স্বদেশ বোস: ভালোবাসার মানুষ -জন্মদিন by জোবাইদা নাসরীন
স্বদেশ বোস একজন দেশপ্রেমিক অর্থনীতিবিদ। আজ তাঁর ৮২তম জন্মদিন। প্রতিবার তাঁর জন্মদিনের আয়োজনে তাঁর সান্নিধ্য স্বজনেরা উপভোগ করতেন। কিন্তু এবার তাঁর অনুপস্থিতি এক বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি করবে। এক মাস আগে পৃথিবীর সঙ্গে বন্ধন ছিন্ন করে স্বদেশ বোস চিরবিদায় নেন।
বাংলাদেশের রত্নগর্ভা অঞ্চল বরিশালে তাঁর জন্ম। এই অঞ্চল ধারণ করেছে অনেক সাহসী, বিপ্লবী ও ত্যাগী মানুষকে। ১৯২৮ সালের ২ জানুয়ারি বরিশালের কাশিনাথ গ্রামে জন্মগ্রহণ করা স্বদেশ বোস কিশোর থেকেই স্বদেশি আন্দোলনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তখন বরিশাল আন্দোলনের তপ্ত জায়গা এবং স্বদেশি আন্দোলনের ঘাঁটি ছিল।
বাঙালির ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার অনন্য এই সৈনিক ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ভাষার দাবি তোলার প্রথম দিকে বাংলা ভাষার দাবিতে ধর্মঘট পালন করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন। সেই শুরু। এরপর দফায় দফায় মামলা দিয়ে দীর্ঘ সময় তাঁকে জেলের ভেতর রাখে পাকিস্তান সরকার। তাঁর আত্মীয়স্বজন সবাই যখন ওই অবস্থায় ভারতে চলে গেল, তখন তিনি একাই পড়ে রইলেন এ দেশে। স্বপ্নের দেশে থাকার সুফল স্বদেশ বোস ভোগ করতে পারলেন না। বরং ‘কমিউনিস্ট’ পরিচয়ের কারণে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি পাওয়া সত্ত্বেও তাঁকে ভিসা দেওয়া হয়নি। দীর্ঘদিন কারাভোগ স্বদেশ বোসকে শারীরিকভাবে কাবু করেছিল, কিন্তু তাঁর প্রতিভাকে চাপিয়ে রাখতে পারেনি। যে কারণে পরবর্তী সময়ে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে এসে যোগদান করেন আগের কর্মস্থল পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকসে (পিআইডিই)। শুধু বিপ্লবী জীবনের জন্য স্বদেশ বোস আলোর পথের যাত্রী নন, তাঁর পিএইচডি গবেষণাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বহু আগেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। একদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাড়া জাগানো শিক্ষার্থী কর্মজীবনেও রেখেছেন কৃতিত্বের স্বাক্ষর; কি দেশে, কি বিদেশে। চিরকাল সযতনে নিজেকে আড়াল করা এ মানুষটি ১৯৬৬ সালের ছয় দফার সঙ্গে নিজেকে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত করেন এবং অনেকের সঙ্গে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস (পিআইডিই) থেকে দুই অঞ্চলের অর্থনৈতিক বৈষম্য তুলে ধরেন।
স্বদেশ বোস ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা সেলের একজন সদস্য ছিলেন। ছিলেন কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের সদস্য। শুধু তা-ই নয়, স্বদেশ বোস বুঝতে পেরেছিলেন, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে একটি সমস্যা হবে খাদ্য সরবরাহ নিয়ে। তাই মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে বাংলাদেশে খাদ্য সরবরাহ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেন।
ভারতে তাঁর আত্মীয়স্বজনের বড় অংশ চলে গেলেও স্বদেশ বোস কখনো এ দেশ ছেড়ে যাননি। অনেক চেষ্টা করেও তাঁর স্বজনেরা তাঁকে নিতে পারেনি ভারতে। নিজের ভাইয়ের সঙ্গে ২৫ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে দেখা হয়েছে স্বদেশ বোসের। কিন্তু দেশকে ভালোবেসে পরিবার থেকে আলাদা হয়ে থেকে যান বাংলাদেশে।
শিক্ষায়, জীবনবোধে, ভালোবাসায় প্রথাগত বর্ণাঢ্য জীবনের বাইরে সমাজ পরিবর্তনে দায়বদ্ধ জীবন বলতে যা বোঝায়, তা-ই তৈরি করেছিলেন তিনি। তরুণ প্রজন্ম তাঁর সেই তারুণ্যের, জেল-জীবনের কিংবা সাম্যবাদের স্বপ্নে বিভোর হওয়া দিনগুলো দেখেনি। প্রথা ভেঙে, সমাজ ভেঙে, জীবন সাজানোর গল্প কেবল শোনা গেছে। তাঁর সম্পর্কে যিকঞ্চিত্ বইয়ে পড়া, বিভিন্ন জার্নালে তাঁর লেখার রেফারেন্স—সবকিছু মিলিয়ে এটুকুই সম্বল। শেষ বয়সে তাঁর উপস্থিতি ছিল একেবারে নির্বাক। সদা ফিটফাট, হাতে ঘড়ি, মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো স্বদেশ বোসকে দেখে বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো, তিনি কথা বলতে পারছেন না। অথচ অন্য সবাই তাঁর সঙ্গে কথা বলতেন। তিনি হাসতেন, হাত উঁচিয়ে এটা-ওটা দেখাতেন, চোখ তুলে, চোখের ভাষায় খুশি ভাবটি প্রকাশ করতেন। শিশুদের মতো মাথা দুলিয়ে কোনো বিষয়ে তাঁর সম্মতি-অসম্মতি জানাতেন।
কিন্তু দিন দিন শরীর ভেঙে পড়ছিল। দীর্ঘদিন কারাগারে থাকার ফলে পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত হয়ে নির্বাক ছিলেন বহুদিন। প্রথমে লিখে, কম্পিউটারে মনের ভাব প্রকাশ করলেও পরবর্তী সময়ে সেটিও হয়ে পড়েছিল অসম্ভব তাঁর পক্ষে। কিন্তু দেখা হলেই রোগা কিন্তু হূদয়ের উষ্ণতামাখা হাত দুটো দিয়ে ধরে থাকতেন প্রিয়জনদের। সেই উষ্ণতার জন্য অনেকেই ছুটে হাজির হয়েছেন তাঁর বাসায়। দেখতে নয়, সঙ্গ দিতে। মানুষের সঙ্গ তিনি উপভোগ করতেন।
শেষবিদায়ের আগে স্বদেশ বোস তাঁর প্রিয় বরিশালে যেতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন বরিশালে তাঁর প্রিয়জনদের দেখতে। চল্লিশের দশকে রক্ত-সূত্রীয় প্রিয়জনদের সঙ্গে ভারতে না গিয়ে মনোরমা মাসিমা ও ঘনিষ্ঠজনদের ভালোবাসায় এ দেশে থেকে গেলেন, সেই তিনিই মৃত্যুর পরও মনোরমা বসুর ভালোবাসায়, আশ্রয়ে থাকার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। তাই তো তাঁর দেহভস্ম সমাধিস্থ হয়েছে বরিশালে মনোরমা বসুর সমাধির সঙ্গে। দেশপ্রেমিক স্বদেশ বোসের জন্মদিনে অভিবাদন।
বাংলাদেশের রত্নগর্ভা অঞ্চল বরিশালে তাঁর জন্ম। এই অঞ্চল ধারণ করেছে অনেক সাহসী, বিপ্লবী ও ত্যাগী মানুষকে। ১৯২৮ সালের ২ জানুয়ারি বরিশালের কাশিনাথ গ্রামে জন্মগ্রহণ করা স্বদেশ বোস কিশোর থেকেই স্বদেশি আন্দোলনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তখন বরিশাল আন্দোলনের তপ্ত জায়গা এবং স্বদেশি আন্দোলনের ঘাঁটি ছিল।
বাঙালির ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার অনন্য এই সৈনিক ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ভাষার দাবি তোলার প্রথম দিকে বাংলা ভাষার দাবিতে ধর্মঘট পালন করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন। সেই শুরু। এরপর দফায় দফায় মামলা দিয়ে দীর্ঘ সময় তাঁকে জেলের ভেতর রাখে পাকিস্তান সরকার। তাঁর আত্মীয়স্বজন সবাই যখন ওই অবস্থায় ভারতে চলে গেল, তখন তিনি একাই পড়ে রইলেন এ দেশে। স্বপ্নের দেশে থাকার সুফল স্বদেশ বোস ভোগ করতে পারলেন না। বরং ‘কমিউনিস্ট’ পরিচয়ের কারণে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি পাওয়া সত্ত্বেও তাঁকে ভিসা দেওয়া হয়নি। দীর্ঘদিন কারাভোগ স্বদেশ বোসকে শারীরিকভাবে কাবু করেছিল, কিন্তু তাঁর প্রতিভাকে চাপিয়ে রাখতে পারেনি। যে কারণে পরবর্তী সময়ে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে এসে যোগদান করেন আগের কর্মস্থল পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকসে (পিআইডিই)। শুধু বিপ্লবী জীবনের জন্য স্বদেশ বোস আলোর পথের যাত্রী নন, তাঁর পিএইচডি গবেষণাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বহু আগেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। একদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাড়া জাগানো শিক্ষার্থী কর্মজীবনেও রেখেছেন কৃতিত্বের স্বাক্ষর; কি দেশে, কি বিদেশে। চিরকাল সযতনে নিজেকে আড়াল করা এ মানুষটি ১৯৬৬ সালের ছয় দফার সঙ্গে নিজেকে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত করেন এবং অনেকের সঙ্গে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস (পিআইডিই) থেকে দুই অঞ্চলের অর্থনৈতিক বৈষম্য তুলে ধরেন।
স্বদেশ বোস ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা সেলের একজন সদস্য ছিলেন। ছিলেন কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের সদস্য। শুধু তা-ই নয়, স্বদেশ বোস বুঝতে পেরেছিলেন, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে একটি সমস্যা হবে খাদ্য সরবরাহ নিয়ে। তাই মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে বাংলাদেশে খাদ্য সরবরাহ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেন।
ভারতে তাঁর আত্মীয়স্বজনের বড় অংশ চলে গেলেও স্বদেশ বোস কখনো এ দেশ ছেড়ে যাননি। অনেক চেষ্টা করেও তাঁর স্বজনেরা তাঁকে নিতে পারেনি ভারতে। নিজের ভাইয়ের সঙ্গে ২৫ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে দেখা হয়েছে স্বদেশ বোসের। কিন্তু দেশকে ভালোবেসে পরিবার থেকে আলাদা হয়ে থেকে যান বাংলাদেশে।
শিক্ষায়, জীবনবোধে, ভালোবাসায় প্রথাগত বর্ণাঢ্য জীবনের বাইরে সমাজ পরিবর্তনে দায়বদ্ধ জীবন বলতে যা বোঝায়, তা-ই তৈরি করেছিলেন তিনি। তরুণ প্রজন্ম তাঁর সেই তারুণ্যের, জেল-জীবনের কিংবা সাম্যবাদের স্বপ্নে বিভোর হওয়া দিনগুলো দেখেনি। প্রথা ভেঙে, সমাজ ভেঙে, জীবন সাজানোর গল্প কেবল শোনা গেছে। তাঁর সম্পর্কে যিকঞ্চিত্ বইয়ে পড়া, বিভিন্ন জার্নালে তাঁর লেখার রেফারেন্স—সবকিছু মিলিয়ে এটুকুই সম্বল। শেষ বয়সে তাঁর উপস্থিতি ছিল একেবারে নির্বাক। সদা ফিটফাট, হাতে ঘড়ি, মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো স্বদেশ বোসকে দেখে বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো, তিনি কথা বলতে পারছেন না। অথচ অন্য সবাই তাঁর সঙ্গে কথা বলতেন। তিনি হাসতেন, হাত উঁচিয়ে এটা-ওটা দেখাতেন, চোখ তুলে, চোখের ভাষায় খুশি ভাবটি প্রকাশ করতেন। শিশুদের মতো মাথা দুলিয়ে কোনো বিষয়ে তাঁর সম্মতি-অসম্মতি জানাতেন।
কিন্তু দিন দিন শরীর ভেঙে পড়ছিল। দীর্ঘদিন কারাগারে থাকার ফলে পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত হয়ে নির্বাক ছিলেন বহুদিন। প্রথমে লিখে, কম্পিউটারে মনের ভাব প্রকাশ করলেও পরবর্তী সময়ে সেটিও হয়ে পড়েছিল অসম্ভব তাঁর পক্ষে। কিন্তু দেখা হলেই রোগা কিন্তু হূদয়ের উষ্ণতামাখা হাত দুটো দিয়ে ধরে থাকতেন প্রিয়জনদের। সেই উষ্ণতার জন্য অনেকেই ছুটে হাজির হয়েছেন তাঁর বাসায়। দেখতে নয়, সঙ্গ দিতে। মানুষের সঙ্গ তিনি উপভোগ করতেন।
শেষবিদায়ের আগে স্বদেশ বোস তাঁর প্রিয় বরিশালে যেতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন বরিশালে তাঁর প্রিয়জনদের দেখতে। চল্লিশের দশকে রক্ত-সূত্রীয় প্রিয়জনদের সঙ্গে ভারতে না গিয়ে মনোরমা মাসিমা ও ঘনিষ্ঠজনদের ভালোবাসায় এ দেশে থেকে গেলেন, সেই তিনিই মৃত্যুর পরও মনোরমা বসুর ভালোবাসায়, আশ্রয়ে থাকার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। তাই তো তাঁর দেহভস্ম সমাধিস্থ হয়েছে বরিশালে মনোরমা বসুর সমাধির সঙ্গে। দেশপ্রেমিক স্বদেশ বোসের জন্মদিনে অভিবাদন।
No comments