এক-নগরের দেশ হয়ে বাঁচবে বাংলাদেশ by আবুল মোমেন
প্রতিবার
ঢাকায় গিয়ে বুঝি যে নগরটির গতি আরও মন্থর হয়েছে। কোথাও যেতে-আসতে দু-তিন
ঘণ্টা চলে যায়। ফলে দিনে একটির বেশি কাজ করা কঠিন। খবর বেরিয়েছে, প্রতিদিন
গড়ে ১০০টি করে নতুন গাড়ি ঢাকার রাস্তায় নামছে। তার মানে বছরে ৩৬ হাজার
গাড়ি। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এক দিন ঢাকা শহর থেমে যাবে, এভাবে চললে
সেদিনটি খুব দূরে নয়।
তা ছাড়া গ্রাম আর মফস্বল থেকে প্রতিদিন রাজধানী ঢাকায় শত-সহস্র নতুন মানুষ এসে ভিড় করছে। ঢাকা জনসংখ্যায় এবং নগর স্থাপনায় দ্রুত বর্ধনশীল একটি নগর। এ নিয়ে কর্তৃপক্ষ এবং যথাযথ আইনকানুন থাকলেও মানুষের তীব্র আকাঙ্ক্ষা, বেপরোয়া চাহিদার কাছে সবই অসহায় ও অকেজো হয়ে পড়ছে। গত ২০-৩০ বছরে এই বর্ধিষ্ণুতার খেসারত দিয়ে ঢাকা মোটামুটি একটি কংক্রিটের জঙ্গল বা বস্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। পূর্বাভাস আছে, ২০৩০ সাল নাগাদ ঢাকার জনসংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
ঢাকার ঘনায়মান বিপর্যয়ের কিছু লক্ষণ এখনই প্রকট হয়ে উঠেছে। এই নগরকে ঘিরে থাকা বুড়িগঙ্গাসহ সব কটি নদীর পানি মানুষ ও তার কর্মকাণ্ডের (যেমন—দখল করে স্থাপনা নির্মাণ এবং শিল্পবর্জ্য ফেলা) ফলে সৃষ্ট বর্জ্যের কারণে ভয়ানকভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। দূষণের ফলে পানিতে অক্সিজেন এত কমে গেছে যে কোনো প্রাণীর পক্ষে সেসব নদীতে বাঁচা সম্ভব নয়, জলজ প্রাণীর পক্ষেও নয়।
প্রশ্ন হলো, সব মানুষ ঢাকায় ছুটছে কেন? আর ঢাকায় যাঁরা একবার থাকছেন, তাঁরা ঢাকা ছাড়েন না কেন? এই প্রশ্ন দুটির উত্তরের মধ্যেই ঢাকার মৃত্যুপথযাত্রী নগরে পরিণত হওয়ার কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে।
আমি চট্টগ্রাম শহরে থাকি। এটি ’৪৭-এর দেশভাগের পর থেকেই এ অঞ্চলের দ্বিতীয় নগর। হাজার বছরের পুরোনো (বস্তুত দুই হাজার বছরের) বন্দরকে ঘিরে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে এটি দেশের ব্যতিক্রমী অনন্য গুরুত্বের এক নগর, আজকাল তোয়াজ করে বাণিজ্যিক রাজধানীও বলা হয়। কিন্তু দেশের এই দ্বিতীয় নগরটি তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছে। মোটা দাগে বোঝার সুবিধার জন্য বলা যায়, স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত যদি ঢাকা-চট্টগ্রামের নাগরিকজীবনের সুযোগ-সুবিধা ও মানের অনুপাত হয় ৫৫-৪৫, তো এখন তা ৮০-২০-এ এসে ঠেকেছে। এর কারণ ব্যবসা-বাণিজ্য ও প্রশাসনিক তথা সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রাপ্তির সঙ্গে যুক্ত সব সরকারি প্রধান দপ্তর ঢাকায় অবস্থিত। অতীতে কাস্টমস, আমদানি-রপ্তানি, শিল্প-বাণিজ্যসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত প্রদানকারী ব্যক্তিদের দপ্তর, এমনকি কোনো কোনো দেশি-বিদেশি ব্যাংকের প্রধান দপ্তরও চট্টগ্রামেই ছিল। ফলে এখানে বসেই ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকারখানা চালানো সম্ভব ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হতে থাকে ঢাকায়।
ক্ষমতা ও প্রভাবশালী নাগরিকদের যদি মোটা দাগে চারটি ভাগ করি, তা হবে আমলা ও পেশাজীবী, বণিক (শিল্পপতিসহ), রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবী। তাঁরা স্বভাবতই ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকতে চান আবার তাঁদের ঘিরে ক্ষমতার চক্র মজবুত ও প্রসারিত হয়। ফলে তাঁদের ঘিরে ঢাকায় ক্ষমতার মৌরসিপাট্টা তৈরি হয়েছে। এটা সর্বতোভাবে আমাদের দেউলিয়াত্ব প্রমাণ করে। বিকাশ ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা নিয়ে সারা দেশের উৎসাহী মানুষ ঢাকাতেই ভিড় জমাচ্ছে। আর এভাবে বাংলাদেশ এক-নগরের শহরে পরিণত হয়েছে।
আজকে বাস্তবতাটা কেমন দাঁড়িয়েছে তা বোঝাতে প্রথমে চট্টগ্রাম থেকেই কয়েকটি উদাহরণ দেব।
সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই এই অঞ্চলের অধিকাংশ বিদেশি কোম্পানির (অফিস এবং কারখানা) আস্তানা ছিল চট্টগ্রামে, কিন্তু স্বাধীনতার পর দিনে দিনে প্রশাসনের ঢাকাকেন্দ্রিকতার ফলে একে একে সব্বাই হয় সদর দপ্তর কিংবা সদর দপ্তর ও উৎপাদনব্যবস্থা সবটাই ঢাকায় সরিয়ে নিয়েছে। দেশীয় বড় বণিক-ধনিকেরাও বারবার চট্টগ্রাম-ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াতের ঝামেলা এড়াতে শেষ পর্যন্ত ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়ে যাচ্ছেন। এর ফলে চট্টগ্রামের জনজীবনে তাঁদের অবদান কমে আসছে। আর এর পরিণতিতে শিল্প, সাহিত্য ও তরুণ-কিশোরদের সব সাংস্কৃতিক উদ্যোগ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে স্থবির হয়ে পড়ছে। তাতে নাগরিকজীবন হারাচ্ছে প্রাণবন্ততা ও হয়ে পড়ছে নির্জীব, স্থবির। বিকেন্দ্রীকরণের নামে বাংলাদেশ সরকারের যে দু-একটি অফিসের সদর দপ্তর চট্টগ্রামে রাখা/স্থানান্তরিত হয়েছে, সেগুলোতে দেখা যায় কর্তাব্যক্তিরা উচ্চতর সিদ্ধান্তের বাধ্যবাধকতার কথা বলে প্রতি সপ্তাহে তিন দিন, বড় জোর চার দিন চট্টগ্রামে কাটিয়ে বাকি তিন-চার দিন ঢাকায় থাকার ব্যবস্থা করে নেন।
ফলে ঘটনার বিপরীত একটি চিত্রও আমাদের জানা থাকা দরকার। ব্রিটিশ আমল থেকে আইন বা নিয়ম ছিল, খোঁজ নিয়ে জেনেছি সে নিয়ম এখনো আছে, সরকারি কর্মকর্তাদের কর্মস্থলে পরিবার নিয়ে থাকতে হবে। এভাবে পদস্থ শিক্ষিত পরিবারগুলোকে ঘিরেই আমাদের মফস্বল শহর, মহকুমা শহরগুলোতে একটি আলোকিত সমাজ গড়ে উঠেছিল। কিন্তু আজকে মুষ্টিমেয় কয়েকজন বাদে যেকোনো স্তরের আমলা—জেলা প্রশাসক থেকে থানার দারোগা পর্যন্ত সবাই পরিবার রাখেন ঢাকায়।
প্রশ্ন করলে স্ত্রীর চাকরি, ছেলেমেয়ের উন্নত লেখাপড়া, বাবা-মায়ের চিকিৎসার অজুহাত তুলে দেন। এই অস্বাভাবিক জীবনব্যবস্থা কীভাবে কাউকে দুর্নীতিতে, কাউকে অনীতির দিকে ঠেলে দেয়। ছোট-বড় আমলাদের হাতে একটি নগরকে প্রাণবন্ত করে তোলার যথেষ্ট সুযোগ ও ক্ষমতা থাকে, যদি তাঁরা তার সদ্ব্যবহার করেন। এভাবেই অতীতে ছোট ছোট শহরগুলোর সাংস্কৃতিক ও সমাজজীবন আলোকিত ও সার্থক হয়ে উঠেছিল। দু-একটি উদাহরণ দেব। বাংলা ভাষার প্রবাদপ্রতিম নাট্যকার-গীতিকার ডি এল রায় খুলনায় ডিএম থাকাকালে নাট্যদল করে শহরকে মাতিয়েছিলেন, সেই দল এই সেদিনও সক্রিয় ছিল। প্রশাসক আখতার হামিদ খান কুমিল্লায় এক মহৎ ও বড় কাজের সূচনা করেছিলেন, রংপুরে সে যুগে ঘূর্ণমান মঞ্চে নাটক হতো আর তুলসী লাহিড়ির মতো নাট্যব্যক্তিত্ব সেখানে থেকেই কাজ করেছেন, লেখক অন্নদাশংকর রায় চট্টগ্রামে এডিএম হিসেবে নিয়মিত সাহিত্যসভায় যোগ দেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে কাঙাল হরিনাথ (হরিনাথ মজুমদার) প্রকাশ করেছিলেন গ্রামবার্তা প্রকাশিকা—এ অঞ্চলের প্রথম সংবাদপত্র। শান্তিনিকেতন থেকে পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেনশাস্ত্রী গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে এসেছিলেন চট্টগ্রামে, বললেন সুচক্রদণ্ডি গ্রামে যেতে হবে। একজন জিজ্ঞেস করলেন, কেন? উত্তর—সে যে তীর্থস্থান। বিস্মিত প্রশ্ন—কেন, কীভাবে? তখন ক্ষিতিমোহন স্মিত হেসে বললেন, কারণ সেখানে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ থাকেন। অমর সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় বাস করেননি কখনো। বাংলা ভাষার বিখ্যাত সাহিত্যিক সতীনাথ ভাদুড়ী, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন যথাক্রমে পাটনা ও লখনৌতে।
পাঞ্জাবি আমলা নিয়াজ মোহাম্মদ খান মহকুমা শাসক হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আর জেলা প্রশাসক হিসেবে চট্টগ্রামে স্টেডিয়াম বানিয়েছিলেন। চট্টগ্রামে পুলিশের বড় কর্তা খালেক সাহেব পুলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পাকিস্তান আমলে কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, মোকাম্মেল হক আর বাংলাদেশ আমলে ঔপন্যাসিক হাসনাত আবদুল হাইয়ের মতো জেলা প্রশাসকদের সোৎসাহ পৃষ্ঠপোষকতায় চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিকজীবন ছিল প্রাণচঞ্চল, সজীব ও সার্থক। অন্যান্য জেলার ইতিহাসও একই রকম হবে।
রাজনৈতিক অঙ্গনের দিকে তাকালেও দেখা যাবে পাকিস্তান আমলে বাঘা বাঘা রাজনীতিকেরা নিজ নিজ শহরে থেকে রাজনীতি করেই জাতীয় নেতা হয়েছেন। আমাদের চার জাতীয় নেতার মধ্যে তিনজনই—সৈয়দ নজরুল ময়মনসিংহে, কামরুজ্জামান রাজশাহীতে এবং মনসুর আলী পাবনায়—নিজ নিজ শহরে বাস করেই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা হয়েছেন এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। এভাবেই তাঁরা মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের শীর্ষ নেতা এবং সর্বোপরি জাতীয় নেতার মর্যাদা পেয়েছেন। আজকের দিনে কেবল ভোটের সময় নেতারা টাকার বান্ডিল নিয়ে এলাকায় আসেন। অন্য সময় ঢাকায় বসে নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য দেখা আর ক্ষমতার ভাগ নেওয়ায় ব্যস্ত থাকেন, এলাকা ও জনগণের সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পর্ক থাকে না।
একসময় ঢাকা-চট্টগ্রাম ছাড়াও পূর্ব বাংলার কত শহরের আর্থিক সমৃদ্ধি ও সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের খবর আমরা পেতাম—নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, চাঁদপুর, রাজশাহী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রংপুর, বগুড়া, পাবনা, বরিশাল, সিলেট, ময়মনসিংহ এমনি কত নাম বলা যাবে।
অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, দেশের সব মফস্বল শহর সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে মৃত্যুপথযাত্রী। সবখানে অভাব-অনটনের ছাপ, সামর্থ্যের দৈন্য, সম্পদের অভাব, পৃষ্ঠপোষকতার অনটন।
এর প্রত্যক্ষ এবং নগদ ফল হলো সব অঞ্চলের মেধাবী, প্রতিভাবান, দক্ষ, পারঙ্গম এবং স্বভাবত উচ্চাভিলাষী (এটা দোষের কিছু নয়) তরুণেরা নিজ নিজ এলাকার দৈন্যের মধ্যে থেকে নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে চায় না। সুযোগের জন্য ঢাকায় পাড়ি জমায়। আমাদের সাহিত্য, সংগীত, নাটক, ক্রীড়া, চলচ্চিত্র—সব ক্ষেত্রের গুণীজন ও তারকারা নিজ নিজ জেলা ছেড়ে ঢাকায় আস্তানা গাড়তে বাধ্য হয়েছেন। এভাবে শহরগুলো নেতৃত্বহীন, অভিভাবকহীন, পৃষ্ঠপোষকতাহীন হয়ে সবাই মিলে অসহায় গতানুগতিক একঘেয়ে জীবনের ঘানি টানতে বাধ্য হচ্ছে। যাঁরা নিজ এলাকার ভালোবাসায় বুঁদ হয়ে তরুণ বয়সে ঢাকা পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেননি, তাঁদের বেশির ভাগ জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে হতাশায় ও ক্ষোভে সিনিক্যাল হয়ে ওঠেন।
বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে ছোট হলেও জনসংখ্যা আমাদের বিশাল। ফলে সিঙ্গাপুরের মতো নগররাষ্ট্র হওয়ার উপায় আমাদের নেই, একই কারণে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের মতো এক-নগরের রাষ্ট্র হয়ে সমৃদ্ধি অর্জন বা সফল হওয়ার কোনো উপায় বা পথ নেই। সুদূর অতীতকাল থেকেই এখানে বিভিন্ন অঞ্চলে সমৃদ্ধ নগর গড়ে উঠেছিল—সোনারগাঁ, গৌড়, পাণ্ডুয়া, তাম্রলিপ্ত, কর্ণসুবর্ণ ইত্যাদি অনেক নাম বলা যায়। ফলে এই দেশ যদি আজকে এক-নগরের দেশে পরিণত হয়, তাহলে তা হবে অন্য সব নগর ও জনপদের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-সমৃদ্ধিকে মূল্য হিসেবে গুনে। অর্থাৎ এভাবে ঢাকাও মরবে দেশও মরবে, যে প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
এ রকম হওয়াটা আমাদের জন্য স্বাভাবিক ছিল না। সৌভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের রাজধানীটি দেশের প্রায় কেন্দ্রে অবস্থিত, বেশির ভাগ দেশের মতো এক পাশে নয়। সুপরিকল্পিত দ্রুতগামী রেল-নেটওয়ার্ক তৈরি করে দেশের ৬৪টি জেলা শহরের মধ্যে ৪৮টিরই রাজধানীর সঙ্গে দুই ঘণ্টা বা তার কম সময়ের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব। তাতে ঢাকায় ভিড় করে বসবাস না করে নিজ নিজ জেলা শহরে বাস করেই লাখ লাখ মানুষ ঢাকায় কাজও করতে পারবে, অন্যান্য যোগাযোগও রাখতে পারবে। মুম্বাইতে প্রতিদিন ৬০ লাখ কর্মজীবী মানুষ এভাবে চলাচল করে থাকে। কলকাতার আশপাশে টাউনশিপ গড়ে তোলায় এখন খোদ কলকাতা শহরের জনসংখ্যা কমে গেছে, তার প্রভাব এতটাই হয়েছে যে ইদানীং কলকাতার লোকসভা ও বিধানসভার আসন কমাতে হয়েছে।
এ অবস্থায় রাজধানী ঢাকাকে মেরে সারা দেশকে মারার এ ব্যবস্থা আমরা কি চালিয়ে যাব, নাকি আমরা বাঁচতে চাই? বাঁচার যে সহজ সুযোগ আছে, সেগুলো কি আমরা গ্রহণ করব? যদি বাঁচতে চাই তাহলে তিনটি কাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করতে হবে—১. ঢাকার সঙ্গে অন্যান্য শহর-শহরতলির দ্রুতগামী রেল-যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা। ২. সব সরকারি কর্মকর্তার নিজ নিজ কর্মস্থলে বসবাসের আইন/নিয়ম প্রয়োগ করা এবং ৩. আজকের উন্নত ই-যোগাযোগব্যবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে ক্ষমতা ও প্রশাসনকে যথার্থই বিকেন্দ্রকরণ করা।
সর্বত্র ভালো স্কুল, ভালো হাসপাতাল, ভালো চিকিৎসক চাই বলে ধুয়া তুললে চলবে না। মানুষ বসতি শুরু করলে নিজ প্রয়োজন ও তাগিদেই সেসব তৈরি করে নেবে, অতীতে যেমন করেছে। সরকারের কাজ হবে সহযোগিতা দেওয়া। অতীতে তো সব সেবামূলক ও শিক্ষা-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান সেভাবেই হয়েছিল। এভাবে দেশের অন্যান্য নগরও যথার্থ নাগরিক সুযোগ-সুবিধায় সমৃদ্ধ হবে। মানুষ না থাকলে উন্নয়ন কীভাবে হবে?
>>>আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
তা ছাড়া গ্রাম আর মফস্বল থেকে প্রতিদিন রাজধানী ঢাকায় শত-সহস্র নতুন মানুষ এসে ভিড় করছে। ঢাকা জনসংখ্যায় এবং নগর স্থাপনায় দ্রুত বর্ধনশীল একটি নগর। এ নিয়ে কর্তৃপক্ষ এবং যথাযথ আইনকানুন থাকলেও মানুষের তীব্র আকাঙ্ক্ষা, বেপরোয়া চাহিদার কাছে সবই অসহায় ও অকেজো হয়ে পড়ছে। গত ২০-৩০ বছরে এই বর্ধিষ্ণুতার খেসারত দিয়ে ঢাকা মোটামুটি একটি কংক্রিটের জঙ্গল বা বস্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। পূর্বাভাস আছে, ২০৩০ সাল নাগাদ ঢাকার জনসংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
ঢাকার ঘনায়মান বিপর্যয়ের কিছু লক্ষণ এখনই প্রকট হয়ে উঠেছে। এই নগরকে ঘিরে থাকা বুড়িগঙ্গাসহ সব কটি নদীর পানি মানুষ ও তার কর্মকাণ্ডের (যেমন—দখল করে স্থাপনা নির্মাণ এবং শিল্পবর্জ্য ফেলা) ফলে সৃষ্ট বর্জ্যের কারণে ভয়ানকভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। দূষণের ফলে পানিতে অক্সিজেন এত কমে গেছে যে কোনো প্রাণীর পক্ষে সেসব নদীতে বাঁচা সম্ভব নয়, জলজ প্রাণীর পক্ষেও নয়।
প্রশ্ন হলো, সব মানুষ ঢাকায় ছুটছে কেন? আর ঢাকায় যাঁরা একবার থাকছেন, তাঁরা ঢাকা ছাড়েন না কেন? এই প্রশ্ন দুটির উত্তরের মধ্যেই ঢাকার মৃত্যুপথযাত্রী নগরে পরিণত হওয়ার কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে।
আমি চট্টগ্রাম শহরে থাকি। এটি ’৪৭-এর দেশভাগের পর থেকেই এ অঞ্চলের দ্বিতীয় নগর। হাজার বছরের পুরোনো (বস্তুত দুই হাজার বছরের) বন্দরকে ঘিরে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে এটি দেশের ব্যতিক্রমী অনন্য গুরুত্বের এক নগর, আজকাল তোয়াজ করে বাণিজ্যিক রাজধানীও বলা হয়। কিন্তু দেশের এই দ্বিতীয় নগরটি তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছে। মোটা দাগে বোঝার সুবিধার জন্য বলা যায়, স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত যদি ঢাকা-চট্টগ্রামের নাগরিকজীবনের সুযোগ-সুবিধা ও মানের অনুপাত হয় ৫৫-৪৫, তো এখন তা ৮০-২০-এ এসে ঠেকেছে। এর কারণ ব্যবসা-বাণিজ্য ও প্রশাসনিক তথা সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রাপ্তির সঙ্গে যুক্ত সব সরকারি প্রধান দপ্তর ঢাকায় অবস্থিত। অতীতে কাস্টমস, আমদানি-রপ্তানি, শিল্প-বাণিজ্যসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত প্রদানকারী ব্যক্তিদের দপ্তর, এমনকি কোনো কোনো দেশি-বিদেশি ব্যাংকের প্রধান দপ্তরও চট্টগ্রামেই ছিল। ফলে এখানে বসেই ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকারখানা চালানো সম্ভব ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হতে থাকে ঢাকায়।
ক্ষমতা ও প্রভাবশালী নাগরিকদের যদি মোটা দাগে চারটি ভাগ করি, তা হবে আমলা ও পেশাজীবী, বণিক (শিল্পপতিসহ), রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবী। তাঁরা স্বভাবতই ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকতে চান আবার তাঁদের ঘিরে ক্ষমতার চক্র মজবুত ও প্রসারিত হয়। ফলে তাঁদের ঘিরে ঢাকায় ক্ষমতার মৌরসিপাট্টা তৈরি হয়েছে। এটা সর্বতোভাবে আমাদের দেউলিয়াত্ব প্রমাণ করে। বিকাশ ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা নিয়ে সারা দেশের উৎসাহী মানুষ ঢাকাতেই ভিড় জমাচ্ছে। আর এভাবে বাংলাদেশ এক-নগরের শহরে পরিণত হয়েছে।
আজকে বাস্তবতাটা কেমন দাঁড়িয়েছে তা বোঝাতে প্রথমে চট্টগ্রাম থেকেই কয়েকটি উদাহরণ দেব।
সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই এই অঞ্চলের অধিকাংশ বিদেশি কোম্পানির (অফিস এবং কারখানা) আস্তানা ছিল চট্টগ্রামে, কিন্তু স্বাধীনতার পর দিনে দিনে প্রশাসনের ঢাকাকেন্দ্রিকতার ফলে একে একে সব্বাই হয় সদর দপ্তর কিংবা সদর দপ্তর ও উৎপাদনব্যবস্থা সবটাই ঢাকায় সরিয়ে নিয়েছে। দেশীয় বড় বণিক-ধনিকেরাও বারবার চট্টগ্রাম-ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াতের ঝামেলা এড়াতে শেষ পর্যন্ত ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়ে যাচ্ছেন। এর ফলে চট্টগ্রামের জনজীবনে তাঁদের অবদান কমে আসছে। আর এর পরিণতিতে শিল্প, সাহিত্য ও তরুণ-কিশোরদের সব সাংস্কৃতিক উদ্যোগ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে স্থবির হয়ে পড়ছে। তাতে নাগরিকজীবন হারাচ্ছে প্রাণবন্ততা ও হয়ে পড়ছে নির্জীব, স্থবির। বিকেন্দ্রীকরণের নামে বাংলাদেশ সরকারের যে দু-একটি অফিসের সদর দপ্তর চট্টগ্রামে রাখা/স্থানান্তরিত হয়েছে, সেগুলোতে দেখা যায় কর্তাব্যক্তিরা উচ্চতর সিদ্ধান্তের বাধ্যবাধকতার কথা বলে প্রতি সপ্তাহে তিন দিন, বড় জোর চার দিন চট্টগ্রামে কাটিয়ে বাকি তিন-চার দিন ঢাকায় থাকার ব্যবস্থা করে নেন।
ফলে ঘটনার বিপরীত একটি চিত্রও আমাদের জানা থাকা দরকার। ব্রিটিশ আমল থেকে আইন বা নিয়ম ছিল, খোঁজ নিয়ে জেনেছি সে নিয়ম এখনো আছে, সরকারি কর্মকর্তাদের কর্মস্থলে পরিবার নিয়ে থাকতে হবে। এভাবে পদস্থ শিক্ষিত পরিবারগুলোকে ঘিরেই আমাদের মফস্বল শহর, মহকুমা শহরগুলোতে একটি আলোকিত সমাজ গড়ে উঠেছিল। কিন্তু আজকে মুষ্টিমেয় কয়েকজন বাদে যেকোনো স্তরের আমলা—জেলা প্রশাসক থেকে থানার দারোগা পর্যন্ত সবাই পরিবার রাখেন ঢাকায়।
প্রশ্ন করলে স্ত্রীর চাকরি, ছেলেমেয়ের উন্নত লেখাপড়া, বাবা-মায়ের চিকিৎসার অজুহাত তুলে দেন। এই অস্বাভাবিক জীবনব্যবস্থা কীভাবে কাউকে দুর্নীতিতে, কাউকে অনীতির দিকে ঠেলে দেয়। ছোট-বড় আমলাদের হাতে একটি নগরকে প্রাণবন্ত করে তোলার যথেষ্ট সুযোগ ও ক্ষমতা থাকে, যদি তাঁরা তার সদ্ব্যবহার করেন। এভাবেই অতীতে ছোট ছোট শহরগুলোর সাংস্কৃতিক ও সমাজজীবন আলোকিত ও সার্থক হয়ে উঠেছিল। দু-একটি উদাহরণ দেব। বাংলা ভাষার প্রবাদপ্রতিম নাট্যকার-গীতিকার ডি এল রায় খুলনায় ডিএম থাকাকালে নাট্যদল করে শহরকে মাতিয়েছিলেন, সেই দল এই সেদিনও সক্রিয় ছিল। প্রশাসক আখতার হামিদ খান কুমিল্লায় এক মহৎ ও বড় কাজের সূচনা করেছিলেন, রংপুরে সে যুগে ঘূর্ণমান মঞ্চে নাটক হতো আর তুলসী লাহিড়ির মতো নাট্যব্যক্তিত্ব সেখানে থেকেই কাজ করেছেন, লেখক অন্নদাশংকর রায় চট্টগ্রামে এডিএম হিসেবে নিয়মিত সাহিত্যসভায় যোগ দেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে কাঙাল হরিনাথ (হরিনাথ মজুমদার) প্রকাশ করেছিলেন গ্রামবার্তা প্রকাশিকা—এ অঞ্চলের প্রথম সংবাদপত্র। শান্তিনিকেতন থেকে পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেনশাস্ত্রী গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে এসেছিলেন চট্টগ্রামে, বললেন সুচক্রদণ্ডি গ্রামে যেতে হবে। একজন জিজ্ঞেস করলেন, কেন? উত্তর—সে যে তীর্থস্থান। বিস্মিত প্রশ্ন—কেন, কীভাবে? তখন ক্ষিতিমোহন স্মিত হেসে বললেন, কারণ সেখানে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ থাকেন। অমর সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় বাস করেননি কখনো। বাংলা ভাষার বিখ্যাত সাহিত্যিক সতীনাথ ভাদুড়ী, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন যথাক্রমে পাটনা ও লখনৌতে।
পাঞ্জাবি আমলা নিয়াজ মোহাম্মদ খান মহকুমা শাসক হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আর জেলা প্রশাসক হিসেবে চট্টগ্রামে স্টেডিয়াম বানিয়েছিলেন। চট্টগ্রামে পুলিশের বড় কর্তা খালেক সাহেব পুলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পাকিস্তান আমলে কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, মোকাম্মেল হক আর বাংলাদেশ আমলে ঔপন্যাসিক হাসনাত আবদুল হাইয়ের মতো জেলা প্রশাসকদের সোৎসাহ পৃষ্ঠপোষকতায় চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিকজীবন ছিল প্রাণচঞ্চল, সজীব ও সার্থক। অন্যান্য জেলার ইতিহাসও একই রকম হবে।
রাজনৈতিক অঙ্গনের দিকে তাকালেও দেখা যাবে পাকিস্তান আমলে বাঘা বাঘা রাজনীতিকেরা নিজ নিজ শহরে থেকে রাজনীতি করেই জাতীয় নেতা হয়েছেন। আমাদের চার জাতীয় নেতার মধ্যে তিনজনই—সৈয়দ নজরুল ময়মনসিংহে, কামরুজ্জামান রাজশাহীতে এবং মনসুর আলী পাবনায়—নিজ নিজ শহরে বাস করেই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা হয়েছেন এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। এভাবেই তাঁরা মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের শীর্ষ নেতা এবং সর্বোপরি জাতীয় নেতার মর্যাদা পেয়েছেন। আজকের দিনে কেবল ভোটের সময় নেতারা টাকার বান্ডিল নিয়ে এলাকায় আসেন। অন্য সময় ঢাকায় বসে নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য দেখা আর ক্ষমতার ভাগ নেওয়ায় ব্যস্ত থাকেন, এলাকা ও জনগণের সঙ্গে তাঁদের কোনো সম্পর্ক থাকে না।
একসময় ঢাকা-চট্টগ্রাম ছাড়াও পূর্ব বাংলার কত শহরের আর্থিক সমৃদ্ধি ও সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের খবর আমরা পেতাম—নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, চাঁদপুর, রাজশাহী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রংপুর, বগুড়া, পাবনা, বরিশাল, সিলেট, ময়মনসিংহ এমনি কত নাম বলা যাবে।
অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, দেশের সব মফস্বল শহর সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে মৃত্যুপথযাত্রী। সবখানে অভাব-অনটনের ছাপ, সামর্থ্যের দৈন্য, সম্পদের অভাব, পৃষ্ঠপোষকতার অনটন।
এর প্রত্যক্ষ এবং নগদ ফল হলো সব অঞ্চলের মেধাবী, প্রতিভাবান, দক্ষ, পারঙ্গম এবং স্বভাবত উচ্চাভিলাষী (এটা দোষের কিছু নয়) তরুণেরা নিজ নিজ এলাকার দৈন্যের মধ্যে থেকে নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে চায় না। সুযোগের জন্য ঢাকায় পাড়ি জমায়। আমাদের সাহিত্য, সংগীত, নাটক, ক্রীড়া, চলচ্চিত্র—সব ক্ষেত্রের গুণীজন ও তারকারা নিজ নিজ জেলা ছেড়ে ঢাকায় আস্তানা গাড়তে বাধ্য হয়েছেন। এভাবে শহরগুলো নেতৃত্বহীন, অভিভাবকহীন, পৃষ্ঠপোষকতাহীন হয়ে সবাই মিলে অসহায় গতানুগতিক একঘেয়ে জীবনের ঘানি টানতে বাধ্য হচ্ছে। যাঁরা নিজ এলাকার ভালোবাসায় বুঁদ হয়ে তরুণ বয়সে ঢাকা পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেননি, তাঁদের বেশির ভাগ জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে হতাশায় ও ক্ষোভে সিনিক্যাল হয়ে ওঠেন।
বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে ছোট হলেও জনসংখ্যা আমাদের বিশাল। ফলে সিঙ্গাপুরের মতো নগররাষ্ট্র হওয়ার উপায় আমাদের নেই, একই কারণে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের মতো এক-নগরের রাষ্ট্র হয়ে সমৃদ্ধি অর্জন বা সফল হওয়ার কোনো উপায় বা পথ নেই। সুদূর অতীতকাল থেকেই এখানে বিভিন্ন অঞ্চলে সমৃদ্ধ নগর গড়ে উঠেছিল—সোনারগাঁ, গৌড়, পাণ্ডুয়া, তাম্রলিপ্ত, কর্ণসুবর্ণ ইত্যাদি অনেক নাম বলা যায়। ফলে এই দেশ যদি আজকে এক-নগরের দেশে পরিণত হয়, তাহলে তা হবে অন্য সব নগর ও জনপদের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-সমৃদ্ধিকে মূল্য হিসেবে গুনে। অর্থাৎ এভাবে ঢাকাও মরবে দেশও মরবে, যে প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
এ রকম হওয়াটা আমাদের জন্য স্বাভাবিক ছিল না। সৌভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের রাজধানীটি দেশের প্রায় কেন্দ্রে অবস্থিত, বেশির ভাগ দেশের মতো এক পাশে নয়। সুপরিকল্পিত দ্রুতগামী রেল-নেটওয়ার্ক তৈরি করে দেশের ৬৪টি জেলা শহরের মধ্যে ৪৮টিরই রাজধানীর সঙ্গে দুই ঘণ্টা বা তার কম সময়ের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব। তাতে ঢাকায় ভিড় করে বসবাস না করে নিজ নিজ জেলা শহরে বাস করেই লাখ লাখ মানুষ ঢাকায় কাজও করতে পারবে, অন্যান্য যোগাযোগও রাখতে পারবে। মুম্বাইতে প্রতিদিন ৬০ লাখ কর্মজীবী মানুষ এভাবে চলাচল করে থাকে। কলকাতার আশপাশে টাউনশিপ গড়ে তোলায় এখন খোদ কলকাতা শহরের জনসংখ্যা কমে গেছে, তার প্রভাব এতটাই হয়েছে যে ইদানীং কলকাতার লোকসভা ও বিধানসভার আসন কমাতে হয়েছে।
এ অবস্থায় রাজধানী ঢাকাকে মেরে সারা দেশকে মারার এ ব্যবস্থা আমরা কি চালিয়ে যাব, নাকি আমরা বাঁচতে চাই? বাঁচার যে সহজ সুযোগ আছে, সেগুলো কি আমরা গ্রহণ করব? যদি বাঁচতে চাই তাহলে তিনটি কাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করতে হবে—১. ঢাকার সঙ্গে অন্যান্য শহর-শহরতলির দ্রুতগামী রেল-যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা। ২. সব সরকারি কর্মকর্তার নিজ নিজ কর্মস্থলে বসবাসের আইন/নিয়ম প্রয়োগ করা এবং ৩. আজকের উন্নত ই-যোগাযোগব্যবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে ক্ষমতা ও প্রশাসনকে যথার্থই বিকেন্দ্রকরণ করা।
সর্বত্র ভালো স্কুল, ভালো হাসপাতাল, ভালো চিকিৎসক চাই বলে ধুয়া তুললে চলবে না। মানুষ বসতি শুরু করলে নিজ প্রয়োজন ও তাগিদেই সেসব তৈরি করে নেবে, অতীতে যেমন করেছে। সরকারের কাজ হবে সহযোগিতা দেওয়া। অতীতে তো সব সেবামূলক ও শিক্ষা-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান সেভাবেই হয়েছিল। এভাবে দেশের অন্যান্য নগরও যথার্থ নাগরিক সুযোগ-সুবিধায় সমৃদ্ধ হবে। মানুষ না থাকলে উন্নয়ন কীভাবে হবে?
>>>আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments