তথ্য কমিশনকে আমরা কেমন দেখতে চাই -তথ্য অধিকার by মুহাম্মদ লুত্ফুল হক
গত ২০০৯ সালের ১ জুলাই তথ্য অধিকার আইন কার্যকর হয়েছে। একই তারিখে তিন সদস্যবিশিষ্ট তথ্য কমিশনও গঠন করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা বলে, তথ্য অধিকার আইনের সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে তথ্য কমিশনের ওপর। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম হবে না। অর্থাত্ নিরপেক্ষ, যোগ্য ও সত্ ব্যক্তিদের তথ্য কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দিলে দেশবাসী এ আইনের সুফল পাবে, নইলে এটি কাগুজে বাঘে পরিণত হবে। তথ্য কমিশনার নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাই সর্বোচ্চ সতর্কতা ও যত্নশীলতা প্রয়োজন। আর এ ক্ষেত্রেই একটি শঙ্কা লক্ষ করা যাচ্ছে। গত ২৫ জুন প্রথম আলো তাদের সম্পাদকীয়তে লিখেছে, ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ কর্তৃক ২১ ও ২২ জুন ২০০৯-এ অনুষ্ঠিত তথ্য অধিকার আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ বলেছিলেন, তথ্য কমিশন গঠনের জন্য অনুসন্ধান কমিটি হয়েছে, তথ্য কমিশন গঠনের কাজও এগিয়ে চলেছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তিন সদস্যবিশিষ্ট তথ্য কমিশন গঠিত হবে। সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন এ জন্য যে, তথ্য কমিশন গঠনের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হচ্ছে এক ধরনের গোপনীয়তার মধ্যে এবং অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে সরকারের পক্ষ থেকে হয়তো রাজনৈতিক বিবেচনায় তথ্য কমিশনের সদস্যদের নিয়োগ দেওয়া হবে, যা কোনো মহলেই বাঞ্ছিত নয়। বিদেশি প্রতিনিধিরাও জোর দিয়ে বলেছেন, তথ্য কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া হওয়া উচিত অত্যন্ত স্বচ্ছ, খোলামেলা ও অংশগ্রহণভিত্তিক। নির্বাচিত কমিশনারেরা দলীয় আনুগত্যের বিচারে না যোগ্যতার কারণে নির্বাচিত হয়েছেন, তা সময়ই বলে দেবে। তবে বাছাই-প্রক্রিয়া এবং কমিশনারদের কিছু কিছু অতীত কার্যকলাপ যোগ্যতার চেয়ে দলীয় আনুগত্যের দিকে ইঙ্গিত বেশি দেয়।
তথ্য কমিশনার; বিশেষ করে, প্রধান তথ্য কমিশনার নিয়োগ স্বচ্ছ, খোলামেলা ও অংশগ্রহণভিত্তিক হওয়ার বিষয়ে ভারতের অভিজ্ঞতা আলোচনা করা যেতে পারে। খুব শিগগির ভারতের প্রধান তথ্য কমিশনার নিযুক্ত হবেন, এর জন্য ভারতে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে প্রবীণ সমাজসেবী আন্না হাজারে, অভিনেতা আমির খান, জি গ্রুপের মালিক সুভাষচন্দ্র, ইনফোসিসের প্রধান নারায়ণ মূর্তিসহ অনেকেই তাঁদের পছন্দের যোগ্য ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের জন্য জনমত সৃষ্টি করছেন, প্রধান তথ্য কমিশনার হিসেবে নাম আসছে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা কিরণ বেদীসহ (বর্তমানে সমাজসেবী) বিখ্যাত সব ব্যক্তির। ভারতে তথ্য অধিকার নিয়ে কাজ করছেন এমন ব্যক্তি এবং সংস্থাও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, কংগ্রেসপ্রধান সোনিয়া গান্ধী প্রমুখকে চিঠি দিয়েছেন, যাতে প্রধান তথ্য কমিশনার নির্বাচনে রাজনীতিবিদ ও আমলারা হস্তক্ষেপ করতে না পারেন।
তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী, ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে তথ্য কমিশন গঠনের আইনগত সিদ্ধান্ত থাকলেও তা পাঁচ মাস বিলম্বে গঠিত হওয়ায় কমিশন তার কাজ শুরু করতেই পাঁচ মাস পিছিয়ে গেছে। তথ্য কমিশন যথাসময়ে গঠিত না হওয়ায় আইনের একটি দুর্বলতাও প্রকাশ পেয়েছে। অর্থাত্ সরকার না চাইলে বা বিপদে পড়লে ইচ্ছে করেই তথ্য কমিশনার নিয়োগ নাও করতে পারে। সে ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে, তাই আইনে শূন্যপদ পূরণে সময়ের আইনি ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকা প্রয়োজন ছিল।
বর্তমানে গঠিত তথ্য কমিশনের তিন সদস্যের দুজনই অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। অনেকে আশঙ্কা করছেন যে তথ্য অধিকার আইন কার্যকর হলে সরকারি কার্যালয়ে দায়িত্ব, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়বে। এমনকি ওই সব কার্যালয়ে প্রচলিত দুর্নীতি বাধাগ্রস্ত হবে। এর ফলে সরকারি কার্যালয়গুলো আইন বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। অথচ শুরুতেই এমন অনেক ঘটনা ঘটবে, যেখানে তথ্য কমিশনকে হস্তক্ষেপ করতে হবে। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে এ সময় তাঁরা এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখতে পারবেন কি না সন্দেহ। অন্তত একজন কমিশনার আমলাদের বাইরে গিয়ে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, সাংবাদিক, আইনবিদ, এনজিও কর্মকর্তা প্রমুখের মধ্য থেকে নিয়োগ করলে কমিশনে ভারসাম্য থাকত।
তথ্য অধিকার আইনের ধারা ১২ অনুযায়ী, তথ্য কমিশন সর্বোচ্চ তিনজন কমিশনার নিয়ে গঠিত, যা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নের জন্য ভারতের প্রতিটি রাজ্যে ১০ জন করে কমিশনার আছেন, ভারতের কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনেও আছেন ১০ জন তথ্য কমিশনার। আমাদের দেশে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ যদি তথ্য অধিকার আইনের সুফল পাওয়া শুরু করে, তবে এ আইনের প্রয়োগ বাড়বে। ফলে তথ্য কমিশনের দায়িত্বও একই ধারায় বাড়তে থাকবে। তথ্য কমিশনে যেকোনো আবেদন সাধারণভাবে ৪৫ দিন এবং সর্বোচ্চ ৭৫ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করার আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকলেও সে পরিস্থিতিতে তথ্য কমিশনারের স্বল্পতার কারণে আপিল আবেদনগুলো সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় পড়ে থাকবে। তাই তথ্য কমিশনারের সংখ্যা তিন থেকে অন্তত পাঁচজনে বাড়ানো দরকার।
গত পাঁচ মাসে তথ্য কমিশনের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, তথ্য কমিশন এখনো গুছিয়ে উঠতে পারেনি। অর্থ, জনবল, স্থান ইত্যাদির অভাবে তারা বিশেষ কোনো কার্যকর ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারেনি। তথ্য কমিশনারদের কথায় বোঝা যায়, তথ্য কমিশনকে কার্যকর করতে বেশ কিছু মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা ও উদ্যোগ প্রয়োজন, অথচ প্রাপ্ত সহযোগিতার গতি প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত মন্থর। এর পরও অবশ্য বলতে হয় যে সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও তথ্য কমিশন যেসব জরুরি ও প্রয়োজনীয় কাজ শুরু করতে পারত, তা তারা করতে পারেনি।
প্রধান তথ্য কমিশনারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, তাঁরা তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নের জন্য স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। ইতিমধ্যে বিধি তৈরি করে তথ্য কমিশন তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন, খুব শিগগির তাঁরা প্রবিধান তৈরির কাজে হাত দেবেন। বিধি ও প্রবিধান প্রস্তুত এবং সরকারের অনুমোদন না হওয়ার কারণে তথ্য অধিকার আইন প্রয়োগের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তথ্য কমিশনারেরা বর্তমানে মাঠপর্যায়ে জনসংযোগ করছেন। তথ্য অধিকার আইনের বিষয়টি সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছেছে কি না, সেটি বোঝার জন্য তাঁরা জরিপ পরিচালনারও পরিকল্পনা করছেন।
তথ্য কমিশনের প্রথম কাজ হওয়া উচিত নিজেদের ও তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বাড়ানো এবং তাদের ষাণ্মাসিক স্বল্পকালীন পরিকল্পনা প্রকাশ করা। প্রধান তথ্য কমিশনার ও অন্য কমিশনারেরা এ বিষয়ে তথ্যমাধ্যমে বক্তৃতা, বিবৃতি ও বিজ্ঞাপন প্রকাশ করতে পারেন। তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নে তথ্যমাধ্যম বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। আশা করা যায়, এ কাজেও তারা তথ্য কমিশনকে সহযোগিতা করবে। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জনসংযোগ বা জরিপ করার চেয়ে এটি বেশি ফলপ্রসূ হবে বলে মনে হয়।
তথ্য অধিকার আইনের বিভিন্ন ধারা ব্যাখ্যা করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজে তথ্য কমিশন এ বিষয়ে পুস্তিকা, লিফলেট, পোস্টার ইত্যাদি তৈরি করতে পারে এবং এ বিষয়ে এনজিওদের সহযোগিতা নিতে পারে। এ আইন প্রণয়নে তারাও বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের কাজে তারা সক্রিয়ভাবে সহযোগিতাও করছে। কিছু কিছু এনজিওর স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশিত পুস্তিকায় আবার দু-একটি বিষয় নিয়ে বিভ্রান্তিরও সৃষ্টি হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে তথ্য কমিশনকে তত্পর হতে হবে।
তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে তথ্য বা দলিল সংরক্ষণ। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। বাংলাদেশে দলিল সংরক্ষণের ব্যাপারে কিছু নির্দেশ থাকলেও প্রয়োজনীয় আইন নেই। তথ্য কমিশনকে এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। নইলে তথ্য বা দলিলের অভাবে আইনটির বাস্তবায়ন পদে পদে বিঘ্নিত হবে।
আইনটির ৭ ধারার শেষাংশে উল্লেখ করা হয়েছে, যে তথ্য প্রকাশে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, তেমন বিষয়ে আবেদন পেলে তথ্য কমিশন তা অনুমতি সাপেক্ষে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করতে পারবে। এমন বিষয়ের তালিকা অত্যন্ত দীর্ঘ। ফলে এ কাজেই কর্তৃপক্ষকে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হবে। বাস্তবতার নিরিখে এ দায়িত্বটি আপিল কর্তৃপক্ষের এখতিয়ারে রাখা যেতে পারে।
তথ্য কমিশন আইনটির ২৯ ধারার এমন একটি মৌখিক ব্যাখ্যা দিয়েছে যে তথ্য প্রদান বিষয়ে তাদের কোনো রায়ের বৈধতা নিয়ে আদালতে মামলা করা যাবে না। এ ব্যাখ্যা যে আইনটির অন্তর্নিহিত নৈতিকতা ও অভিপ্রায়ের পরিপন্থী, আইন বিশেষজ্ঞরাও সে বিষয়ে একমত।
দুর্নীতি সংক্রামক ব্যাধির মতো দেশের নানা স্তরে ভয়ংকরভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। তথ্য অধিকার আইন সে অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একটি সুযোগ আমাদের হাতের নাগালে এনে দিয়েছে। এ সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার যাতে আমরা করতে পারি, তার উদ্যোগ নাগরিক সমাজ থেকে আমাদেরই নিতে হবে।
মুহাম্মদ লুত্ফুল হক: গবেষক, লেখক।
lutful55@gmail.com
তথ্য কমিশনার; বিশেষ করে, প্রধান তথ্য কমিশনার নিয়োগ স্বচ্ছ, খোলামেলা ও অংশগ্রহণভিত্তিক হওয়ার বিষয়ে ভারতের অভিজ্ঞতা আলোচনা করা যেতে পারে। খুব শিগগির ভারতের প্রধান তথ্য কমিশনার নিযুক্ত হবেন, এর জন্য ভারতে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে প্রবীণ সমাজসেবী আন্না হাজারে, অভিনেতা আমির খান, জি গ্রুপের মালিক সুভাষচন্দ্র, ইনফোসিসের প্রধান নারায়ণ মূর্তিসহ অনেকেই তাঁদের পছন্দের যোগ্য ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের জন্য জনমত সৃষ্টি করছেন, প্রধান তথ্য কমিশনার হিসেবে নাম আসছে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা কিরণ বেদীসহ (বর্তমানে সমাজসেবী) বিখ্যাত সব ব্যক্তির। ভারতে তথ্য অধিকার নিয়ে কাজ করছেন এমন ব্যক্তি এবং সংস্থাও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, কংগ্রেসপ্রধান সোনিয়া গান্ধী প্রমুখকে চিঠি দিয়েছেন, যাতে প্রধান তথ্য কমিশনার নির্বাচনে রাজনীতিবিদ ও আমলারা হস্তক্ষেপ করতে না পারেন।
তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী, ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে তথ্য কমিশন গঠনের আইনগত সিদ্ধান্ত থাকলেও তা পাঁচ মাস বিলম্বে গঠিত হওয়ায় কমিশন তার কাজ শুরু করতেই পাঁচ মাস পিছিয়ে গেছে। তথ্য কমিশন যথাসময়ে গঠিত না হওয়ায় আইনের একটি দুর্বলতাও প্রকাশ পেয়েছে। অর্থাত্ সরকার না চাইলে বা বিপদে পড়লে ইচ্ছে করেই তথ্য কমিশনার নিয়োগ নাও করতে পারে। সে ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে, তাই আইনে শূন্যপদ পূরণে সময়ের আইনি ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকা প্রয়োজন ছিল।
বর্তমানে গঠিত তথ্য কমিশনের তিন সদস্যের দুজনই অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। অনেকে আশঙ্কা করছেন যে তথ্য অধিকার আইন কার্যকর হলে সরকারি কার্যালয়ে দায়িত্ব, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়বে। এমনকি ওই সব কার্যালয়ে প্রচলিত দুর্নীতি বাধাগ্রস্ত হবে। এর ফলে সরকারি কার্যালয়গুলো আইন বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। অথচ শুরুতেই এমন অনেক ঘটনা ঘটবে, যেখানে তথ্য কমিশনকে হস্তক্ষেপ করতে হবে। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে এ সময় তাঁরা এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখতে পারবেন কি না সন্দেহ। অন্তত একজন কমিশনার আমলাদের বাইরে গিয়ে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, সাংবাদিক, আইনবিদ, এনজিও কর্মকর্তা প্রমুখের মধ্য থেকে নিয়োগ করলে কমিশনে ভারসাম্য থাকত।
তথ্য অধিকার আইনের ধারা ১২ অনুযায়ী, তথ্য কমিশন সর্বোচ্চ তিনজন কমিশনার নিয়ে গঠিত, যা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নের জন্য ভারতের প্রতিটি রাজ্যে ১০ জন করে কমিশনার আছেন, ভারতের কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনেও আছেন ১০ জন তথ্য কমিশনার। আমাদের দেশে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ যদি তথ্য অধিকার আইনের সুফল পাওয়া শুরু করে, তবে এ আইনের প্রয়োগ বাড়বে। ফলে তথ্য কমিশনের দায়িত্বও একই ধারায় বাড়তে থাকবে। তথ্য কমিশনে যেকোনো আবেদন সাধারণভাবে ৪৫ দিন এবং সর্বোচ্চ ৭৫ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করার আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকলেও সে পরিস্থিতিতে তথ্য কমিশনারের স্বল্পতার কারণে আপিল আবেদনগুলো সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় পড়ে থাকবে। তাই তথ্য কমিশনারের সংখ্যা তিন থেকে অন্তত পাঁচজনে বাড়ানো দরকার।
গত পাঁচ মাসে তথ্য কমিশনের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, তথ্য কমিশন এখনো গুছিয়ে উঠতে পারেনি। অর্থ, জনবল, স্থান ইত্যাদির অভাবে তারা বিশেষ কোনো কার্যকর ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারেনি। তথ্য কমিশনারদের কথায় বোঝা যায়, তথ্য কমিশনকে কার্যকর করতে বেশ কিছু মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা ও উদ্যোগ প্রয়োজন, অথচ প্রাপ্ত সহযোগিতার গতি প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত মন্থর। এর পরও অবশ্য বলতে হয় যে সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও তথ্য কমিশন যেসব জরুরি ও প্রয়োজনীয় কাজ শুরু করতে পারত, তা তারা করতে পারেনি।
প্রধান তথ্য কমিশনারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, তাঁরা তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নের জন্য স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। ইতিমধ্যে বিধি তৈরি করে তথ্য কমিশন তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন, খুব শিগগির তাঁরা প্রবিধান তৈরির কাজে হাত দেবেন। বিধি ও প্রবিধান প্রস্তুত এবং সরকারের অনুমোদন না হওয়ার কারণে তথ্য অধিকার আইন প্রয়োগের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তথ্য কমিশনারেরা বর্তমানে মাঠপর্যায়ে জনসংযোগ করছেন। তথ্য অধিকার আইনের বিষয়টি সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছেছে কি না, সেটি বোঝার জন্য তাঁরা জরিপ পরিচালনারও পরিকল্পনা করছেন।
তথ্য কমিশনের প্রথম কাজ হওয়া উচিত নিজেদের ও তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বাড়ানো এবং তাদের ষাণ্মাসিক স্বল্পকালীন পরিকল্পনা প্রকাশ করা। প্রধান তথ্য কমিশনার ও অন্য কমিশনারেরা এ বিষয়ে তথ্যমাধ্যমে বক্তৃতা, বিবৃতি ও বিজ্ঞাপন প্রকাশ করতে পারেন। তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নে তথ্যমাধ্যম বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। আশা করা যায়, এ কাজেও তারা তথ্য কমিশনকে সহযোগিতা করবে। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জনসংযোগ বা জরিপ করার চেয়ে এটি বেশি ফলপ্রসূ হবে বলে মনে হয়।
তথ্য অধিকার আইনের বিভিন্ন ধারা ব্যাখ্যা করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজে তথ্য কমিশন এ বিষয়ে পুস্তিকা, লিফলেট, পোস্টার ইত্যাদি তৈরি করতে পারে এবং এ বিষয়ে এনজিওদের সহযোগিতা নিতে পারে। এ আইন প্রণয়নে তারাও বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের কাজে তারা সক্রিয়ভাবে সহযোগিতাও করছে। কিছু কিছু এনজিওর স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশিত পুস্তিকায় আবার দু-একটি বিষয় নিয়ে বিভ্রান্তিরও সৃষ্টি হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে তথ্য কমিশনকে তত্পর হতে হবে।
তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে তথ্য বা দলিল সংরক্ষণ। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। বাংলাদেশে দলিল সংরক্ষণের ব্যাপারে কিছু নির্দেশ থাকলেও প্রয়োজনীয় আইন নেই। তথ্য কমিশনকে এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। নইলে তথ্য বা দলিলের অভাবে আইনটির বাস্তবায়ন পদে পদে বিঘ্নিত হবে।
আইনটির ৭ ধারার শেষাংশে উল্লেখ করা হয়েছে, যে তথ্য প্রকাশে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, তেমন বিষয়ে আবেদন পেলে তথ্য কমিশন তা অনুমতি সাপেক্ষে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করতে পারবে। এমন বিষয়ের তালিকা অত্যন্ত দীর্ঘ। ফলে এ কাজেই কর্তৃপক্ষকে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হবে। বাস্তবতার নিরিখে এ দায়িত্বটি আপিল কর্তৃপক্ষের এখতিয়ারে রাখা যেতে পারে।
তথ্য কমিশন আইনটির ২৯ ধারার এমন একটি মৌখিক ব্যাখ্যা দিয়েছে যে তথ্য প্রদান বিষয়ে তাদের কোনো রায়ের বৈধতা নিয়ে আদালতে মামলা করা যাবে না। এ ব্যাখ্যা যে আইনটির অন্তর্নিহিত নৈতিকতা ও অভিপ্রায়ের পরিপন্থী, আইন বিশেষজ্ঞরাও সে বিষয়ে একমত।
দুর্নীতি সংক্রামক ব্যাধির মতো দেশের নানা স্তরে ভয়ংকরভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। তথ্য অধিকার আইন সে অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একটি সুযোগ আমাদের হাতের নাগালে এনে দিয়েছে। এ সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার যাতে আমরা করতে পারি, তার উদ্যোগ নাগরিক সমাজ থেকে আমাদেরই নিতে হবে।
মুহাম্মদ লুত্ফুল হক: গবেষক, লেখক।
lutful55@gmail.com
No comments