চীনের পাখির চোখ 'গণতন্ত্র' by অ্যাডাম নেলসন ও মে বুটয়

২০২৪ সালের এপ্রিলে ফিলিপাইনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে-এর একজন মুখপাত্র পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, ফিলিপাইন এবং চীন ২০১৬ থেকে  ২০২২ এর মধ্যে গোপনে একটি চুক্তি করেছে। যেখানে বলা ছিল চীন পশ্চিম ফিলিপাইন সাগরে স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করবে না এবং ফিলিপাইন আয়ুঙ্গিন শোলে তার কর্মীদের জন্য শুধুমাত্র মৌলিক সরবরাহ পাঠাবে। কিন্তু এখন ফিলিপাইন এই অঞ্চলে চীনের কৌশলগত উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে প্রতিহত করার জন্য একটি অপরিহার্য খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়রের প্রশাসন নৌ-সংঘাত এবং নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ফিলিপাইনের সামুদ্রিক দাবির ওপর জোর দিচ্ছে। এটি এমন একটি সময়ে ঘটছে যখন দেশটি নীরবে গুরুতর, হুমকির মুখোমুখি। ফিলিপাইনের একজন প্রাক্তন মেয়র অ্যালিস গুও যিনি দুর্নীতি, মানি লন্ডারিং এবং গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত- প্রমাণ করে যে কীভাবে দেশীয় দুর্নীতি ফিলিপাইনকে চীনা অনুপ্রবেশ এবং অপসারণের ঝুঁকিতে ফেলেছে। ফিলিপাইন কীভাবে এই চ্যালেঞ্জ নেভিগেট করে তা কেবল তার ভবিষ্যতই নয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তর স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হবে।

আশেপাশের সমুদ্রে আক্রমণাত্মক সামরিক কৌশল পরিচালনার পাশাপাশি, চীন ফিলিপাইনের নেতাদের (সরকারের সব স্তরে) আরও চীন-বান্ধব অবস্থানে ফেলতে কৌশলগত বিনিয়োগ করছে।  চীনের এই কৌশল অন্যান্য দেশের অভিজাত, গোপন ব্যবসায়িক জোট এবং অর্থনৈতিক প্রণোদনাকে লক্ষ্য করে বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রভাব তৈরির বৈশ্বিক কৌশলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ফিলিপাইন ২০২৫ এবং ২০২৮ সালের সমালোচনামূলক নির্বাচনের কাছাকাছি আসার সাথে সাথে, চীন তার বন্ধুত্বর হাত বাড়ানোর চেষ্টা করবে। এই প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে, অনেকেই মনে করছেন ভবিষ্যত ফিলিপাইন সরকার চীনের নিজস্ব শাসন, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ এবং গণ নজরদারির মডেল গ্রহণ করতে পারে। এই ধরনের সরকার ভিন্নমত প্রশমনের জন্য চীনের কর্তৃত্ববাদী শাসকের পরামর্শে চলার পাশাপাশি জবাবদিহিতা এড়াতে চীনের সম্পদ এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সমর্থন লাভ করতে পারেন।

ফিলিপাইনের জনগণের সেবা করার জন্য গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলি বিরোধী এবং সমালোচকদের গতিবিধি সীমিত করার  হাতিয়ার হয়ে উঠবে এবং চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নিজের  অবস্থান সুরক্ষিত করতে সক্ষম হবে। ফিলিপাইনকে আমেরিকা-বিরোধী আখ্যান প্রচার এবং চীন-পন্থী মনোভাব গড়ে তোলার জন্য পরিকল্পিত কৌশলের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করে চীন বিশ্বব্যাপী তার  তথ্য প্রচারের কার্যক্রম জোরদার করছে। ফেসবুক এবং টিকটকের এর মতো প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে, (যেগুলির ওপর  অনেক ফিলিপিনো খবরের জন্য নির্ভর করে) চীনা অ্যাকাউন্টগুলি এমন বিষয়বস্তুকে ছড়িয়ে দিচ্ছে  যা ফিলিপাইন-মার্কিন সম্পর্কের উপর সন্দেহের জায়গা তৈরী করছে  এবং ফিলিপাইন সমাজের মধ্যে সামাজিক আস্থা নষ্ট করছে।

অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতাকে কাজে লাগিয়ে, চীনের  লক্ষ্য হল পার্শ্ববর্তী সমুদ্রে  নিজস্ব আগ্রাসন সম্পর্কে ফিলিপাইন কর্তৃপক্ষকে বিভ্রান্ত করা। অস্থিতিশীলতা তৈরি করে মুসলিম মিন্দানাও (বারম) এর বাংসামোরো স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলকে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। । সেখানে একটি চলমান শান্তি প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়লে, এই অঞ্চলটি অবশ্যম্ভাবীভাবে জাতীয় সরকারের মনোযোগ এবং সম্পদের অনেক বেশি দাবি করবে।

এক্ষেত্রে কী করা যায়? মার্কিন বিনিয়োগ ফিলিপাইনে চীনের অবকাঠামো প্রকল্পের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলেও পশ্চিমের কৌশলগত সহায়তা চীনের ঋণ-চালিত মডেলের একটি স্পষ্ট বিকল্প হতে পারে। এই ধরনের কৌশল শুধুমাত্র ফিলিপাইনের সার্বভৌমত্বকে সমর্থন করবে না বরং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আমেরিকার জোটের নেটওয়ার্ককেও শক্তিশালী করবে। বিশেষ করে, চীনা হস্তক্ষেপ মোকাবেলা করার জন্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের উচিত পাঁচটি   অগ্রাধিকারকে মাথায় রেখে বিনিয়োগ ও সহায়তার নির্দেশনা দেওয়া।

প্রথমত, যেহেতু দুর্নীতি ফিলিপাইনের জন্য একটি জাতীয় নিরাপত্তা হুমকি, তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের উচিত ‘সুবিধাপূর্ণ মালিকানা’ (যারা ব্যক্তিগত ব্যবসার মালিক), ঋণের স্বচ্ছতা ও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট এবং টেন্ডারিং প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে প্রোগ্রামগুলিতে অর্থায়ন করা। এটি শুধুমাত্র সমস্ত ব্যবসার ক্ষেত্রেই সুবিধা দেবে না বরং এটি ফিলিপাইনের প্রতিষ্ঠান ও  রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে গোপন বিদেশী কারসাজি থেকে রক্ষা করতেও সাহায্য করবে।

দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের অখণ্ডতা জোরদার করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদী নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি গোপন বিদেশী প্রভাব এবং সম্পদের অপব্যবহার প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে। যদি যথাযথভাবে সমর্থন করা হয়, তাহলে নাগরিক-নেতৃত্বাধীন পর্যবেক্ষণ প্রচেষ্টা এই প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতে পারে। নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানগুলিকে বাহ্যিক চাপের বিরুদ্ধে আরও স্থিতিশীল করে তুলতেও সাহায্য করবে।

তৃতীয়ত, স্থানীয় শাসন ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করে এমন উদ্যোগে অর্থায়নের মাধ্যমে ফিলিপাইনের মিত্রদের বারম শান্তি প্রক্রিয়াকে রক্ষা করতে হবে।  শান্তি প্রক্রিয়াকে স্থিতিশীল করতে হলে তথ্য নিরাপত্তাকে জোরদার করতে হবে। স্থানীয় উদ্যোগের মাধ্যমে জনগণের কাছে যথার্থ ডিজিটাল সংবাদ পৌঁছে দিতে হবে।

শেষে বলতে হয় , ফিলিপাইনের নাগরিক এবং সরকারি  কর্মকর্তাদের চীনা নজরদারি মোকাবেলায় পারস্পরিক সহায়তা প্রয়োজন। সাইবার সিকিউরিটি এবং ডিজিটাল অধিকার রক্ষায় মার্কিন সমর্থন চীনা কৌশলগুলিকে প্রতিহত করতে পারে এবং প্রধান ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলিতে আরও স্বচ্ছতা প্রদান করতে পারে।

একটি স্থিতিশীল, গণতান্ত্রিক ফিলিপাইন মার্কিন স্বার্থ এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।আমেরিকা, তার ইন্দো-প্যাসিফিক অংশীদার এবং মিত্রদের অবশ্যই চীনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফিলিপাইনকে শুধু তার আঞ্চলিক জলসীমাতেই নয়, বরং রাজনীতিতেও স্থিতিস্থাপকতা গড়ে তুলতে সাহায্য করতে হবে।

লেখক : অ্যাডাম নেলসন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের এশিয়া-প্যাসিফিকের সিনিয়র প্রোগ্রাম ডিরেক্টর। মে বুটয় ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটে ফিলিপাইনের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.