ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্ত: চোরাচালানিদের স্বর্গরাজ্য by জাবেদ রহিম বিজন
আখাউড়া রেলজংশনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী একটি মালবাহী ট্রেনে গত ১৭ই ফেব্রুয়ারি রাতে অভিযান চালায় জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি রেইডিং টিম। ৬০১ নম্বর ট্রেনটির ৯৪০২৯ এবং ৯৪০৩২ নম্বর ওয়াগন (বগি) ঘিরে চলে অভিযান। এরমধ্যে ইঞ্জিনের ঠিক পেছনের ৯৪০২৯ নম্বর ওয়াগন তল্লাশি করে ওয়াগনের নিচে লোহার অ্যাঙ্গেলের সঙ্গে আটকানো ২টি সিনথেটিক বস্তার ভেতর থেকে ১ কেজির পলিথিন প্যাকেটে থাকা মোট ৩৯ কেজি গাঁজা উদ্ধার করা হয়।
জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম জানান, কসবার সালদা নদী ও মন্দভাগ স্টেশনের মাঝামাঝি প্রায়ই মালবাহী ট্রেন থামিয়ে গাঁজা ও অন্যান্য মাদকদ্রব্য উঠানো হয় বলে খবর পাচ্ছিলাম আমরা। এই অভিযানটির আগে আরও ৪ বার মালবাহী ট্রেনে করে মাদক পাচার হওয়ার তথ্য আসে আমাদের কাছে। এই খবরের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয়।
অভিযান সংশ্লিষ্টরা জানান, অভিযানে ট্রেনের চালক, গার্ড, স্টেশন মাস্টার এবং রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর কারও সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। ট্রেনটি জংশনে পৌঁছার পরই চালকরা গাড়ি থেকে নেমে রেস্ট রুমে চলে যান। তাদের অনেক ডাকাডাকি করে সেখানে আনা যায়নি। স্টেশন মাস্টারকে ডাকার ৩ ঘণ্টা পর সেখানে আসেন। তিনি বলেন, ওরাতো (চালক) ট্রেন হস্তান্তর করে চলে গেছে। ওরা কেন আসবে। আপনারা তাদের কাছে যান। মাদক পেয়ে থাকলে ট্রেন জব্দ করে নিয়ে যেতে বলেন স্টেশন মাস্টার।
ট্রেনটির গার্ড মো. ফরিদ উদ্দিন (৬৮) অভিযানের সময় উপস্থিত থাকলেও এসব মাদকদ্রব্য কোত্থেকে উঠানো হয়েছে, কারা উঠিয়েছে- এব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে পারেননি। ট্রেনটি আখাউড়ায় আসার আগে হাওয়া চলে যাওয়ার কারণে কোথাও কয়েক মিনিট দাঁড়িয়েছিল বলে জানানো হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, গাঁজার প্যাকেট যেভাবে ট্রেনের বগির নিচে রাখা ছিল সেগুলো উদ্ধার করতে তাদের কয়েক ঘণ্টা সময় লেগেছে। কয়েক মিনিট ট্রেন থামার সুযোগে এসব মাদকদ্রব্য এভাবে লোড করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। দীর্ঘ সময় ট্রেন দাঁড় করিয়ে রেখেই মাদকদ্রব্যগুলো উঠানো হয় বলে আমাদের ধারণা।
এ ঘটনায় জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক নজরুল ইসলাম গত ১৮ই ফেব্রুয়ারি আখাউড়া রেলওয়ে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। এরপর গত ১০ই মার্চ জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় এনিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠক সূত্র জানায়, জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম সভায় বিষয়টি উত্থাপন করলে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দিদারুল আলম বলেন, রেলপথ মন্ত্রণালয়কে জানানো হবে যে তাদের দু’জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারা মাদক পরিবহনের সঙ্গে জড়িত। তাদেরকে আমরা ছেড়ে দিতে পারি না। পরবর্তীতে এমন হলে রেগুলার মামলা না হলে মোবাইল কোর্ট করতে হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালত করে স্পটে সাজা দিতে হবে।
জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ট্রেনটির ২ জন চালকের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করেছেন। তারা হচ্ছেন মো. আবু তালহা (৪১) ও মুহাম্মদ গোলাম শাহরিয়ার (৪৫)। জিডিতে লোকো মাস্টার মো. আবু তালহা ও গার্ড মো. ফরিদ উদ্দিনকে সাক্ষী করা হয়েছে। এদিকে গত কয়েক মাস ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সীমান্তবর্তী ৩ উপজেলায় চোরাচালানিরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তথ্য মিলেছে শুধু কসবার কাইয়ুমপুর ইউনিয়নের চকবস্তা, কালতা, দিঘীরপাড়, চাটুয়াখলা ও রাউৎখলা সীমান্তপথে প্রতি রাতে দেড়শ’ থেকে আড়াশ’ কেজি গাঁজা আসছে। এ ছাড়াও মদ-বিয়ার, ইয়াবা, ফেনসিডিলের পাশাপাশি শাড়ি, থ্রি-পিস, কসমেটিকস, মোবাইল ডিসপ্লে, চিনিসহ অন্যান্য মালামালও নামছে জেলার সীমান্ত এলাকার নানা পথে। তবে সবচেয়ে বেশি আসছে গাঁজা। সড়কপথে বিভিন্ন গাড়িতে এবং মালবাহী ট্রেনে করে মাদকসহ অন্যান্য চোরাচালানি পণ্য ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে পরিবহন করা হচ্ছে। কাইয়ুমপুরের চকবস্তা সীমান্ত পথে দিনদুপরে চোরাচালানি পণ্য নামানো হচ্ছে। এখানে আলোচিত এক চোরাচালানি। তার ১২৪ জন শ্রমিক চোরাচালানি পণ্য নামানোর কাজে নিয়োজিত বলে তথ্য পাওয়া গেছে। অভিযোগ বিভিন্ন সংস্থাকে ম্যানেজ করেই চলছে রমরমা এ চোরাচালান বাণিজ্য। লাইন ক্লিয়ার রাখতে চোরাচালানিদের বাজেট কয়েক কোটি টাকা। যা যাচ্ছে বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের পকেটে।
No comments