হাওয়ার্ড জিন ও তাঁর শেষ প্রতিবাদ by মার্ক ফিনে
লেখক, শিক্ষক ও রাজনৈতিক কর্মী হাওয়ার্ড জিন গত হয়েছেন। ‘বিকল্প ইতিহাস’ নামে পরিচিত তাঁর জনপ্রিয় বই এ পিপলস হিস্টরি অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস বিক্রির তালিকার শীর্ষে উঠেছিল। গত ২৭ জানুয়ারি ৮৭ বছর বয়সে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমেরিকার ইতিহাসের সেই যুগটি শেষের কাছাকাছি পৌঁছালো, যে যুগে তারকা গায়কের চেয়ে কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতেন বেশি। দাপুটে ক্ষমতার বিরুদ্ধে তাঁদের নৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থান একটা সময় কোটি কোটি মানুষকে আলোড়িত করত, দুনিয়াকে অন্যভাবে দেখতে ও সক্রিয় হতে প্রেরণা জোগাত।
ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম যাঁরা প্রতিবাদ করেছিলেন, বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ হাওয়ার্ড জিন ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তাঁর সম্পর্কে আরেক মার্কিন পণ্ডিত ও সোচ্চার লেখক নোয়াম চমস্কি বলেছেন, ‘তাঁর লেখালেখি গত শতকের ষাট দশকের তরুণ প্রজন্মের চিন্তাচেতনা পাল্টে দিয়েছিল। যখনই যুদ্ধ বা কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনো কর্মসূচি দেওয়া হতো, তখন যে কেউ নিশ্চিত থাকতে পারত, হাওয়ার্ড জিনকে সবার সামনে দেখা যাবে। তিনি ছিলেন একটি দৃষ্টান্ত ও বিশ্বস্ত পথপ্রদর্শক।
হাওয়ার্ড জিনের জন্য প্রতিবাদী তত্পরতা ছিল তাঁর বিকল্প ইতিহাসচর্চারই স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ। ১৯৮০ সালে প্রকাশিত তাঁর এ পিপলস হিস্টরি অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস বইয়ের নায়ক আমেরিকার ‘প্রতিষ্ঠাতা পিতারা’ ছিলেন না। তাঁর নায়কেরা ছিলেন কৃষক বিদ্রোহের নেতা, কিংবা ত্রিশের দশকের শ্রমিক ইউনিয়নের সংগঠকেরা।
তাঁর আত্মজীবনী চলন্ত ট্রেনে আপনি নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না (১৯৯৪) গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘গোড়া থেকেই আমার শিক্ষকতা উত্সারিত হতো আমার নিজেরই জীবন থেকে। আমি অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করতাম। তবে আমি কেবল “নৈর্ব্যক্তিকতায়” সন্তুষ্ট ছিলাম না। আমি চাইতাম শিক্ষার্থীরা আমার কাছ থেকে কেবল বুঝমান হয়েই ফিরে না যাক; তারা নীরবতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হোক, যেখানেই অন্যায় দেখবে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার নৈতিক সাহস রাখুক। বলতে বাধা নেই, এ জন্য আমাকে অনেক বাধাবিপত্তির মধ্যে পড়তে হয়েছে।’ এ জন্য তাঁকে এই অভিযোগও শুনতে হয়েছে, ‘হাওয়ার্ড জিন শিক্ষার পরিবেশ বিষাক্ত করে তুলছেন।’
ড. জিনের জন্ম ১৯২২ সালের ২২ আগস্ট, নিউইয়র্ক শহরে অভিবাসী হয়ে আসা এক ইহুদি পরিবারে। তিনি নিউইয়র্ক পাবলিক স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন বিমান বাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগে তিনি ব্রুকলিন বন্দরে শ্রমিক হিসেবে কাজ নিয়েছিলেন। যুদ্ধে বোমারু হিসেবে বীরত্বের জন্য তাঁকে ‘এয়ার মেডেল’ দেওয়া হয় এবং তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত হন।
যুদ্ধের পরে তাঁকে গায়ে খাটা মজুরের কাজ করতে হয়েছে। ২৭ বছর বয়সে তিনি নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। দিনের বেলায় পড়াশোনা আর রাতে কুলির কাজ করে পড়াশোনার খরচ জোগাতে হতো তাঁকে। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করার পর তিনি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
ড. জিন অনেক নাগরিক অধিকার আন্দোলনে কাজ করেছেন। তাঁর সময়ে সবচেয়ে প্রতিবাদী ছাত্রসংগঠন স্টুডেন্ট নন-ভায়োলেন্ট কো-অর্ডিনেশন কমিটির (অহিংস ছাত্রদের সমন্বয় কমিটি) নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে তাঁর সোচ্চার ভূমিকার জন্য তিনি একই সঙ্গে খ্যাতি ও বিড়ম্বনার শিকার হন। তাঁর খ্যাতি যখন তুঙ্গে, তিনি ও আরেক যুদ্ধবিরোধী সংগঠক রেভারেন্ড ড্যানিয়েল বেরিগান ১৯৬৮ সালে ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ে গিয়ে উত্তর ভিয়েতনামের গেরিলাদের কাছ থেকে তিন মার্কিন বন্দীকে গ্রহণ করেন। গেরিলা মুক্তিসংগ্রামীরা তাঁর সম্মানে ওই তিন মার্কিনিকে মুক্তি দেয়।
যুদ্ধবিরোধী তত্পরতার অংশ হিসেবে তিনি দুটি বই লেখেন—ভিয়েতনাম: দ্য লজিক অব উইথড্রয়াল (১৯৬৭) ও ডিসঅবিডিয়েন্স অ্যান্ড ডেমোক্রেসি (১৯৬৮)। এ ছাড়া লিখেছেন দ্য পলিটিকস অব হিস্টরি (১৯৭০), পোস্টওয়ার আমেরিকা (১৯৭৩), জাস্টিস ইন এভরি ডে (১৯৭৪) ও ডিক্লারেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্স (১৯৯০)। তাঁর বই অবলম্বনে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র, নাটক ও টেলিভিশনের ধারাবাহিক অনুষ্ঠান। ১৯৮৮ সালে জিন আগাম অবসর নেন, যাতে লেখালেখি ও বক্তৃতায় আরও মন দিতে পারেন।
মৃত্যুর দিন বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি তাঁর পাঠদান ৩০ মিনিট আগে শেষ করেন। কারণ, সেখান থেকে তিনি যাবেন একটি মিছিলে যোগ দিতে। তাঁর ক্লাসে উপস্থিত প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থীকেও সেই মিছিলে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। তাঁদের মধ্য থেকে এক শয়ের মতো শিক্ষার্থী তাঁর সঙ্গে গিয়েছিলেন। সেটাই ছিল তাঁর শেষ প্রতিবাদ।
বোস্টন গ্লোব থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
মার্ক ফিনে: মার্কিন সাংবাদিক।
ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম যাঁরা প্রতিবাদ করেছিলেন, বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ হাওয়ার্ড জিন ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তাঁর সম্পর্কে আরেক মার্কিন পণ্ডিত ও সোচ্চার লেখক নোয়াম চমস্কি বলেছেন, ‘তাঁর লেখালেখি গত শতকের ষাট দশকের তরুণ প্রজন্মের চিন্তাচেতনা পাল্টে দিয়েছিল। যখনই যুদ্ধ বা কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনো কর্মসূচি দেওয়া হতো, তখন যে কেউ নিশ্চিত থাকতে পারত, হাওয়ার্ড জিনকে সবার সামনে দেখা যাবে। তিনি ছিলেন একটি দৃষ্টান্ত ও বিশ্বস্ত পথপ্রদর্শক।
হাওয়ার্ড জিনের জন্য প্রতিবাদী তত্পরতা ছিল তাঁর বিকল্প ইতিহাসচর্চারই স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ। ১৯৮০ সালে প্রকাশিত তাঁর এ পিপলস হিস্টরি অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস বইয়ের নায়ক আমেরিকার ‘প্রতিষ্ঠাতা পিতারা’ ছিলেন না। তাঁর নায়কেরা ছিলেন কৃষক বিদ্রোহের নেতা, কিংবা ত্রিশের দশকের শ্রমিক ইউনিয়নের সংগঠকেরা।
তাঁর আত্মজীবনী চলন্ত ট্রেনে আপনি নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না (১৯৯৪) গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘গোড়া থেকেই আমার শিক্ষকতা উত্সারিত হতো আমার নিজেরই জীবন থেকে। আমি অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করতাম। তবে আমি কেবল “নৈর্ব্যক্তিকতায়” সন্তুষ্ট ছিলাম না। আমি চাইতাম শিক্ষার্থীরা আমার কাছ থেকে কেবল বুঝমান হয়েই ফিরে না যাক; তারা নীরবতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হোক, যেখানেই অন্যায় দেখবে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার নৈতিক সাহস রাখুক। বলতে বাধা নেই, এ জন্য আমাকে অনেক বাধাবিপত্তির মধ্যে পড়তে হয়েছে।’ এ জন্য তাঁকে এই অভিযোগও শুনতে হয়েছে, ‘হাওয়ার্ড জিন শিক্ষার পরিবেশ বিষাক্ত করে তুলছেন।’
ড. জিনের জন্ম ১৯২২ সালের ২২ আগস্ট, নিউইয়র্ক শহরে অভিবাসী হয়ে আসা এক ইহুদি পরিবারে। তিনি নিউইয়র্ক পাবলিক স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন বিমান বাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগে তিনি ব্রুকলিন বন্দরে শ্রমিক হিসেবে কাজ নিয়েছিলেন। যুদ্ধে বোমারু হিসেবে বীরত্বের জন্য তাঁকে ‘এয়ার মেডেল’ দেওয়া হয় এবং তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত হন।
যুদ্ধের পরে তাঁকে গায়ে খাটা মজুরের কাজ করতে হয়েছে। ২৭ বছর বয়সে তিনি নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। দিনের বেলায় পড়াশোনা আর রাতে কুলির কাজ করে পড়াশোনার খরচ জোগাতে হতো তাঁকে। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করার পর তিনি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
ড. জিন অনেক নাগরিক অধিকার আন্দোলনে কাজ করেছেন। তাঁর সময়ে সবচেয়ে প্রতিবাদী ছাত্রসংগঠন স্টুডেন্ট নন-ভায়োলেন্ট কো-অর্ডিনেশন কমিটির (অহিংস ছাত্রদের সমন্বয় কমিটি) নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে তাঁর সোচ্চার ভূমিকার জন্য তিনি একই সঙ্গে খ্যাতি ও বিড়ম্বনার শিকার হন। তাঁর খ্যাতি যখন তুঙ্গে, তিনি ও আরেক যুদ্ধবিরোধী সংগঠক রেভারেন্ড ড্যানিয়েল বেরিগান ১৯৬৮ সালে ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ে গিয়ে উত্তর ভিয়েতনামের গেরিলাদের কাছ থেকে তিন মার্কিন বন্দীকে গ্রহণ করেন। গেরিলা মুক্তিসংগ্রামীরা তাঁর সম্মানে ওই তিন মার্কিনিকে মুক্তি দেয়।
যুদ্ধবিরোধী তত্পরতার অংশ হিসেবে তিনি দুটি বই লেখেন—ভিয়েতনাম: দ্য লজিক অব উইথড্রয়াল (১৯৬৭) ও ডিসঅবিডিয়েন্স অ্যান্ড ডেমোক্রেসি (১৯৬৮)। এ ছাড়া লিখেছেন দ্য পলিটিকস অব হিস্টরি (১৯৭০), পোস্টওয়ার আমেরিকা (১৯৭৩), জাস্টিস ইন এভরি ডে (১৯৭৪) ও ডিক্লারেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্স (১৯৯০)। তাঁর বই অবলম্বনে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র, নাটক ও টেলিভিশনের ধারাবাহিক অনুষ্ঠান। ১৯৮৮ সালে জিন আগাম অবসর নেন, যাতে লেখালেখি ও বক্তৃতায় আরও মন দিতে পারেন।
মৃত্যুর দিন বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি তাঁর পাঠদান ৩০ মিনিট আগে শেষ করেন। কারণ, সেখান থেকে তিনি যাবেন একটি মিছিলে যোগ দিতে। তাঁর ক্লাসে উপস্থিত প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থীকেও সেই মিছিলে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। তাঁদের মধ্য থেকে এক শয়ের মতো শিক্ষার্থী তাঁর সঙ্গে গিয়েছিলেন। সেটাই ছিল তাঁর শেষ প্রতিবাদ।
বোস্টন গ্লোব থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
মার্ক ফিনে: মার্কিন সাংবাদিক।
No comments