গুলিতে স্বামীর মৃত্যু, সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তা লাকির by ফাহিমা আক্তার সুমি

দুই সন্তান নিয়ে কোথায় যাবো? কী হবে আমার সন্তানদের ভবিষ্যৎ। পাঁচ বছরের মেয়েটি সবসময় ওর বাবার জন্য কান্নাকাটি করে। একমাত্র ছেলে আল-আমিন সংসারের হাল ধরতে ঢাকায় একটি  হোটেলে কাজ শুরু করেছে। চলতি বছরে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেয়ার কথা ছিল তার। বুঝতে পারছি না সন্তানদের নিয়ে সামনের দিনগুলো কীভাবে কাটবে। এভাবে হতাশার কথাগুলো বলছিলেন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিতে নিহত পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী আবদুল গণি শেখের স্ত্রী লাকি আক্তার। তিনি গুলশান-২ এ একটি আবাসিক হোটেলের কর্মচারী ছিলেন। রাজধানীর উত্তর বাড্ডার একটি বাসায় ছোট ভাইকে নিয়ে বসবাস করতেন। গত ১৯শে জুলাই কর্মস্থলে যাওয়ার পথে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। নিহত গণি শেখ রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানখানাপুর ইউনিয়নের আবদুল মজিদের সন্তান। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন গণি শেখ।

নিহতের স্ত্রী লাকি আক্তার মানবজমিনকে বলেন, আমার স্বামী ছিল সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি। তার মৃত্যুতে আমরা ভেঙে পড়েছি। সন্তানদের কোনো চাহিদা পূরণ করতে পারছি না। পূরণ করতে পারি না তাদের বাবার অভাব। সন্তানদের লেখাপড়া ঠিকমতো হচ্ছে না। এদের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে কীভাবে আমি তৈরি করে দিবো সেই চিন্তাই কাটছে না। আমরা এখন গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ীতে থাকি। এরআগে ১৪ বছর ধরে ঢাকায় ছিলাম। খুব ভালো চলছিলো সন্তানদের নিয়ে। এখন অবস্থা খুবই খারাপ। আমার ছেলে গত বছর এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল তখন দুই সাবজেক্টে ফলাফল খারাপ এসেছিল। এইবার আবার পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল কিন্তু ওর বাবা মারা যাওয়ার পর আর পরীক্ষা দিতে পারেনি। ওর বাবা যে হোটেলে কাজ করতো সেই হোটেলে সে এখন কাজ করে। খুব অল্প বয়সে সংসারের হাল ধরার জন্য পড়াশোনা বাদ দিয়ে ছেলেটি কাজ শুরু করেছে। আমি এসএসসি পাস করেছিলাম। যেকোনো একটা কাজের ব্যবস্থা হলে সন্তানদের নিয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকতে পারবো। এ বছরের জানুয়ারিতে মেয়েকেও স্কুলে ভর্তি করেছি। অল্প কিছু সহযোগিতা পেয়েছিলাম সেইটা দিয়ে কোনোমতে চলছি। তিনি বলেন, স্বপ্ন ছিল সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করবো। একটা সুখের সংসার হবে আমাদের কিন্তু সেটি আর পূরণ হলো না। মেয়েটা সারাদিন ওর বাবার জন্য কান্নাকাটি করে। আমি বুঝতে পারছি না সামনের দিনগুলো আমার কীভাবে যাবে। সন্তানরা বড় হলে তবুও দুশ্চিন্তা কমতো। দুইটা সন্তানই এখনো অনেক ছোট।

গণি শেখের ছোট ভাই তরিকুল ইসলাম ওইদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, গত ১৯শে জুলাই শুক্রবার সকালে কাজে যাওয়ার সময় ভাটারা থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হয় আমার ভাই। গুলশান-২ নম্বরের একটি হোটেলে স্যানিটারির কাজ করতেন। তার মোবাইল থেকে বাবাকে কল করে জানানো হয় ঘটনাটি। কিছুক্ষণ পরে বাবা আমাকে ভাইয়ের বিষয়টি জানায়। ভাইয়ের মাথার এক পাশ থেকে গুলি লেগে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। এ সময় তাকে আশেপাশে থাকা ব্যক্তিরা উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে অবস্থা গুরুতর হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে জানতে পারি হাসপাতালে নেয়ার দশ মিনিট পরে আমার ভাই মারা যান। মারা যাওয়ার তিনদিন পর মরদেহ নিয়ে গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ীতে যাই সেখানে আমার ভাইকে দাফন করা হয়। ভাইয়ের স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে। ১২ বছর ধরে ওই হোটেলে কাজ করতো ভাই। এখন ১ মাস ধরে সেই হোটেলে তার ছেলে আল আমিন কাজ করছে। সাত হাজার টাকার মতো বেতন পাবে। মেয়েটি মাত্র স্কুলে ভর্তি হয়েছে। ভাই তার আয় দিয়ে নিজের সংসারের পাশাপাশি বাবা-মাকেও দেখাশোনা করতেন। ঢাকাতে আমরা দুই ভাই একসঙ্গে থাকতাম। অনেকে খোঁজখবর নাম-ঠিকানা নিয়ে আর কোনো খবর রাখেনি।

তিনি বলেন, আমার ভাই তো মারা গেছেন তাকে তো আর পাওয়া যাবে না। তার স্ত্রী-সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। বাবা আবদুল মজিদ ছোটবেলাতেই আমাদের ঢাকায় নিয়ে আসে। আমরা একটু বড় হলে যখন কাজ করা শুরু করেছি তখন গ্রামে চলে যায়। বাবা এখন গ্রামে নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ করেন। সেদিন সকালে বাইরে যাওয়ার পর আমার খবর নেয়ার জন্য ভাই ফোন দিয়েছিল এরপর আর তার সঙ্গে কথা হয়নি। আমি একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করি। আমার ভাইয়ের সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল, দীর্ঘদিন ধরে আমি আর সে একসঙ্গে ঢাকায় থাকি। এখন প্রতিদিনই ভাইয়ের চেহারা চোখে ভাসে। মনে হয় দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকছে। আমি রান্না করতাম আমার ভাই খেতো। ভাইয়ের মেয়েটা সবসময় তার বাবার জন্য মন খারাপ করে। অপেক্ষায় থাকে তার বাবা কখন আসবে। 

mzamin

No comments

Powered by Blogger.