প্রথম দিনের সূর্য -চিরকুট by শাহাদুজ্জামান
বহু বহু যুগ আগে এই পৃথিবী-গ্রহেরই কোনো কোনো মানবগোষ্ঠী তাঁদের আদিম লোকাচারের অংশ হিসেবে প্রতি সন্ধ্যায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে একটি বিশেষ প্রার্থনা করতেন অস্তগামী সূর্যের কাছে। তাঁরা প্রার্থনা করতেন, ‘সূর্যদেব, দয়া করে আগামীকাল উদিত হবেন, ভুলে যাবেন না আমাদের।’ তাঁদের ভয় ছিল, এই যে তেজোদীপ্ত সূর্য ক্রমশ ম্লান হয়ে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছেন মহাশূন্যের অতলে। তিনি যদি আগামীকাল আর ফিরে না আসেন, যদি তাঁদের রাতের পর রাত এভাবে অন্ধকারে ফেলে রেখে সূর্যদেব চলে যান অন্য কোনো মহাশূন্যে কিংবা ভুলে যান তাঁদের! পরদিন পূর্বাকাশে সূর্যের মুখ দেখে গভীর স্বস্তি হতো তাঁদের। যুগের পর যুগ করজোড়ে সূর্যের কাছে প্রার্থনা করেছেন তাঁরা, আর সূর্যকে উদিত হতে দেখে আশ্বস্ত হয়েছেন। বলা বাহুল্য, আমরা আজকাল প্রার্থনা না করলেও সূর্যদেব প্রতিদিন পূর্বদিকে দেখা দেন। কেন দেখা দেন, এই সত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে বিজ্ঞানীদের।
নিয়মমাফিক এবারও বছরের প্রথম দিনে আকাশে দেখা দিয়েছেন পরিচিত, বিখ্যাত সেই সূর্যগোলক। প্রকৃতি কোনো সূর্যোদয়কেই বাদ্য বাজিয়ে বিশেষ সুর্যোদয় বলে ঘোষণা করে না। প্রকৃতির কাছে প্রতিটি সূর্যোদয়ই অন্য একটি সূর্যোদয়েরই পুনরাবৃত্তি। আমরাই আমাদের স্বপ্ন, ভাবনা, আবেগ দিয়ে নিত্যকার একটি সূর্যোদয়কে করে তুলি তাত্পর্যময়। বছরের প্রথম মাসের প্রথম সূর্য তাই আর আটপৌরে কোনো সূর্য থাকেন না। রোমানরা বছরের এই মাসটির নামকরণ করেছেন তাঁদের দেবতা জানুসের নাম অনুযায়ী। এই দেবতার দুটি মুখ। একটি মুখ তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে, অন্যটি পেছনে। তিনিই একমাত্র দেবতা, যিনি একই সঙ্গে অতীত এবং ভবিষ্যেক দেখতে পান।
নতুন বছরের শুরুতে আমাদেরও সুযোগ রয়েছে জানুসের মতো স্মৃতি আর স্বপ্নের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হিসাব-নিকাশ মেলানোর। আমরা এমন এক পৃথিবীতে এসে দাঁড়িয়েছি, যখন ব্যক্তিমানুষের স্মৃতি আর স্বপ্ন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে গেছে বৃহত্তর পৃথিবীর স্মৃতি আর স্বপ্নের সঙ্গে। কোনো দূরের এক শ্বেতাঙ্গ দেশে কৃষ্ণাঙ্গ এক রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছেন বলে দেখি নারায়ণগঞ্জের এক যুবক বুকভরে আনন্দের নিঃশ্বাস নিয়ে ভাবছে, আগামী বছরটি তার ভালো যাবে। মধ্যপ্রাচ্যে তেলের সংকট হলো বলে লালমনিরহাটের কৃষক সারা বছরেও জমাতে পারলেন না মেয়ের বিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ। আগামী বছরও স্থগিত থাকবে মেয়েটির বিয়ে। মন্দা আঘাত করল বলে বিলাতে বাংলাদেশি মালিকানাধীন ভারতীয় রেস্টুরেন্টে চিকেন টিক্কা মাসালার প্যাকেট সাজানোর কাজটি হারালেন নবাবপুরের তরুণ। হিম তুষারে বুট ডুবিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে নবাবপুরের তরুণ ভাবে, আগামী বছর দেশে ফিরবে সে। ভাবে, একটা ছোট চাকরিও কি জোগাড় হবে না ঢাকা শহরে, যা দিয়ে অন্তত সপ্তাহে একবার শুকনো কাঁঠালপাতার বাটিতে খাওয়া যাবে গরম ভাপ ওঠা হাজির বিরিয়ানি? অনেক দ্বিধার পর ধানমন্ডির ব্যবসায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আগামী বছর অভিবাসী হবেন ক্যাঙ্গারুর দেশে। দেশে তাঁর বিপুল সচ্ছলতা আছে, বিন্দুমাত্র স্বস্তি নেই। রাস্তার দুর্বিষহ যানজট, সন্তানের স্কুল, স্ত্রীর চিকিত্সা নিয়ে নারকীয় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে তাঁর গত বছর। বিশ্বায়নের পৃথিবীতে বিশ্বনাগরিক হওয়ার সামর্থ্য তাঁর আছে। কিন্তু যাঁরা থেকে যাবেন এই মানচিত্রে তাঁরা সবাই অজানা আশঙ্কায় তাকিয়ে আছেন আগামী বছরটির দিকে। তিল তিল করে যে ভুল, ক্লেদ আর অবহেলার ধুলো আমরা জমিয়েছি, তা কি একটু একটু করে সরতে শুরু করবে এবার? আজিমপুরের যে তরুণীর স্বামীকে একটি রহস্যময় মাটিলেপা মাইক্রোবাস যুদ্ধদিনে নিয়ে গিয়েছিল বধ্যভূমিতে, সেই তরুণী দিনের পর দিন বুকে দীর্ঘশ্বাস চেপে হয়েছেন প্রৌঢ়; প্রথমবারের মতো তিনি আশায় বুক বাঁধছেন, আগামী বছর তিনি হয়তো সেই দুর্বৃত্তদের দেখবেন কাঠগড়ায়। ফরিদপুরের যে বৃদ্ধ একটি লাল কাপড়-কাচা সাবান দিয়ে গোসল করিয়েছিলেন অবিসংবাদিত নেতার গুলিবিদ্ধ লাশ, অপেক্ষায় আছেন সেই দেশনেতার চোরাগোপ্তা লুকিয়ে থাকা ঘাতকদের প্রত্যেককে তিনি আগামী বছর দেখবেন গরাদের ওপারে। পুরোনো ধুলো সরানোর সঙ্গে সঙ্গে নতুন হাওয়া জাগানোর প্রতিশ্রুতি যাঁরা দিয়েছেন, তাঁরা কি আন্তরিক থাকবেন? তাদের কি আন্তরিক থাকতে দেওয়া হবে? নাকি আবার আমরা নিক্ষিপ্ত হব দুঃস্বপ্নের ঘেরাটোপে? সবারই রুদ্ধশ্বাস জপ, তা যেন না ঘটে।
যেমন জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তেমনি আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ঝুলিতেও নিশ্চয়ই গত বছর জমা হয়েছে টুকরো কোনো অভিমান, অপমান, বেদনা। সেই ঝুলির অন্ধকার গহ্বরে সেসব ছুড়ে দিয়ে নিংড়ে আনা যাক যতটুকু অবশিষ্ট মধুরিমা। বারবার চোখের জলে মুছে যায় বলে যে নারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তিনি আর চোখে কাজল লাগাবেন না, আগামী বছর আবার তাঁর চোখে উঠুক কাজল।
বছরের শেষ দিন। সাইবেরিয়ায় প্রচণ্ড তুষারঝড় হচ্ছে। বাড়ির বাইরে শুভ্র তুষারে ঢেকে আছে চারদিক। ঘরের ভেতর কাঠের আগুন জ্বালিয়ে ওম নিচ্ছে পুরো পরিবার। নাতি বলছে, ‘দাদু, একটা গল্প বলো।’ দাদু বলেন, ‘বুঝলি ইভান, আমাদের সবার বুকের ভেতর একটা চিড়িয়াখানা আছে। কাল নতুন বছরের প্রথম সূর্য উঠলেই সেই চিড়িয়াখানায় দুটো নেকড়ে আসবে। একটা নেকড়ে ভালো, সবার মঙ্গল চায়, বিশ্বাসী; আর অন্যটি মন্দ, হিংস্র, স্বার্থপর। সারা বছর ওই দুটোতে লড়াই করবে বুকের মধ্যে। বছর শেষে জিতবে একটি।’ নাতি বলে, ‘কোনটি জিতবে, দাদু?’ দাদু উত্তর দেন, ‘যেটিকে তুই বেশি খেতে দিবি।’
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
নিয়মমাফিক এবারও বছরের প্রথম দিনে আকাশে দেখা দিয়েছেন পরিচিত, বিখ্যাত সেই সূর্যগোলক। প্রকৃতি কোনো সূর্যোদয়কেই বাদ্য বাজিয়ে বিশেষ সুর্যোদয় বলে ঘোষণা করে না। প্রকৃতির কাছে প্রতিটি সূর্যোদয়ই অন্য একটি সূর্যোদয়েরই পুনরাবৃত্তি। আমরাই আমাদের স্বপ্ন, ভাবনা, আবেগ দিয়ে নিত্যকার একটি সূর্যোদয়কে করে তুলি তাত্পর্যময়। বছরের প্রথম মাসের প্রথম সূর্য তাই আর আটপৌরে কোনো সূর্য থাকেন না। রোমানরা বছরের এই মাসটির নামকরণ করেছেন তাঁদের দেবতা জানুসের নাম অনুযায়ী। এই দেবতার দুটি মুখ। একটি মুখ তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে, অন্যটি পেছনে। তিনিই একমাত্র দেবতা, যিনি একই সঙ্গে অতীত এবং ভবিষ্যেক দেখতে পান।
নতুন বছরের শুরুতে আমাদেরও সুযোগ রয়েছে জানুসের মতো স্মৃতি আর স্বপ্নের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হিসাব-নিকাশ মেলানোর। আমরা এমন এক পৃথিবীতে এসে দাঁড়িয়েছি, যখন ব্যক্তিমানুষের স্মৃতি আর স্বপ্ন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে গেছে বৃহত্তর পৃথিবীর স্মৃতি আর স্বপ্নের সঙ্গে। কোনো দূরের এক শ্বেতাঙ্গ দেশে কৃষ্ণাঙ্গ এক রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছেন বলে দেখি নারায়ণগঞ্জের এক যুবক বুকভরে আনন্দের নিঃশ্বাস নিয়ে ভাবছে, আগামী বছরটি তার ভালো যাবে। মধ্যপ্রাচ্যে তেলের সংকট হলো বলে লালমনিরহাটের কৃষক সারা বছরেও জমাতে পারলেন না মেয়ের বিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ। আগামী বছরও স্থগিত থাকবে মেয়েটির বিয়ে। মন্দা আঘাত করল বলে বিলাতে বাংলাদেশি মালিকানাধীন ভারতীয় রেস্টুরেন্টে চিকেন টিক্কা মাসালার প্যাকেট সাজানোর কাজটি হারালেন নবাবপুরের তরুণ। হিম তুষারে বুট ডুবিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে নবাবপুরের তরুণ ভাবে, আগামী বছর দেশে ফিরবে সে। ভাবে, একটা ছোট চাকরিও কি জোগাড় হবে না ঢাকা শহরে, যা দিয়ে অন্তত সপ্তাহে একবার শুকনো কাঁঠালপাতার বাটিতে খাওয়া যাবে গরম ভাপ ওঠা হাজির বিরিয়ানি? অনেক দ্বিধার পর ধানমন্ডির ব্যবসায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আগামী বছর অভিবাসী হবেন ক্যাঙ্গারুর দেশে। দেশে তাঁর বিপুল সচ্ছলতা আছে, বিন্দুমাত্র স্বস্তি নেই। রাস্তার দুর্বিষহ যানজট, সন্তানের স্কুল, স্ত্রীর চিকিত্সা নিয়ে নারকীয় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে তাঁর গত বছর। বিশ্বায়নের পৃথিবীতে বিশ্বনাগরিক হওয়ার সামর্থ্য তাঁর আছে। কিন্তু যাঁরা থেকে যাবেন এই মানচিত্রে তাঁরা সবাই অজানা আশঙ্কায় তাকিয়ে আছেন আগামী বছরটির দিকে। তিল তিল করে যে ভুল, ক্লেদ আর অবহেলার ধুলো আমরা জমিয়েছি, তা কি একটু একটু করে সরতে শুরু করবে এবার? আজিমপুরের যে তরুণীর স্বামীকে একটি রহস্যময় মাটিলেপা মাইক্রোবাস যুদ্ধদিনে নিয়ে গিয়েছিল বধ্যভূমিতে, সেই তরুণী দিনের পর দিন বুকে দীর্ঘশ্বাস চেপে হয়েছেন প্রৌঢ়; প্রথমবারের মতো তিনি আশায় বুক বাঁধছেন, আগামী বছর তিনি হয়তো সেই দুর্বৃত্তদের দেখবেন কাঠগড়ায়। ফরিদপুরের যে বৃদ্ধ একটি লাল কাপড়-কাচা সাবান দিয়ে গোসল করিয়েছিলেন অবিসংবাদিত নেতার গুলিবিদ্ধ লাশ, অপেক্ষায় আছেন সেই দেশনেতার চোরাগোপ্তা লুকিয়ে থাকা ঘাতকদের প্রত্যেককে তিনি আগামী বছর দেখবেন গরাদের ওপারে। পুরোনো ধুলো সরানোর সঙ্গে সঙ্গে নতুন হাওয়া জাগানোর প্রতিশ্রুতি যাঁরা দিয়েছেন, তাঁরা কি আন্তরিক থাকবেন? তাদের কি আন্তরিক থাকতে দেওয়া হবে? নাকি আবার আমরা নিক্ষিপ্ত হব দুঃস্বপ্নের ঘেরাটোপে? সবারই রুদ্ধশ্বাস জপ, তা যেন না ঘটে।
যেমন জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তেমনি আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ঝুলিতেও নিশ্চয়ই গত বছর জমা হয়েছে টুকরো কোনো অভিমান, অপমান, বেদনা। সেই ঝুলির অন্ধকার গহ্বরে সেসব ছুড়ে দিয়ে নিংড়ে আনা যাক যতটুকু অবশিষ্ট মধুরিমা। বারবার চোখের জলে মুছে যায় বলে যে নারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তিনি আর চোখে কাজল লাগাবেন না, আগামী বছর আবার তাঁর চোখে উঠুক কাজল।
বছরের শেষ দিন। সাইবেরিয়ায় প্রচণ্ড তুষারঝড় হচ্ছে। বাড়ির বাইরে শুভ্র তুষারে ঢেকে আছে চারদিক। ঘরের ভেতর কাঠের আগুন জ্বালিয়ে ওম নিচ্ছে পুরো পরিবার। নাতি বলছে, ‘দাদু, একটা গল্প বলো।’ দাদু বলেন, ‘বুঝলি ইভান, আমাদের সবার বুকের ভেতর একটা চিড়িয়াখানা আছে। কাল নতুন বছরের প্রথম সূর্য উঠলেই সেই চিড়িয়াখানায় দুটো নেকড়ে আসবে। একটা নেকড়ে ভালো, সবার মঙ্গল চায়, বিশ্বাসী; আর অন্যটি মন্দ, হিংস্র, স্বার্থপর। সারা বছর ওই দুটোতে লড়াই করবে বুকের মধ্যে। বছর শেষে জিতবে একটি।’ নাতি বলে, ‘কোনটি জিতবে, দাদু?’ দাদু উত্তর দেন, ‘যেটিকে তুই বেশি খেতে দিবি।’
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
No comments