...এবং ম্যারাডোনা
প্রথম আলো অফিসের উল্টো দিকের পাঁচতলা ভবনের ছাদে একই লোহার পাইপে তিনটি পতাকা। আর্জেন্টিনার আকাশি-সাদা, ব্রাজিলের সবুজ-হলুদ...সবার ওপরে বাংলাদেশের লাল-সবুজ। দেখে মনে হলো, অন্তত এই দেশে বিশ্বকাপ ফুটবলের এর চেয়ে আদর্শ প্রতীকী উপস্থাপনা আর হতে পারে না!
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত প্রশ্ন তো এখন এটাই—ব্রাজিল, না আর্জেন্টিনা? তুলনাটা একটু বেমানান মনে হতে পারে, কিন্তু সেটিই যে মনে হলো! যেন কোরবানির ঈদের আগে-আগে মুখে-মুখে ফেরা সেই প্রশ্ন—গরু, না খাসি?
একটা সময়ে বাংলাদেশের সুস্থ-স্বাভাবিক প্রায় সব মানুষকেই যেমন ‘হয় আবাহনী, নয় মোহামেডান’ বলে ভাগ করা যেত; বিশ্বকাপ এলেই বাংলাদেশ যেন দুই ভাগ। হয় ব্রাজিল, নয় আর্জেন্টিনা।
বাংলাদেশের জন্য বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলাটা যেখানে স্বপ্ন, এবং ‘আশা’ করা যায় চিরদিনই তা-ই হয়ে থাকবে; অন্য দেশকে সমর্থন করাটা খুবই স্বাভাবিক। যেটি অস্বাভাবিকতার পর্যায়ে পড়ে তা হলো, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে উন্মাদনার বাড়াবাড়ি। তর্কাতর্কি-খোঁচাখুঁচি ঠিক আছে। সমর্থনের মজা তো এটাই। কিন্তু তাই বলে কোথাকার কোন ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার জন্য মারামারিও করতে হবে!
সেটিও তো হচ্ছে। কদিন আগে কোথায় যেন দু দলের সমর্থকদের তুমুল মারামারি হয়ে গেল। ডেইলি স্টার খবরটার সঙ্গে দারুণ একটা কার্টুন ছেপেছে। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার পতাকা হাতে দু দল লাঠিসোঁটা নিয়ে মহারণে লিপ্ত...দুঙ্গা আর ম্যারাডোনা প্রবল বিস্ময়ে একে অন্যকে প্রশ্ন করছেন—‘ওরা আমাদের পতাকা নিয়ে মারামারি করছে কেন?’
এসব দেখেশুনে মাঝেমধ্যে মনে প্রশ্ন জাগে, বিশ্বকাপটা শুধু ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাই খেলছে নাকি! আর কোনো দল কি বিশ্বকাপে কিছু করেনি! ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স...স্পেন-পর্তুগাল বিশ্বকাপ না জিতলেও তো দারুণ ফুটবল খেলে।
বিশ্বকাপ জেতাটা আসলে এখানে বিবেচ্যই নয়। আর্জেন্টিনার চেয়ে তো বেশিবার বিশ্বকাপ জিতেছে ইতালি ও জার্মানি। কই, ওদের পতাকা তো বলতে গেলে চোখেই পড়ে না! বাংলাদেশে ওই দু দলের সমর্থক নেই, এমন নয়। ফ্রান্সের খেলাও অনেকে খুব পছন্দ করেন। কিন্তু ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা দ্বৈরথে ওই সমর্থকেরা চিৎকার করলেও সেটি ‘চিঁচিঁ’ আওয়াজ বলে মনে হয়!
বাংলাদেশের আর্জেন্টিনা-সমর্থকেরা খুব আবেগী। এই যে ইতালি-জার্মানি আর্জেন্টিনার চেয়ে বেশি বিশ্বকাপ জিতেছে—এটা মনে করিয়ে দেওয়াতেই যেমন অনেকে ক্ষুব্ধ হবেন। মজাটা হলো, ক্ষুব্ধ হয়ে কেউ এই লেখককে ইতালি বা জার্মানির সমর্থক বলবেন না। নির্ঘাত বলবেন, ‘বুঝেছি, এই ব্যাটা ব্রাজিলের সমর্থক!’
এই সমর্থনের আরেকটি ব্যাপারও আমাকে খুব ভাবায়। নিজের দেশ যখন খেলে, ভালো খেলুক-খারাপ খেলুক, সমর্থনে কোনো হেরফের না হওয়াই স্বাভাবিক। যেনতেনভাবে হলেও আমার দেশের জয় তো আমি চাইবই। কিন্তু ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ক্ষেত্রে কেন এমন হবে? ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে সাম্বার ছন্দ দেখে যে ব্রাজিলের সমর্থক, সেই ছন্দ হারিয়ে গেলেও সে কেন ব্রাজিল-ব্রাজিল বলে গলা ফাটাবে? আর্জেন্টাইনদের বল স্কিলে মুগ্ধ হয়ে যে আর্জেন্টিনার সমর্থক, ১৯৯০ বিশ্বকাপে জঘন্য নেতিবাচক ফুটবল খেলার পরও সে কেন আর্জেন্টিনা ওই বিশ্বকাপটি জিততে পারেনি বলে হাহাকার করবে?
সমর্থনের এ এক অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব। যুক্তি দিয়ে যেটির ব্যাখ্যা দেওয়া খুব কঠিন। সমর্থন মানেই যে আবেগ। আর, আবেগ আর যুক্তির তো চির বৈরিতা। তবে বাংলাদেশে যারা আর্জেন্টিনার সমর্থক, একটি শব্দেই তাদের আবেগের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। ম্যারাডোনা!
১৯৮৬ বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশের খুব বেশি মানুষ ‘আর্জেন্টিনা’ নামের দেশটা কোথায়, সেটিই জানত না। জানাল সেই বিশ্বকাপ। সেই বিশ্বকাপে অনেকগুলো ব্যাপার একসঙ্গে ঘটল। সেবারই প্রথম বাংলাদেশ টেলিভিশনে সবচেয়ে বেশি খেলা সরাসরি সম্প্রচারিত হলো। সাদা-কালো ছবির টেলিভিশন রঙিন হয়ে উচ্চবিত্তের সীমা ছাড়িয়ে মধ্যবিত্তের ঘরেও ঢুকতে শুরু করেছে তখন। বাংলাদেশের মানুষ সেবারই প্রথম প্রাণভরে বিশ্বকাপ দেখল। দেখল এক ফুটবল-জাদুকরকেও, রঙিন টেলিভিশন ফুঁড়ে বেরিয়ে যিনি ঢুকে গেলেন মানুষের হূদয়ে।
এরপর যতই সময় পেরিয়েছে, প্রিয় খেলোয়াড় থেকে ম্যারাডোনা হয়ে উঠেছেন এক আবেগের নাম। খেলার বাইরে তাঁর এত সব কাণ্ডকীর্তি, অথচ তাতে যেন আরও হাওয়া লেগেছে ওই আবেগের পালে। ম্যারাডোনা হয়ে উঠেছেন আরও আপন—‘আরে, এ তো অন্য গ্রহের কেউ নয়। আমাদের মতোই একজন। ভুল করে, অন্যায় করে, প্রতিজ্ঞা করে আবার তা ভুলে যায়।’
বাকি বিশ্ব আর্জেন্টিনাকে অন্য পরিচয়েও চেনে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে আর্জেন্টিনা নামটির অর্থ একটাই। ডিয়েগো ম্যারাডোনা!
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত প্রশ্ন তো এখন এটাই—ব্রাজিল, না আর্জেন্টিনা? তুলনাটা একটু বেমানান মনে হতে পারে, কিন্তু সেটিই যে মনে হলো! যেন কোরবানির ঈদের আগে-আগে মুখে-মুখে ফেরা সেই প্রশ্ন—গরু, না খাসি?
একটা সময়ে বাংলাদেশের সুস্থ-স্বাভাবিক প্রায় সব মানুষকেই যেমন ‘হয় আবাহনী, নয় মোহামেডান’ বলে ভাগ করা যেত; বিশ্বকাপ এলেই বাংলাদেশ যেন দুই ভাগ। হয় ব্রাজিল, নয় আর্জেন্টিনা।
বাংলাদেশের জন্য বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলাটা যেখানে স্বপ্ন, এবং ‘আশা’ করা যায় চিরদিনই তা-ই হয়ে থাকবে; অন্য দেশকে সমর্থন করাটা খুবই স্বাভাবিক। যেটি অস্বাভাবিকতার পর্যায়ে পড়ে তা হলো, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে উন্মাদনার বাড়াবাড়ি। তর্কাতর্কি-খোঁচাখুঁচি ঠিক আছে। সমর্থনের মজা তো এটাই। কিন্তু তাই বলে কোথাকার কোন ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার জন্য মারামারিও করতে হবে!
সেটিও তো হচ্ছে। কদিন আগে কোথায় যেন দু দলের সমর্থকদের তুমুল মারামারি হয়ে গেল। ডেইলি স্টার খবরটার সঙ্গে দারুণ একটা কার্টুন ছেপেছে। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার পতাকা হাতে দু দল লাঠিসোঁটা নিয়ে মহারণে লিপ্ত...দুঙ্গা আর ম্যারাডোনা প্রবল বিস্ময়ে একে অন্যকে প্রশ্ন করছেন—‘ওরা আমাদের পতাকা নিয়ে মারামারি করছে কেন?’
এসব দেখেশুনে মাঝেমধ্যে মনে প্রশ্ন জাগে, বিশ্বকাপটা শুধু ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাই খেলছে নাকি! আর কোনো দল কি বিশ্বকাপে কিছু করেনি! ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স...স্পেন-পর্তুগাল বিশ্বকাপ না জিতলেও তো দারুণ ফুটবল খেলে।
বিশ্বকাপ জেতাটা আসলে এখানে বিবেচ্যই নয়। আর্জেন্টিনার চেয়ে তো বেশিবার বিশ্বকাপ জিতেছে ইতালি ও জার্মানি। কই, ওদের পতাকা তো বলতে গেলে চোখেই পড়ে না! বাংলাদেশে ওই দু দলের সমর্থক নেই, এমন নয়। ফ্রান্সের খেলাও অনেকে খুব পছন্দ করেন। কিন্তু ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা দ্বৈরথে ওই সমর্থকেরা চিৎকার করলেও সেটি ‘চিঁচিঁ’ আওয়াজ বলে মনে হয়!
বাংলাদেশের আর্জেন্টিনা-সমর্থকেরা খুব আবেগী। এই যে ইতালি-জার্মানি আর্জেন্টিনার চেয়ে বেশি বিশ্বকাপ জিতেছে—এটা মনে করিয়ে দেওয়াতেই যেমন অনেকে ক্ষুব্ধ হবেন। মজাটা হলো, ক্ষুব্ধ হয়ে কেউ এই লেখককে ইতালি বা জার্মানির সমর্থক বলবেন না। নির্ঘাত বলবেন, ‘বুঝেছি, এই ব্যাটা ব্রাজিলের সমর্থক!’
এই সমর্থনের আরেকটি ব্যাপারও আমাকে খুব ভাবায়। নিজের দেশ যখন খেলে, ভালো খেলুক-খারাপ খেলুক, সমর্থনে কোনো হেরফের না হওয়াই স্বাভাবিক। যেনতেনভাবে হলেও আমার দেশের জয় তো আমি চাইবই। কিন্তু ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ক্ষেত্রে কেন এমন হবে? ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে সাম্বার ছন্দ দেখে যে ব্রাজিলের সমর্থক, সেই ছন্দ হারিয়ে গেলেও সে কেন ব্রাজিল-ব্রাজিল বলে গলা ফাটাবে? আর্জেন্টাইনদের বল স্কিলে মুগ্ধ হয়ে যে আর্জেন্টিনার সমর্থক, ১৯৯০ বিশ্বকাপে জঘন্য নেতিবাচক ফুটবল খেলার পরও সে কেন আর্জেন্টিনা ওই বিশ্বকাপটি জিততে পারেনি বলে হাহাকার করবে?
সমর্থনের এ এক অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব। যুক্তি দিয়ে যেটির ব্যাখ্যা দেওয়া খুব কঠিন। সমর্থন মানেই যে আবেগ। আর, আবেগ আর যুক্তির তো চির বৈরিতা। তবে বাংলাদেশে যারা আর্জেন্টিনার সমর্থক, একটি শব্দেই তাদের আবেগের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। ম্যারাডোনা!
১৯৮৬ বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশের খুব বেশি মানুষ ‘আর্জেন্টিনা’ নামের দেশটা কোথায়, সেটিই জানত না। জানাল সেই বিশ্বকাপ। সেই বিশ্বকাপে অনেকগুলো ব্যাপার একসঙ্গে ঘটল। সেবারই প্রথম বাংলাদেশ টেলিভিশনে সবচেয়ে বেশি খেলা সরাসরি সম্প্রচারিত হলো। সাদা-কালো ছবির টেলিভিশন রঙিন হয়ে উচ্চবিত্তের সীমা ছাড়িয়ে মধ্যবিত্তের ঘরেও ঢুকতে শুরু করেছে তখন। বাংলাদেশের মানুষ সেবারই প্রথম প্রাণভরে বিশ্বকাপ দেখল। দেখল এক ফুটবল-জাদুকরকেও, রঙিন টেলিভিশন ফুঁড়ে বেরিয়ে যিনি ঢুকে গেলেন মানুষের হূদয়ে।
এরপর যতই সময় পেরিয়েছে, প্রিয় খেলোয়াড় থেকে ম্যারাডোনা হয়ে উঠেছেন এক আবেগের নাম। খেলার বাইরে তাঁর এত সব কাণ্ডকীর্তি, অথচ তাতে যেন আরও হাওয়া লেগেছে ওই আবেগের পালে। ম্যারাডোনা হয়ে উঠেছেন আরও আপন—‘আরে, এ তো অন্য গ্রহের কেউ নয়। আমাদের মতোই একজন। ভুল করে, অন্যায় করে, প্রতিজ্ঞা করে আবার তা ভুলে যায়।’
বাকি বিশ্ব আর্জেন্টিনাকে অন্য পরিচয়েও চেনে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে আর্জেন্টিনা নামটির অর্থ একটাই। ডিয়েগো ম্যারাডোনা!
No comments