ইভ টিজিং নাকি অ্যাডাম টেররাইজিং by আইরিন খান
সম্প্রতি বিবিসির ওয়েবসাইটে দুটি খবর পাশাপাশি গেছে—আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী কার্যক্রমে বাংলাদেশ নারী পুলিশ কর্মকর্তা নিযুক্ত করবে এবং সরকার ১৩ জুনকে ছাত্রীদের উত্যক্তকরণ প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে মনোনীত করেছে। একদিকে অগ্রগতি আর অন্যদিকে পেছন দিকে চলা। এ দুই খবর আজকের বাংলাদেশে নারীর জন্য যে ভগ্নমনস্ক অবস্থা বিরাজ করছে তার নজির।
যে দেশে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা নারী, সে দেশে নারী ও কিশোরীরা পুরুষের লোলুপ চাহনি, বিদ্রূপ বা কটু মন্তব্য, লাঞ্ছনা, হয়রানি, যৌন নিগ্রহ, গায়ে পুরুষের হাত বা আকস্মিক হামলার শিকার না হয়ে রাস্তায় হাঁটতে পারেন না, কিংবা বিদ্যালয়, দোকান, উদ্যান বা অন্য কোনো সামাজিক পরিসরে যেতে পারেন না, জনপরিবহন ব্যবহার করতে পারেন না—আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসিড আক্রমণ, অপহরণ বা হত্যার শিকার হন।
এমন অভিজ্ঞতার ফলে অল্প বয়সী কিছু মেয়ে এতটাই যন্ত্রণার্ত ও লাঞ্ছিত বোধ করেছে যে তারা আত্মহত্যা করেছে।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী পরিষদের মতে, ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সী মেয়েদের প্রায় ৯০ শতাংশই সামাজিক পরিসরে যৌন হয়রানির শিকার। আর কলেজছাত্র, বেকার যুবক থেকে শুরু করে ফেরিওয়ালা, রিকশাচালক, বাসচালক, সহযাত্রী, সহকর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক পর্যন্ত সবাই এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত। অর্থ্যাৎ তরুণ-বৃদ্ধ, ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত—সব পুরুষ এমন অপরাধ করে থাকেন।
ভিকটিমরাও তেমনি বিচিত্র—কারখানাশ্রমিক ও গৃহপরিচারিকা থেকে ছাত্রী এবং অত্যন্ত যোগ্যতাসম্পন্ন পেশাজীবী নারী সবাই। দারিদ্র্য এর ঝুঁকি বাড়ায়, কিন্তু আর্থিক সংগতি নিরাপত্তার কোনো নিশ্চয়তা দেয় না।
সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যে স্বীকৃতি মিলেছে যে ছাত্রী ও শিক্ষিকাদের পিছু নেওয়ার মাধ্যমে উত্ত্যক্ত করার মাত্রা এত তীব্র হয়েছে যে কিছু বিদ্যালয় বন্ধ এবং পরীক্ষা স্থগিত করে দিতে হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নের একটি পথ হলো শিক্ষা। অথচ শিক্ষাক্ষেত্রও লিঙ্গীয় সহিংসতার কাছে জিম্মি। মেয়েদের নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন মা-বাবা বহু মেয়েকে বিদ্যালয় থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছেন, বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। ফলে বাল্যবিবাহ ও কিশোরী বয়সে গর্ভধারণের সঙ্গে সম্পর্কিত নানা সমস্যা বাড়ছে। মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়ছে।
সিগমুন্ড ফ্রয়েড লিখেছিলেন, ‘জীবদেহের গঠন নিয়তিনির্ভর।’ তাঁর এ কথা বাংলাদেশের বাস্তবতায় নতুন অর্থ তৈরি করে। ব্যাপক মাত্রায় চর্চিত লিঙ্গীয় সহিংসতার আতঙ্কে নারী ও কিশোরীর জীবন, জীবিকা, সচলতা ও স্বাধীনতা এখন বিপর্যস্ত।
অন্ধকার নেমে এলে আপনি বাইরে বেরোতে পারেন না। তরুণদের লোলুপ দৃষ্টি সবখানে ছড়ানো যে সামাজিক পরিসরে সেটি আপনি পরিহার করেন। আপনার নিরাপত্তার জন্য আপনি পরিবারের পুরুষ সদস্যদের ওপর নির্ভরশীল। অন্যের দৃষ্টি এড়াতে আপনি ঢিলেঢালা পোশাক অথবা হিজাব পরেন। আপনি অবমাননা হজম করেন, আর ভান করেন যেন লোলুপ দৃষ্টি, লাম্পট্যপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি, বারবার অগ্রসর হওয়া এবং গায়ে হাত দেওয়া আপনি খেয়াল করছেন না। আরও আক্রমণের শিকার হওয়ার ভয়ে অথবা এই আক্রমণের উসকানি দেওয়ার অভিযোগ আপনার ওপরই আসার আশঙ্কায়, এমনকি আপনার চলাফেরার ওপর পরিবারের আরও কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের আশঙ্কায় আপনি অভিযোগ করার সাহস করেন না।
যে দেশে নারী সম-অধিকার ভোগ করেন না এবং যে রক্ষণশীল সমাজে নারীর ওপর কলঙ্কচিহ্ন পড়ে, নারীকে লজ্জিত হতে হয়, সেখানকার সামাজিক পরিসরে লিঙ্গীয় নিগ্রহ হলো পুরুষের ক্ষমতার নির্লজ্জ প্রদর্শনী। কোনো পুরুষ সেখানে নারীকে অপমান করে, আক্রমণ করে, তাঁর জীবন ধ্বংস করে দিয়ে পার পেয়ে যেতে পারেন। আইন অপর্যাপ্ত, সমাজ নিস্পৃহ অথবা এতে সহযোগীর ভূমিকায়।
‘ইভ টিজিং’ বা ‘ওমেন টিজিং’ শব্দগুচ্ছই এই অপরাধ যে কতটা গুরুতর, সেটিকে হালকা করে ফেলে। টিজিং তো কৌতুকপূর্ণ, নিরিহ আচরণ। ছোট ছেলেরা ছোট মেয়েদের চুলের বেণী ধরে টান দেওয়াকে বর্ণনা করতে এটা ব্যবহার করা যেতে পারে; কিন্তু নারীর স্তনে বা নিতম্বে পুরুষের হাত দেওয়া, নারীর উদ্দেশ্যে কটু বাক্য ছুড়ে দেওয়া, নারীর পিছু নেওয়া বা জনসম্মুখে তাঁদের পোশাক টেনে ধরার বর্ণনা দিতে গিয়ে নয়।
ইলোরা, পিংকি, তন্বী, সীমা, রুমি, রুনা, রিনা ও অন্যরা টিজিংয়ের শিকার নয়। নির্যাতন ও ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে যা ঘটছে তা যৌন-সন্ত্রাস। এটা সন্ত্রাস, কারণ এর শিকার হওয়া নারী শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। এটা সন্ত্রাস, কারণ অপরাধ সংঘটনকারী তার শিকারকে বশে আনতে, আতঙ্কিত ও ধ্বংস করতে তার অপ্রতিসম ক্ষমতা কাজে লাগায়।
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের প্রতিক্রিয়ায় নানা দেশে সরকার জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলে মানবাধিকারকে কাটছাঁট করে। আর বাংলাদেশে যৌন-সন্ত্রাসের প্রতিক্রিয়ায় সমাজ ও পরিবার নারীর স্বাধীনতায় লাগাম পরাচ্ছে অধিকতর শারীরিক নিরাপত্তার আশায়। কিন্তু ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ আমাদের দেখাচ্ছে যে নিরাপত্তা অর্জনের জন্য স্বাধীনতা বিসর্জন শেষ পর্যন্ত উভয়েরই ক্ষতি করে। যৌন-সন্ত্রাসের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। নারীর স্বাধীনতার ওপর বাধানিষেধ বেড়েই চলেছে, কিন্তু তাদের জীবন একটুও নিরাপদ হয়নি।
মেয়েদের পিছু নেওয়া ঠেকাতে শিক্ষামন্ত্রী সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণের আহ্বান জানিয়েছেন। এটা ভালো, কিন্তু যথেষ্ট নয়। যাঁরা এই সন্ত্রাসের শিকার তাঁদের সুরক্ষা ও সহায়তা দেওয়া, নারীর মানবাধিকারকে তুলে ধরা, অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া এবং এমন সহিংসতার মূল কারণগুলোকে আঘাত করার জন্য আরও অনেক কিছু করার প্রয়োজন আছে।
সব ধরনের যৌন হয়রানি নিষিদ্ধ করে সংসদে আইন করা উচিত। লিঙ্গীয় সমতাভিত্তিক আইন প্রণয়নের বিষয়কে জরুরি ভিত্তিতে সংসদের গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
পুলিশি ব্যবস্থা যাতে নারীর নিরাপত্তায় দ্রুত সাড়া দেয় সেভাবে গড়ে তোলা দরকার। উদাহরণস্বরূপ, এমন সহিংসতার শিকার নারীদের জন্য পুলিশের একটি নিবেদিত অভিযোগ কক্ষ এবং হেল্প লাইনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
যৌন হয়রানির বিষয়ে গত বছর হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশনা বাস্তবায়নের প্রশ্নটিকে রাষ্ট্র ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আরও গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত। কোন প্রতিষ্ঠান তা না করলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা থাকা উচিত।
আক্রান্তদের সহায়তা ও পরামর্শ দেওয়া এবং জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালানোর জন্য সুশীল সমাজের সংগঠন ও নারী সংগঠনগুলোকে অধিকতর সম্পদ দেওয়াা উচিত।
অনেক অপরাধী বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্য বা সহযোগী অথবা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া কোনো দুর্বৃত্ত। আমাদের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বে আছেন নারী। তাঁরা কেমন করে এই অবমাননা সহ্য করেন? নিজ নিজ দলের ভেতর তাঁদেরকে এই সন্ত্রাসীদের মোকাবিলা করা উচিত এবং নারীর ক্ষমতায়ন ঘটানো উচিত যেন তাঁরা নিপীড়কের অবস্থান যে রাজনৈতিক স্তরেই হোক না কেন তাঁর বিরুদ্ধে নির্ভয়ে প্রকাশ্যে অভিযোগ করতে পারেন।
দমনমূলক সামাজিক পরিবেশ কিশোর ও তরুণদের মনে নারীর নেতিবাচক ইমেজ তৈরি করে। কোন নারী নিজের মতো চলতে চাইলে ধর্মীয় নেতারা তাঁকে দুশ্চরিত্র বলে নিন্দা করেন। বলিউডের সিনেমায় নারীকে উপস্থাপন করা হয় যৌন আকাঙ্ক্ষার বস্তু হিসেবে।
নারী-পুরুষ বিচ্ছিন্নভাবে বেড়ে ওঠার ফলে ছেলেরা মেয়েদের সঙ্গে সম্মানজনক সম্পর্ক বজায় রেখে বেড়ে ওঠার পথ রুদ্ধ হয়। যৌনশিক্ষা নিষিদ্ধ থাকার ফলে না ঘরে না বাইরের বিদ্যালয়ে অল্প বয়সীরা তাদের শরীরে যৌনতাকেন্দ্রীক পরিবর্তনকে অনুভব করতে পারার সময়টাতে যৌনতাকে বুঝতে পারা এবং এ অবস্থায় তারা কী ধরণের আচরণ করবে তার বিহিত করার কোনো সুযোগ থাকে না। কেন মেয়েদের সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখতে হবে সে বিষয়ে ছেলেরা কিছু মাত্রায় শিখতে পারবে যদি বিদ্যালয়ে যৌনতা বিষয়ে এবং সমাজে লিঙ্গীয় ভূমিকা ও লিঙ্গীয় সহিংসতা বিষয়ে আলোচনার সুযোগ তৈরি করা যায়।
সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের সন্তানদের আমরা কেমনভাবে লালনপালন করব, সেটাও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। অনেক মা-বাবা তাঁদের সব ছেলে ও মেয়েকে সমান চোখে দেখেন না। ছেলে ও মেয়ের প্রতি ভিন্ন ভিন্ন নৈতিক বিধি প্রয়োগ করে তাঁরা যে শুধু আইনি বৈষম্যকে উৎসাহিত করেন তাই নয়, বরং মেয়েদের মধ্যে হীনম্মন্যতা আর ছেলেদের মধ্যে উচ্চম্মন্যতার অনুভূতি সঞ্চারিত করেন।
পিতৃতান্ত্রিক আচরণ, কুসংস্কার, সাংস্কৃতিক প্রথা, অসম নীতি এবং বৈষম্যমূলক আইন, যা নারীকে অবমূল্যায়ন করে ও অধিকারবঞ্চিত রাখে, এই সবকিছুর কারণে যৌন-সন্ত্রাস বাড়ে। এই সন্ত্রাস দূর করতে দরকার রূপান্তরমূলক সামাজিক পরিবর্তন। এ কাজটি হবে চ্যালেঞ্জিং, বিতর্কিত, জটিল ও সময়সাপেক্ষ। এ পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু করতে রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তির অনেক কিছু করার আছে। এ পথেই নারী ও কিশোরীর জন্য নিরাপদ হবে রাস্তাঘাট, বিদ্যালয় ও সামাজিক পরিসর।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
আইরিন খান: সাবেক মহাসচিব, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
যে দেশে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা নারী, সে দেশে নারী ও কিশোরীরা পুরুষের লোলুপ চাহনি, বিদ্রূপ বা কটু মন্তব্য, লাঞ্ছনা, হয়রানি, যৌন নিগ্রহ, গায়ে পুরুষের হাত বা আকস্মিক হামলার শিকার না হয়ে রাস্তায় হাঁটতে পারেন না, কিংবা বিদ্যালয়, দোকান, উদ্যান বা অন্য কোনো সামাজিক পরিসরে যেতে পারেন না, জনপরিবহন ব্যবহার করতে পারেন না—আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসিড আক্রমণ, অপহরণ বা হত্যার শিকার হন।
এমন অভিজ্ঞতার ফলে অল্প বয়সী কিছু মেয়ে এতটাই যন্ত্রণার্ত ও লাঞ্ছিত বোধ করেছে যে তারা আত্মহত্যা করেছে।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী পরিষদের মতে, ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সী মেয়েদের প্রায় ৯০ শতাংশই সামাজিক পরিসরে যৌন হয়রানির শিকার। আর কলেজছাত্র, বেকার যুবক থেকে শুরু করে ফেরিওয়ালা, রিকশাচালক, বাসচালক, সহযাত্রী, সহকর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক পর্যন্ত সবাই এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত। অর্থ্যাৎ তরুণ-বৃদ্ধ, ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত—সব পুরুষ এমন অপরাধ করে থাকেন।
ভিকটিমরাও তেমনি বিচিত্র—কারখানাশ্রমিক ও গৃহপরিচারিকা থেকে ছাত্রী এবং অত্যন্ত যোগ্যতাসম্পন্ন পেশাজীবী নারী সবাই। দারিদ্র্য এর ঝুঁকি বাড়ায়, কিন্তু আর্থিক সংগতি নিরাপত্তার কোনো নিশ্চয়তা দেয় না।
সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যে স্বীকৃতি মিলেছে যে ছাত্রী ও শিক্ষিকাদের পিছু নেওয়ার মাধ্যমে উত্ত্যক্ত করার মাত্রা এত তীব্র হয়েছে যে কিছু বিদ্যালয় বন্ধ এবং পরীক্ষা স্থগিত করে দিতে হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নের একটি পথ হলো শিক্ষা। অথচ শিক্ষাক্ষেত্রও লিঙ্গীয় সহিংসতার কাছে জিম্মি। মেয়েদের নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন মা-বাবা বহু মেয়েকে বিদ্যালয় থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছেন, বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। ফলে বাল্যবিবাহ ও কিশোরী বয়সে গর্ভধারণের সঙ্গে সম্পর্কিত নানা সমস্যা বাড়ছে। মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়ছে।
সিগমুন্ড ফ্রয়েড লিখেছিলেন, ‘জীবদেহের গঠন নিয়তিনির্ভর।’ তাঁর এ কথা বাংলাদেশের বাস্তবতায় নতুন অর্থ তৈরি করে। ব্যাপক মাত্রায় চর্চিত লিঙ্গীয় সহিংসতার আতঙ্কে নারী ও কিশোরীর জীবন, জীবিকা, সচলতা ও স্বাধীনতা এখন বিপর্যস্ত।
অন্ধকার নেমে এলে আপনি বাইরে বেরোতে পারেন না। তরুণদের লোলুপ দৃষ্টি সবখানে ছড়ানো যে সামাজিক পরিসরে সেটি আপনি পরিহার করেন। আপনার নিরাপত্তার জন্য আপনি পরিবারের পুরুষ সদস্যদের ওপর নির্ভরশীল। অন্যের দৃষ্টি এড়াতে আপনি ঢিলেঢালা পোশাক অথবা হিজাব পরেন। আপনি অবমাননা হজম করেন, আর ভান করেন যেন লোলুপ দৃষ্টি, লাম্পট্যপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি, বারবার অগ্রসর হওয়া এবং গায়ে হাত দেওয়া আপনি খেয়াল করছেন না। আরও আক্রমণের শিকার হওয়ার ভয়ে অথবা এই আক্রমণের উসকানি দেওয়ার অভিযোগ আপনার ওপরই আসার আশঙ্কায়, এমনকি আপনার চলাফেরার ওপর পরিবারের আরও কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের আশঙ্কায় আপনি অভিযোগ করার সাহস করেন না।
যে দেশে নারী সম-অধিকার ভোগ করেন না এবং যে রক্ষণশীল সমাজে নারীর ওপর কলঙ্কচিহ্ন পড়ে, নারীকে লজ্জিত হতে হয়, সেখানকার সামাজিক পরিসরে লিঙ্গীয় নিগ্রহ হলো পুরুষের ক্ষমতার নির্লজ্জ প্রদর্শনী। কোনো পুরুষ সেখানে নারীকে অপমান করে, আক্রমণ করে, তাঁর জীবন ধ্বংস করে দিয়ে পার পেয়ে যেতে পারেন। আইন অপর্যাপ্ত, সমাজ নিস্পৃহ অথবা এতে সহযোগীর ভূমিকায়।
‘ইভ টিজিং’ বা ‘ওমেন টিজিং’ শব্দগুচ্ছই এই অপরাধ যে কতটা গুরুতর, সেটিকে হালকা করে ফেলে। টিজিং তো কৌতুকপূর্ণ, নিরিহ আচরণ। ছোট ছেলেরা ছোট মেয়েদের চুলের বেণী ধরে টান দেওয়াকে বর্ণনা করতে এটা ব্যবহার করা যেতে পারে; কিন্তু নারীর স্তনে বা নিতম্বে পুরুষের হাত দেওয়া, নারীর উদ্দেশ্যে কটু বাক্য ছুড়ে দেওয়া, নারীর পিছু নেওয়া বা জনসম্মুখে তাঁদের পোশাক টেনে ধরার বর্ণনা দিতে গিয়ে নয়।
ইলোরা, পিংকি, তন্বী, সীমা, রুমি, রুনা, রিনা ও অন্যরা টিজিংয়ের শিকার নয়। নির্যাতন ও ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে যা ঘটছে তা যৌন-সন্ত্রাস। এটা সন্ত্রাস, কারণ এর শিকার হওয়া নারী শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। এটা সন্ত্রাস, কারণ অপরাধ সংঘটনকারী তার শিকারকে বশে আনতে, আতঙ্কিত ও ধ্বংস করতে তার অপ্রতিসম ক্ষমতা কাজে লাগায়।
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের প্রতিক্রিয়ায় নানা দেশে সরকার জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলে মানবাধিকারকে কাটছাঁট করে। আর বাংলাদেশে যৌন-সন্ত্রাসের প্রতিক্রিয়ায় সমাজ ও পরিবার নারীর স্বাধীনতায় লাগাম পরাচ্ছে অধিকতর শারীরিক নিরাপত্তার আশায়। কিন্তু ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ আমাদের দেখাচ্ছে যে নিরাপত্তা অর্জনের জন্য স্বাধীনতা বিসর্জন শেষ পর্যন্ত উভয়েরই ক্ষতি করে। যৌন-সন্ত্রাসের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। নারীর স্বাধীনতার ওপর বাধানিষেধ বেড়েই চলেছে, কিন্তু তাদের জীবন একটুও নিরাপদ হয়নি।
মেয়েদের পিছু নেওয়া ঠেকাতে শিক্ষামন্ত্রী সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণের আহ্বান জানিয়েছেন। এটা ভালো, কিন্তু যথেষ্ট নয়। যাঁরা এই সন্ত্রাসের শিকার তাঁদের সুরক্ষা ও সহায়তা দেওয়া, নারীর মানবাধিকারকে তুলে ধরা, অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া এবং এমন সহিংসতার মূল কারণগুলোকে আঘাত করার জন্য আরও অনেক কিছু করার প্রয়োজন আছে।
সব ধরনের যৌন হয়রানি নিষিদ্ধ করে সংসদে আইন করা উচিত। লিঙ্গীয় সমতাভিত্তিক আইন প্রণয়নের বিষয়কে জরুরি ভিত্তিতে সংসদের গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
পুলিশি ব্যবস্থা যাতে নারীর নিরাপত্তায় দ্রুত সাড়া দেয় সেভাবে গড়ে তোলা দরকার। উদাহরণস্বরূপ, এমন সহিংসতার শিকার নারীদের জন্য পুলিশের একটি নিবেদিত অভিযোগ কক্ষ এবং হেল্প লাইনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
যৌন হয়রানির বিষয়ে গত বছর হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশনা বাস্তবায়নের প্রশ্নটিকে রাষ্ট্র ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আরও গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত। কোন প্রতিষ্ঠান তা না করলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা থাকা উচিত।
আক্রান্তদের সহায়তা ও পরামর্শ দেওয়া এবং জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালানোর জন্য সুশীল সমাজের সংগঠন ও নারী সংগঠনগুলোকে অধিকতর সম্পদ দেওয়াা উচিত।
অনেক অপরাধী বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্য বা সহযোগী অথবা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া কোনো দুর্বৃত্ত। আমাদের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বে আছেন নারী। তাঁরা কেমন করে এই অবমাননা সহ্য করেন? নিজ নিজ দলের ভেতর তাঁদেরকে এই সন্ত্রাসীদের মোকাবিলা করা উচিত এবং নারীর ক্ষমতায়ন ঘটানো উচিত যেন তাঁরা নিপীড়কের অবস্থান যে রাজনৈতিক স্তরেই হোক না কেন তাঁর বিরুদ্ধে নির্ভয়ে প্রকাশ্যে অভিযোগ করতে পারেন।
দমনমূলক সামাজিক পরিবেশ কিশোর ও তরুণদের মনে নারীর নেতিবাচক ইমেজ তৈরি করে। কোন নারী নিজের মতো চলতে চাইলে ধর্মীয় নেতারা তাঁকে দুশ্চরিত্র বলে নিন্দা করেন। বলিউডের সিনেমায় নারীকে উপস্থাপন করা হয় যৌন আকাঙ্ক্ষার বস্তু হিসেবে।
নারী-পুরুষ বিচ্ছিন্নভাবে বেড়ে ওঠার ফলে ছেলেরা মেয়েদের সঙ্গে সম্মানজনক সম্পর্ক বজায় রেখে বেড়ে ওঠার পথ রুদ্ধ হয়। যৌনশিক্ষা নিষিদ্ধ থাকার ফলে না ঘরে না বাইরের বিদ্যালয়ে অল্প বয়সীরা তাদের শরীরে যৌনতাকেন্দ্রীক পরিবর্তনকে অনুভব করতে পারার সময়টাতে যৌনতাকে বুঝতে পারা এবং এ অবস্থায় তারা কী ধরণের আচরণ করবে তার বিহিত করার কোনো সুযোগ থাকে না। কেন মেয়েদের সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখতে হবে সে বিষয়ে ছেলেরা কিছু মাত্রায় শিখতে পারবে যদি বিদ্যালয়ে যৌনতা বিষয়ে এবং সমাজে লিঙ্গীয় ভূমিকা ও লিঙ্গীয় সহিংসতা বিষয়ে আলোচনার সুযোগ তৈরি করা যায়।
সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের সন্তানদের আমরা কেমনভাবে লালনপালন করব, সেটাও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। অনেক মা-বাবা তাঁদের সব ছেলে ও মেয়েকে সমান চোখে দেখেন না। ছেলে ও মেয়ের প্রতি ভিন্ন ভিন্ন নৈতিক বিধি প্রয়োগ করে তাঁরা যে শুধু আইনি বৈষম্যকে উৎসাহিত করেন তাই নয়, বরং মেয়েদের মধ্যে হীনম্মন্যতা আর ছেলেদের মধ্যে উচ্চম্মন্যতার অনুভূতি সঞ্চারিত করেন।
পিতৃতান্ত্রিক আচরণ, কুসংস্কার, সাংস্কৃতিক প্রথা, অসম নীতি এবং বৈষম্যমূলক আইন, যা নারীকে অবমূল্যায়ন করে ও অধিকারবঞ্চিত রাখে, এই সবকিছুর কারণে যৌন-সন্ত্রাস বাড়ে। এই সন্ত্রাস দূর করতে দরকার রূপান্তরমূলক সামাজিক পরিবর্তন। এ কাজটি হবে চ্যালেঞ্জিং, বিতর্কিত, জটিল ও সময়সাপেক্ষ। এ পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু করতে রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তির অনেক কিছু করার আছে। এ পথেই নারী ও কিশোরীর জন্য নিরাপদ হবে রাস্তাঘাট, বিদ্যালয় ও সামাজিক পরিসর।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
আইরিন খান: সাবেক মহাসচিব, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
No comments