৃষ্টতম বিশ্বকাপ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এর যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে ’৯০-এর বিশ্বকাপেই সবচেয়ে কম গোল হয়েছে, দলগুলোর মধ্যে দেখা গেছে অসম্ভব বাজে রকমের রক্ষণাত্মক মানসিকতা এবং ছিল লাল-হলুদ কার্ডের ছড়াছড়ি। সব মিলিয়ে দর্শকেরা একেবারেই এ বিশ্বকাপ উপভোগ করতে পারেনি।
আগেই বলা হয়েছে, বিশ্বকাপে এর আগে ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপের মতো গোল-খরা আর কখনই দেখেনি বিশ্ব। সেমিফাইনালে ইতালি, ইংল্যান্ড, জার্মানি ও আর্জেন্টিনার মতো দেশগুলো উঠলেও দুটি সেমিফাইনালই নিষ্পত্তি হয়েছে টাইব্রেকারে। ফাইনালে আর্জেন্টিনার পীড়াদায়ক রক্ষণাত্মক ফুটবল সবার মধ্যে বিরক্তিরই উদ্রেক করেছিল। বিশ্বকাপ ফুটবল ইতিহাসের নিকৃষ্টতম ও বিতর্কিত রেফারিং ইতালি বিশ্বকাপকে করেছিল কলুষিত।
ফাইনালে আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা আজও ভুলে যেতে পারেনি মেক্সিকোর রেফারি কোডেশাল মেন্ডেজের সেই বিতর্কিত পেনাল্টির সিদ্ধান্তটি। যেই পেনাল্টি গোলেই আর্জেন্টিনাকে ১-০ গোলে হারিয়ে পশ্চিম জার্মানি জয় করে ’৯০-এর বিশ্বকাপের শিরোপা।
পুরো ’৯০-এর বিশ্বকাপ দৃষ্টিনন্দন ফুটবলের অভাবে ম্রিয়মাণ থাকলেও এ প্রতিযোগিতায় আশ্চর্য ব্যতিক্রম ছিল লোথার ম্যাথিয়াস, ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যান আর রুডি ফোলারের জার্মানি। ১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের কোচিংয়ে জার্মানি ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপে দারুণ গতিশীল ও ছকবদ্ধ ফুটবল উপহার দেয়। ’৯০-এর বিশ্বকাপে শিরোপা জয়ে জার্মানির মতো সংঘবদ্ধ আর কোনো দলকেই মনে হয়নি।
১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা প্রতিযোগিতা উদ্বোধনী ম্যাচেই ১-০ গোলে হেরে যায় আফ্রিকার প্রতিনিধি ক্যামেরুনের কাছে। ’৯০-এর বিশ্বকাপের বিস্ময় ক্যামেরুন এই প্রতিযোগিতার কোয়ার্টার ফাইনালে খেলে সবাইকে চমকে দেয়। কোয়ার্টার ফাইনালে বিতর্কিত রেফারিংয়ের শিকার না হলে তাদের সেমিফাইনালেই দেখা যেত। সেই ম্যাচে দুবার এগিয়ে গিয়েও রেফারির দেওয়া দুটি পেনাল্টি গোলে ইংল্যান্ডের কাছে ৩-২ গোলে হেরে যায় ক্যামেরুন।
স্বাগতিক ইতালি শক্তিশালী দল নিয়ে মোটামুটি ভালোভাবেই সেমিফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে এক গোলে এগিয়ে গেলেও পরবর্তীকালে গোল খেয়ে টাইব্রেকারে হেরে যায়। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে অবশ্য ইংল্যান্ডকে ২-১ গোলে হারিয়ে ইতালি ’৯০-এর বিশ্বকাপে তৃতীয় স্থান অর্জন করে।
১৯৯০ সালের বিশ্বকাপ অবশ্য স্মরণীয় হয়ে আছে কয়েকজন খেলোয়াড়ের অনন্য নৈপুণ্যের কারণে। প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় ম্যাচে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার নিয়মিত গোলরক্ষক পম্পিডোর হাত ভেঙে গেলে পুরো বিশ্বকাপেই আর্জেন্টিনার গোলবার আগলান তরুণ গোলরক্ষক সার্জিও গয়কোচিয়া। পরে কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমিফাইনালে দুটো করে পেনাল্টি ঠেকিয়ে গয়কোচিয়া আর্জেন্টিনাকে নিয়ে যান ফাইনালে। আরেক আর্জেন্টাইন ক্লদিও ক্যানিজিয়া ছিলেন ’৯০-এর বিশ্বকাপের উজ্জ্বল নক্ষত্র। দ্বিতীয় রাউন্ডে একমাত্র সফল আক্রমণ থেকে ম্যারাডোনার বাড়ানো বলে ব্রাজিলের বিপক্ষে একটি সুযোগ সন্ধানী গোলের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন ক্যানিজিয়া। সেমিফাইনালে ইতালির বিপক্ষে আর্জেন্টিনার সমতাসূচক গোলটিও আসে তাঁরই পা থেকে। ইতালির রবার্তো ব্যাজ্জিও ’৯০-এর বিশ্বকাপে নিজেকে ইতালি দলের অন্যতম ভরসায় পরিণত করেন। একই দলের গোলরক্ষক ওয়াল্টার জেঙ্গা পুরো বিশ্বকাপে গোল হজম করেছিলেন মাত্র দুটি। বিশ্বকাপে দীর্ঘসময় অপরাজিত থাকার অনন্য রেকর্ডটিও তাঁর। আরেক ‘আজ্জুরি’ পাওলো মালদিনি এ বিশ্বকাপেই প্রমাণ করে দেন, ইতালির ফুটবল ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হওয়ার সব গুণাবলি তাঁর রয়েছে। আফ্রিকার ‘অদম্য সিংহ’ ক্যামেরুনের ৩৮ বছর বয়স্ক রজার মিলা সঠিক সময়ে চারটি গোল করে দলের সাফল্যে সবচেয়ে বড় অবদান রাখেন। গোল করার পর কর্নার পতাকার কাছে গিয়ে কোমর দুলিয়ে তাঁর অনন্য নৃত্য আজও মনে রেখেছেন ফুটবলামোদীরা। জার্মানির ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যান, গোলরক্ষক বেডে ইলগনার, যুগোস্লাভিয়ার ড্রাগন স্টইকোভিচ, চেকোস্লোভাকিয়ার আন্দ্রে স্কুরভি, রুমানিয়ার জর্জ হ্যাজি, ক্যামেরুনের ওমাম বিইক, কানা বিইক, ম্যাকানাকি, ইংল্যান্ডের পল গ্যাসকোয়েন, ডেভিড প্ল্যাট প্রমুখ খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত ক্যারিশমার কারণেই স্মরণীয় হয়ে আছে ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপ।
১৯৯০ সালের বিশ্বকাপের দুজন ‘ফ্লপ’ তারকাও ছিলেন। তাঁরা হলেন নেদারল্যান্ডের রুড খুলিত ও মার্কো ভ্যান বাস্তেন। ১৯৮৮ সালের ইউরো চ্যাম্পিয়ন নেদারল্যান্ডের এই দুই তারকাকে নিয়ে বিশ্বকাপের আগ থেকেই অনেক আলোচনা হয়। অনেকেই ভবিষ্যদ্বাণী করেন, এই দুই তারকার ওপর ভর করেই নেদারল্যান্ড বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হবে। কিন্তু আদতে পুরো বিশ্বকাপেই খুলিতের একমাত্র কাজ ছিল, মাথাভর্তি অদ্ভুত-দর্শন চুল নাচিয়ে মাঠময় দৌড়িয়ে বেড়ানো আর বাস্তেন বিশ্বকাপে কেন যেন ছিলেন একেবারই নিষ্প্রভ। অথচ এ দুজনকেই নেদারল্যান্ডের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা তারকা বলা হয়ে থাকে। খুলিত ও বাস্তেন ছাড়াও রোনাল্ড কোয়েম্যান, রাইকার্ডের নেদারল্যান্ড ইতিহাসের অন্যতম সেরা দল নিয়ে খেলতে এলেও ’৯০-এর বিশ্বকাপে কিছুই করতে পারেনি। তবে রাইকার্ডকে মনে রাখতে হবে অন্য একটি কারণে। বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে জার্মানির বিপক্ষে ম্যাচে রাইকার্ড জার্মানির রুডি ফোলারের সঙ্গে এক ‘থুথু ছোড়াছুড়ি’ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। একটি সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ দুজন দুজনের দিকে রীতিমতো গলা খাঁকারি দিয়ে থুথু ছুড়তে থাকেন। বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আছে এ ঘটনাটি। খেলায় আন্দ্রেস ব্রেইমে ও ক্লিন্সম্যানের দেওয়া দুই গোলে জার্মানি ২-১ গোলে নেদারল্যান্ডকে পরাজিত করে।
এত কথার ভিড়ে হারিয়েই গিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার ডিয়েগো ম্যারাডোনা। ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই এসে যায় ডিয়েগো ম্যারাডোনার নাম। পায়ের পাতায় ইনজুরি নিয়ে পুরো বিশ্বকাপে দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন ম্যারাডোনা। দ্বিতীয় রাউন্ডে ব্রাজিলের বিপক্ষে চমত্কারভাবে ক্লদিও ক্যানিজিয়াকে গোলের জন্য বল বানিয়ে দেন ম্যারাডোনা। সেদিন সেই ম্যাচে ওই একবারই ম্যারাডোনা ব্রাজিলীয় রক্ষণভাগের পাহারা ছেড়ে বেরিয়ে আসেন স্বমহিমায়। একটি বলকেই নিশ্চিত গোলের সুযোগে পরিণত করেন ম্যারাডোনা। ক্যানিজিয়ার সেই গোলটিতেই বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিশ্চিত হয়ে যায় ব্রাজিলের।
ফাইনালে মেক্সিকান রেফারি কোডেশাল মেন্ডেজের পেনাল্টি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে গিয়ে হলুদ কার্ডের খড়গ পড়ে তাঁর ওপর। ফাইনালে হেরে যাওয়ার পর ফিফা সভাপতি জোয়াও হ্যাভালাঞ্জের সঙ্গে হাত না মিলিয়ে সবাইকে অবাক করে দেয়। এর পরেই ম্যারাডোনার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদার দৃশ্য আজও দাগ কাটে বিশ্বের কোটি কোটি ফুটবল ভক্তদের মনে।
১৯৯০ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে জার্মানি ও আর্জেন্টিনার মধ্যকার খেলাটিকে বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসের নিকৃষ্টতম ফাইনাল হিসেবে অভিহিত করা হয়। হলুদ কার্ডজনিত কারণে আর্জেন্টিনার পক্ষে সেদিন খেলতে পারেননি ’৯০-এর বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার মূল গোল মেশিন হিসেবে পরিচিত ক্লদিও ক্যানিজিয়া। সে কারণেই হয়তো আর্জেন্টাইন কোচ কার্লোস বিলার্দো পুরো ম্যাচেই রক্ষণাত্মক কৌশল গ্রহণ করেন। পুরো খেলায় আর্জেন্টিনার কমপক্ষে আটজন খেলোয়াড় দৃষ্টিকটুভাবে রক্ষণসীমানায় দাঁড়িয়ে থেকে জার্মান আক্রমণ ঠেকাতে থাকেন। গোটা ম্যাচে আর্জেন্টিনাকে একটি আক্রমণও করতে দেখা যায়নি, যার মাধ্যমে গোল হতে পারত। খেলা শেষ হওয়ার ১০ মিনিট আগে একটি জার্মান আক্রমণ থেকে বিদ্যুত্গতিতে আর্জেন্টিনার বক্সে বল নিয়ে ঢুকে যেতে থাকেন ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যান। আর্জেন্টিনার ডিফেন্ডার রবার্তো সেনসিনি ক্লিন্সম্যানকে বাধা দেন। এ সময় ক্লিন্সম্যান ডাইভ দিয়ে পেনাল্টি বক্সের মধ্যে পড়ে গেলে মেক্সিকান রেফারি কোডেশাল মেন্ডেজ পেনাল্টির নির্দেশ দেন। পেনাল্টি থেকে গোল করেন জার্মানির আন্দ্রেস ব্রেইমে। ম্যাচে আর্জেন্টিনা লাল কার্ডজনিত কারণে শেষ পাঁচ মিনিট খেলে নয়জন খেলোয়াড় নিয়ে।
শেষ পর্যন্ত বিশ্লেষকদের ধারণামতো বিশ্বকাপের শিরোপা ওঠে জার্মানির হাতে। কিন্তু ফাইনালে রেফারির বিতর্কিত কর্মকাণ্ড কিছুটা হলেও কালিমালিপ্ত করে জার্মানির এ সাফল্য। লোথার ম্যাথিয়াস তৃতীয় জার্মান অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বকাপের ট্রফিতে চুমু খান। অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বকাপ জয়ের পর কোচ হিসেবেও বিশ্বকাপ জয়ের অনন্য গৌরবের অধিকারী হন ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার।
No comments