ইতালি আর লিপ্পির বিদায়ের রাতে
বিজয়ী ও বিজিত দলের কোচ এবং ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় এসে কথা বলবেন, সব সাংবাদিকের চোখ থাকবে টেবিলটার দিকে। ওটাকে তাই পরিপাটি করেই সাজিয়ে রাখা হয়। তিনটি মাইক্রোফোন, একটি জাবুলানি বল, আর কয়েক বোতল কোমল পানীয়। কথা বলতে বলতে গলা শুকিয়ে গেলে গলাটা ভিজিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা। কিন্তু জাবুলানি বলটা কেন? ওটা বিশ্বকাপের প্রতীক। তবে জাবুলানি পরশু ইতালির কোচ মার্সেলো লিপ্পিকে হয়তো এটাও মনে করিয়ে দিল, পৃথিবীটা গোলাকার। এখানে সবকিছুই একটা চক্র সম্পন্ন করে।
ফুটবল খেলাটা বড় নির্মম। ফুটবল যা দেয়, একসময় তা ফিরিয়েও নেয়। চার বছর আগে এই বিশ্বকাপই মার্সেলো লিপ্পিকে দিয়েছিল দু হাত ভরে। চার বছর পর তা তাঁকে নিঃস্ব করে বিদায় দিল।
চার বছর আগে ঘানার বিপক্ষে ২-০ গোলের অনুজ্জ্বল জয়ে যখন বিশ্বকাপ শুরু করল ইতালি, কেউই তখন ভাবতে পারেনি লিপ্পির দল বিশ্বকাপ জিতবে। অথচ ইতালিকে ঠিকই চতুর্থ বিশ্বকাপ শিরোপা এনে দিলেন লিপ্পি। এবার কেপটাউনে প্যারাগুয়ের সঙ্গে ১-১ ড্রয়ে বিশ্বকাপ শুরু করলেও ‘হায় হায়’ রব ওঠেনি। ইতালি তো টুর্নামেন্ট শুরুই করে ঘষা কাচের মতো। খেলা যতই এগোতে থাকে, ততই উজ্জ্বল হয় তাদের আলো। কিন্তু পরের ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গেও ড্র করার পর সবাই ভাবতে বসে গেল। এই ইতালি তো অন্য রকম, কেমন যেন ভেতর থেকেই দলটির ক্ষয়াটে ভাব। পরশু বিশ্বকাপে নতুন দল স্লোভাকিয়ার কাছে হেরে প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায়।
ম্যাচ শেষের ২০ মিনিট পর যে লিপ্পি সংবাদ সম্মেলনে এলেন, তাঁর চোখগুলো যেন ঘষা কাচ, একটুও আলো নেই। মুখে এক খণ্ড কালো মেঘ। ইতালির সাংবাদিকেরা একেবারে ছুরিতে শান দিয়ে বসেছিলেন। তাঁরা আর কী বলবেন, লিপ্পি নিজেই বেদনাভরা কণ্ঠে কথা বললেন, ‘আজ ইতালির বড় দুঃখের দিন।’
দিন তিনেক আগে একটা মাত্র ড্র, একটা মাত্র গোলের সঙ্গে দুটো পরাজয়ের বোঝা পিঠে বয়ে বিদায় হয়ে গেছে গতবারের রানার্সআপ ফ্রান্স। এবার গেল চ্যাম্পিয়নরাও। লজ্জার নতুন ইতিহাস লেখা হলো। পরপর দুটি বিশ্বকাপ জিতে ভিত্তোরিও পোজ্জোর পাশে বসা হলো না লিপ্পির। সারা পৃথিবীর মনে যদিও এই সম্ভাবনাটা একটু হলেও উঁকি দিয়েছিল, লিপ্পির মনে নাকি কখনোই নয়, ‘আমি কখনো ভাবিনি, আবারও বিশ্বকাপ জিতব আমরা। তবে এটা কল্পনা করতে পারিনি যে বেশি দূর পর্যন্ত যেতে পারব না।’
লিপ্পি কথা বলেন, আর তাঁর সামনে ইতালীয় সাংবাদিকদের জটলা শুধুই প্রতিধ্বনি তোলে। ইতালীয় ভাষা বুঝতে না পারলেও এটা বোঝা গেল, কথাগুলো প্রীতিকর নয়। মাথাভর্তি সাদা চুলের নিচে থাকা মুখটায় অদৃশ্য কান্না, ‘আমরা খেলতেই পারলাম না। আমাদের পা চলল না। প্রতিপক্ষকে অনেক জায়গা দিলাম। ওদের গোলমুখে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেললাম। কিছুই হলো না আমাদের।’
কুরিয়েরো দেল্লা সেরার সাংবাদিক লুকা জেলমিনি ঝাঁঝের সঙ্গে জানতে চাইলেন, ‘বিশ্বকাপ জিতিয়েই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন, এখন কি মনে হচ্ছে না আবার ফিরে এসে ভুল করেছেন?’ মাথা নাড়লেন লিপ্পি, ‘না, ভুল করিনি। আমি ভেবেছিলাম, যে দলটিকে আমি গড়ে তুলেছি, তাদের ওপর আস্থা রাখার প্রতিদান আমি পাব। কিন্তু হলো না।’
সারা দুনিয়া বলছিল, গোটা ইতালি বলছিল, ওরা বুড়িয়ে গেছে, ওদের দিয়ে আর চলবে না। লিপ্পির যুক্তি ছিল, মাত্রই তো সাতটি ম্যাচ। এখানে বয়স কিংবা তারুণ্যের নয়, প্রশ্নটা অভিজ্ঞতার। অভিজ্ঞতা শেষ পর্যন্ত লজ্জাই দিল ইতালিকে। ফ্যাবিও ক্যানাভারো রক্ষণকে সামলাতে পারলেন না, জেনারো গাত্তুসো মাঝমাঠে বল দখলের জন্য ছুটতে পারলেন না, জিয়ানলুকা জামব্রোত্তা গতিশীল স্লোভাকদের আটকাতে পারলেন না। দ্বিতীয়ার্ধে প্লে-মেকার আন্দ্রে পিরলোই বা কোন ডিফেন্স-চেরা পাসটি দিতে পেরেছেন? লিপ্পির সঙ্গে হয়তো এঁদের বিদায়টাও পরশু এলিস পার্ক স্টেডিয়াম দেখে ফেলল।
ইতালির নাপোলিতে খেলা স্লোভাক মিডফিল্ডার মারেক হামসিক মিক্সড জোনে বলেছেন, ‘এখনো আমার বিশ্বাস হচ্ছে না যে ইতালিকে বিদায় করে আমরা দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠে গেছি!’ বিশ্বাস কেইবা করেছে। খেলার শেষ সেকেন্ডগুলোতেও গ্যালারির ‘নীল অরণ্য’কে বিশ্বাস ধরে রাখতে দেখেছি। শেষ বাঁশি বাজলে পর স্লোভাকিয়ার ‘সব পেয়েছি’র আনন্দে সেই বিশ্বাস খান খান হয়ে ভেঙে পড়েছে।
তুরিন থেকে বন্ধুকে নিয়ে বিশ্বকাপ দেখতে আসা আন্তোনিনার মাথায় তখনো তেরঙা নকল চুল জ্বলজ্বল করছিল, কিন্তু চোখের কোণে অশ্রু। গাজেত্তা দেল্লো স্পোর্তের রিপোর্টার রিকার্দো প্রাতেসি ধরা গলায় বললেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে ফিরে লিপ্পি পচা টমেটোর হাত থেকে বাঁচতে পারবেন না। নিজস্ব জেট নিয়ে ফ্রান্সের খেলোয়াড়দের মতো না পালালেই হয়।’
এই কি প্রাপ্য ছিল মার্সেলো লিপ্পির?
ফুটবল খেলাটা বড় নির্মম। ফুটবল যা দেয়, একসময় তা ফিরিয়েও নেয়। চার বছর আগে এই বিশ্বকাপই মার্সেলো লিপ্পিকে দিয়েছিল দু হাত ভরে। চার বছর পর তা তাঁকে নিঃস্ব করে বিদায় দিল।
চার বছর আগে ঘানার বিপক্ষে ২-০ গোলের অনুজ্জ্বল জয়ে যখন বিশ্বকাপ শুরু করল ইতালি, কেউই তখন ভাবতে পারেনি লিপ্পির দল বিশ্বকাপ জিতবে। অথচ ইতালিকে ঠিকই চতুর্থ বিশ্বকাপ শিরোপা এনে দিলেন লিপ্পি। এবার কেপটাউনে প্যারাগুয়ের সঙ্গে ১-১ ড্রয়ে বিশ্বকাপ শুরু করলেও ‘হায় হায়’ রব ওঠেনি। ইতালি তো টুর্নামেন্ট শুরুই করে ঘষা কাচের মতো। খেলা যতই এগোতে থাকে, ততই উজ্জ্বল হয় তাদের আলো। কিন্তু পরের ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গেও ড্র করার পর সবাই ভাবতে বসে গেল। এই ইতালি তো অন্য রকম, কেমন যেন ভেতর থেকেই দলটির ক্ষয়াটে ভাব। পরশু বিশ্বকাপে নতুন দল স্লোভাকিয়ার কাছে হেরে প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায়।
ম্যাচ শেষের ২০ মিনিট পর যে লিপ্পি সংবাদ সম্মেলনে এলেন, তাঁর চোখগুলো যেন ঘষা কাচ, একটুও আলো নেই। মুখে এক খণ্ড কালো মেঘ। ইতালির সাংবাদিকেরা একেবারে ছুরিতে শান দিয়ে বসেছিলেন। তাঁরা আর কী বলবেন, লিপ্পি নিজেই বেদনাভরা কণ্ঠে কথা বললেন, ‘আজ ইতালির বড় দুঃখের দিন।’
দিন তিনেক আগে একটা মাত্র ড্র, একটা মাত্র গোলের সঙ্গে দুটো পরাজয়ের বোঝা পিঠে বয়ে বিদায় হয়ে গেছে গতবারের রানার্সআপ ফ্রান্স। এবার গেল চ্যাম্পিয়নরাও। লজ্জার নতুন ইতিহাস লেখা হলো। পরপর দুটি বিশ্বকাপ জিতে ভিত্তোরিও পোজ্জোর পাশে বসা হলো না লিপ্পির। সারা পৃথিবীর মনে যদিও এই সম্ভাবনাটা একটু হলেও উঁকি দিয়েছিল, লিপ্পির মনে নাকি কখনোই নয়, ‘আমি কখনো ভাবিনি, আবারও বিশ্বকাপ জিতব আমরা। তবে এটা কল্পনা করতে পারিনি যে বেশি দূর পর্যন্ত যেতে পারব না।’
লিপ্পি কথা বলেন, আর তাঁর সামনে ইতালীয় সাংবাদিকদের জটলা শুধুই প্রতিধ্বনি তোলে। ইতালীয় ভাষা বুঝতে না পারলেও এটা বোঝা গেল, কথাগুলো প্রীতিকর নয়। মাথাভর্তি সাদা চুলের নিচে থাকা মুখটায় অদৃশ্য কান্না, ‘আমরা খেলতেই পারলাম না। আমাদের পা চলল না। প্রতিপক্ষকে অনেক জায়গা দিলাম। ওদের গোলমুখে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেললাম। কিছুই হলো না আমাদের।’
কুরিয়েরো দেল্লা সেরার সাংবাদিক লুকা জেলমিনি ঝাঁঝের সঙ্গে জানতে চাইলেন, ‘বিশ্বকাপ জিতিয়েই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন, এখন কি মনে হচ্ছে না আবার ফিরে এসে ভুল করেছেন?’ মাথা নাড়লেন লিপ্পি, ‘না, ভুল করিনি। আমি ভেবেছিলাম, যে দলটিকে আমি গড়ে তুলেছি, তাদের ওপর আস্থা রাখার প্রতিদান আমি পাব। কিন্তু হলো না।’
সারা দুনিয়া বলছিল, গোটা ইতালি বলছিল, ওরা বুড়িয়ে গেছে, ওদের দিয়ে আর চলবে না। লিপ্পির যুক্তি ছিল, মাত্রই তো সাতটি ম্যাচ। এখানে বয়স কিংবা তারুণ্যের নয়, প্রশ্নটা অভিজ্ঞতার। অভিজ্ঞতা শেষ পর্যন্ত লজ্জাই দিল ইতালিকে। ফ্যাবিও ক্যানাভারো রক্ষণকে সামলাতে পারলেন না, জেনারো গাত্তুসো মাঝমাঠে বল দখলের জন্য ছুটতে পারলেন না, জিয়ানলুকা জামব্রোত্তা গতিশীল স্লোভাকদের আটকাতে পারলেন না। দ্বিতীয়ার্ধে প্লে-মেকার আন্দ্রে পিরলোই বা কোন ডিফেন্স-চেরা পাসটি দিতে পেরেছেন? লিপ্পির সঙ্গে হয়তো এঁদের বিদায়টাও পরশু এলিস পার্ক স্টেডিয়াম দেখে ফেলল।
ইতালির নাপোলিতে খেলা স্লোভাক মিডফিল্ডার মারেক হামসিক মিক্সড জোনে বলেছেন, ‘এখনো আমার বিশ্বাস হচ্ছে না যে ইতালিকে বিদায় করে আমরা দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠে গেছি!’ বিশ্বাস কেইবা করেছে। খেলার শেষ সেকেন্ডগুলোতেও গ্যালারির ‘নীল অরণ্য’কে বিশ্বাস ধরে রাখতে দেখেছি। শেষ বাঁশি বাজলে পর স্লোভাকিয়ার ‘সব পেয়েছি’র আনন্দে সেই বিশ্বাস খান খান হয়ে ভেঙে পড়েছে।
তুরিন থেকে বন্ধুকে নিয়ে বিশ্বকাপ দেখতে আসা আন্তোনিনার মাথায় তখনো তেরঙা নকল চুল জ্বলজ্বল করছিল, কিন্তু চোখের কোণে অশ্রু। গাজেত্তা দেল্লো স্পোর্তের রিপোর্টার রিকার্দো প্রাতেসি ধরা গলায় বললেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে ফিরে লিপ্পি পচা টমেটোর হাত থেকে বাঁচতে পারবেন না। নিজস্ব জেট নিয়ে ফ্রান্সের খেলোয়াড়দের মতো না পালালেই হয়।’
এই কি প্রাপ্য ছিল মার্সেলো লিপ্পির?
No comments