জীবনানন্দ দাশের বাড়ির সেই দুটি খুঁটি by দীপংকর চন্দ
বরিশাল সদরের খানাখন্দভরা রাজপথ। বগুড়া রোড। আম্বিয়া হাসপাতালের বিরাট ভবন। খুব কাছেই মুন্সির গ্যারেজ। কয়েকটি রিকশা রাস্তার পাশের লাইটপোস্টের সঙ্গে চেইন দিয়ে বাঁধা। ছায়া সুনিবিড় একটি বাড়ির প্রবেশদ্বার। হালকা লালচে ওই প্রবেশদ্বারের মোটা থামে একটা নামফলক। ওই ফলকে কালো হরফে লেখা ‘ধানসিড়ি’। হ্যাঁ, অনেক অনেক দিন আগে, এ বাড়িতেই থাকতেন কবি জীবনানন্দ দাশ।
বরিশাল সদরের ধানসিড়ি নামের এ বাড়িটির পূর্বনাম ছিল সর্বানন্দ ভবন। জীবনানন্দ দাশের পিতামহ সর্বানন্দ দাশের নামানুসারেই বাড়িটির এই নামকরণ করা হয়েছিল। সর্বানন্দ দাশের আদি নিবাস ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগনার পদ্মাপারের গাউপাড়া গ্রামে। জীবনানন্দের পিতামহ বরিশালের কালেক্টরেট অফিসে চাকরি নিয়ে গাউপাড়া থেকে বরিশালে আসেন। বংশগতভাবে তাঁরা ছিলেন হিন্দু। আদিতে তাঁদের পদবি ছিল দাশগুপ্ত। কিন্তু এ পরিবারে সর্বানন্দই প্রথম ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন এবং পদবি দাশগুপ্তের শেষাংশ অর্থাত্ ‘গুপ্ত’ ছেঁটে ফেলে নামশেষে ব্যবহার করা শুরু করেন দাশ উপাধিটুকু। সর্বানন্দ দাশের সাত ছেলে, চার মেয়ে। সর্বানন্দের ছেলেমেয়েরা বরিশাল শহরে বাড়ি তৈরি করে বাবার নামে সেই বাড়ির নাম রাখেন ‘সর্বানন্দ ভবন’।
জীবনানন্দ দাশের জন্ম ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ সালে। তাঁর বাবা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন সর্বানন্দের দ্বিতীয় ছেলে। জীবনানন্দের মায়ের নাম কুসুমকুমারী দাশ। জীবনানন্দ দাশের বাল্যশিক্ষার সূত্রপাত বাড়িতে, মায়ের কাছেই। তারপর ব্রজমোহন স্কুলে ভর্তি হন তিনি। ১৯১৫ সালে মেট্রিক পাস করেন জীবনানন্দ দাশ। ১৯১৭ সালে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে আইএ, ১৯১৯ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন তিনি। এ বছরই প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় তাঁর। ‘বর্ষ-আবাহন’ নামে এই কবিতাটি জীবনানন্দের বাবা সত্যানন্দ দাশ প্রতিষ্ঠিত ও সম্পাদিত ব্রহ্মবাদী পত্রিকার বৈশাখ ১৩২৬ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন তিনি। ১৯২২ সালে কলকাতা সিটি কলেজে ইংরেজি ভাষা সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন জীবনানন্দ দাশ। ১৯২৫ সালে প্রথম গদ্যরচনা প্রকাশিত হয় তাঁর। ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতাগ্রন্থ ঝরা পালক। ১৯২৯ সালে খুলনা জেলার বাগেরহাট কলেজে মাস তিনেক অধ্যাপনা করেন তিনি। ওই বছরের শেষদিকে যোগ দেন দিল্লির রামযশ কলেজে। ১৯৩০ সালের মে মাসে চাকরি ছেড়ে দেশে ফেরেন জীবনানন্দ দাশ। ৯ মে বিয়ে করেন রোহিণীকুমার গুপ্তের মেয়ে লাবণ্য গুপ্তকে। বিয়ের পর অনেক দিন কর্মহীন জীবন যাপন করেন জীবনানন্দ দাশ। ১৯৩৫ সালে তিনি আবার যুক্ত হন শিক্ষকতা পেশায়। এবার বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে যোগ দেন জীবনানন্দ দাশ। ১৯৪৬ সালের ৮ জুলাই কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে কলকাতা যান তিনি। কিন্তু ১৯৪৭ সালের দেশভাগ, সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি বিনষ্টকারী দাঙ্গাসহ নানা প্রতিকূল কারণেই আর দেশে ফেরা হয়নি জীবনানন্দ দাশের।
দেশভাগের পর কবি-পরিবারও চলে যায় কলকাতায়। ১৯৫৫ সালে কবি পরিবারের পক্ষ থেকে সর্বানন্দ ভবন সংরক্ষণের আইনসিদ্ধ অনুমতি প্রদান করা হয় আইনজীবী পবিত্র কুমার ঘোষকে। তবে আইনসিদ্ধ এই অনুমতি প্রদানের অনেক আগে থেকেই এ বাড়িতে বাস করতেন কালেক্টরেটের কর্মচারী আবদুর রাজ্জাক। তিনি ১৯৬০ সালের ১৭ জুন বাড়িটির বেশ কিছু অংশ ক্রয় করেন। পরবর্তীকালে বাড়িটির ৭০ ভাগ জমি হুকুম-দখল করে সরকার। বর্তমানে সেখানে রয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের একটি আবাসিক ভবন এবং সিটি করপোরেশনের একটি জল উত্তোলন প্রকল্প। সরকারি এই স্থাপনা, প্রকল্প সহজেই চোখে পড়ে আমাদের। বিষণ্ন মনে সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আমরা ধানসিড়ি নামের বাড়িটির প্রবেশদ্বার অতিক্রম করি। ভেতরে ছায়া সুনিবিড় সরুপথ। একহারা গড়নের সুপারি গাছের সারি পথের দুই পাশে। এ ছাড়া আছে চিত্র-বিচিত্র পাতাবাহার আর বাহারি পুষ্পবীথির সুসম বিন্যাস। পাতা-পুষ্পের প্রদীপ্ত সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতেই জলিল ফারুকের সঙ্গে পরিচয় হলো আমাদের। ক্রয়সূত্রে কবির সম্পত্তির কিয়দংশের মালিক মরহুম আবদুর রাজ্জাকের তৃতীয় ছেলে তিনি। জলিল ফারুক আন্তরিকভাবেই আমাদের ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখালেন জীবনানন্দ দাশের বসতবাড়ির পরিবর্তিত অংশটুকু। কবির সময়ের চিহ্ন বলতে দুটি সিমেন্টে নির্মিত খুঁটি ছাড়া তেমন কিছুই নেই আজ দেখার মতো। আমরা সেই খুঁটি দুটোর সামনে দাঁড়াই কিছুক্ষণ। অল্প সময়ের জন্য হলেও কেমন একটা বিহ্বলতা কাজ করে আমাদের ভেতর। জলিল ফারুক জানালেন, শুধু কবির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ এখনো ধরে রেখেছেন তাঁরা খুঁটি দুটোর অস্তিত্ব। সরকার চাইলে অধিগ্রহণ করতে পারে কবি জীবনানন্দের পুরো বাড়ি। এতে জলিল ফারুক এবং তাঁর পরিবারের আপত্তি নেই মোটেই। কিন্তু সরকার কি তা চায় আদৌ? সংশয়ের সতেজ বীজ রোপিত হয় তত্ক্ষণাত্ আমাদের ভাবনার ভরকেন্দ্রে। অতি দ্রুত সেই বীজ থেকে জন্ম নেয় সন্দেহের অচিন বৃক্ষ। অচিন সেই বৃক্ষ শাখা-প্রশাখায় বেড়ে ওঠে কী অবলীলায়! কত সহজে!
বরিশাল সদরের ধানসিড়ি নামের এ বাড়িটির পূর্বনাম ছিল সর্বানন্দ ভবন। জীবনানন্দ দাশের পিতামহ সর্বানন্দ দাশের নামানুসারেই বাড়িটির এই নামকরণ করা হয়েছিল। সর্বানন্দ দাশের আদি নিবাস ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগনার পদ্মাপারের গাউপাড়া গ্রামে। জীবনানন্দের পিতামহ বরিশালের কালেক্টরেট অফিসে চাকরি নিয়ে গাউপাড়া থেকে বরিশালে আসেন। বংশগতভাবে তাঁরা ছিলেন হিন্দু। আদিতে তাঁদের পদবি ছিল দাশগুপ্ত। কিন্তু এ পরিবারে সর্বানন্দই প্রথম ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন এবং পদবি দাশগুপ্তের শেষাংশ অর্থাত্ ‘গুপ্ত’ ছেঁটে ফেলে নামশেষে ব্যবহার করা শুরু করেন দাশ উপাধিটুকু। সর্বানন্দ দাশের সাত ছেলে, চার মেয়ে। সর্বানন্দের ছেলেমেয়েরা বরিশাল শহরে বাড়ি তৈরি করে বাবার নামে সেই বাড়ির নাম রাখেন ‘সর্বানন্দ ভবন’।
জীবনানন্দ দাশের জন্ম ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ সালে। তাঁর বাবা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন সর্বানন্দের দ্বিতীয় ছেলে। জীবনানন্দের মায়ের নাম কুসুমকুমারী দাশ। জীবনানন্দ দাশের বাল্যশিক্ষার সূত্রপাত বাড়িতে, মায়ের কাছেই। তারপর ব্রজমোহন স্কুলে ভর্তি হন তিনি। ১৯১৫ সালে মেট্রিক পাস করেন জীবনানন্দ দাশ। ১৯১৭ সালে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে আইএ, ১৯১৯ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন তিনি। এ বছরই প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় তাঁর। ‘বর্ষ-আবাহন’ নামে এই কবিতাটি জীবনানন্দের বাবা সত্যানন্দ দাশ প্রতিষ্ঠিত ও সম্পাদিত ব্রহ্মবাদী পত্রিকার বৈশাখ ১৩২৬ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন তিনি। ১৯২২ সালে কলকাতা সিটি কলেজে ইংরেজি ভাষা সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন জীবনানন্দ দাশ। ১৯২৫ সালে প্রথম গদ্যরচনা প্রকাশিত হয় তাঁর। ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতাগ্রন্থ ঝরা পালক। ১৯২৯ সালে খুলনা জেলার বাগেরহাট কলেজে মাস তিনেক অধ্যাপনা করেন তিনি। ওই বছরের শেষদিকে যোগ দেন দিল্লির রামযশ কলেজে। ১৯৩০ সালের মে মাসে চাকরি ছেড়ে দেশে ফেরেন জীবনানন্দ দাশ। ৯ মে বিয়ে করেন রোহিণীকুমার গুপ্তের মেয়ে লাবণ্য গুপ্তকে। বিয়ের পর অনেক দিন কর্মহীন জীবন যাপন করেন জীবনানন্দ দাশ। ১৯৩৫ সালে তিনি আবার যুক্ত হন শিক্ষকতা পেশায়। এবার বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে যোগ দেন জীবনানন্দ দাশ। ১৯৪৬ সালের ৮ জুলাই কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে কলকাতা যান তিনি। কিন্তু ১৯৪৭ সালের দেশভাগ, সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি বিনষ্টকারী দাঙ্গাসহ নানা প্রতিকূল কারণেই আর দেশে ফেরা হয়নি জীবনানন্দ দাশের।
দেশভাগের পর কবি-পরিবারও চলে যায় কলকাতায়। ১৯৫৫ সালে কবি পরিবারের পক্ষ থেকে সর্বানন্দ ভবন সংরক্ষণের আইনসিদ্ধ অনুমতি প্রদান করা হয় আইনজীবী পবিত্র কুমার ঘোষকে। তবে আইনসিদ্ধ এই অনুমতি প্রদানের অনেক আগে থেকেই এ বাড়িতে বাস করতেন কালেক্টরেটের কর্মচারী আবদুর রাজ্জাক। তিনি ১৯৬০ সালের ১৭ জুন বাড়িটির বেশ কিছু অংশ ক্রয় করেন। পরবর্তীকালে বাড়িটির ৭০ ভাগ জমি হুকুম-দখল করে সরকার। বর্তমানে সেখানে রয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের একটি আবাসিক ভবন এবং সিটি করপোরেশনের একটি জল উত্তোলন প্রকল্প। সরকারি এই স্থাপনা, প্রকল্প সহজেই চোখে পড়ে আমাদের। বিষণ্ন মনে সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আমরা ধানসিড়ি নামের বাড়িটির প্রবেশদ্বার অতিক্রম করি। ভেতরে ছায়া সুনিবিড় সরুপথ। একহারা গড়নের সুপারি গাছের সারি পথের দুই পাশে। এ ছাড়া আছে চিত্র-বিচিত্র পাতাবাহার আর বাহারি পুষ্পবীথির সুসম বিন্যাস। পাতা-পুষ্পের প্রদীপ্ত সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতেই জলিল ফারুকের সঙ্গে পরিচয় হলো আমাদের। ক্রয়সূত্রে কবির সম্পত্তির কিয়দংশের মালিক মরহুম আবদুর রাজ্জাকের তৃতীয় ছেলে তিনি। জলিল ফারুক আন্তরিকভাবেই আমাদের ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখালেন জীবনানন্দ দাশের বসতবাড়ির পরিবর্তিত অংশটুকু। কবির সময়ের চিহ্ন বলতে দুটি সিমেন্টে নির্মিত খুঁটি ছাড়া তেমন কিছুই নেই আজ দেখার মতো। আমরা সেই খুঁটি দুটোর সামনে দাঁড়াই কিছুক্ষণ। অল্প সময়ের জন্য হলেও কেমন একটা বিহ্বলতা কাজ করে আমাদের ভেতর। জলিল ফারুক জানালেন, শুধু কবির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ এখনো ধরে রেখেছেন তাঁরা খুঁটি দুটোর অস্তিত্ব। সরকার চাইলে অধিগ্রহণ করতে পারে কবি জীবনানন্দের পুরো বাড়ি। এতে জলিল ফারুক এবং তাঁর পরিবারের আপত্তি নেই মোটেই। কিন্তু সরকার কি তা চায় আদৌ? সংশয়ের সতেজ বীজ রোপিত হয় তত্ক্ষণাত্ আমাদের ভাবনার ভরকেন্দ্রে। অতি দ্রুত সেই বীজ থেকে জন্ম নেয় সন্দেহের অচিন বৃক্ষ। অচিন সেই বৃক্ষ শাখা-প্রশাখায় বেড়ে ওঠে কী অবলীলায়! কত সহজে!
No comments