রাজা সীতারাম রায়ের প্রাসাদ-দুর্গ by দীপংকর চন্দ
একটানা দীর্ঘদিন ঢাকায় থাকলেই অশান্তির অবদমিত অনলে দগ্ধ হয় মন। ক্লান্ত লাগে। অবসন্ন লাগে। লাগামহীন অসহনীয়তার বীজ রোপিত হয় নাগরিকজীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তখন? তখন অবসরের অপেক্ষায় না থেকে বেরিয়ে পড়ি—মহানগরের যান্ত্রিক আকর্ষণ উপেক্ষা করে দূরপথ অতিক্রম করি—খাল-বিল-নদী ছুঁয়ে ধানখেতের দিগন্তপ্রসারী সবুজের কাছে সমর্পিত করি নিজেকে। অশান্ত মন প্রশান্ত হয়—অচেনা গ্রামের সঙ্গে রচিত হয় আত্মীয়তা, অজানা পথের সঙ্গে সৃষ্টি হয় পরিচয়। সেই পরিচয়সূত্রেই আউনাড়া মোড় থেকে সামনে এগোলাম। যশপুরের কাইয়ুম মিয়ার রিকশাভ্যানে চেপে ধোয়াইল পৌঁছালাম ধীরে-সুস্থে। লাইবা নামের একটা দ্রুতগামী বাস পাশ কাটাল আমাদের। ধোয়াইল তিন রাস্তার মোড় পেছনে ফেলে বাঁ দিকে অগ্রসর হলাম আমরা। বড় বড় শিরীষগাছের স্নিগ্ধ ছায়া এই পথে। পথের অনেক ওপরের আকাশ মেঘমুক্ত, দ্বিধাশূন্য। পরিপার্শ্বের বাতাস অনুন্নত জনপদের গন্ধমাখা। রাজপথ ছেড়ে একটা শাখাপথে প্রবেশ করলাম এবার। ‘এই পথে মাইলদেড়েক এগোলেই মধুমতী নদী...’, উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে জানালেন ভ্রমণসঙ্গী সাধন পোদ্দার এবং তুষার সাহা, ‘...তবে নদী পর্যন্ত যাব না আমরা। বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের মোহাম্মদপুর কার্যালয়ের কাছেই থামতে হবে আমাদের, নামতে হবে ভ্যান থেকে। কারণ, সেখানেই মাগুরা জেলার মোহাম্মদপুর উপজেলার অনন্য প্রত্নকীর্তি রাজা সীতারাম রায়ের প্রাসাদ-দুর্গ।’
মাগুরা সদর উপজেলা থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে মধুমতী নদীর তীরে অবস্থিত এই প্রত্নস্থানটি রাজবাড়ি এলাকা নামে পরিচিত সাধারণ্যে। এ মুহূর্তে এলাকাটিকে ভীষণ অনুন্নত, অপ্রাগ্রসর বলে মনে হলেও সপ্তদশ-অষ্টদশ শতাব্দীতে এখানে যে একটি উন্নত জনপদের পত্তন হয়েছিল, রাজা সীতারাম রায়ের প্রাসাদ-দুর্গের অবস্থিতিই তার স্মৃতিভারাতুর সাক্ষ্য বহন করে।
রাজা সীতারাম রায় প্রচলিত অর্থে রাজা ছিলেন না, ছিলেন মোহাম্মদপুর অঞ্চলের প্রখ্যাত জমিদার। তাঁর পিতা সত্যজিত্ রায় মুর্শিদাবাদের নবাব সরকারের একজন আমলা ছিলেন। সীতারাম রায় পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমলা থেকে জমিদারি এবং পরে স্বীয় প্রতিভাবলে রাজা উপাধি লাভ করেন। উপাধি লাভের পর সীতারাম রায় একজন রাজার মতোই রাজ্য বিস্তারে সচেষ্ট হন। সেনাবল বৃদ্ধি করে তিনি পার্শ্ববর্তী জমিদারদের ভূ-সম্পত্তি নিজ অধিকারে নিয়ে আসেন। তারপর নবাব সরকারের রাজস্ব প্রদান বন্ধ করে একজন স্বাধীন, সার্বভৌম নৃপতির মতোই মোহাম্মদপুর জমিদারিতে প্রবর্তন করেন নিজস্ব শাসনব্যবস্থা। নতুন শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের পরপরই জমিদারি সুরক্ষার পদক্ষেপ নেন রাজা সীতারাম। এ জন্য নদীতীরবর্তী এ স্থানটিতে তিনি গড়ে তোলেন দুর্ভেদ্য দুর্গ, কাঁচারিবাড়ি, পরিখা পরিবেষ্টিত রাজপ্রাসাদ, পূজার্চনার জন্য নির্মাণ করেন দেবালয়, জনহিতার্থে খনন করেন বেশ কিছু বিশালাকার জলাশয়। রামসাগর, সুখসাগর, দুধসাগর, কৃষ্ণসাগর নামের সেই জলাশয়গুলো কি এখনো রয়েছে মোহাম্মদপুরে? ভাবতে ভাবতে ভ্যান থেকে নামলাম আমরা। সংশয়াকীর্ণ মন নিয়ে পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের হলুদ দ্বিতল ভবনের সামনের পথটুকু পেরিয়ে একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়ালাম। সেমিপাকা এই বিদ্যালয়টির একপাশেই রাজা সীতারাম রায়ের কাঁচারিবাড়ির প্রবেশদ্বার। জরাজীর্ণ সেই প্রবেশদ্বার অতিক্রম করে ভেতরে পা রাখতেই দৃষ্টিপ্রত্যক্ষে উন্মোচিত হলো কাঁচারিবাড়ির বিবর্ণ সৌন্দর্য। কাঁচারিবাড়ির উত্তরে দোলমঞ্চ। ভূমি সমতল থেকে খানিকটা নিচুতে অবস্থিত দোলমঞ্চের পশ্চিমে মূল রাজবাড়ি এলাকা। মোহাম্মদপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস পেছনে ফেলে সামনে এগোলাম এবার। দুধসাগর নামের অনতিবৃহত্ জলাশয়ের কাছেই রাজা সীতারাম রায়ের রাজবাড়ি। তবে বর্তমানে রাজবাড়ির সেই সুনির্দিষ্ট স্থানে সুপ্রাচীন কিছু ইট-সুরকির ভগ্নস্তূপ; স্তূপের ওপর সানন্দে বেড়ে ওঠা কিছু লতা, গাছপালা এবং সেসবের চারপাশজুড়ে বিস্তৃত হওয়া অবৈধ দখলদারি ব্যতীত দেখার মতো কিছুই নেই আর। রাজা সীতারাম রায়ের প্রতিষ্ঠিত দশভুজার মণ্ডপটি রাজবাড়ির ভগ্নস্তূপের কাছেই। মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় মন্দির হিসেবে ব্যবহূত এ মণ্ডপটির অনাড়ম্বর আঙিনায় আমরা দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ। মণ্ডপের অভ্যন্তরে উপবিষ্ট মৃত্তিকা নির্মিত শিবঠাকুর। হিন্দু শাস্ত্রমতে, শিবঠাকুর সংহারকর্তা, ধ্বংসের দেবতা। ধ্বংসের এই দেবতার মুখাবয়বে স্থির হয়ে থাকা রহস্যময় হাসি। সেই হাসি দেখতে দেখতে প্রাচীন মোহাম্মদপুরের উন্নত জনপদ ধ্বংস হওয়ার সূচনালগ্নের কথা ভাবি আমরা, ভাবি রাজা সীতারাম রায়ের শেষ দিনগুলোর কথা—বিরুদ্ধাচারী হওয়ার পর রাজা সীতারাম রায়কে দমন করার উদ্দেশ্যে নবাব মুর্শিদ কুলী খান ফৌজদার মীর আবু তোরাবকে প্রেরণ করেন মোহাম্মদপুরে। কিন্তু তাঁকে বিপুল বিক্রমে পরাস্ত করেন রাজা সীতারাম। এ পরাজয়ে ভীষণ ক্ষুব্ধ হন মুর্শিদাবাদের নবাব। এরপর তিনি আরও অধিকসংখ্যক সেনাসহ ফৌজদার বখত আলী খাঁকে প্রেরণ করেন। এবার আর শেষরক্ষা হয় না সীতারামের। ১৭১৪ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পরাজিত ও নিহত হন রাজা সীতারাম রায়। তাঁর মৃত্যুর পর নবাব সরকারের আনুকূল্যে নাটোরের জমিদারদের হাতে এ স্থানের তত্ত্বাবধানের ভার অর্পিত হলেও স্বাধীন-সার্বভৌম সত্তা হারানো মোহাম্মদপুরের প্রাণরস শুকিয়ে যায়—শুরু হয় একটি উন্নত জনপদ ধ্বংস হওয়ার সকরুণ প্রক্রিয়া।
মাগুরা সদর উপজেলা থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে মধুমতী নদীর তীরে অবস্থিত এই প্রত্নস্থানটি রাজবাড়ি এলাকা নামে পরিচিত সাধারণ্যে। এ মুহূর্তে এলাকাটিকে ভীষণ অনুন্নত, অপ্রাগ্রসর বলে মনে হলেও সপ্তদশ-অষ্টদশ শতাব্দীতে এখানে যে একটি উন্নত জনপদের পত্তন হয়েছিল, রাজা সীতারাম রায়ের প্রাসাদ-দুর্গের অবস্থিতিই তার স্মৃতিভারাতুর সাক্ষ্য বহন করে।
রাজা সীতারাম রায় প্রচলিত অর্থে রাজা ছিলেন না, ছিলেন মোহাম্মদপুর অঞ্চলের প্রখ্যাত জমিদার। তাঁর পিতা সত্যজিত্ রায় মুর্শিদাবাদের নবাব সরকারের একজন আমলা ছিলেন। সীতারাম রায় পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমলা থেকে জমিদারি এবং পরে স্বীয় প্রতিভাবলে রাজা উপাধি লাভ করেন। উপাধি লাভের পর সীতারাম রায় একজন রাজার মতোই রাজ্য বিস্তারে সচেষ্ট হন। সেনাবল বৃদ্ধি করে তিনি পার্শ্ববর্তী জমিদারদের ভূ-সম্পত্তি নিজ অধিকারে নিয়ে আসেন। তারপর নবাব সরকারের রাজস্ব প্রদান বন্ধ করে একজন স্বাধীন, সার্বভৌম নৃপতির মতোই মোহাম্মদপুর জমিদারিতে প্রবর্তন করেন নিজস্ব শাসনব্যবস্থা। নতুন শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের পরপরই জমিদারি সুরক্ষার পদক্ষেপ নেন রাজা সীতারাম। এ জন্য নদীতীরবর্তী এ স্থানটিতে তিনি গড়ে তোলেন দুর্ভেদ্য দুর্গ, কাঁচারিবাড়ি, পরিখা পরিবেষ্টিত রাজপ্রাসাদ, পূজার্চনার জন্য নির্মাণ করেন দেবালয়, জনহিতার্থে খনন করেন বেশ কিছু বিশালাকার জলাশয়। রামসাগর, সুখসাগর, দুধসাগর, কৃষ্ণসাগর নামের সেই জলাশয়গুলো কি এখনো রয়েছে মোহাম্মদপুরে? ভাবতে ভাবতে ভ্যান থেকে নামলাম আমরা। সংশয়াকীর্ণ মন নিয়ে পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের হলুদ দ্বিতল ভবনের সামনের পথটুকু পেরিয়ে একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়ালাম। সেমিপাকা এই বিদ্যালয়টির একপাশেই রাজা সীতারাম রায়ের কাঁচারিবাড়ির প্রবেশদ্বার। জরাজীর্ণ সেই প্রবেশদ্বার অতিক্রম করে ভেতরে পা রাখতেই দৃষ্টিপ্রত্যক্ষে উন্মোচিত হলো কাঁচারিবাড়ির বিবর্ণ সৌন্দর্য। কাঁচারিবাড়ির উত্তরে দোলমঞ্চ। ভূমি সমতল থেকে খানিকটা নিচুতে অবস্থিত দোলমঞ্চের পশ্চিমে মূল রাজবাড়ি এলাকা। মোহাম্মদপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস পেছনে ফেলে সামনে এগোলাম এবার। দুধসাগর নামের অনতিবৃহত্ জলাশয়ের কাছেই রাজা সীতারাম রায়ের রাজবাড়ি। তবে বর্তমানে রাজবাড়ির সেই সুনির্দিষ্ট স্থানে সুপ্রাচীন কিছু ইট-সুরকির ভগ্নস্তূপ; স্তূপের ওপর সানন্দে বেড়ে ওঠা কিছু লতা, গাছপালা এবং সেসবের চারপাশজুড়ে বিস্তৃত হওয়া অবৈধ দখলদারি ব্যতীত দেখার মতো কিছুই নেই আর। রাজা সীতারাম রায়ের প্রতিষ্ঠিত দশভুজার মণ্ডপটি রাজবাড়ির ভগ্নস্তূপের কাছেই। মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় মন্দির হিসেবে ব্যবহূত এ মণ্ডপটির অনাড়ম্বর আঙিনায় আমরা দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ। মণ্ডপের অভ্যন্তরে উপবিষ্ট মৃত্তিকা নির্মিত শিবঠাকুর। হিন্দু শাস্ত্রমতে, শিবঠাকুর সংহারকর্তা, ধ্বংসের দেবতা। ধ্বংসের এই দেবতার মুখাবয়বে স্থির হয়ে থাকা রহস্যময় হাসি। সেই হাসি দেখতে দেখতে প্রাচীন মোহাম্মদপুরের উন্নত জনপদ ধ্বংস হওয়ার সূচনালগ্নের কথা ভাবি আমরা, ভাবি রাজা সীতারাম রায়ের শেষ দিনগুলোর কথা—বিরুদ্ধাচারী হওয়ার পর রাজা সীতারাম রায়কে দমন করার উদ্দেশ্যে নবাব মুর্শিদ কুলী খান ফৌজদার মীর আবু তোরাবকে প্রেরণ করেন মোহাম্মদপুরে। কিন্তু তাঁকে বিপুল বিক্রমে পরাস্ত করেন রাজা সীতারাম। এ পরাজয়ে ভীষণ ক্ষুব্ধ হন মুর্শিদাবাদের নবাব। এরপর তিনি আরও অধিকসংখ্যক সেনাসহ ফৌজদার বখত আলী খাঁকে প্রেরণ করেন। এবার আর শেষরক্ষা হয় না সীতারামের। ১৭১৪ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পরাজিত ও নিহত হন রাজা সীতারাম রায়। তাঁর মৃত্যুর পর নবাব সরকারের আনুকূল্যে নাটোরের জমিদারদের হাতে এ স্থানের তত্ত্বাবধানের ভার অর্পিত হলেও স্বাধীন-সার্বভৌম সত্তা হারানো মোহাম্মদপুরের প্রাণরস শুকিয়ে যায়—শুরু হয় একটি উন্নত জনপদ ধ্বংস হওয়ার সকরুণ প্রক্রিয়া।
No comments