ঢাকার শহর আইসা আমার আশা পুরাইছে by ফরিদুর রেজা সাগর
তখন নাচের শিল্পীদের রিহার্সেল হতো টেলিভিশনের দোতলায়। কোনার দিকে একটি রিহার্সেল রুম ছিল সেখানে। নাচের শিল্পীদের রিহার্সেল মানেই শিল্পী মোস্তফা মনোয়ারের উপস্থিতি। মোস্তফা মনোয়ারকে অনেক অনুষ্ঠানে দেখা যেতো বিশেষ করে নাটক, বিশেষ গানের অনুষ্ঠানে, ছোটদের অনুষ্ঠানে তো বটেই। আমরা দেখেছি মোস্তফা মনোয়ার নিজে থেকে এসে বিভিন্ন রকম পরামর্শ দিতেন। নাচের রিহার্সেল চলতো দীর্ঘসময় ধরে। মোস্তফা মনোয়ার আটকে যেতেন। বিশেষ করে ছোটদের অনুষ্ঠানের সময়। ছোটদের অনুষ্ঠানের সঙ্গে আমিও জড়িত ছিলাম, ফলে অনুষ্ঠানের ব্যাপারে কথা বলার জন্য অনেক সময় ধরে অপেক্ষা করতে হতো। তারপর এক সময় অপেক্ষা করতে করতে রিহার্সেল রুমে ঢুকে যেতাম। সবার দিকে তাকিয়ে বলতামÑ স্যার, একটু সময় লাগবে, এই এক মিনিট পরামর্শ ছিল। সবাই কেমন তাকিয়ে থাকতো। মাঝে মাঝে আমিই এই কাণ্ডটা করতাম। আমার সঙ্গে কখনো কখনো কাজী কাইয়ুমও রিহার্সেল রুমে চলে যেতেন।
একদিন অঞ্জনা সুলতানা বললেন, সাগর তোমার সব কাজই কি আমাদের এই নাচের রিহার্সেলের সময় পড়ে?
আমি বললাম, ঠিক তা নয়, আপনারা তো দীর্ঘ সময় ধরে রিহার্সেল করেন, আমরা আমাদের অনুষ্ঠানের জন্য একটু কথা বলা বা পরামর্শের জন্য আটকে যাই। তিনি বললেন, তোমাকে এমনিতেই বললাম, আমরা তো অনুষ্ঠানের জন্য মন্টু মামার (মোস্তফা মনোয়ার) পরামর্শ নিই। সুতরাং কি আর করার আছে তোমাদের লাগলে চলে আসবে। আমাদের রিহার্সেল যতক্ষণ করার ততক্ষণই করবো।
একজন শিল্পীর এই কথা আমরা রিহার্সেল অনেকক্ষণ ধরেই করবো। এটা আজকাল হারিয়ে গেছে। অনুষ্ঠান করা মানেই শো-এর আয়োজন করো, স্টেজে দেখিয়ে দেবো। কিন্তু অঞ্জনার মতো শিল্পীরা ভালো কিছু করার জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন। রিহার্সেল করেছেন দীর্ঘক্ষণ ধরে। ভালো কিছু দর্শকদের উপহার দেয়ার জন্য অঞ্জনাদের চেষ্টা অব্যাহত থেকেছে। সেই সময় নাচের বিভিন্ন দল দেশের বাইরে অনুষ্ঠানে যেতো। সেই সমস্ত দলে অঞ্জনা ছিলেন নিয়মিত শিল্পী। ফিরে এসে তিনি প্রচুর ছোট ছোট উপহার দিতেন আমাদের। যে দেশে যেতেন সে দেশের গল্প শোনাতেন। তার এই গল্প বলার অভ্যাস যখন যেখানে যে অনুষ্ঠান হয়েছে অঞ্জনাকে দেখেছিÑ এফডিসিতে বা চ্যানেল আইয়ের যেকোনো অনুষ্ঠানে বেশ আগেই চলে আসতেন তিনি। বিশেষ করে চ্যানেল আইয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে আমি বলতে পারি- তিনি এসেই গল্প করতেন, নানা রকম পরামর্শ দিতেন। যেতেনও বেশ দেরি করে। অর্থাৎ শিল্পের সঙ্গে শিল্পীদের সম্পৃক্ত থাকতে তিনি পছন্দ করতেন।
তখন তিনি সিনেমায় নাম লিখিয়েছেন। তার অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র ‘সেতু’ হলেও প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘দস্যু বনহুর’। ‘দস্যু বনহুর’ সিরিজ তখন তুমুল জনপ্রিয়। ১৯৭৬ সালে শামসুদ্দিন টগর পরিচালিত ‘দস্যু বনহুর’ সিনেমায় তিনি নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন, তার বিপরীতে ছিলেন নায়ক সোহেল রানা। তিনি যখন টেলিভিশনে আসতেন আমরা অবাক বিস্ময়ে তাকে দেখতাম নায়িকা হিসেবে। তখন তাকে নায়িকা আপা বলে ডাকতাম।
তিনি বলতেন, আমি নৃত্যশিল্পী হিসেবেই সব সময় পরিচিত থাকতে চাই।
তারপরও ঘটনাযজ্ঞে তিনি খ্যাতিমান নায়িকা হয়েছেন। প্রায় শতাধিক বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। এর বাইরে যৌথ প্রযোজনার সবচেয়ে বেশি চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। ৬০টি দেশের সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছেন নায়িকা হিসেবে। যার সাফল্যের এত বড় একটি তালিকা রয়েছে। সাফল্যের মুকুট হিসেবে তিনি তিনবার নৃত্যশিল্পী হিসেবে এবং দুইবার অভিনয়শিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। তালিকাটা এত দীর্ঘ তবুও তাকে দীর্ঘ সময় অসহায়ের মতো থাকতে হয়েছে। হাসপাতালে যে ক’দিন ছিলেন, শিল্পীরা কেউ কেউ তাকে দেখতে গিয়েছেন। তারপরও হাসপাতালের জীবন তো সুখকর নয়। নানান হিসাব-নিকাশ করতে হয়। অঞ্জনার বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। শুনেছি প্রথম তিনি যে হাসপাতালে ছিলেন সেই হাসপাতালের বিল দিতে হয়েছে তার সমস্ত গয়না বিক্রি করে। অঞ্জনা বেশ কয়েকটি টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেছিলেন। প্রথম যে নাটকটিতে তিনি অভিনয় করেছিলেন, সেই নাটকটি ছিল আমার লেখা। কাজী কাইয়ুম ছিলেন সেই নাটকের প্রযোজক। তখন তিনি নায়িকা হয়ে গেছেন। আমরা চিন্তা করলাম অঞ্জনা সুলতানাকে দিয়ে অভিনয় করানোর। এই নাটকে তাকে ভালো মানাবে। গল্পটা হলো- একটি পাহাড়ি এলাকায় কয়েকজন পর্যটক আটকে গেছে, তারপর তারা সেখান থেকে কিভাবে উদ্ধার পেলেন, সেই গল্পের নায়ক ছিলেন বুলবুল আহমেদ। প্রযোজক কাজী কাইয়ুম। কাজী কাইয়ুমের সঙ্গে ছিলেন শেখ রিয়াজউদ্দিন বাদশা। রিয়াজউদ্দিন বাদশা, অঞ্জনা সুলতানাকে রাজি করিয়েছিলেন। অঞ্জনা সুলতানা সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন এবং খুব সুন্দর অভিনয় করেছিলেন তিনি। তারপর তিনি আরও বেশ কয়েকটা নাটকে অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু আমার গর্ব তিনি আমার লেখা নাটকে প্রথম অভিনয় করেছিলেন। তারচেয়ে বড় অহংকার এই নায়িকার ‘ঢাকার শহর আইসা আমার আশা পুরাইছে’ গানে অথবা ‘দস্যু বনহুর’ সিনেমায় অভিনয় দেখে আমরা মুগ্ধ হয়েছি। তিনি পরবর্তী জীবনে আমাদের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তিনি চ্যানেল আইয়ের সঙ্গে ছিলেন। অঞ্জনা’র সবচেয়ে কাছের বন্ধু প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন এসেছেন চ্যানেল আইতে। সাবিনা ইয়াসমিন এবং অঞ্জনা ছিলেন হরিহর আত্মা। সাবিনা ইয়াসমিন তার প্রিয় বন্ধুটিকে দেখতে এসেছেন। অঞ্জনাও এসেছেন কিন্তু তিনি নিথর, স্থির দেহ তার। তার সেই প্রিয় বন্ধুটিকে দেখে বুকে জড়িয়ে নিতে পারছেন না। চোখ বুজে আছে লাশবাহী গাড়িতে। সাবিনার চোখ ছলছল। অঞ্জনা কোনো কথা বলছেন না। কোনো সাড়া নেই নীরবে শুয়ে আছেন।
তার মতো শিল্পীবান্ধব মানুষ আমাদের চলচ্চিত্র বা টেলিভিশন জগতে খুব কম শিল্পীই ছিলেন। অঞ্জনা আপনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
No comments