শুনতে কি পাও : বিজয়ী প্রাণের জয়বার্তা by রহমান মুফিজ
ছবিটা চলছে...
হ্যাঁ, ছবিটা চলছে এখনো...
**দেখতে পাচ্ছি শঙ্খ আর উলুধ্বনিতে জাগছে একটা বিষন্ন ভোর। জাগছে বিপন্ন এক জনপদ। দূরে একটা নদীর ধারে জ্বলছে কয়েকটা আলোর কণা। আঁধার ভেঙে উদ্ভাসিত হচ্ছে একটা জনপদ, উদ্ভাসিত হচ্ছে কিছু মুখ, কিছু চরিত্র। তারা কথা বলছে, হাঁটছে, দৌড়চ্ছে—যাপিত জীবন। আবার তারা ফের মিলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে, আবার জেগে উঠছে জলের শব্দে। দেখতে পাচ্ছি—বিস্তীর্ণ জলরাশি, ধূসর আকাশ, কাদারঙ নোনা জল, স্যাঁতস্যাঁতে বৃষ্টির একটানা শব্দ। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। দানবীয় জল সমস্ত চরাচর দখল করে যখন নিথর-নিস্তেজ তখন ছবির এই মানুষগুলো তৈরি করছে জীবনের আরেক উপখ্যান। এ উপখ্যানে জলের সঙ্গে বাস-সহবাস দুইই আছে। প্রেম আছে, অভিমান আছে, তীব্র দ্বন্দ্ব আছে, আছে মহাযুদ্ধ। আছে বিজয়ের স্বতন্ত্র মন্ত্র। দেখতে পাচ্ছি সূতারখালি গ্রাম; একটি বাংলাদেশ, একটি পৃথিবী—যেখানে উদ্দাম বুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জনতার ঐক্য।
ছবিটা চলছে...নাকে এসে লাগছে নোনা গন্ধ, দখিনা হাওয়ার ঝাঁজ। কানে বাজছে কাদা ও বৃষ্টির অপূর্ব সঙ্গমের শব্দ। শুনতে পাচ্ছি—মানুষের যুদ্ধে জেতার অপার আনন্দ-হর্ষধ্বনি আর শুনতে পাচ্ছি একটা নিভৃত হাহাকার। হ্যাঁ, এখনো শুনতে পাচ্ছি...স্পষ্টই শুনতে পাচ্ছি...
কামার আহমাদ সাইমনের ছবি শুনতে কি পাও যারা দেখেছেন, তাদের চোখে, কানে এভাবেই ছায়া আর শব্দেরা সারি বেঁধে দাঁড়াবে। হঠাৎ চোখে ভেসে আসতে পারে মেঘমেদুর এক বিস্তীর্ণ ক্যানভাসের নিচে আকাশের সমান্তরাল জমিনে দুরান্বয়ী একটি রেখার উপর দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য মানুষের ছবি। ভেসে আসতে পারে সে দৃশ্যের অপসৃয়মান কোলাহল, যার মধ্যে আপনি পেয়ে যাবেন বিপন্নতার বিপরীতে বুক টানটান করে দাঁড়ানো মানুষের সংকল্প। অথচ কী অদ্ভূত! তারা তখন কাদামাঠে চমৎকার এক ফুটবল ম্যাচ দেখে বাড়ি ফিরছিল। খেলা দেখে বাড়ি ফেরা এই গড়পড়তা মানুষগুলোই ছবির পরতে পরতে রচনা করলো প্রতি মুহূর্তের সংগ্রাম; রচনা করলো বিজয়ের পূর্বরাগ।
এ ছবির বিষয়, অনুসঙ্গ, ভাষাভঙ্গি, জীবন-চিত্রায়ন এবং নির্মাণকৌশল অভিনব। কাজেই তার সুর বাজছে কানে, রঙ ভেসে উঠছে চোখে। শেষ কবে দেখেছি ছবিটা? অন্তত তিন বছর তো হবেই। মুক্তি পাওয়ার পর থেকে বেশ কয়েকবার দেখেছি, শুনেছি, পত্রিকায় পড়েছি, দেশ-বিদেশের নানা জায়গা থেকে নানা পুরস্কার জিতে এনেছে ছবিটি। এই ছবি দিয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও ঘরে তুলেছেন নির্মাতা। পুরস্কার ছবিটিকে মহিমা কতটা দিয়েছে সে প্রশ্ন পরের। উপরন্তু, এ ছবি পুরস্কারের আদৌ ধার ধারে কি না, সে প্রশ্নই জরুরি।
কথাশিল্পী শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাস ৬০-এর দশকের শেষদিকে আইয়ুব সরকার পুরস্কারে ভূষিত করেছিল। ওই উপন্যাসের ভাব-ভাষা ও প্রতিকী অনুধাবনে অযোগ্য, মাথামোটা সামরিকজান্তা কী ভেবে পুরস্কারটি দিয়েছিল, ভেবে পাই না। শুনেছি পরে এ নিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের ভেতরেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। কেন না, ওই উপন্যাসের মূল বিষয়-বক্তব্যই ছিল, একরোখা স্বৈরাচারী মনোভাবের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ। সেদিনের সে পুরস্কারের কারণে ‘ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাস এবং কথাশিল্পী হিসেবে শওকত ওসমানের সামাজিক দায় ও অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। পুরস্কার যে সবসময় সম্মান ও স্বীকৃতিই এনে দেয় সর্বান্তকরণে তা ভাববার কোনো কারণ নেই। পৃথিবীর অধিকাংশ পুরস্কারের অভিপ্রায়ই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। কোথাও কোথাও গ্লানীকরও বটে। শুনতে কি পাও-এর পুরস্কারগুলো সে প্রশ্নকে নিশ্চয় উসকে দেবে না। তবে পুরস্কারের কারণে যে ছবিটি বিশেষ মহিমা পাবে, সেটা ভাববার অবকাশ না রাখার পক্ষে কথা বলছি, আমি মনে করি নির্মাতা ছবিটি নির্মাণ করেছেন তার সৃষ্টির তাড়না থেকে, সামাজিক দায় ও রাজনৈতিক অবস্থান থেকে। একটি উৎকৃষ্ট নির্মাণই নির্মাতার সর্বোচ্চ পুরস্কার। বোধ করি, সেটা সাইমন পেয়ে গেছেন অনেক আগেই। বাকি যা, তা নিছক বাড়তি পাওনা। বড়জোর ‘দুর্মুল্যের বাজারে’ ছবি বানানোর খরচাপাতি যদি কিছু উঠে আসে, মন্দ কি— ব্যাপারটা এভাবে ভাবাটাই শ্রেয়তর।
কেন বলছি এ কথা? সে প্রশ্নের উত্তর ছবিটিতেই নিহিত। ‘শুনতে কি পাও’ গদ বাঁধা মানসের ছবি নয়। সিনেমা বানানোর জন্য যারা যারপরনাই প্রাণপাত করছেন—গল্প, টেক্সট, ক্যামেরা, লাইট, অ্যাকশন, ডিরেকশন, পারফেক্ট ক্যারেক্টারাইজেশন নিয়ে সংশয় ও দ্বিধায় মাথার চুল ছিঁড়ছেন, অথবা এই নেই, ওই নেই, ছবি কী করে হবে বলে হতাশাবিলাসে ডুবে আছেন, আর যারা বাংলাদেশের ছবির ব্যাপারে নাক সিঁটকান, কুৎসা রটিয়ে বেড়ান অথবা বলে বেড়ান ছবিগুলো ঠিক ছবি হয়ে উঠছে না, ক্ল্যাসিক হয়ে উঠছে না, তাদের জন্য ছবিটি একটি ‘ক্লাসরুম’। নির্মাতা যেমন দীর্ঘ প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ‘সাধারণ’ এই ছবিটি বানিয়েছেন, তেমনি ‘বোদ্ধা’ দর্শকদেরও ছবিটি দেখার আগে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা উচিৎ। তবে সাধারণ দর্শকদের ক্ষেত্রে এ শর্ত প্রযোজ্য হবে না। সাধারণ দর্শক ছবিটির ভাব ও ভাষা ধরতে পারবেন অনায়াসে। কেননা, এখানে সাধারণ সংগ্রামী মানুষের জীবন উৎকীর্ণ হয়েছে তাদের নিজস্ব ভঙ্গিতে। ‘বোদ্ধারা’ ওই পথ মাড়িয়ে আসেন না। বোদ্ধারা বসে থাকেন মাউথপিস হাতে বিশ্বচলচ্চিত্রের মানচিত্র বর্ণনা করে নির্বাচিত নির্মাতাকে শেষতক একখানা ‘ম্যাডেল’ তুলে দেওয়ার জন্য।
ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ২০১৪ সালে। ছবির গল্প তার মাত্র পাঁচ বছর আগের। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ‘আইলা’ নামের যে ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হেনেছিল তার পরবর্তী প্রাকৃতিক পরিস্থিতি এবং সে পরিস্থিতির বিপরীতে জীবনজয়ী মানুষের সংগ্রামই ছবিটির প্লট। ছবিটি দেখতে দেখতে প্লট, ক্যামেরা আর নির্মাতার অভূতপূর্ব রসায়ন উপভোগ করেন দর্শকেরা।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা তখন তলিয়ে গেছে সাগরের নোনাজলে। ঘরবাড়ি, অফিস, স্কুল, দোকানপাট, খেলার মাঠ, বাগান, চাষের জমি সবকিছু অধিকার করেছে সাগরজল। খুলনার ভদ্রাপাড়ের ছোট্ট সুতারখালি গ্রাম তারই একটি। হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে বেড়িবাঁধের উপর। মাসের পর মাস সেই বাঁধে চালাঘর তুলে বাস করছে ঘরহারা মানুষ। বাঁধই যেন জলবক্ষে মাথা তুলে থাকা একখানা জনাকীর্ণ দ্বীপ। একখানা বিশ্বমানচিত্র। সেখানে বিপন্ন মানুষের দুর্দশা বাড়ে দিনদিন। বাঁধ নির্মাণে প্রশাসনের গড়িমসির কারণে সে দুর্দশা দীর্ঘতর হয়। আইলাবিধ্বস্ত বিপন্ন মানুষগুলো স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির লোভনীয় ইস্যুতে পরিণত হয়। বিপন্ন মানুষগুলো তো কেবলই মানুষ নয়, আন্তর্জাতিক বাজারের ‘কনজিয়্যুমার’ও বটে। ফলে কনজিয়ুমারকে বিপন্নাবস্থা থেকে বাঁচানো আন্তর্জাতিক দায়িত্ব তো বটেই, একইসঙ্গে এ বিষয়ে বহির্বিশ্বের সঙ্গে সরকারের তদ্বিরের বিষয়টিও জড়িত। সেই সঙ্গে এনজিও আসবে, প্রকল্প তৈরি করবে, সরকারি হর্তা-কর্তা, রাজনৈতিক হোমরা-চোমরারা আসবে, ভোটের সমীকরণ মেলাবে—এতসব জটিলতা পার হয়েই সুতারখালি গ্রামে আসবে ত্রাণ, বাঁধ নির্মাণের জন্য আসবে বরাদ্দ! সে তো দিল্লীদূর ব্যাপারস্যাপার! সুতারখালীর বিপন্ন মানুষগুলো বুঝে ফেলে তারা কেবল দুর্যোগ কবলিত মানুষ নয়, তারা ‘সংখ্যায়’ পরিণত হয়ে যাচ্ছে। এরপরও তাদের উপায়ন্ত নেই। এইসব মেনে নিয়েই ঝড়ে ভিজে, রোদে পুড়ে টানা দুইটি বছর কাটায় বেড়িবাঁধের উপর।
সৌমেন, রাখী এবং তাদের শিশুসন্তান রাহুল-এর গল্পসূত্র দিয়ে গাঁথা হয়েছে সুতারখালির সমগ্র বিপন্ন মানুষের সহস্র গল্পকে। জলোচ্ছ্বাসে গৃহহারা সৌমেন-রাখি ও রাহুলরা অপেক্ষার প্রহর গুনছে কখন জল নেমে যাবে। জল ফুঁড়ে উৎকীর্ণ হবে তাদের ভিটেমাটি, জমি-জমা, খেত, পেয়ারা বাগান, খেলার মাঠ, পুকুর। গ্রীষ্ম যায়, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত যায়, শৈতপ্রবাহে কেঁপে ওঠে জনপদ। ফিকে বসন্তও লুপ্ত হয় নোনা হাওয়ায়। কিন্তু জল তো নামে না। দেশি-বিদেশি ত্রাণ লুটে খায় বাগঢাসে। জলবায়ু ব্যবসার বিশ্বব্যাপারীরা আন্তর্জাতিক সেমিনার সিম্পোজিয়াম ডাকে, বাগিয়ে নেয় নানা প্রকল্প। সুতারখালির চারিদিকে জল, অথচ পানের যোগ্য জল নেই কোথাও। এ যেন জলের মরুভূমি! ত্রাণের জলের জন্য মানুষের দীর্ঘ সারি। দীর্ঘ হাহাকার। জলের জন্য আকুতি মানুষের— ‘জল যদি না দ্যাও, তো এক বোতল বিষ কিনি দ্যাও’।
অবশেষে জল আসে জলে ভেসে। কিন্তু সে জল অপ্রতুল! সে জল যে সমস্ত মানুষের তৃষ্ণা মেটাতে অক্ষম। মানুষের মধ্যে ক্ষোভ, আক্ষেপ, বঞ্চনার জ্বালা তীব্রতর হয়। দুর্গত মানুষেরা অনুভব করে একটা দুর্যোগ ওই অঞ্চলের ধনী-গরীব-মধ্যবিত্ত-ভিখিরি সকল মানুষকে সমান করে দিয়েছে। এতসব মানুষের মধ্যে আলাদা করে ‘হতদরিদ্র’ চিহ্নিত করার কোনো সুযোগ নেই। সবাই হতদরিদ্র। সবাই সমান।
এক সন্ধ্যায় চায়ের কাপে ঝড় তুলছে বাঁধবাসী। নিত্যদিনের সুখ-দুঃখ নিয়ে আলাপ করছে টং দোকানে। সেখানে উঠে আসে—মন্ত্রী-এমপি, সরকারি কর্তারা কালোগ্লাসে ঘেরা গাড়িতে চলাফেরা করে, যে কারণে সে গ্লাসের ভেতর দিয়ে তারা মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখতে পায় না। এমন সময় একজন তীব্র আক্রোশে বলে ওঠে— ‘গিলাসটা ভাইঙ্গে দিতে পারেন না?’...কি দুর্দান্ত সে সংলাপ! একটি দুর্যোগ মানুষের শ্রেণিচেতনাকে কতটা প্রখর করতে পারে, তার উৎকৃষ্ট মুহূর্ত সে সন্ধ্যার চায়ের দোকানের আড্ডা।
সুতারখালীবাসীর এমন প্রলেতারিয়েত চেতনায় উত্তরণ মূলত আরেকটি মহা-দুর্যোগের আভাস। এ দুর্যোগ লুটপাটের রাষ্ট্র, নগ্ন ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতি, জগদ্দল আমলাতন্ত্র, শ্রেণিবিভক্ত সমাজের উৎপীড়ন থেকে মানুষকে মুক্ত করার এক বাঞ্ছিত দুর্যোগ, যা কথিত রাষ্ট্রের জন্য বিপদসঙ্কেত। এজন্য আমরা দেখি, সচেতন রাষ্ট্র খুব সচেতনভাবেই সুতারখালীর প্রজন্মকে রাষ্ট্রের প্রতি আনগুত্য ও নাগরিকের কর্তব্যের পাঠ দিতে ভোলে না। অথচ এমন দুর্দশায়ও রাখিকে ক্ষুদ্রঋণের কিস্তি শোধ করতে হয়। আর ক’য় টাকা কম পড়েছে বলে মাঠকর্মীর নসিহতের শেষ নেই।
সুতারখালীর মানুষ মূলত বিশ্বমানুষ। রেডিওতে কোপেনহেগেনের জলবায়ু সম্মেলনের খবরও তারা শোনে। ক্যাসেটপ্লেয়ারে বাজায় ‘চেওনা সুনয়না এ নয়নপানে’। সুতারখালির মানুষ কেবলই সুতারখালীতেই বন্দি থাকে না। তাদের ভাষ্যেই উঠে আসে—তারা ঢাকা পর্যন্তও যেতে পারে! সুতারখালীর মানুষের প্রচণ্ড আত্মসম্মানবোধ। তারা রিলিফকে ভিক্ষাজ্ঞান করে। তারা না পারতে রিলিফের লাইনে দাঁড়াচ্ছে। সুতারখালীর মানুষ আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের খেলা দেখে। আর্জেন্টিনা ব্রাজিলের পতাকা উড়ায় আকাশে। আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলে ভাগ হয়ে তারা ফুটবল খেলায় মেতে উঠে। পুরস্কার জেতে। তারা ফুটবেল খেলার আসর ভাঙে সাকিরার ‘ওয়াকা ওয়াকা’ গান শুনে। তারা সমস্ত দুর্যোগ-দুর্বিপাকেও জীবনের রস আস্বাদনে ভুলে না। তারা নাচে, গায়, ঝগড়া করে। আর বিশাল মেঘমেদুর আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে উপভোগ করে ঐক্যের স্পর্ধা। সুতারখালি আমাদের গ্রাম, সবার গ্রাম হয়ে উঠে।
বোদ্ধামহলে ছবিটি নিয়ে আলোচনা হয়। একটি সাধারণ ‘ছবি’ নিয়ে এত আলোচনার কি আছে? প্রশ্নটা একান্তই আমার। ফলে আমার মতো করেই এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হয়েছে। ছবিটি ‘খোলাবাজারে’ নেই। কোনো প্রতিষ্ঠান, চলচ্চিত্র হিতৈষী কোনো সংগঠন বা নির্মাতা নিজের উদ্যোগে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করলেই কেবল ছবিটি দেখার সুযোগ মেলে। বার কয়েক সে সুযোগ পেয়েমাত্র আর হাতছাড়া করিনি। টানা ৯০ মিনিটের ছবির প্রতিটি দৃশ্যই বিস্ময়-বিমুগ্ধ চোখে দেখেছি। ছবিটিতে ছবিটির নেপথ্যে কামার আহমাদ সাইমনের দীর্ঘ প্রস্তুতি ও সঙ্কল্প পরিস্ফুট হয়েছে। দেখতে দেখতে মনে হয়েছে, সাইমন বিদ্যমান বাংলাদেশের এক উৎকৃষ্ট রূপক হাজির করেছেন। কিন্তু এ রূপক কেবলই রূপক (মেটাফোর) নয়। এ রূপক এক জ্বলন্ত বাস্তবতা। আগুনের রূপক কেবল যে আগুনই হয় তা-ই তিনি দেখিয়েছেন। দেখিয়েছেন জীবনের রূপক কেবল জীবনই হতে পারে। ফলে তিনি ছবিতে কোনো গল্প হাজির করেননি। কেবলই তার ক্যামেরায় বন্দি করেছেন এক অমোঘ ও অকৃত্রিম জীবনকে। গল্পে জীবন বা জীবনের স্বাদ নাও থাকতে পারে। কিন্তু জীবনে তো গল্পের শেষ নেই। সেইসব গল্প—যা মানুষকে জীবনের মুখোমুখী করে, জীবন-সংগ্রামে প্রতিমুহূর্তে তাড়া দিয়ে বেড়ায়। ‘শুনতে কি পাও’ যে জীবনকে উপস্থাপন করে সেখানে সেই অজস্র, অশেষ, অসীম ও অনুল্লেখ গল্পগুলো ‘ইলিশফাইল’ দিয়ে আছে। সে গল্পের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে অভাবিত সব ‘মেটাফোর’। ছবিটিতে বিপণ্নতার রূপকগুলো যে মাত্রিকতা পেয়েছে, যে সুরে বা ভাষায় গাঁথা হয়েছে তা অভূতপূর্ব। বাংলা চলচ্চিত্রে ভাষা অভিনব। অথচ তথাকথিত ‘মেসেজ’ বা ‘বক্তব্যকে’ আয়োজন করে, ঠেসে ধরে গেলানোর প্রবণতা নেই। নেই নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের প্রবণতাও। কত বিচিত্র কায়দায় ক্যামেরা ছুটেছে, কত কৌশলে ধারণ করা হচ্ছে সোমেন-রাখি-রাহুলের একেকটা মুহূর্ত—তা এক অপার বিস্ময়ের যোগান দেবে। না কাহিনীচিত্র না প্রামান্যচিত্র—এমন একটি প্যারাডক্সের ভেতর দিয়ে গোটা চলচ্চিত্রটি উপভোগ্য হয়ে উঠবে। এর বিষয়বস্তু, রঙ, বৈশিষ্ট্য, আখ্যানধর্মীতা, ভাষা, নির্মাণপ্রকৌশলের অভিনবত্ব দর্শককে এমন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাবে,যে কামার আহমাদ সাইমন শেষতক আমাদের কী শোনাতে চেয়েছেন? কেবলই বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলে আইলাবিধ্বস্ত এক জনপদের গল্প? নাকি জীবন?
মূলত ‘জীবন’ শব্দটাই এখানে যুৎসই। ঘটনা এখানে জীবনের উপলক্ষ, গল্প না থাকলেও জীবন এক প্রবহমান সুন্দর অথবা গল্প জীবনের চেয়ে অধিক কিছু নয়, এমন স্বভাব-সত্যই এ ছবির অন্যতম দিক। জীবন যে কত মহত্তর, কত মহিমায় উৎকীর্ণ, কত রঙে সে রঙিন, কত ভাষায় সে প্রকাশিত আর কত সংগ্রামে সে উজ্জীবিত হয় তারই দৃশ্য-দর্শন এই ছবিটি। এই অনুসৃতিতেই খুলনার ভদ্রা নদীর পাড়ের ছোট্ট সুতারখালী গ্রাম হয়ে উঠে ‘বাংলাদেশের’ যথাযথ রূপক। সাইমন যে ভঙ্গি বা ভাষায় এবং যে কৌশলে ছবিটি নির্মাণ করেছেন তা আমাদের চলচ্চিত্র অভিধানেও দেবে নতুন সংযুক্তি।
বহুজাতিক আগ্রাসন, সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য, জলবায়ু ব্যবসা, রাষ্ট্রীয় ঔদাসীন্য, আমলাতন্ত্রের জগদ্দল ব্যবস্থা এবং কথিত বিশ্বায়নের বিপরীতে সুতারখালি এক নিঃশব্দ ব্যঙ্গ, সুতারখালিই হয়ে ওঠে বিশ্বব্যবস্থার এক অখণ্ড অংশ, আন্তর্জাতিকতাবাদে দীক্ষিত অনন্য এক জনপদ। নদীমাতৃক জনপদ।
পৃথিবীর সমস্ত নদীই মিশেছে এক অখণ্ড জলধারায়। ‘শুনতে কি পাও’ সেই অখণ্ড জলধারায় প্রবাহিত এক প্রাচীণ নদীর গল্পও যার কলকল ধ্বনিই আমরা শুনতে পাই এখানে। শুনতে পাই মানুষের উৎসব ও মহিমান্বিত জীবনের গল্প। কেননা এখানে প্রতিনিয়ত ‘মৃত্যুর মুখে ঘোষিত হয় বিজয়ী প্রাণের জয়বার্তা’।
হ্যাঁ, ছবিটা চলছে এখনো...
**দেখতে পাচ্ছি শঙ্খ আর উলুধ্বনিতে জাগছে একটা বিষন্ন ভোর। জাগছে বিপন্ন এক জনপদ। দূরে একটা নদীর ধারে জ্বলছে কয়েকটা আলোর কণা। আঁধার ভেঙে উদ্ভাসিত হচ্ছে একটা জনপদ, উদ্ভাসিত হচ্ছে কিছু মুখ, কিছু চরিত্র। তারা কথা বলছে, হাঁটছে, দৌড়চ্ছে—যাপিত জীবন। আবার তারা ফের মিলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে, আবার জেগে উঠছে জলের শব্দে। দেখতে পাচ্ছি—বিস্তীর্ণ জলরাশি, ধূসর আকাশ, কাদারঙ নোনা জল, স্যাঁতস্যাঁতে বৃষ্টির একটানা শব্দ। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। দানবীয় জল সমস্ত চরাচর দখল করে যখন নিথর-নিস্তেজ তখন ছবির এই মানুষগুলো তৈরি করছে জীবনের আরেক উপখ্যান। এ উপখ্যানে জলের সঙ্গে বাস-সহবাস দুইই আছে। প্রেম আছে, অভিমান আছে, তীব্র দ্বন্দ্ব আছে, আছে মহাযুদ্ধ। আছে বিজয়ের স্বতন্ত্র মন্ত্র। দেখতে পাচ্ছি সূতারখালি গ্রাম; একটি বাংলাদেশ, একটি পৃথিবী—যেখানে উদ্দাম বুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জনতার ঐক্য।
ছবিটা চলছে...নাকে এসে লাগছে নোনা গন্ধ, দখিনা হাওয়ার ঝাঁজ। কানে বাজছে কাদা ও বৃষ্টির অপূর্ব সঙ্গমের শব্দ। শুনতে পাচ্ছি—মানুষের যুদ্ধে জেতার অপার আনন্দ-হর্ষধ্বনি আর শুনতে পাচ্ছি একটা নিভৃত হাহাকার। হ্যাঁ, এখনো শুনতে পাচ্ছি...স্পষ্টই শুনতে পাচ্ছি...
কামার আহমাদ সাইমনের ছবি শুনতে কি পাও যারা দেখেছেন, তাদের চোখে, কানে এভাবেই ছায়া আর শব্দেরা সারি বেঁধে দাঁড়াবে। হঠাৎ চোখে ভেসে আসতে পারে মেঘমেদুর এক বিস্তীর্ণ ক্যানভাসের নিচে আকাশের সমান্তরাল জমিনে দুরান্বয়ী একটি রেখার উপর দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য মানুষের ছবি। ভেসে আসতে পারে সে দৃশ্যের অপসৃয়মান কোলাহল, যার মধ্যে আপনি পেয়ে যাবেন বিপন্নতার বিপরীতে বুক টানটান করে দাঁড়ানো মানুষের সংকল্প। অথচ কী অদ্ভূত! তারা তখন কাদামাঠে চমৎকার এক ফুটবল ম্যাচ দেখে বাড়ি ফিরছিল। খেলা দেখে বাড়ি ফেরা এই গড়পড়তা মানুষগুলোই ছবির পরতে পরতে রচনা করলো প্রতি মুহূর্তের সংগ্রাম; রচনা করলো বিজয়ের পূর্বরাগ।
এ ছবির বিষয়, অনুসঙ্গ, ভাষাভঙ্গি, জীবন-চিত্রায়ন এবং নির্মাণকৌশল অভিনব। কাজেই তার সুর বাজছে কানে, রঙ ভেসে উঠছে চোখে। শেষ কবে দেখেছি ছবিটা? অন্তত তিন বছর তো হবেই। মুক্তি পাওয়ার পর থেকে বেশ কয়েকবার দেখেছি, শুনেছি, পত্রিকায় পড়েছি, দেশ-বিদেশের নানা জায়গা থেকে নানা পুরস্কার জিতে এনেছে ছবিটি। এই ছবি দিয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও ঘরে তুলেছেন নির্মাতা। পুরস্কার ছবিটিকে মহিমা কতটা দিয়েছে সে প্রশ্ন পরের। উপরন্তু, এ ছবি পুরস্কারের আদৌ ধার ধারে কি না, সে প্রশ্নই জরুরি।
কথাশিল্পী শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাস ৬০-এর দশকের শেষদিকে আইয়ুব সরকার পুরস্কারে ভূষিত করেছিল। ওই উপন্যাসের ভাব-ভাষা ও প্রতিকী অনুধাবনে অযোগ্য, মাথামোটা সামরিকজান্তা কী ভেবে পুরস্কারটি দিয়েছিল, ভেবে পাই না। শুনেছি পরে এ নিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের ভেতরেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। কেন না, ওই উপন্যাসের মূল বিষয়-বক্তব্যই ছিল, একরোখা স্বৈরাচারী মনোভাবের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ। সেদিনের সে পুরস্কারের কারণে ‘ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাস এবং কথাশিল্পী হিসেবে শওকত ওসমানের সামাজিক দায় ও অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। পুরস্কার যে সবসময় সম্মান ও স্বীকৃতিই এনে দেয় সর্বান্তকরণে তা ভাববার কোনো কারণ নেই। পৃথিবীর অধিকাংশ পুরস্কারের অভিপ্রায়ই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। কোথাও কোথাও গ্লানীকরও বটে। শুনতে কি পাও-এর পুরস্কারগুলো সে প্রশ্নকে নিশ্চয় উসকে দেবে না। তবে পুরস্কারের কারণে যে ছবিটি বিশেষ মহিমা পাবে, সেটা ভাববার অবকাশ না রাখার পক্ষে কথা বলছি, আমি মনে করি নির্মাতা ছবিটি নির্মাণ করেছেন তার সৃষ্টির তাড়না থেকে, সামাজিক দায় ও রাজনৈতিক অবস্থান থেকে। একটি উৎকৃষ্ট নির্মাণই নির্মাতার সর্বোচ্চ পুরস্কার। বোধ করি, সেটা সাইমন পেয়ে গেছেন অনেক আগেই। বাকি যা, তা নিছক বাড়তি পাওনা। বড়জোর ‘দুর্মুল্যের বাজারে’ ছবি বানানোর খরচাপাতি যদি কিছু উঠে আসে, মন্দ কি— ব্যাপারটা এভাবে ভাবাটাই শ্রেয়তর।
কেন বলছি এ কথা? সে প্রশ্নের উত্তর ছবিটিতেই নিহিত। ‘শুনতে কি পাও’ গদ বাঁধা মানসের ছবি নয়। সিনেমা বানানোর জন্য যারা যারপরনাই প্রাণপাত করছেন—গল্প, টেক্সট, ক্যামেরা, লাইট, অ্যাকশন, ডিরেকশন, পারফেক্ট ক্যারেক্টারাইজেশন নিয়ে সংশয় ও দ্বিধায় মাথার চুল ছিঁড়ছেন, অথবা এই নেই, ওই নেই, ছবি কী করে হবে বলে হতাশাবিলাসে ডুবে আছেন, আর যারা বাংলাদেশের ছবির ব্যাপারে নাক সিঁটকান, কুৎসা রটিয়ে বেড়ান অথবা বলে বেড়ান ছবিগুলো ঠিক ছবি হয়ে উঠছে না, ক্ল্যাসিক হয়ে উঠছে না, তাদের জন্য ছবিটি একটি ‘ক্লাসরুম’। নির্মাতা যেমন দীর্ঘ প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ‘সাধারণ’ এই ছবিটি বানিয়েছেন, তেমনি ‘বোদ্ধা’ দর্শকদেরও ছবিটি দেখার আগে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা উচিৎ। তবে সাধারণ দর্শকদের ক্ষেত্রে এ শর্ত প্রযোজ্য হবে না। সাধারণ দর্শক ছবিটির ভাব ও ভাষা ধরতে পারবেন অনায়াসে। কেননা, এখানে সাধারণ সংগ্রামী মানুষের জীবন উৎকীর্ণ হয়েছে তাদের নিজস্ব ভঙ্গিতে। ‘বোদ্ধারা’ ওই পথ মাড়িয়ে আসেন না। বোদ্ধারা বসে থাকেন মাউথপিস হাতে বিশ্বচলচ্চিত্রের মানচিত্র বর্ণনা করে নির্বাচিত নির্মাতাকে শেষতক একখানা ‘ম্যাডেল’ তুলে দেওয়ার জন্য।
ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ২০১৪ সালে। ছবির গল্প তার মাত্র পাঁচ বছর আগের। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ‘আইলা’ নামের যে ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হেনেছিল তার পরবর্তী প্রাকৃতিক পরিস্থিতি এবং সে পরিস্থিতির বিপরীতে জীবনজয়ী মানুষের সংগ্রামই ছবিটির প্লট। ছবিটি দেখতে দেখতে প্লট, ক্যামেরা আর নির্মাতার অভূতপূর্ব রসায়ন উপভোগ করেন দর্শকেরা।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা তখন তলিয়ে গেছে সাগরের নোনাজলে। ঘরবাড়ি, অফিস, স্কুল, দোকানপাট, খেলার মাঠ, বাগান, চাষের জমি সবকিছু অধিকার করেছে সাগরজল। খুলনার ভদ্রাপাড়ের ছোট্ট সুতারখালি গ্রাম তারই একটি। হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে বেড়িবাঁধের উপর। মাসের পর মাস সেই বাঁধে চালাঘর তুলে বাস করছে ঘরহারা মানুষ। বাঁধই যেন জলবক্ষে মাথা তুলে থাকা একখানা জনাকীর্ণ দ্বীপ। একখানা বিশ্বমানচিত্র। সেখানে বিপন্ন মানুষের দুর্দশা বাড়ে দিনদিন। বাঁধ নির্মাণে প্রশাসনের গড়িমসির কারণে সে দুর্দশা দীর্ঘতর হয়। আইলাবিধ্বস্ত বিপন্ন মানুষগুলো স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির লোভনীয় ইস্যুতে পরিণত হয়। বিপন্ন মানুষগুলো তো কেবলই মানুষ নয়, আন্তর্জাতিক বাজারের ‘কনজিয়্যুমার’ও বটে। ফলে কনজিয়ুমারকে বিপন্নাবস্থা থেকে বাঁচানো আন্তর্জাতিক দায়িত্ব তো বটেই, একইসঙ্গে এ বিষয়ে বহির্বিশ্বের সঙ্গে সরকারের তদ্বিরের বিষয়টিও জড়িত। সেই সঙ্গে এনজিও আসবে, প্রকল্প তৈরি করবে, সরকারি হর্তা-কর্তা, রাজনৈতিক হোমরা-চোমরারা আসবে, ভোটের সমীকরণ মেলাবে—এতসব জটিলতা পার হয়েই সুতারখালি গ্রামে আসবে ত্রাণ, বাঁধ নির্মাণের জন্য আসবে বরাদ্দ! সে তো দিল্লীদূর ব্যাপারস্যাপার! সুতারখালীর বিপন্ন মানুষগুলো বুঝে ফেলে তারা কেবল দুর্যোগ কবলিত মানুষ নয়, তারা ‘সংখ্যায়’ পরিণত হয়ে যাচ্ছে। এরপরও তাদের উপায়ন্ত নেই। এইসব মেনে নিয়েই ঝড়ে ভিজে, রোদে পুড়ে টানা দুইটি বছর কাটায় বেড়িবাঁধের উপর।
সৌমেন, রাখী এবং তাদের শিশুসন্তান রাহুল-এর গল্পসূত্র দিয়ে গাঁথা হয়েছে সুতারখালির সমগ্র বিপন্ন মানুষের সহস্র গল্পকে। জলোচ্ছ্বাসে গৃহহারা সৌমেন-রাখি ও রাহুলরা অপেক্ষার প্রহর গুনছে কখন জল নেমে যাবে। জল ফুঁড়ে উৎকীর্ণ হবে তাদের ভিটেমাটি, জমি-জমা, খেত, পেয়ারা বাগান, খেলার মাঠ, পুকুর। গ্রীষ্ম যায়, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত যায়, শৈতপ্রবাহে কেঁপে ওঠে জনপদ। ফিকে বসন্তও লুপ্ত হয় নোনা হাওয়ায়। কিন্তু জল তো নামে না। দেশি-বিদেশি ত্রাণ লুটে খায় বাগঢাসে। জলবায়ু ব্যবসার বিশ্বব্যাপারীরা আন্তর্জাতিক সেমিনার সিম্পোজিয়াম ডাকে, বাগিয়ে নেয় নানা প্রকল্প। সুতারখালির চারিদিকে জল, অথচ পানের যোগ্য জল নেই কোথাও। এ যেন জলের মরুভূমি! ত্রাণের জলের জন্য মানুষের দীর্ঘ সারি। দীর্ঘ হাহাকার। জলের জন্য আকুতি মানুষের— ‘জল যদি না দ্যাও, তো এক বোতল বিষ কিনি দ্যাও’।
অবশেষে জল আসে জলে ভেসে। কিন্তু সে জল অপ্রতুল! সে জল যে সমস্ত মানুষের তৃষ্ণা মেটাতে অক্ষম। মানুষের মধ্যে ক্ষোভ, আক্ষেপ, বঞ্চনার জ্বালা তীব্রতর হয়। দুর্গত মানুষেরা অনুভব করে একটা দুর্যোগ ওই অঞ্চলের ধনী-গরীব-মধ্যবিত্ত-ভিখিরি সকল মানুষকে সমান করে দিয়েছে। এতসব মানুষের মধ্যে আলাদা করে ‘হতদরিদ্র’ চিহ্নিত করার কোনো সুযোগ নেই। সবাই হতদরিদ্র। সবাই সমান।
এক সন্ধ্যায় চায়ের কাপে ঝড় তুলছে বাঁধবাসী। নিত্যদিনের সুখ-দুঃখ নিয়ে আলাপ করছে টং দোকানে। সেখানে উঠে আসে—মন্ত্রী-এমপি, সরকারি কর্তারা কালোগ্লাসে ঘেরা গাড়িতে চলাফেরা করে, যে কারণে সে গ্লাসের ভেতর দিয়ে তারা মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখতে পায় না। এমন সময় একজন তীব্র আক্রোশে বলে ওঠে— ‘গিলাসটা ভাইঙ্গে দিতে পারেন না?’...কি দুর্দান্ত সে সংলাপ! একটি দুর্যোগ মানুষের শ্রেণিচেতনাকে কতটা প্রখর করতে পারে, তার উৎকৃষ্ট মুহূর্ত সে সন্ধ্যার চায়ের দোকানের আড্ডা।
সুতারখালীবাসীর এমন প্রলেতারিয়েত চেতনায় উত্তরণ মূলত আরেকটি মহা-দুর্যোগের আভাস। এ দুর্যোগ লুটপাটের রাষ্ট্র, নগ্ন ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতি, জগদ্দল আমলাতন্ত্র, শ্রেণিবিভক্ত সমাজের উৎপীড়ন থেকে মানুষকে মুক্ত করার এক বাঞ্ছিত দুর্যোগ, যা কথিত রাষ্ট্রের জন্য বিপদসঙ্কেত। এজন্য আমরা দেখি, সচেতন রাষ্ট্র খুব সচেতনভাবেই সুতারখালীর প্রজন্মকে রাষ্ট্রের প্রতি আনগুত্য ও নাগরিকের কর্তব্যের পাঠ দিতে ভোলে না। অথচ এমন দুর্দশায়ও রাখিকে ক্ষুদ্রঋণের কিস্তি শোধ করতে হয়। আর ক’য় টাকা কম পড়েছে বলে মাঠকর্মীর নসিহতের শেষ নেই।
সুতারখালীর মানুষ মূলত বিশ্বমানুষ। রেডিওতে কোপেনহেগেনের জলবায়ু সম্মেলনের খবরও তারা শোনে। ক্যাসেটপ্লেয়ারে বাজায় ‘চেওনা সুনয়না এ নয়নপানে’। সুতারখালির মানুষ কেবলই সুতারখালীতেই বন্দি থাকে না। তাদের ভাষ্যেই উঠে আসে—তারা ঢাকা পর্যন্তও যেতে পারে! সুতারখালীর মানুষের প্রচণ্ড আত্মসম্মানবোধ। তারা রিলিফকে ভিক্ষাজ্ঞান করে। তারা না পারতে রিলিফের লাইনে দাঁড়াচ্ছে। সুতারখালীর মানুষ আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের খেলা দেখে। আর্জেন্টিনা ব্রাজিলের পতাকা উড়ায় আকাশে। আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলে ভাগ হয়ে তারা ফুটবল খেলায় মেতে উঠে। পুরস্কার জেতে। তারা ফুটবেল খেলার আসর ভাঙে সাকিরার ‘ওয়াকা ওয়াকা’ গান শুনে। তারা সমস্ত দুর্যোগ-দুর্বিপাকেও জীবনের রস আস্বাদনে ভুলে না। তারা নাচে, গায়, ঝগড়া করে। আর বিশাল মেঘমেদুর আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে উপভোগ করে ঐক্যের স্পর্ধা। সুতারখালি আমাদের গ্রাম, সবার গ্রাম হয়ে উঠে।
বোদ্ধামহলে ছবিটি নিয়ে আলোচনা হয়। একটি সাধারণ ‘ছবি’ নিয়ে এত আলোচনার কি আছে? প্রশ্নটা একান্তই আমার। ফলে আমার মতো করেই এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হয়েছে। ছবিটি ‘খোলাবাজারে’ নেই। কোনো প্রতিষ্ঠান, চলচ্চিত্র হিতৈষী কোনো সংগঠন বা নির্মাতা নিজের উদ্যোগে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করলেই কেবল ছবিটি দেখার সুযোগ মেলে। বার কয়েক সে সুযোগ পেয়েমাত্র আর হাতছাড়া করিনি। টানা ৯০ মিনিটের ছবির প্রতিটি দৃশ্যই বিস্ময়-বিমুগ্ধ চোখে দেখেছি। ছবিটিতে ছবিটির নেপথ্যে কামার আহমাদ সাইমনের দীর্ঘ প্রস্তুতি ও সঙ্কল্প পরিস্ফুট হয়েছে। দেখতে দেখতে মনে হয়েছে, সাইমন বিদ্যমান বাংলাদেশের এক উৎকৃষ্ট রূপক হাজির করেছেন। কিন্তু এ রূপক কেবলই রূপক (মেটাফোর) নয়। এ রূপক এক জ্বলন্ত বাস্তবতা। আগুনের রূপক কেবল যে আগুনই হয় তা-ই তিনি দেখিয়েছেন। দেখিয়েছেন জীবনের রূপক কেবল জীবনই হতে পারে। ফলে তিনি ছবিতে কোনো গল্প হাজির করেননি। কেবলই তার ক্যামেরায় বন্দি করেছেন এক অমোঘ ও অকৃত্রিম জীবনকে। গল্পে জীবন বা জীবনের স্বাদ নাও থাকতে পারে। কিন্তু জীবনে তো গল্পের শেষ নেই। সেইসব গল্প—যা মানুষকে জীবনের মুখোমুখী করে, জীবন-সংগ্রামে প্রতিমুহূর্তে তাড়া দিয়ে বেড়ায়। ‘শুনতে কি পাও’ যে জীবনকে উপস্থাপন করে সেখানে সেই অজস্র, অশেষ, অসীম ও অনুল্লেখ গল্পগুলো ‘ইলিশফাইল’ দিয়ে আছে। সে গল্পের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে অভাবিত সব ‘মেটাফোর’। ছবিটিতে বিপণ্নতার রূপকগুলো যে মাত্রিকতা পেয়েছে, যে সুরে বা ভাষায় গাঁথা হয়েছে তা অভূতপূর্ব। বাংলা চলচ্চিত্রে ভাষা অভিনব। অথচ তথাকথিত ‘মেসেজ’ বা ‘বক্তব্যকে’ আয়োজন করে, ঠেসে ধরে গেলানোর প্রবণতা নেই। নেই নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের প্রবণতাও। কত বিচিত্র কায়দায় ক্যামেরা ছুটেছে, কত কৌশলে ধারণ করা হচ্ছে সোমেন-রাখি-রাহুলের একেকটা মুহূর্ত—তা এক অপার বিস্ময়ের যোগান দেবে। না কাহিনীচিত্র না প্রামান্যচিত্র—এমন একটি প্যারাডক্সের ভেতর দিয়ে গোটা চলচ্চিত্রটি উপভোগ্য হয়ে উঠবে। এর বিষয়বস্তু, রঙ, বৈশিষ্ট্য, আখ্যানধর্মীতা, ভাষা, নির্মাণপ্রকৌশলের অভিনবত্ব দর্শককে এমন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাবে,যে কামার আহমাদ সাইমন শেষতক আমাদের কী শোনাতে চেয়েছেন? কেবলই বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলে আইলাবিধ্বস্ত এক জনপদের গল্প? নাকি জীবন?
মূলত ‘জীবন’ শব্দটাই এখানে যুৎসই। ঘটনা এখানে জীবনের উপলক্ষ, গল্প না থাকলেও জীবন এক প্রবহমান সুন্দর অথবা গল্প জীবনের চেয়ে অধিক কিছু নয়, এমন স্বভাব-সত্যই এ ছবির অন্যতম দিক। জীবন যে কত মহত্তর, কত মহিমায় উৎকীর্ণ, কত রঙে সে রঙিন, কত ভাষায় সে প্রকাশিত আর কত সংগ্রামে সে উজ্জীবিত হয় তারই দৃশ্য-দর্শন এই ছবিটি। এই অনুসৃতিতেই খুলনার ভদ্রা নদীর পাড়ের ছোট্ট সুতারখালী গ্রাম হয়ে উঠে ‘বাংলাদেশের’ যথাযথ রূপক। সাইমন যে ভঙ্গি বা ভাষায় এবং যে কৌশলে ছবিটি নির্মাণ করেছেন তা আমাদের চলচ্চিত্র অভিধানেও দেবে নতুন সংযুক্তি।
বহুজাতিক আগ্রাসন, সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য, জলবায়ু ব্যবসা, রাষ্ট্রীয় ঔদাসীন্য, আমলাতন্ত্রের জগদ্দল ব্যবস্থা এবং কথিত বিশ্বায়নের বিপরীতে সুতারখালি এক নিঃশব্দ ব্যঙ্গ, সুতারখালিই হয়ে ওঠে বিশ্বব্যবস্থার এক অখণ্ড অংশ, আন্তর্জাতিকতাবাদে দীক্ষিত অনন্য এক জনপদ। নদীমাতৃক জনপদ।
পৃথিবীর সমস্ত নদীই মিশেছে এক অখণ্ড জলধারায়। ‘শুনতে কি পাও’ সেই অখণ্ড জলধারায় প্রবাহিত এক প্রাচীণ নদীর গল্পও যার কলকল ধ্বনিই আমরা শুনতে পাই এখানে। শুনতে পাই মানুষের উৎসব ও মহিমান্বিত জীবনের গল্প। কেননা এখানে প্রতিনিয়ত ‘মৃত্যুর মুখে ঘোষিত হয় বিজয়ী প্রাণের জয়বার্তা’।
No comments