কে এই ফয়সল by হাসান ফেরদৌস
প্রশ্নটি আমার নয়, ড. আদিল নাজামের। ভদ্রলোক নামজাদা পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবী, হার্ভার্ডের অধ্যাপক; ‘অল থিংস পাকিস্তান’ নামের একটি জনপ্রিয় ব্লগের পরিচালক। এই ব্লগেই তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, ‘হু ইজ ফয়সল শাহজাদ?’ নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে গাড়িবোমা রাখার অভিযোগে ফয়সল শাহজাদ নামের এক লেখাপড়া জানা পাকিস্তানি-আমেরিকান ধরা পড়েছেন। আমেরিকায় যেসব পাকিস্তানি বাস করেন, ড. আদিল তাঁদেরই একজন। তাঁরা আবারও পাকিস্তান নামের পাশে ‘টেররিস্ট’ কথাটা যুক্ত হলো দেখে ভীত। এই বুঝি শুরু হলো আমেরিকা থেকে ‘পাকিস্তানি খেদাও’ আন্দোলন! সে কথা টের পেয়ে ড. আদিল আগেভাগেই বলে দিয়েছেন, ফয়সল একজন ক্রিমিনাল, শুধু এক ক্রিমিনালের কারণে পুরো একটা দেশকে বা একটা কমিউনিটিকে অভিযুক্ত করা কোনো কাজের কথা নয়।
ড. আদিলের কথার সঙ্গে অধিকাংশ মুক্তবুদ্ধির মানুষই একমত হবেন। এমনকি নিউইয়র্ক শহরের মেয়র মাইক ব্লুমবার্গও সে কথাই বলেছেন। এক ফয়সলের জন্য যেন কোনো পাকিস্তানি বা মুসলমানের ওপর আক্রমণ না করা হয়, তারা যেন বৈষম্যের শিকার না হয়, সে কথার হুঁশিয়ারি তিনি ফয়সল ধরা পড়ার পরই স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন। তার পরও পাকিস্তানি শুনলে লোকজন ট্যারা চোখে তাকাবে না বা বাড়িভাড়া চাইতে এলে দ্বিধাগ্রস্ত হবে না, এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই। ড. আদিল অবশ্য এই ভেবে আশ্বস্ত হয়েছেন, ফয়সল ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই খোদ পাকিস্তান সরকার কবুল করেছে, এ ব্যাপারে আমেরিকার সঙ্গে সব রকম সহযোগিতা তারা করবে। হাফ ডজন পাকিস্তানিকে এরই মধ্যে তারা পাকড়াও করেছে।
পাকিস্তানের সরকার, সে দেশের তথ্যমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষ বরাবর সন্ত্রাসবাদের কথা উঠলেই বিদেশি ষড়যন্ত্রের গন্ধ আবিষ্কার করেছেন। হয় ভারত, নয়তো আমেরিকা সব অপকর্মের হোতা! মুম্বাইয়ে সরাসরি টিভির পর্দায় বোমা ও বন্দুক নিয়ে নিজেদের ভাই-ব্রাদারদের ছোটাছুটি করতে দেখার পরও তাদের বিশ্বাস, এ সবই ‘র’ এবং ‘সিআইএ’র কারসাজি। কিন্তু এবার দেখছি পাকিস্তানিদের গলার আওয়াজ কিঞ্চিত বদলেছে। যেমন, দৈনিক নিউজ ইন্টারন্যাশনাল পত্রিকা ক্ষোভের সঙ্গে লিখেছে, ‘ইদানীং অন্য আর কিছুর বদলে পাকিস্তান সবচেয়ে বেশি যা রপ্তানি করা শুরু করেছে, তা হলো সন্ত্রাসী।’ আরেক পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবী পারভেজ হুদোবয় মন্তব্য করেছেন, ‘কে এই ফয়সল, সে প্রশ্ন করার চেয়ে অনেক জরুরি, ওই এক পাকিস্তান থেকে বারবার কেন আন্তর্জাতিক টেররিস্ট তৈরি হচ্ছে?’
যত দিন পর্যন্ত নিজেদের ঘরে পোষা সন্ত্রাসীদের হামলায় মুখ্যত পাকিস্তানিরাই ঘায়েল হচ্ছিল, তত দিন আমেরিকার বা বিদেশি অন্য কোনো দেশের এই নিয়ে ঘুম হারাম হয়নি। ভারতে হামলা হয়েছে, তারা পাকিস্তানি তালেবানের পুরোনো টার্গেট। লন্ডনের পাতালরেলে হামলা হয়েছে, বড় ধরনের ক্ষতি না হওয়ায় তা নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য আমরা শুনিনি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, আমেরিকার দিকে হাত বাড়িয়েছে এসব সন্ত্রাসী। আমেরিকায় বাস করে, কেউ কেউ আমেরিকার নাগরিক, এমন লোকজনকে দলে ভিড়িয়ে সন্ত্রাসী হামলার ষড়যন্ত্র হয়েছে, এমন গোটা তিনেক ঘটনা গত এক বছরে ধরা পড়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই হয় আল-কায়েদা, নয়তো পাকিস্তানি তালেবান এসব হামলাচেষ্টার পেছনে কলকাঠি নেড়েছে। ফয়সলের বেলায় যেমন তারা তাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, কী করে বোমা বানাতে হয় তার বুদ্ধি বাতলে দিয়েছে, নগদ অর্থে বিমানের টিকিট কেনার পয়সাও সম্ভবত তাদের কাছ থেকেই এসেছে। (সম্ভবত বলছি, কারণ এ ব্যাপারটি এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি)। এ পর্যন্ত তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু ভবিষ্যতে যে কোথাও আগুন জ্বলবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়?
পারভেজ হুদোবয় পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় লিখেছেন, একজন পাকিস্তানি যে টাইমস স্কয়ারে গাড়িতে বোমা ফাটিয়ে মানুষ মারার পাঁয়তারা করছিল, তা মোটেই বিস্ময়ের কিছু নয়। ‘আপনি যখন জ্বালানি তেলের ট্যাংকের মুখের ওপর জ্বলন্ত দেশলাই ধরে রাখেন, রসায়নশাস্ত্রের নিয়ম অনুসারে একসময় না একসময় সেখানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠবেই।’ অন্য কথায়, এসব জিহাদি তো খোদ পাকিস্তানের নিজের সৃষ্টি। এখন বোতল ফুঁড়ে জিন বাইরে আসা শুরু করেছে। বস্তুত ব্যাপারটা আকস্মিক বা কাকতালীয় নয় মোটেই। ধর্মের নামে জিহাদ—তা কখনো ভারতের বিরুদ্ধে, কখনো আমেরিকার বিরুদ্ধে—পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভেতর-শরীরে ঢুকে বসে আছে গত ৩০ বছর। ৩০ বছর কেন, পাকিস্তানের সৃষ্টির গোড়া থেকেই, তবে ১৯৭৪-এ জিয়াউল হক ক্ষমতা গ্রহণের পর জিহাদ ও রাজনীতি সমার্থক হয়ে ওঠে। এর একটি যদি হয় বন্দুক, তো অন্যটি সে বন্দুকের সুদৃশ্য চামড়ার মোড়ক। আসলে পাকিস্তান এমন একটা দেশ, যেখানে সে দেশের মানুষকে এক ছাতার নিচে আনতে পারে ওই এক ধর্ম ছাড়া অন্য কিছুই নেই। ফলে সেখানে যারাই ক্ষমতা নিয়েছে—তা উর্দি পরা জেনারেল হোক বা শেরোয়ানি পরা চতুর রাজনীতিক—সবাই ধর্মকে ব্যবহার করেছে নিজেদের ক্ষমতা দখলকে জায়েজ করতে। নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণে কে কত ইসলাম-পছন্দ, তার পাল্লা দিয়েছে। শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক নাগরিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলে কী হবে, পাকিস্তানি সরকারের নজরদারিতেই দেশজুড়ে গড়ে উঠেছে মাদ্রাসাভিত্তিক জিহাদি শিক্ষাব্যবস্থা। এদের নেতৃত্বেই পাকিস্তানের ১১ হাজার মাদ্রাসা থেকে প্রতিবছর পাঁচ লাখ ছাত্র বেরোচ্ছে, যাদের ভেতর কম করে হলেও ১০ হাজার ছাত্র হাতে-কলমে সন্ত্রাসী কাজে সামরিক প্রশিক্ষণ পাচ্ছে। অনেক সময় সে শিক্ষা যে খোদ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানেই হয়েছে, তা আর গোপন কোনো ব্যাপার নয়। সবচেয়ে পরিহাসের কথা হলো, এসব জিহাদির রোষের আগুনে সবচেয়ে বেশি পুড়েছে পাকিস্তানিরা নিজেরাই। কখনো শিয়া মসজিদে, কখনো বাজারে, কখনো বা মেয়েদের স্কুলঘরে বা পাঁচতারা হোটেলে জিহাদি হামলার ফলে গত কয়েক বছরে পাঁচ হাজারেরও বেশি পাকিস্তানির মৃত্যু হয়েছে। পাকিস্তান আশা করেছিল, এসব জিহাদি নজর দেবে ভারতের দিকে। কিন্তু তারা যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে উঠবে, তা তাদের মাথায় ঢোকেনি।
এবার তারা নজর দিয়েছে আমেরিকার ওপর। তার সৃষ্টির গোড়া থেকেই পাকিস্তান আমেরিকার তাঁবেদার রাষ্ট্র, আমেরিকাই তাকে ডলার, গম ও বোমারু বিমান সরবরাহ করে টিকিয়ে রেখেছে। আমেরিকা যেন পাকিস্তানের কামধেনু, বোঁটা ধরে টিপলেই ডলার ছলাৎ ছলাৎ করে পড়তে থাকে। তো, সেই দুধেল গাইয়ের ওপরেই যে জিহাদিরা পেছন থেকে ঢিল ছুড়বে, তা সম্ভবত পাকিস্তানের সরকারি জিহাদ প্ল্যানাররা ভাবেননি। এ কথা ঠিক যে আমেরিকার ব্যাপারে পাকিস্তানের সরকার ও তার দেশের মানুষের মনোভাবে বড় রকমের ব্যবধান রয়েছে। পাকিস্তানের উত্তর পাড়া-দক্ষিণ পাড়া যে যত মার্কিনপন্থীই হোক না কেন, দেশের মানুষ আমেরিকাকে ভারতের চেয়েও বড় শত্রু মনে করে। দেশের তথ্যমাধ্যমেও এ নিয়ে জ্বালাময়ী সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয়র কমতি নেই। সবচেয়ে তেতে রয়েছে টিভির টক শো হোস্টগুলো। ব্যাপারটার ভেতর যে এক ধরনের পরিহাস রয়েছে, সে কথা অলক্ষ্যে জানিয়ে পারভেজ হুদোবয় লিখেছেন, এদের কথা শুনে মনে হয়, আমেরিকা বছর বছর যে কোটি কোটি ডলার পাকিস্তানের টাঁকশালে ঢালছে, তা যেন পাকিস্তানের নিজের টাকা, আমেরিকাই সে টাকায় ভাগ বসাতে চায়!
পাকিস্তানিদের মার্কিনবিরোধী মনোভাবকে সে দেশের খাকিওয়ালারা এত দিন পর্যন্ত নিজেদের স্বার্থেই ব্যবহার করেছে। পাকিস্তানের ভেতর সন্ত্রাসী হুমকি যত বেড়েছে, আমেরিকাও তড়িঘড়ি করে সেখানে তাদের অনুদানের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। যে নতুন লুগার-কেরি আইন আমেরিকার কংগ্রেসে পাস হয়েছে, তাতে আগামী পাঁচ বছরে পাকিস্তানের জন্য সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার রাখা হয়েছে। এই টাকার একটা বড় অংশ সামরিক খাতে ব্যবহার করা হবে, বাকিটা হবে সামাজিক খাতে। কিন্তু শর্ত দেওয়া হয়েছে একটা—সন্ত্রাসীদের ঠেকাতে হবে। তো, ঠেকানো দূরের কথা, সে জিহাদিরা এখন যদি আমেরিকাকেই টার্গেট বানিয়ে বসে, তাহলে উল্টো বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। শুধু যে এই দুধেল গরু দুধ দেওয়া বন্ধ করবে তা-ই নয়, সরাসরি গুঁতো দিতেও তেড়ে আসবে। আমেরিকান নীতিনির্ধারকেরা কোনো রাখঢাক ছাড়াই বলেছেন, তাঁদের নিজেদের ভূখণ্ডে কারও গায়ে যদি আঁচড়টুকুও লাগে, পাল্টা ব্যবস্থা নিতে তাঁরা বাধ্য হবেন। শুধু আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই নয়, নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার জন্যও তাঁদের খোদ পাকিস্তানের ভেতর হামলা করতে হবে। ওবামা প্রশাসনের এমনিতেই বদনাম রয়েছে যে নিরাপত্তার ব্যাপারে তারা নরম, ‘টেররিস্ট’দের সঙ্গে হাত মেলাতেও তাদের আপত্তি নেই। এ অবস্থায় নিজের গদি সামাল দিতেই ওবামাকে সাঁড়াশি হামলা চালাতে হবে। যেমন হামলা চালিয়েছিলেন জর্জ বুশ ওসামা বিন লাদেনের আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে, ৯/১১-এর আক্রমণের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে।
অবস্থা যাতে তত দূর না গড়ায়, তার জন্য পাকিস্তানের সামনে খোলা পথ একটাই—নিজের গৃহপালিত জিহাদিদের বিষদাঁত ভেঙে দেওয়া। শুধু সামরিক ব্যবস্থা নিলেই হবে না, দেশের মানুষের জিহাদি সংস্কৃতি পরিবর্তনেও হাত লাগাতে হবে। এই কাজটা যদি দেশের ভেতর থেকে, নাগরিক প্রতিরোধের ভিত্তিতে অর্জিত না হয়, তাহলে সফল হওয়া অসম্ভব হবে। আশার কথা, পাকিস্তানিদের ভেতরেই কেউ কেউ এখন সে দাবি তোলা শুরু করেছেন।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
ড. আদিলের কথার সঙ্গে অধিকাংশ মুক্তবুদ্ধির মানুষই একমত হবেন। এমনকি নিউইয়র্ক শহরের মেয়র মাইক ব্লুমবার্গও সে কথাই বলেছেন। এক ফয়সলের জন্য যেন কোনো পাকিস্তানি বা মুসলমানের ওপর আক্রমণ না করা হয়, তারা যেন বৈষম্যের শিকার না হয়, সে কথার হুঁশিয়ারি তিনি ফয়সল ধরা পড়ার পরই স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন। তার পরও পাকিস্তানি শুনলে লোকজন ট্যারা চোখে তাকাবে না বা বাড়িভাড়া চাইতে এলে দ্বিধাগ্রস্ত হবে না, এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই। ড. আদিল অবশ্য এই ভেবে আশ্বস্ত হয়েছেন, ফয়সল ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই খোদ পাকিস্তান সরকার কবুল করেছে, এ ব্যাপারে আমেরিকার সঙ্গে সব রকম সহযোগিতা তারা করবে। হাফ ডজন পাকিস্তানিকে এরই মধ্যে তারা পাকড়াও করেছে।
পাকিস্তানের সরকার, সে দেশের তথ্যমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষ বরাবর সন্ত্রাসবাদের কথা উঠলেই বিদেশি ষড়যন্ত্রের গন্ধ আবিষ্কার করেছেন। হয় ভারত, নয়তো আমেরিকা সব অপকর্মের হোতা! মুম্বাইয়ে সরাসরি টিভির পর্দায় বোমা ও বন্দুক নিয়ে নিজেদের ভাই-ব্রাদারদের ছোটাছুটি করতে দেখার পরও তাদের বিশ্বাস, এ সবই ‘র’ এবং ‘সিআইএ’র কারসাজি। কিন্তু এবার দেখছি পাকিস্তানিদের গলার আওয়াজ কিঞ্চিত বদলেছে। যেমন, দৈনিক নিউজ ইন্টারন্যাশনাল পত্রিকা ক্ষোভের সঙ্গে লিখেছে, ‘ইদানীং অন্য আর কিছুর বদলে পাকিস্তান সবচেয়ে বেশি যা রপ্তানি করা শুরু করেছে, তা হলো সন্ত্রাসী।’ আরেক পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবী পারভেজ হুদোবয় মন্তব্য করেছেন, ‘কে এই ফয়সল, সে প্রশ্ন করার চেয়ে অনেক জরুরি, ওই এক পাকিস্তান থেকে বারবার কেন আন্তর্জাতিক টেররিস্ট তৈরি হচ্ছে?’
যত দিন পর্যন্ত নিজেদের ঘরে পোষা সন্ত্রাসীদের হামলায় মুখ্যত পাকিস্তানিরাই ঘায়েল হচ্ছিল, তত দিন আমেরিকার বা বিদেশি অন্য কোনো দেশের এই নিয়ে ঘুম হারাম হয়নি। ভারতে হামলা হয়েছে, তারা পাকিস্তানি তালেবানের পুরোনো টার্গেট। লন্ডনের পাতালরেলে হামলা হয়েছে, বড় ধরনের ক্ষতি না হওয়ায় তা নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য আমরা শুনিনি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, আমেরিকার দিকে হাত বাড়িয়েছে এসব সন্ত্রাসী। আমেরিকায় বাস করে, কেউ কেউ আমেরিকার নাগরিক, এমন লোকজনকে দলে ভিড়িয়ে সন্ত্রাসী হামলার ষড়যন্ত্র হয়েছে, এমন গোটা তিনেক ঘটনা গত এক বছরে ধরা পড়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই হয় আল-কায়েদা, নয়তো পাকিস্তানি তালেবান এসব হামলাচেষ্টার পেছনে কলকাঠি নেড়েছে। ফয়সলের বেলায় যেমন তারা তাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, কী করে বোমা বানাতে হয় তার বুদ্ধি বাতলে দিয়েছে, নগদ অর্থে বিমানের টিকিট কেনার পয়সাও সম্ভবত তাদের কাছ থেকেই এসেছে। (সম্ভবত বলছি, কারণ এ ব্যাপারটি এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি)। এ পর্যন্ত তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু ভবিষ্যতে যে কোথাও আগুন জ্বলবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়?
পারভেজ হুদোবয় পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় লিখেছেন, একজন পাকিস্তানি যে টাইমস স্কয়ারে গাড়িতে বোমা ফাটিয়ে মানুষ মারার পাঁয়তারা করছিল, তা মোটেই বিস্ময়ের কিছু নয়। ‘আপনি যখন জ্বালানি তেলের ট্যাংকের মুখের ওপর জ্বলন্ত দেশলাই ধরে রাখেন, রসায়নশাস্ত্রের নিয়ম অনুসারে একসময় না একসময় সেখানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠবেই।’ অন্য কথায়, এসব জিহাদি তো খোদ পাকিস্তানের নিজের সৃষ্টি। এখন বোতল ফুঁড়ে জিন বাইরে আসা শুরু করেছে। বস্তুত ব্যাপারটা আকস্মিক বা কাকতালীয় নয় মোটেই। ধর্মের নামে জিহাদ—তা কখনো ভারতের বিরুদ্ধে, কখনো আমেরিকার বিরুদ্ধে—পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভেতর-শরীরে ঢুকে বসে আছে গত ৩০ বছর। ৩০ বছর কেন, পাকিস্তানের সৃষ্টির গোড়া থেকেই, তবে ১৯৭৪-এ জিয়াউল হক ক্ষমতা গ্রহণের পর জিহাদ ও রাজনীতি সমার্থক হয়ে ওঠে। এর একটি যদি হয় বন্দুক, তো অন্যটি সে বন্দুকের সুদৃশ্য চামড়ার মোড়ক। আসলে পাকিস্তান এমন একটা দেশ, যেখানে সে দেশের মানুষকে এক ছাতার নিচে আনতে পারে ওই এক ধর্ম ছাড়া অন্য কিছুই নেই। ফলে সেখানে যারাই ক্ষমতা নিয়েছে—তা উর্দি পরা জেনারেল হোক বা শেরোয়ানি পরা চতুর রাজনীতিক—সবাই ধর্মকে ব্যবহার করেছে নিজেদের ক্ষমতা দখলকে জায়েজ করতে। নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণে কে কত ইসলাম-পছন্দ, তার পাল্লা দিয়েছে। শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক নাগরিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলে কী হবে, পাকিস্তানি সরকারের নজরদারিতেই দেশজুড়ে গড়ে উঠেছে মাদ্রাসাভিত্তিক জিহাদি শিক্ষাব্যবস্থা। এদের নেতৃত্বেই পাকিস্তানের ১১ হাজার মাদ্রাসা থেকে প্রতিবছর পাঁচ লাখ ছাত্র বেরোচ্ছে, যাদের ভেতর কম করে হলেও ১০ হাজার ছাত্র হাতে-কলমে সন্ত্রাসী কাজে সামরিক প্রশিক্ষণ পাচ্ছে। অনেক সময় সে শিক্ষা যে খোদ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানেই হয়েছে, তা আর গোপন কোনো ব্যাপার নয়। সবচেয়ে পরিহাসের কথা হলো, এসব জিহাদির রোষের আগুনে সবচেয়ে বেশি পুড়েছে পাকিস্তানিরা নিজেরাই। কখনো শিয়া মসজিদে, কখনো বাজারে, কখনো বা মেয়েদের স্কুলঘরে বা পাঁচতারা হোটেলে জিহাদি হামলার ফলে গত কয়েক বছরে পাঁচ হাজারেরও বেশি পাকিস্তানির মৃত্যু হয়েছে। পাকিস্তান আশা করেছিল, এসব জিহাদি নজর দেবে ভারতের দিকে। কিন্তু তারা যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে হুমকি হয়ে উঠবে, তা তাদের মাথায় ঢোকেনি।
এবার তারা নজর দিয়েছে আমেরিকার ওপর। তার সৃষ্টির গোড়া থেকেই পাকিস্তান আমেরিকার তাঁবেদার রাষ্ট্র, আমেরিকাই তাকে ডলার, গম ও বোমারু বিমান সরবরাহ করে টিকিয়ে রেখেছে। আমেরিকা যেন পাকিস্তানের কামধেনু, বোঁটা ধরে টিপলেই ডলার ছলাৎ ছলাৎ করে পড়তে থাকে। তো, সেই দুধেল গাইয়ের ওপরেই যে জিহাদিরা পেছন থেকে ঢিল ছুড়বে, তা সম্ভবত পাকিস্তানের সরকারি জিহাদ প্ল্যানাররা ভাবেননি। এ কথা ঠিক যে আমেরিকার ব্যাপারে পাকিস্তানের সরকার ও তার দেশের মানুষের মনোভাবে বড় রকমের ব্যবধান রয়েছে। পাকিস্তানের উত্তর পাড়া-দক্ষিণ পাড়া যে যত মার্কিনপন্থীই হোক না কেন, দেশের মানুষ আমেরিকাকে ভারতের চেয়েও বড় শত্রু মনে করে। দেশের তথ্যমাধ্যমেও এ নিয়ে জ্বালাময়ী সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয়র কমতি নেই। সবচেয়ে তেতে রয়েছে টিভির টক শো হোস্টগুলো। ব্যাপারটার ভেতর যে এক ধরনের পরিহাস রয়েছে, সে কথা অলক্ষ্যে জানিয়ে পারভেজ হুদোবয় লিখেছেন, এদের কথা শুনে মনে হয়, আমেরিকা বছর বছর যে কোটি কোটি ডলার পাকিস্তানের টাঁকশালে ঢালছে, তা যেন পাকিস্তানের নিজের টাকা, আমেরিকাই সে টাকায় ভাগ বসাতে চায়!
পাকিস্তানিদের মার্কিনবিরোধী মনোভাবকে সে দেশের খাকিওয়ালারা এত দিন পর্যন্ত নিজেদের স্বার্থেই ব্যবহার করেছে। পাকিস্তানের ভেতর সন্ত্রাসী হুমকি যত বেড়েছে, আমেরিকাও তড়িঘড়ি করে সেখানে তাদের অনুদানের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। যে নতুন লুগার-কেরি আইন আমেরিকার কংগ্রেসে পাস হয়েছে, তাতে আগামী পাঁচ বছরে পাকিস্তানের জন্য সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার রাখা হয়েছে। এই টাকার একটা বড় অংশ সামরিক খাতে ব্যবহার করা হবে, বাকিটা হবে সামাজিক খাতে। কিন্তু শর্ত দেওয়া হয়েছে একটা—সন্ত্রাসীদের ঠেকাতে হবে। তো, ঠেকানো দূরের কথা, সে জিহাদিরা এখন যদি আমেরিকাকেই টার্গেট বানিয়ে বসে, তাহলে উল্টো বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। শুধু যে এই দুধেল গরু দুধ দেওয়া বন্ধ করবে তা-ই নয়, সরাসরি গুঁতো দিতেও তেড়ে আসবে। আমেরিকান নীতিনির্ধারকেরা কোনো রাখঢাক ছাড়াই বলেছেন, তাঁদের নিজেদের ভূখণ্ডে কারও গায়ে যদি আঁচড়টুকুও লাগে, পাল্টা ব্যবস্থা নিতে তাঁরা বাধ্য হবেন। শুধু আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই নয়, নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার জন্যও তাঁদের খোদ পাকিস্তানের ভেতর হামলা করতে হবে। ওবামা প্রশাসনের এমনিতেই বদনাম রয়েছে যে নিরাপত্তার ব্যাপারে তারা নরম, ‘টেররিস্ট’দের সঙ্গে হাত মেলাতেও তাদের আপত্তি নেই। এ অবস্থায় নিজের গদি সামাল দিতেই ওবামাকে সাঁড়াশি হামলা চালাতে হবে। যেমন হামলা চালিয়েছিলেন জর্জ বুশ ওসামা বিন লাদেনের আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে, ৯/১১-এর আক্রমণের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে।
অবস্থা যাতে তত দূর না গড়ায়, তার জন্য পাকিস্তানের সামনে খোলা পথ একটাই—নিজের গৃহপালিত জিহাদিদের বিষদাঁত ভেঙে দেওয়া। শুধু সামরিক ব্যবস্থা নিলেই হবে না, দেশের মানুষের জিহাদি সংস্কৃতি পরিবর্তনেও হাত লাগাতে হবে। এই কাজটা যদি দেশের ভেতর থেকে, নাগরিক প্রতিরোধের ভিত্তিতে অর্জিত না হয়, তাহলে সফল হওয়া অসম্ভব হবে। আশার কথা, পাকিস্তানিদের ভেতরেই কেউ কেউ এখন সে দাবি তোলা শুরু করেছেন।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments