একটি ভুল এবং জন্মের আগেই নারীর মৃত্যু প্রসঙ্গ by ফরিদা আখতার
কলকাতা থেকে প্রকাশিত ২৫ জানুয়ারি দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার প্রথম পাতায় আট কলামজুড়ে শিরোনাম, ‘হোয়ার এ পাক পিকচার ক্যান প্রভোক শেইম...’ (যেখানে একটি ছবি লজ্জাকে উস্কে দেয়) আমার দৃষ্টি কেড়েছে। শিরোনামটি উপেক্ষা করার জো নেই। খবরের সঙ্গে একটি সরকারি বিজ্ঞাপনের ছবিও রয়েছে। সেই বিজ্ঞাপনের আংশিক ছবিতে পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান তানভীর মাহমুদ আহমেদ ও ওস্তাদ আমজাদ আলী খানের ছবি দেখা যাচ্ছে। ঘটনা কী, জানার জন্য দ্রুত পড়ে ফেললাম।
২৪ জানুয়ারি ছিল জাতীয় কন্যাশিশু দিবস। এ উপলক্ষে ভারতে নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় পত্র-পত্রিকায় পুরো পাতাজুড়ে একটি বিজ্ঞাপন ছেপেছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা-নেত্রী, সংগীতজ্ঞ, ক্রীড়াবিদের ছবি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘আপনি কোথায় থাকতেন, যদি আপনার মাকে জন্মাতে না দেওয়া হতো?’ এ স্লোগানের ওপরের অংশে ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, সোনিয়া গান্ধী এবং নারী ও শিশুবিষয়কমন্ত্রী কৃষ্ণা তিরাতের ছবি। নিচে ছিল, ক্রিকেট সুপারস্টার বিরেন্দর শেবাগ ও কপিল দেব, সরোদসম্রাট ওস্তাদ আমজাদ আলী খান এবং পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান তানভীর মাহমুদ আহমেদের ছবি। তানভীর মাহমুদ আহমেদ ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর প্রধান পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। নাশতার টেবিলে যাঁরা পত্রিকা পড়েন, তাঁদের জন্য একটা বোমা ফাটার মতো ঘটনাই ঘটে গেছে সাত-সকালে। হইচই পড়ে গেল চারদিকে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ঘটনার তদন্ত ও মন্ত্রীকে ক্ষমা প্রার্থনা করার কথা বলা হলো। কন্যাশিশুকে বাঁচানোর জন্য যে বক্তব্য, তা ছাপিয়ে উঠে এল রাজনৈতিক বক্তব্য।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঘটনাটি ঘটেছে ইন্টারনেট থেকে গুগল ইমেজের ছবি ব্যবহার করতে গিয়ে। ভারত সরকারের ডিরেক্টরেট অব অ্যাডভার্টাইজিং অ্যান্ড ভিজুয়াল পাবলিসিটি (ডিএভিপি) ছবি সহকারে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য গুগল থেকে ছবি সংগ্রহ করতে গিয়েই এই গোলমাল বাধিয়েছে। তারা অবশ্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে কাজটি করতে দিয়েছিল। তারা চেয়েছিল কন্যাশিশু দিবসে ভ্রূণ হত্যার (ফিমেল ফেটিসাইড) যে প্রবণতা ভারতে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, এই দিনে বিভিন্ন পেশার মানুষের ছবি দিয়ে এই বক্তব্য তুলে ধরা যে এই কন্যাশিশুরাই তো এত গুরুত্বপূর্ণ মানুষের মা, ভবিষ্যতেও তারা এমন সন্তানই জন্ম দেবে। বিশেষ করে ক্রিকেট খেলোয়াড়, সংগীতশিল্পী, সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তার ছবি বিজ্ঞাপনে থাকলে খুব ভালো হবে বলেই মনে করেছিল এই অধিদপ্তর। কিন্তু গুগল থেকে ছবি ডাউনলোড করার পর তারা লক্ষ্য করে দেখেনি যে বিমানবাহিনীর পোশাক পরা ব্যক্তি ভারতের নন, পাকিস্তানের। সর্বনাশ! ফলে সরকারি বিজ্ঞাপনে বিদেশি নাগরিকের (শুধু বিদেশি নয়, ‘শত্রু দেশের’ সামরিক বাহিনীর) ছবি প্রকাশিত হয়েছে। দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় এ খবরের উপশিরোনাম ছিল অ্যাপোলজি আফটার অ্যাড শোয়িং ‘এনিমি’ (বিজ্ঞাপনে ‘শত্রু’কে দেখানোর জন্যক্ষমাপ্রার্থনা)। কাজেই ঘটনাটি খুব সহজে ফেলে দেওয়ার নয়। যদিও মন্ত্রী কৃষ্ণা তিরাত তাঁর মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এই ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন, কিন্তু তাঁর মতে যে বক্তব্য তিনি এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নারীভ্রূণ হত্যার বিরুদ্ধে দিতে চেয়েছেন, তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাত্ জন্মের আগে কন্যাশিশু হত্যা বা ভ্রূণ হত্যা রোধ করার জন্য সব ধরনের পেশার মানুষের জন্ম দেয় যে নারী, তাকে জন্মাতে দেওয়া হচ্ছে না, তাই এই বক্তব্য। যাক গে। গুগল ইমেজ নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের জন্য এ ঘটনা একটি সাবধান বাণী হয়ে থাকবে আশা করি। ছবি হলেই হবে না, ছবি চিনে তবে ছাপতে হবে।
রাজনৈতিক দিক থেকে দেখতে গেলে বিদেশি নাগরিকের ছবি দিয়ে সরকারি বিজ্ঞাপন করা অবশ্যই সঠিক কাজ নয়। তবে যাঁকে নিয়ে এত হইচই তিনি এতে বিব্রত নন। বিবিসি নিউজ ওয়েবসাইটে প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান তানভীর মাহমুদ আহমেদ বিষয়টি লক্ষ করেননি। কারণ, তিনি গলফ ম্যাচ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর মতে, এটা একটা ইনোসেন্ট (নিষ্পাপ) ভুল। পাঠকেরা এ বিষয় নিয়ে আরও জানতে চাইলে গুগলেই পাওয়া যাবে।
জাতিসংঘের হিসাব মতে, ভারতে প্রতিদিন অবৈধভাবে দুই হাজার কন্যাশিশুর ভ্রূণ গর্ভপাত ঘটছে। ফলে ভারতে সার্বিকভাবে নারীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ২০০১ সালের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি হাজার পুরুষের বিপরীতে ৯২৭ জন নারী। অথচ ১৯৬১ সালে তা ছিল, প্রতি হাজার পুরুষের তুলনায় ৯৭৬ জন নারী। প্রায় তিন থেকে চার কোটি কন্যাশিশু ভারতের জনসংখ্যা থেকে হারিয়ে গেছে। পাঞ্জাব, উড়িষ্যা, রাজস্থান, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র এমনকি মুম্বাই এবং রাজধানী দিল্লির অবস্থা আরও খারাপ। সাম্প্রতিক হিসাবে দেখা গেছে, দক্ষিণ দিল্লিতে নারী-পুরুষ অনুপাত হচ্ছে প্রতি হাজারে ৭৬২ জন নারী এবং মুম্বাইতে প্রতি হাজারে ৭২৮ জন নারী। ধনী-গরিব সব ধরনের পরিবারেই কন্যাশিশুদের জন্মের আগেই হত্যা করা হচ্ছে।
এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে বাংলাদেশেও এ ঘটনা ঘটছে না। মোট জনসংখ্যায় নারীর সংখ্যা কম হওয়ার কারণ জন্মের আগেই নারীর মৃত্যু বা হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে চিকিত্সা বিজ্ঞানের তথাকথিত ‘উন্নত’ প্রযুক্তি বা সেক্স সিলেকশন টেকনোলজি ব্যবহারের মাধ্যমে, যার মাধ্যমে গর্ভাবস্থায়সন্তানের লিঙ্গ চিহ্নিত করা যায়। বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিকে বন্ধ্যত্ব দূরীকরণের চিকিত্সা এবং গর্ভধারণের পর ভ্রূণটি ছেলে না মেয়ে জানার জন্য প্রিইমপ্লেনটেশন জেনেটিক ডায়াগনোসিস (পিজিডি) প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রায় শোনা যায়, আলট্রা সাউন্ড পরীক্ষা দিয়ে সন্তান ছেলে না মেয়ে জানা যাচ্ছে এবং প্রয়োজনে গর্ভপাতও ঘটানো হচ্ছে। গর্ভকালীন সময় মধ্যবিত্ত নারীরা এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাচ্ছেন, চিকিত্সকেরাও তাঁদের সহায়তা করছেন। কিন্তু সরকারের এ বিষয়ে কোনো নীতি আছে কি-না, তা কারোই জানা নেই। পরিবারগুলো পুত্রসন্তান চায়। পরিবারে সব ছেলে থাকলে তখন মেয়ে হলে আদর লাগে, কিন্তু সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইনের কারণে মেয়েদের ভ্রূণেই মৃত্যু ঘটানো হচ্ছে। এটা একটা নীরব হত্যাকাণ্ড, যা ঘটে চলেছে আমাদের সবারই অজান্তে। অন্ধকার ও বর্বর যুগে যা ছিল, তা এখন আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে ঘটছে বলেই কি আমরা সবাই মেনে নিচ্ছি?
চীন দেশে এক সন্তান জনসংখ্যা নীতিগ্রহণের কারণে একটি সন্তান কন্যা হলে তাকে হত্যা করার ঘটনা জাতীয়পর্যায়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারলে গর্ভেই নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে আর প্রযুক্তি যেখানে নেই, সেখানে মেয়েটি জন্মে পৃথিবীর আলো দেখতে না দেখতেই তাকে যে কোনোভাবে মেরে ফেলা হচ্ছে। কেউ কেউ এত নিষ্ঠুর হতে চাননি, তাই কন্যাকে এতিমখানায় পালতে দিয়ে কিংবা জন্মনিবন্ধন না করিয়ে আর একটি ছেলেসন্তানের চেষ্টা করার সুযোগ নিয়েছে। এটাও তো এক ধরনের মৃত্যু, কারণ এই মেয়েটি মা-বাবা থাকা সত্ত্বেও স্বীকৃতি পেল না। সে এতিম হলো কিংবা জন্মেছে এমন হিসাবের বাইরে চলে গেল। চীনে প্রতি ১১৬ জন ছেলের বিপরীতে মেয়ের সংখ্যা ১০০। কিন্তু এখন হয়েছে অন্য বিপদ। কন্যাশিশুকে নিয়ে এই ভয়ানক সমস্যা চিহ্নিত আবারও সেই পুরুষদেরই প্রয়োজনে। যেমন ভারতের কয়েকটি রাজ্যে পুরুষেরা বিবাহযোগ্য হয়ে উঠেছে কিন্তু তাদের বউ হবে এমন বয়সী মেয়ে সেখানে নেই। চীনেও একই সমস্যা। বউ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই অন্য রাজ্য কিংবা দেশ থেকে পাচার করে মেয়েদের নিয়ে আসা হচ্ছে ছেলেদের বিয়ে করানোর জন্য এবং বংশ বৃদ্ধির জন্য।
আবারও ভারতের সেই বিজ্ঞাপনের কথায় ফিরে যাই। আসলে যদিও বলা হচ্ছে, ‘আপনি কেমন করে জন্মাতেন যদি আপনার মা না জন্মাতো’—সেটা বলা হচ্ছে, বিখ্যাত পুরুষদের জন্ম নিশ্চিত করার জন্য। এই নারীদের বেঁচে থাকা বা জন্মানোর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কি? নারীকে জন্মাতে হবে পুরুষ জন্ম দেওয়ার জন্য, আর কিছু নয়? বাহ্। এটাই কি কন্যাশিশু দিবসের মূল কথা?
ফরিদা আখতার: নারী আন্দোলনের নেত্রী।
২৪ জানুয়ারি ছিল জাতীয় কন্যাশিশু দিবস। এ উপলক্ষে ভারতে নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় পত্র-পত্রিকায় পুরো পাতাজুড়ে একটি বিজ্ঞাপন ছেপেছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা-নেত্রী, সংগীতজ্ঞ, ক্রীড়াবিদের ছবি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘আপনি কোথায় থাকতেন, যদি আপনার মাকে জন্মাতে না দেওয়া হতো?’ এ স্লোগানের ওপরের অংশে ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, সোনিয়া গান্ধী এবং নারী ও শিশুবিষয়কমন্ত্রী কৃষ্ণা তিরাতের ছবি। নিচে ছিল, ক্রিকেট সুপারস্টার বিরেন্দর শেবাগ ও কপিল দেব, সরোদসম্রাট ওস্তাদ আমজাদ আলী খান এবং পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান তানভীর মাহমুদ আহমেদের ছবি। তানভীর মাহমুদ আহমেদ ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর প্রধান পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। নাশতার টেবিলে যাঁরা পত্রিকা পড়েন, তাঁদের জন্য একটা বোমা ফাটার মতো ঘটনাই ঘটে গেছে সাত-সকালে। হইচই পড়ে গেল চারদিকে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ঘটনার তদন্ত ও মন্ত্রীকে ক্ষমা প্রার্থনা করার কথা বলা হলো। কন্যাশিশুকে বাঁচানোর জন্য যে বক্তব্য, তা ছাপিয়ে উঠে এল রাজনৈতিক বক্তব্য।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঘটনাটি ঘটেছে ইন্টারনেট থেকে গুগল ইমেজের ছবি ব্যবহার করতে গিয়ে। ভারত সরকারের ডিরেক্টরেট অব অ্যাডভার্টাইজিং অ্যান্ড ভিজুয়াল পাবলিসিটি (ডিএভিপি) ছবি সহকারে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য গুগল থেকে ছবি সংগ্রহ করতে গিয়েই এই গোলমাল বাধিয়েছে। তারা অবশ্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে কাজটি করতে দিয়েছিল। তারা চেয়েছিল কন্যাশিশু দিবসে ভ্রূণ হত্যার (ফিমেল ফেটিসাইড) যে প্রবণতা ভারতে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, এই দিনে বিভিন্ন পেশার মানুষের ছবি দিয়ে এই বক্তব্য তুলে ধরা যে এই কন্যাশিশুরাই তো এত গুরুত্বপূর্ণ মানুষের মা, ভবিষ্যতেও তারা এমন সন্তানই জন্ম দেবে। বিশেষ করে ক্রিকেট খেলোয়াড়, সংগীতশিল্পী, সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তার ছবি বিজ্ঞাপনে থাকলে খুব ভালো হবে বলেই মনে করেছিল এই অধিদপ্তর। কিন্তু গুগল থেকে ছবি ডাউনলোড করার পর তারা লক্ষ্য করে দেখেনি যে বিমানবাহিনীর পোশাক পরা ব্যক্তি ভারতের নন, পাকিস্তানের। সর্বনাশ! ফলে সরকারি বিজ্ঞাপনে বিদেশি নাগরিকের (শুধু বিদেশি নয়, ‘শত্রু দেশের’ সামরিক বাহিনীর) ছবি প্রকাশিত হয়েছে। দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় এ খবরের উপশিরোনাম ছিল অ্যাপোলজি আফটার অ্যাড শোয়িং ‘এনিমি’ (বিজ্ঞাপনে ‘শত্রু’কে দেখানোর জন্যক্ষমাপ্রার্থনা)। কাজেই ঘটনাটি খুব সহজে ফেলে দেওয়ার নয়। যদিও মন্ত্রী কৃষ্ণা তিরাত তাঁর মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এই ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন, কিন্তু তাঁর মতে যে বক্তব্য তিনি এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নারীভ্রূণ হত্যার বিরুদ্ধে দিতে চেয়েছেন, তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাত্ জন্মের আগে কন্যাশিশু হত্যা বা ভ্রূণ হত্যা রোধ করার জন্য সব ধরনের পেশার মানুষের জন্ম দেয় যে নারী, তাকে জন্মাতে দেওয়া হচ্ছে না, তাই এই বক্তব্য। যাক গে। গুগল ইমেজ নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের জন্য এ ঘটনা একটি সাবধান বাণী হয়ে থাকবে আশা করি। ছবি হলেই হবে না, ছবি চিনে তবে ছাপতে হবে।
রাজনৈতিক দিক থেকে দেখতে গেলে বিদেশি নাগরিকের ছবি দিয়ে সরকারি বিজ্ঞাপন করা অবশ্যই সঠিক কাজ নয়। তবে যাঁকে নিয়ে এত হইচই তিনি এতে বিব্রত নন। বিবিসি নিউজ ওয়েবসাইটে প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান তানভীর মাহমুদ আহমেদ বিষয়টি লক্ষ করেননি। কারণ, তিনি গলফ ম্যাচ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর মতে, এটা একটা ইনোসেন্ট (নিষ্পাপ) ভুল। পাঠকেরা এ বিষয় নিয়ে আরও জানতে চাইলে গুগলেই পাওয়া যাবে।
জাতিসংঘের হিসাব মতে, ভারতে প্রতিদিন অবৈধভাবে দুই হাজার কন্যাশিশুর ভ্রূণ গর্ভপাত ঘটছে। ফলে ভারতে সার্বিকভাবে নারীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ২০০১ সালের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি হাজার পুরুষের বিপরীতে ৯২৭ জন নারী। অথচ ১৯৬১ সালে তা ছিল, প্রতি হাজার পুরুষের তুলনায় ৯৭৬ জন নারী। প্রায় তিন থেকে চার কোটি কন্যাশিশু ভারতের জনসংখ্যা থেকে হারিয়ে গেছে। পাঞ্জাব, উড়িষ্যা, রাজস্থান, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র এমনকি মুম্বাই এবং রাজধানী দিল্লির অবস্থা আরও খারাপ। সাম্প্রতিক হিসাবে দেখা গেছে, দক্ষিণ দিল্লিতে নারী-পুরুষ অনুপাত হচ্ছে প্রতি হাজারে ৭৬২ জন নারী এবং মুম্বাইতে প্রতি হাজারে ৭২৮ জন নারী। ধনী-গরিব সব ধরনের পরিবারেই কন্যাশিশুদের জন্মের আগেই হত্যা করা হচ্ছে।
এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে বাংলাদেশেও এ ঘটনা ঘটছে না। মোট জনসংখ্যায় নারীর সংখ্যা কম হওয়ার কারণ জন্মের আগেই নারীর মৃত্যু বা হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে চিকিত্সা বিজ্ঞানের তথাকথিত ‘উন্নত’ প্রযুক্তি বা সেক্স সিলেকশন টেকনোলজি ব্যবহারের মাধ্যমে, যার মাধ্যমে গর্ভাবস্থায়সন্তানের লিঙ্গ চিহ্নিত করা যায়। বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিকে বন্ধ্যত্ব দূরীকরণের চিকিত্সা এবং গর্ভধারণের পর ভ্রূণটি ছেলে না মেয়ে জানার জন্য প্রিইমপ্লেনটেশন জেনেটিক ডায়াগনোসিস (পিজিডি) প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রায় শোনা যায়, আলট্রা সাউন্ড পরীক্ষা দিয়ে সন্তান ছেলে না মেয়ে জানা যাচ্ছে এবং প্রয়োজনে গর্ভপাতও ঘটানো হচ্ছে। গর্ভকালীন সময় মধ্যবিত্ত নারীরা এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাচ্ছেন, চিকিত্সকেরাও তাঁদের সহায়তা করছেন। কিন্তু সরকারের এ বিষয়ে কোনো নীতি আছে কি-না, তা কারোই জানা নেই। পরিবারগুলো পুত্রসন্তান চায়। পরিবারে সব ছেলে থাকলে তখন মেয়ে হলে আদর লাগে, কিন্তু সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইনের কারণে মেয়েদের ভ্রূণেই মৃত্যু ঘটানো হচ্ছে। এটা একটা নীরব হত্যাকাণ্ড, যা ঘটে চলেছে আমাদের সবারই অজান্তে। অন্ধকার ও বর্বর যুগে যা ছিল, তা এখন আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে ঘটছে বলেই কি আমরা সবাই মেনে নিচ্ছি?
চীন দেশে এক সন্তান জনসংখ্যা নীতিগ্রহণের কারণে একটি সন্তান কন্যা হলে তাকে হত্যা করার ঘটনা জাতীয়পর্যায়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারলে গর্ভেই নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে আর প্রযুক্তি যেখানে নেই, সেখানে মেয়েটি জন্মে পৃথিবীর আলো দেখতে না দেখতেই তাকে যে কোনোভাবে মেরে ফেলা হচ্ছে। কেউ কেউ এত নিষ্ঠুর হতে চাননি, তাই কন্যাকে এতিমখানায় পালতে দিয়ে কিংবা জন্মনিবন্ধন না করিয়ে আর একটি ছেলেসন্তানের চেষ্টা করার সুযোগ নিয়েছে। এটাও তো এক ধরনের মৃত্যু, কারণ এই মেয়েটি মা-বাবা থাকা সত্ত্বেও স্বীকৃতি পেল না। সে এতিম হলো কিংবা জন্মেছে এমন হিসাবের বাইরে চলে গেল। চীনে প্রতি ১১৬ জন ছেলের বিপরীতে মেয়ের সংখ্যা ১০০। কিন্তু এখন হয়েছে অন্য বিপদ। কন্যাশিশুকে নিয়ে এই ভয়ানক সমস্যা চিহ্নিত আবারও সেই পুরুষদেরই প্রয়োজনে। যেমন ভারতের কয়েকটি রাজ্যে পুরুষেরা বিবাহযোগ্য হয়ে উঠেছে কিন্তু তাদের বউ হবে এমন বয়সী মেয়ে সেখানে নেই। চীনেও একই সমস্যা। বউ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই অন্য রাজ্য কিংবা দেশ থেকে পাচার করে মেয়েদের নিয়ে আসা হচ্ছে ছেলেদের বিয়ে করানোর জন্য এবং বংশ বৃদ্ধির জন্য।
আবারও ভারতের সেই বিজ্ঞাপনের কথায় ফিরে যাই। আসলে যদিও বলা হচ্ছে, ‘আপনি কেমন করে জন্মাতেন যদি আপনার মা না জন্মাতো’—সেটা বলা হচ্ছে, বিখ্যাত পুরুষদের জন্ম নিশ্চিত করার জন্য। এই নারীদের বেঁচে থাকা বা জন্মানোর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কি? নারীকে জন্মাতে হবে পুরুষ জন্ম দেওয়ার জন্য, আর কিছু নয়? বাহ্। এটাই কি কন্যাশিশু দিবসের মূল কথা?
ফরিদা আখতার: নারী আন্দোলনের নেত্রী।
No comments