মাহিয়ানের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় পরিবার by সুদীপ অধিকারী

মাহিয়ান ইবনে সরোয়ার (১৮)। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন বড় ইঞ্জিনিয়ার হবেন। পড়ালেখাতেও অন্যদের থেকে ছিলেন বেশ এগিয়ে। মাধ্যমিকের পর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাতেও আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল থেকে গোল্ডেন-এ প্লাস পেয়েছেন। তবে গত জুলাই-আগস্টে দেশব্যাপী চলা আন্দোলনে যোগ দিয়ে গত ৪ঠা আগস্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি গুলি কেড়ে নিয়েছে তার সব স্বপ্ন। হাত এফোঁড়-ওফোঁড় করে পিঠে লাগা পুলিশের গুলিতে শিরা ছিঁড়ে অবস হয়ে গেছে মাহিয়ানের ডান হাত। নিজে হাতে ভাত খাওয়া তো দূরের কথা কলমও ধরতে পারছেন না। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হলে তারা বিদেশে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে বাবার বেসরকারি চাকরির সামান্য বেতনের টাকা দিয়ে ছেলের উন্নত চিকিৎসা ও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় দিন পার করছে মাহিয়ানের পরিবার।

সেদিনের স্মৃতি টেনে ১৮ বছরের এই যুবক মাহিয়ান মানবজমিনকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রথম থেকেই যুক্ত ছিলাম। বাসার কাছে হওয়ায় বেশির ভাগ সময় মিরপুর-১০ নম্বর, ২ নম্বর, ১২ নম্বর, ১৪ নম্বর, ইসিবি চত্বর এলাকার আন্দোলনে যোগ দিতাম। পুরো আন্দোলনে তেমন কিছু না হলেও সরকার পতনের ঠিক আগের দিন সন্ধ্যায় মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকায় আমার ডান হাতের কনুইয়ের নিচে গুলি লাগে। তিনি বলেন, আমরা সেদিন ১৪ নম্বরের দিক থেকে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরের দিকে যাচ্ছিলাম। বিআরটিএ অফিসটা পার করে সামনের দিকে এগুতেই সামনের দিক থেকে পুলিশ গুলি শুরু করে। পুলিশের গুলির মুখেই আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও আমাদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলছিল। এরইমধ্যে কোথা থেকে হঠাৎ আমার ডান হাতে এসে একটা গুলি লাগে। গুলিটি আমার ডান হাতের কনুইয়ের নিচের একপাশ দিয়ে ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে বের হয়ে পিঠে গিয়ে লাগে। আমি সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় পড়ে যাই। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। আমার সঙ্গীরা আমাকে উদ্ধার করে পার্শ্ববর্তী আলোক হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরিস্থিতি এমন ছিল যে- হাসপাতালে যেতেও ভয় লাগছিলো। যদি পুলিশ অ্যারেস্ট করে? তাই সেদিন আলোক থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাসায় চলে যাই। পুলিশের ভয়ে সেদিন গুলি লাগার পরও কাছের কোনো আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবকে জানাতে পারিনি। সারা রাত পরিবারের সকলে এক ফোটা ঘুমাইনি। পরদিন যখন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়- তখন বুকে কিছুটা বল পাই। বাবা সরোয়ার হোসেন আগে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) কাজ করায় তার রেফারেন্স দিয়ে ৭ই আগস্ট সেখানে ভর্তি হই। সেখান থেকে জানা যায়, গুলি আমার ডান হাতের একপাশ দিয়ে ঢুকে অন্যপাশ দিয়ে বের হয়ে পিঠে লাগলেও শরীরের ভেতরে প্রবেশ করেনি। তবে আমার ডান হাতের দুইটা নার্ভ ছিঁড়ে গেছে। আমি আগের মতো আর হাত দিয়ে কাজ করতে পারবো না। ৭ই আগস্ট থেকে ১৩ দিনের চিকিৎসা শেষে ১৯শে আগস্ট আমাকে সিএমএইচ থেকে রিলিজ দেয়া হয়। আমি বাড়ি ফিরে এলেও এখনো ডান হাত দিয়ে কিছু করতে পারি না। খাবারটা পর্যন্ত বাবা-মা খাইয়ে দেয়। পুরো হাতটা বাঁকা হয়ে রয়েছে। ছাড়পত্র দেয়ার পরও বেশ কয়েকবার সিএমএইচে ও স্কয়ার হাসপাতালে দেখিয়েছি। সিএমএইচ’র চিকিৎসকরা বলেছেন- দুইটা নার্ভের একটি রিপিয়ার করা হয়েছে। ফিজিওথেরাপি করলে হাতের কিছুটা উন্নতি হবে। তবে সময় লাগবে।

এদিকে মাহিয়ানের বাবা সাবেক সেনা সদস্য সরোয়ার হোসেন বলেন, আমার দুই ছেলে। মাহিয়ান বড়। আর নাহিয়ান ইবনে সরোয়ার ছোট। মাহিয়ান আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল থেকে এবার এইচএসসি পাস করেছে আর নাহিয়ান মাদ্রাসার ছাত্র। আমরা ইসিবি চত্বরের কাছে মানিকদি থাকি। সবকিছু ঠিকই চলছিল। সেদিনের একটা গুলি আমার পুরো পরিবারকে এলোমেলো করে দিয়েছে। তিনি বলেন, মাহিয়ানের ছোট বেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল ও বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবে। পড়ালেখাতেও অনেক ভালো। ডাবল এ প্লাস। কিন্তু এখন সে ডান হাতে কলমটাও ধরতে পারে না। ওকে রেটিনায় কোচিং করিয়েছি। কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি) ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে। কিন্তু পাস করবে কী করে ওতো কিছুই লিখতে পারেনি। ডান হাতে বল পায় না। হাতটা বাঁকা হয়ে থাকে। বাবা হয়ে ছেলের এই অবস্থা আমি দেখতে পারি না। তিনি বলেন, আন্দোলনের সময় আমাদের সকলকে লুকিয়ে বেড়াতে হতো। এই একজন এসে বলতো- আপনার ছেলের নামে লিস্ট হয়েছে। ওকে পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে। কতো সব কথা। কিসের মধ্য দিয়ে যে আমরা দিন পার করেছি তা শুধু আমরাই জানি। জুলাই অভ্যুত্থানের এই যোদ্ধার বাবা বলেন, সিএমএইচ-এ চিকিৎসার পরে সেখান থেকে বলা হয়- মাহিয়ানের ডান হাতের দুটি নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একটি নার্ভের কাজ আমরা করিয়েছি। এরপর আমি মাহিয়ানকে স্কয়ার হাসপাতালের একজন চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যায়। সেখান থেকে বলা হয়- গুলি লাগার পর ওর হাতের ভাঙা হাড়ের অংশ বিশেষ ভেতরে আটকে আছে। তাই ও হাত সোজা করতে পারছে না। একইসঙ্গে ডান হাতের নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাহিয়ানের হাতে এখনো সার্জারি প্রয়োজন। দেশের বাইরে নিয়ে গেলে এই অস্ত্রোপচার আরও ভালো হবে। তাই ওই চিকিৎসক ছাড়পত্রে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে দিয়েছে। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত মাহিয়ানের চিকিৎসা বাবদ দেড় লাখের বেশি টাকা খরচ হয়ে গেলেও কোনো সরকারি সহায়তা পাইনি। এর ওপর সংসারের খরচ রয়েছেই। তাই আমার ছাপোষা চাকরির বেতনে ওকে বিদেশে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো সম্ভব হচ্ছে না। আমি এই বিষয়ে জুলাই ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। সেখান থেকে আরেকজনের নম্বর দেয়া হয়। সেই নম্বরে অনেকবার যোগাযোগের পরও কাজ না হওয়ায় ওদের হটলাইন নম্বরে কল করি। সেখান থেকে আমাকে বলা হয়- মাহিয়ানের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হলে বা বিদেশ নিতে হলে পঙ্গু হাসপাতাল বা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) ছাড়পত্রে চিকিৎসকদের মন্তব্য উল্লেখ থাকতে হবে। তা না হলে আমরা কিছু করতে পারবো না। তিনি বলেন, আজ আমার সামর্থ্য থাকলে আমি কাউকেই আমার ছেলের বিষয়ে বলতাম না। কিন্তু আমার নিজেরই অবস্থা ভালো না। আমার এই ছেলে ভবিষ্যতে কী করবে? কী করে ওর পুরো জীবন পার করবে এসব ভেবে রাতে ঘুম আসে না। তাই পরিবারের পক্ষ থেকে আমাদের একটাই দাবি- আমার ছেলেকে সরকার বা জুলাই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বিদেশে নিয়ে যেন উন্নত চিকিৎসা করানো হয়। ওর ভবিষ্যৎ যেন ও নিজেই গড়তে পারে। ও যেন কারোর ওপর বোঝা না হয়।

এসব বিষয়ে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের মিডিয়া অ্যান্ড পিআর এক্সিকিউটিভ জাহিদ হোসেন মানবজমিনকে বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে আমাদের অনেক ভাই আহত হয়েছেন। আমরা আমাদের সেই আহত যোদ্ধাদের জন্য দিনে রাতে কাজ করে চলেছি। তবে আহত যোদ্ধাদের বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার বিষয়ে কিছু পদক্ষেপের মধ্যদিয়ে আমাদের এগুতে হয়। যেমন আহত ব্যক্তির ক্ষেত্রে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে একটি ফরম নিয়ে তা পূরণ করে যে হাসপাতালের চিকিৎসা নিয়েছেন সেই চিকিৎসক কর্তৃক সত্যায়িত করতে হবে। যেখানে ওই চিকিৎসকের স্বাক্ষর এবং সিলমোহর থাকবে। এ ছাড়া যেই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন সেই হাসপাতালে ভর্তির ফরম কিংবা ছাড়পত্র প্রয়োজন হবে সেখানেও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক সত্যায়িত করবে। এর সঙ্গে যেই হাসপাতাল থেকে আহত যোদ্ধা চিকিৎসা নিয়েছেন সেই হাসপাতালে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের মেডিকেল টিমের দিয়ে কাগজ ভেরিফাই করাতে হবে। এসব প্রসেসিং শেষে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাই মাহিয়ানের পরিবারের সদস্যদের ফর্ম নিয়ে আগে সিএমএইচ হাসপাতালের চিকিৎসক ও মেডিকেল টিমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। তারা যদি সব ভেরিফাই করে দেয় তাহলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারবো।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.