বিটিভি’র মাহফুজার অনিয়ম-দুর্নীতি: দশ মাসেও শেষ হয়নি অনুসন্ধান by মারুফ কিবরিয়া

বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মাহফুজা আক্তার ও মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলমসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে দশ মাস আগে অনুসন্ধান শুরু হয়েছিল। দীর্ঘ সময় কেটে গেলেও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এখনো তা শেষ করতে পারেনি। সংস্থাটি বলছে, একাধিক অভিযোগ ও প্রয়োজনীয় নথিপত্র সময়মতো  না পাওয়ায় অনুসন্ধান শেষ করতে দেরি হচ্ছে।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, বিটিভি’র সাবেক জিএম দায়িত্বে থাকাকালীন মাহফুজা আক্তারের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। এই অভিযোগের মধ্যে রয়েছে- শিল্পী সম্মানির ১৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে উত্তোলন করে তা আত্মসাতের ঘটনা। দুদকের একটি দল বিষয়টি অনুসন্ধান করছে। এ ছাড়া ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের মে-জুন ২০২৪ মাসে অনুষ্ঠান না করে, ভুয়া বিল-ভাউচার এবং বাজেটের মাধ্যমে ১৮ কোটি টাকা লুটপাট করার অভিযোগ রয়েছে মাহফুজা আক্তারের বিরুদ্ধে। বিটিভি’র একাধিক সূত্র জানিয়েছে,  অর্থ আত্মসাতের এসব কর্মকাণ্ডে বিটিভি’র সাবেক ডিজি জাহাঙ্গীর আলমের সম্পৃক্ততাও রয়েছে। এ ছাড়া আত্মসাতের এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে অতিরিক্ত পরিচালক (অর্থ) মো. আতাউর রহমান, নিয়ন্ত্রক (ডিজাইন) মোহাম্মদ সেলিম, পিএম মোহাম্মদ মোল্লা আবু তৌহিদ এবং পিএম (চলতি দায়িত্ব) সাহরিয়ার মোহাম্মদ হাসানের নামও রয়েছে। দুদকের কর্মকর্তারা জানান, অনুসন্ধানে যাদের নাম আসছে তাদের কার কি দায় আছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মূলত একটি অনুসন্ধানের মধ্যে একাধিক অভিযোগ থাকায় বেশি দেরি হচ্ছে বলেও জানা গেছে।

সূত্র জানায়, এর আগেও মাহফুজা আক্তার বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রে স্বল্প সময়ের জন্য দায়িত্ব পালনকালেও ১ কোটি ২০ লাখ টাকা অতিরিক্ত খরচের নামে আত্মসাৎ করেছেন। অন্যদিকে, তথ্য ও সমপ্রচার মন্ত্রণালয় কর্তৃক সর্বশেষ অনুমোদিত বাংলাদেশ টেলিভিশনের শিল্পী, নাট্যকার, গীতিকার, পাণ্ডুলিপি রচয়িতা ও কলাকুশলী তালিকাভুক্তি এবং গ্রেডেশন নির্ধারণ সংক্রান্ত নীতিমালা লঙ্ঘন করে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের মাধ্যমে ১৭৬১ জন শিল্পীকে তালিকাভুক্ত করেছে বিটিভি’র সাবেক মহাপরিচালক, ডিডিজি ড. সৈয়দা তাসমিনা আহমেদ (কমিটির আহ্বায়ক), ঢাকা কেন্দ্রের সাবেক জিএম এবং পিএম মোহাম্মদ মোল্লা আবু তৌহিদ (কমিটির সদস্য সচিব)। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি করে নীতিমালা লঙ্ঘন করে নিজের ইচ্ছামতো কমিটি গঠনের নামে ১৭৬১ জন শিল্পীকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে বলেও অভিযোগনামায় উল্লেখ রয়েছে।

সূত্র আরও জানায়, সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে এবং নীতিমালা লঙ্ঘন করে তালিকাভুক্তির আগে এবং পরে নিজের ছেলেকে দিয়ে বহু অনুষ্ঠান নির্মাণ করে ১০৭টি চেক নিয়েছেন। ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে তিনি তার ছেলেকে সংবাদ পাঠকসহ নজরুল, রবীন্দ্র, পল্লীগীতি এবং আধুনিক গানে তালিকাভুক্ত করেন। আর এসব অনিয়মের সঙ্গে মাহফুজা আক্তারের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে জানা গেছে দুদক সূত্রে। সূত্র আরও জানায়, মাহফুজা আক্তার চট্টগ্রামে দায়িত্ব পালনকালে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে নিজেই প্রযোজক সেজে ৬৩৯টি অনুষ্ঠান নির্মাণ দেখিয়ে ভুয়া বিল-ভাউচার এবং নামে-বেনামে প্রায় ৯৮ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন।

সূত্র জানায়, মাহফুজা আক্তার বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের জিএম হিসেবে চলতি দায়িত্ব পালনকালে এবং এইচডিটিভি প্রকল্পের পিডি থাকাকালীন  ক্ষমতার অপব্যবহার এবং স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে ২১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এরই মধ্যে এই অনিয়মের বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম কেন্দ্রে বেশ কয়েকটি পত্র প্রেরণ করেছেন দুদকের অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।

দুদকের অনুসন্ধান সূত্র বলছে, মাহফুজা আক্তারের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। পাচারকৃত অর্থে কানাডার টরেন্টোতে বাড়ি কিনেছেন। দুদকের অনুসন্ধান টেবিলে এসব তথ্যও রয়েছে। পাচারের বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে সংস্থাটির পক্ষ থেকে  বিএফআইইউতে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
সূত্রের বরাতে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৮ই জুলাই বিটিভি’র ঢাকা কেন্দ্রে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। বিটিভি’র একাধিক কর্মকর্তার দাবি, ভবনের বাইরের হামলা ও ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ একটি পক্ষ করেছে। আর ভেতরের অগ্নিসংযোগের সঙ্গে মাহফুজা আক্তারসহ তার সিন্ডিকেটের কর্মকর্তারা জড়িত।

এদিকে বিটিভি’র শিল্পী, কলা-কুশলী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মনে করছেন, বিটিভি’র ইতিহাসে এ ধরনের লুটপাট কখনোই ঘটেনি। এই সিন্ডিকেটের কারণেই বিটিভি’র ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ঢাকা কেন্দ্রের শিল্পী সম্মানি খাতে ৬৯ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও ৬ মাস অনুষ্ঠান নির্মাণ না করে পুরো খরচ দেখানো হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে বলে জানান একাধিক বিটিভি’র কর্মকর্তা। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দুর্নীতির এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বহু শিল্পী, কলা-কুশলী, কর্মকর্তা-কর্মচারী সমপ্রতি মানববন্ধন করে বিটিভি’র সামনে।

অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকতারুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, এ বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। কর্মকর্তা ভালো বলতে পারবেন।  নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, মাহফুজা আক্তার ও বিটিভি’র বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঢাকা ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রের একাধিক অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। বিপুল অঙ্কের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় অনুসন্ধানগুলো ধীরে  এগুচ্ছে। তবে কাজ একদম শেষের দিকে। আগামী মাসেই প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে মাহফুজা আক্তারকে একাধিকবার কল করা হয়। তিনি তার মুঠোফোন রিসিভ করেননি। এমনকি বক্তব্য জানতে তাকে ক্ষুদে বার্তাও পাঠানো হয়েছে। তাতে সাড়া দেননি মাহফুজা আক্তার। তবে এই প্রতিবেদকের কাছে থাকা অন্য একটি নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। এ সময় কল রিসিভ করে মাফফুজা আক্তারের স্বামী পরিচয়ে একজন কথা বলেন। তিনি বলেন, নম্বরটি বাসায় ব্যবহার হয়। তিনি (মাহফুজা) বাসায় নেই। আসলে আপনার কথা বলবো।

সার্বিক বিষয়ে জানতে বিটিভি’র বর্তমান মহাপরিচালক মো. মাহবুবুল আলম মানবজমিনকে বলেন, এটি একটি সেনসেটিভ বিষয়। এ ব্যাপারে কথা বলতে হলে সামনাসামনি আসুন।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.