এক ভুবনের দুই বাসিন্দা: যেখানে কেবলই চমক আর বিস্ময় by কাজল ঘোষ
ঘটনাটি
১৯৯৯ সালের। কোনো এক বর্ষণমুখর দিন। ৬২/২, সিদ্ধেশ্বরী। তিনরুমের ছোট্ট
একটি টেলিভিশন অফিস। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ
আবু সায়ীদ এসেছেন। এক কামরাতেই বসে আছেন দুই বন্ধু। একজন ফরিদুর রেজা সাগর
আর অন্যজন শাইখ সিরাজ। চা আসতে আসতেই একজন ইশারা করলেন অন্যজনকে।
চ্যানেল আইয়ের পর্দায় তখন কোনো একটি নাটক চলছিল। হঠাৎ সচকিত চোখ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের। টিভি পর্দায় ঘোষণা, এখন ঝুম বৃষ্টি চলছে। আর এ সময় চলুন একটি বৃষ্টির গান শুনে আসি। সময়ের সঙ্গে চ্যানেল আইয়ের পর্দাও বদলে গেল ইশারাতেই। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ অবাক চাহনিতে বলে ওঠেন, তোমরা এটা কি দেখালে? ঢাকায় বৃষ্টি আর সিঙ্গাপুর থেকে তোমরা কীভাবে বৃষ্টির গান দেখাচ্ছো?
বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়। একই বছরের ঘটনা। চলছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। প্রথমবারের মতো অংশ নেয়ার মর্যাদা পেয়েছে বাংলাদেশ। বাঁচা-মরার লড়াই। সারা দেশ উন্মুখ। হারজিৎ যাই হোক, এটাই শিরোনাম। সকল মিডিয়াতেই ব্যাপক প্রস্তুতি। স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো তখন একরকম সংকটে। কারণ, ট্রান্সমিশন তো বাইরে। চাইলেই যেকোনো অনুষ্ঠান তাৎক্ষণিক প্রচার সম্ভব নয়। কিন্তু কিছুতো চমক থাকতে হবে। আর এই চমকটি কি হবে?
খেলা শেষ, বাংলাদেশ জিতেছে। মিছিলে সয়লাব শহর। চারপাশে লাল সবুজের পতাকা। বিটিভিসহ অন্যান্য টিভি চ্যানেলগুলো তখন ক্যামেরা পাঠিয়েছে দর্শকদের বিজয়োল্লাসের ফুটেজ আনতে। কিন্তু চ্যানেল আইয়ের পর্দায় তখন কেবলই দর্শকদের উল্লাস। বাংলাদেশ বাংলাদেশ জয়ধ্বনি। নড়েচড়ে বসে বিটিভিসহ অন্যরাও। ঘটনা কি? কীভাবে সম্ভব? কি এমন কারিগরি প্রযুক্তি চ্যানেলটির যে, মুহূর্তেই আপডেট। একদিন পরই বিটিভি’র প্রধান প্রধান কুশলীরা চ্যানেল আই পরিদর্শন করতে চলে আসেন। কি আছে তাদের, তা দেখার জন্য। এমন অসংখ্য গল্প। যে গল্পের শেষ নেই। এমন চমক দুই দশক ধরে বিশ্বের ছয়টি মহাদেশের কোটি কোটি দর্শক উপভোগ করছে দুই গুণী মানুষের মুন্সিয়ানায়।
নির্মাণের কারিগর এরাই। একটিই ভুবন। আর এই ভুবনের দুই বাসিন্দা। ফরিদুর রেজা সাগর। শাইখ সিরাজ। দু’জনই স্বমহিমায় উজ্জ্বল। মিডিয়া ক্যারিয়ারের বাইরে একজন শিশু সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র। অন্যজন কৃষি ও উন্নয়ন সাংবাদিকতার দিকপাল। তাদের ঝুলিতে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান পৌঁছেছে অনেক আগেই। কিন্তু আজকের যে দৃপ্ত পদক্ষেপ, সাফল্যের জয়টিকা তার জন্য দিতে হয়েছে দুর্গম অভিজ্ঞতার পথ পাড়ি।
ঢাকা স্টেডিয়ামের পাশে খাবার দাবার পিঠাঘর। বলা যায়, আজকের এই মিডিয়া কর্মযজ্ঞের অভিযাত্রা শুরু সেখান থেকেই। সেখানেই একটি ভিডিও ক্যামেরায় বিয়েসহ নানান অনুষ্ঠানের দৃশ্য ধারণের কাজ চলতো। একই সঙ্গে দুই বন্ধু বিটিভিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান নির্মাণে সম্পৃক্ত ছিলেন। অভিজ্ঞতা আর পারঙ্গমতা চলতে থাকে এভাবেই।
সময়টা নব্বইয়ের দশক। এক আমলার পারিবারিক অনুষ্ঠান কভার করতে ক্যামেরা পাঠিয়েছেন। এডিটিং টেবিলে বসে দেখা গেল সব ফুটেজ লাল হয়ে আছে। এটি ছিল বিয়ের অনুষ্ঠান। কিন্তু তখন তো কিছু করার নেই। কোনোভাবে সম্পাদনা শেষ করে টেপ পাঠিয়ে দিলেন। পরে সেই আমলা ফোন করে ধন্যবাদ জানালেন, বাঃ ভালো হয়েছে। ভিডিওটা একেবারেই রঙিন হয়েছে। এমনই ছিল অভিজ্ঞতা। তা থেকে শিক্ষা নিয়েছেন দু’জনই। চ্যানেল আইয়ের যাত্রা শুরুর প্রথমদিকে এমনও হয়েছে শাইখ সিরাজ শুটিংয়ে যাবেন, ক্যামেরা নেই। অফিসের সিঁড়িতে বসে কেঁদেছেন। আজ দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা প্রযুক্তির সমাহার এই চ্যানেলেই। সাতটি স্টুডিওতে এক সঙ্গে চলে অনুষ্ঠান ধারণের কাজ। দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম আর অগুনতি মানুষের ভালোবাসাতেই এটি সম্ভব হয়েছে মনে করেন দুজনই।
শুরুটা ছিল সময়ের প্রয়োজনে। তখন প্যাকেজ অনুষ্ঠান নির্মাণের হাওয়া চলছে। ইমপ্রেস টেলিফিল্ম প্রচুর অনুষ্ঠান বানাচ্ছে। প্রচারের জায়গা বলতে একটি দু’টি। বিটিভিই মূল ক্ষেত্র। এত অনুষ্ঠান হচ্ছে। প্রচার হবে কোথায়? ফরিদুর রেজা সাগর বরাবরের মতো অভিনব কিছু করতে চান। চ্যালেঞ্জ নিলেন। বললেন, আমাদের নিজস্ব একটি চ্যানেল থাকা দরকার। নামও প্রস্তাব করলেন। তা হবে, ‘চ্যানেল আই’। শাইখ সিরাজ তো ছিলেনই। পূর্ণতা দিতে আরো এগিয়ে এলেন আবদুর রশিদ মজুমদার, এনায়েত হোসেন সিরাজ, জহির উদ্দিন মাহমুদ মামুন, মুকিত মজুমদার বাবু, রিয়াজ আহমেদ খান ও রবিউল ইসলাম। গঠিত হলো বোর্ড অব ডিরেক্টরস। আর পিছে ফেরা নয়। জয়যাত্রা শুরু সেখান থেকেই।
এক হাজার স্কয়ার ফিটের তিন রুম- বেডরুম, ড্রয়িং, আর ডাইনিং এই ছিল অফিস। সিদ্ধেশ্বরীর সেই বাড়িটি আজও আছে। সেখানে জায়গার প্রয়োজনে রান্নাঘরে বসাতে হয়েছে এডিটিং প্যানেল। বহুদিন পর্যন্ত দুই বন্ধুকে এক রুমে বসতে হয়েছে। খাবার ঘরে রেকর্ডিং স্টুডিও আর টয়লেট ভেঙে আর্কাইভ এই ছিল শুরু।
অথচ এই চ্যানেলটিই দেশের মিডিয়ায় অনেক শুরুর কারিগর। জোয়ার-ভাটার মতো প্রতিদিনের ধারাবাহিক নাটক, হৃদয়ে মাটি ও মানুষ, ফিরে চল মাটির টানে, আবৃত্তি ছন্দে আনন্দে, তৃতীয় মাত্রা, সংবাদপত্র নিয়ে মধ্যরাতের আয়োজন ‘আজকের সংবাদপত্র’, প্রকৃতি ও জীবন, তারকাকথন, দেশ-বিদেশের রান্না, খুদে গানরাজ, শুভরাত, দিন প্রতিদিন, ছাদ কৃষির মতো অসাধারণ সব আইডিয়া নিয়ে কাজ করে চলেছে দুই দশক ধরে। দেশ-বিদেশের অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার আর দিনব্যাপী টেলিভিশনে সরাসরি মেলার আয়োজন চ্যানেল আই-ই এদেশে প্রচলন করে। একের পর এক রেকর্ড গড়ে চ্যানেলটি আজ শীর্ষ শিখরে।
লাল সবুজ। দেশমাতৃকা। সবার আগে দেশ। দেশপ্রেমই মূল ভিত্তি। হৃদয়ে বাংলাদেশ। প্রবাসেও বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে পাঠ করেছেন, যা প্রচারিত হয়েছে একমাত্র চ্যানেল আইতেই। অংশ নিয়েছেন চ্যানেল আই আয়োজিত অনুষ্ঠানেও। এক সকালে শত ব্যস্ততাতেও প্রধানমন্ত্রী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে সরাসরি অনুষ্ঠানে ফোনে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন জন্মদিনের। এটি একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। বিরলতম ঘটনা। ঝুলিতে একের পর এক রেকর্ড। ২০০১ সালে শুরু হয় খবর প্রচার। সেবারই নির্বাচন কভার করতে চ্যানেল আই প্রথমবারের মতো হেলিকপ্টার নিয়ে সংবাদ প্রচার করে। প্রতি মুহূর্তের আপডেট জানায় দর্শকদের। একটু একটু করে চ্যানেলটির আজকের এই পথচলা দৃঢ় হয়েছে। গণ আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছেছে আজ এই চ্যানেল। বিশ্বময় বাংলা ভাষাভাষীর স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা আর জীবনধারার প্রিয়সঙ্গী চ্যানেল আই পথচলার বিশ বছর পার করেছে। একুশে পা দিয়েছে।
তারুণ্য পেরিয়ে পরিণত চ্যানেলটি নিয়ে এর কর্ণধার ফরিদুর রেজা সাগর বলেন, টেলিভিশন সঙ্গী করেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছি। চ্যানেল আই কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নয়- সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য সবকিছুর সমাহার। চ্যানেল আই একটি ‘কালচারাল হাব’।
তিনি যোগ করেন, এ ধরনের প্রতিষ্ঠান কোনো মালিকানার বিষয় নয়, দর্শকরাই এর প্রকৃত মালিক। দর্শক পছন্দ করলে হিরো আর না করলে জিরো।
চ্যানেল আইয়ের পরিচালক ও বার্তা প্রধান, কৃষি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ মনে করিয়ে দিলেন মিডিয়ার আগামী দিনের চ্যালেঞ্জের কথা। বললেন, আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অনেক বেশি সৃষ্টিশীল হতে হবে। এক সময় ছিল টেলিভিশন আর অনলাইন একে অন্যের পরিপূরক কিন্তু বর্তমানে তা প্রতিদ্বন্দ্বী। আর অনলাইনে প্রতিমুহূর্তে ব্যক্তি পর্যায় থেকে যে ধরনের কনটেন্ট আপ করা হয় তার কোনো সেন্সর নেই। যে কারও সম্পর্কে যা খুশি লিখে অনলাইনে প্রচার করা যায়, মন্তব্য লিখে দেয়া যায়। আর মানুষ সেন্সরবিহীন বিষয়বস্তু দেখতেই সহনশীল হয়ে উঠছে। এর একটি বড় রকমের ক্ষতিকর দিকও আছে। কিন্তু টেলিভিশন চাইলেই যা খুশি প্রচার করতে পারে না। নীতি মেনে চলতে হয়। সময় বদলাচ্ছে। ফেসবুক প্রধান জাকারবার্গকেও নীতি-নৈতিকতাবিরোধী কনটেন্টের জন্য জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
শাইখ সিরাজ বলেন, বিভিন্ন দেশে নির্বাচনের ফল পরিবর্তনেও হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ উঠছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিরুদ্ধে। অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের চেয়ে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফরম এখন অনেক বেশি শক্তিশালী, এটা তো হতে পারে না। কাজেই লাগাম টেনে ধরা দরকার। টেলিভিশন তার গৌরব নিয়ে ফিরে আসবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু এই স্রোতকে টেনে ধরা দরকার সত্যিকার আদর্শ, মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ বিনির্মাণের স্বার্থেই। দুই দশক। শুধু সময় পরিক্রমা নয়। চ্যানেল আই কুটির শিল্প থেকে মহীরুহ হয়েছে। এক হাজার স্কয়ার ফিট থেকে ৫০ হাজার স্কয়ার ফিট। খাবার ঘরে রেকর্ডিং স্টুডিও থেকে বিশাল আকৃতির সাত স্টুডিও। সিদ্ধেশ্বরীর ভাড়া বাড়ি থেকে তেজগাঁওয়ের সুপরিসর বিশাল ভবন। কর্মী সংখ্যা ৫ জন থেকে পাঁচশ’ ছাড়িয়েছে। ক্ষুদ্র স্টুডিওর ধারণকৃত অনুষ্ঠান ৫৬ হাজার বর্গমাইলের লাল সবুজের আকাশ ছাড়িয়ে ছয়টি মহাদেশে কোটি কোটি দর্শকের অন্তরে পৌঁছেছে।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ দিয়ে শুরু করেছিলাম শেষও করতে চাই তাকে নিয়েই একটি ঘটনার উল্লেখ করে। ২০০১ সালে চ্যানেল আই খবর প্রচারের অনুমতি চাইলে আপত্তি জানায় একুশে টেলিভিশন। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। সে সময় চ্যানেল আইয়ের পাশে দাঁড়ান বিশিষ্টজনেরা। খবর প্রচারে চ্যানেল আইকে সমর্থন জানিয়ে একটি বিবৃতিও প্রচার করেন তারা। তাদের মধ্যে ছিলেন প্রয়াত সব্যসাচী কবি সৈয়দ শামসুল হক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। বিষয়টি নিয়ে একুশে টেলিভিশনের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী সাইমন ড্রিং-এর সঙ্গে বাক্যুদ্ধে জড়িয়ে ছিলেন দুজনেই।
শামসুল হককে সাইমন ড্রিং বলেছিলেন, চ্যানেল আইয়ের পক্ষে বিবৃতি দিয়ে আপনি একটি দরজা বন্ধ করলেন। প্রত্যুত্তরে সৈয়দ হক বলেছিলেন, হকের জন্য কখনো দরজা বন্ধ হয় না। শামসুল হক নিজেই একটি দরজা। একই বিষয়ে ইটিভিতে বসে সাইমন ড্রিং কথা বলছিলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গেও। তিনি বলেছিলেন, চ্যানেল আই এমন একটি চ্যানেল, যেখানে সাগর নিজের চেয়ার ছেড়ে দেয় সকলের জন্য। যেখানে আমি এমন সম্মান পাবো সেটিই আমার চ্যানেল।
দর্শকদের ভালোবাসাই মূল পুঁজি। যা নিয়ে এগিয়ে যেতে চায় চ্যানেল আই। পাড়ি দিতে চায় সাফল্যের পথ। প্রতিষ্ঠা লগ্নে এ প্রত্যাশাই ব্যক্ত করলেন ফরিদুর রেজা সাগর ও শাইখ সিরাজ।
চ্যানেল আইয়ের পর্দায় তখন কোনো একটি নাটক চলছিল। হঠাৎ সচকিত চোখ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের। টিভি পর্দায় ঘোষণা, এখন ঝুম বৃষ্টি চলছে। আর এ সময় চলুন একটি বৃষ্টির গান শুনে আসি। সময়ের সঙ্গে চ্যানেল আইয়ের পর্দাও বদলে গেল ইশারাতেই। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ অবাক চাহনিতে বলে ওঠেন, তোমরা এটা কি দেখালে? ঢাকায় বৃষ্টি আর সিঙ্গাপুর থেকে তোমরা কীভাবে বৃষ্টির গান দেখাচ্ছো?
বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়। একই বছরের ঘটনা। চলছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। প্রথমবারের মতো অংশ নেয়ার মর্যাদা পেয়েছে বাংলাদেশ। বাঁচা-মরার লড়াই। সারা দেশ উন্মুখ। হারজিৎ যাই হোক, এটাই শিরোনাম। সকল মিডিয়াতেই ব্যাপক প্রস্তুতি। স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো তখন একরকম সংকটে। কারণ, ট্রান্সমিশন তো বাইরে। চাইলেই যেকোনো অনুষ্ঠান তাৎক্ষণিক প্রচার সম্ভব নয়। কিন্তু কিছুতো চমক থাকতে হবে। আর এই চমকটি কি হবে?
খেলা শেষ, বাংলাদেশ জিতেছে। মিছিলে সয়লাব শহর। চারপাশে লাল সবুজের পতাকা। বিটিভিসহ অন্যান্য টিভি চ্যানেলগুলো তখন ক্যামেরা পাঠিয়েছে দর্শকদের বিজয়োল্লাসের ফুটেজ আনতে। কিন্তু চ্যানেল আইয়ের পর্দায় তখন কেবলই দর্শকদের উল্লাস। বাংলাদেশ বাংলাদেশ জয়ধ্বনি। নড়েচড়ে বসে বিটিভিসহ অন্যরাও। ঘটনা কি? কীভাবে সম্ভব? কি এমন কারিগরি প্রযুক্তি চ্যানেলটির যে, মুহূর্তেই আপডেট। একদিন পরই বিটিভি’র প্রধান প্রধান কুশলীরা চ্যানেল আই পরিদর্শন করতে চলে আসেন। কি আছে তাদের, তা দেখার জন্য। এমন অসংখ্য গল্প। যে গল্পের শেষ নেই। এমন চমক দুই দশক ধরে বিশ্বের ছয়টি মহাদেশের কোটি কোটি দর্শক উপভোগ করছে দুই গুণী মানুষের মুন্সিয়ানায়।
নির্মাণের কারিগর এরাই। একটিই ভুবন। আর এই ভুবনের দুই বাসিন্দা। ফরিদুর রেজা সাগর। শাইখ সিরাজ। দু’জনই স্বমহিমায় উজ্জ্বল। মিডিয়া ক্যারিয়ারের বাইরে একজন শিশু সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র। অন্যজন কৃষি ও উন্নয়ন সাংবাদিকতার দিকপাল। তাদের ঝুলিতে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান পৌঁছেছে অনেক আগেই। কিন্তু আজকের যে দৃপ্ত পদক্ষেপ, সাফল্যের জয়টিকা তার জন্য দিতে হয়েছে দুর্গম অভিজ্ঞতার পথ পাড়ি।
ঢাকা স্টেডিয়ামের পাশে খাবার দাবার পিঠাঘর। বলা যায়, আজকের এই মিডিয়া কর্মযজ্ঞের অভিযাত্রা শুরু সেখান থেকেই। সেখানেই একটি ভিডিও ক্যামেরায় বিয়েসহ নানান অনুষ্ঠানের দৃশ্য ধারণের কাজ চলতো। একই সঙ্গে দুই বন্ধু বিটিভিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান নির্মাণে সম্পৃক্ত ছিলেন। অভিজ্ঞতা আর পারঙ্গমতা চলতে থাকে এভাবেই।
সময়টা নব্বইয়ের দশক। এক আমলার পারিবারিক অনুষ্ঠান কভার করতে ক্যামেরা পাঠিয়েছেন। এডিটিং টেবিলে বসে দেখা গেল সব ফুটেজ লাল হয়ে আছে। এটি ছিল বিয়ের অনুষ্ঠান। কিন্তু তখন তো কিছু করার নেই। কোনোভাবে সম্পাদনা শেষ করে টেপ পাঠিয়ে দিলেন। পরে সেই আমলা ফোন করে ধন্যবাদ জানালেন, বাঃ ভালো হয়েছে। ভিডিওটা একেবারেই রঙিন হয়েছে। এমনই ছিল অভিজ্ঞতা। তা থেকে শিক্ষা নিয়েছেন দু’জনই। চ্যানেল আইয়ের যাত্রা শুরুর প্রথমদিকে এমনও হয়েছে শাইখ সিরাজ শুটিংয়ে যাবেন, ক্যামেরা নেই। অফিসের সিঁড়িতে বসে কেঁদেছেন। আজ দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা প্রযুক্তির সমাহার এই চ্যানেলেই। সাতটি স্টুডিওতে এক সঙ্গে চলে অনুষ্ঠান ধারণের কাজ। দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম আর অগুনতি মানুষের ভালোবাসাতেই এটি সম্ভব হয়েছে মনে করেন দুজনই।
শুরুটা ছিল সময়ের প্রয়োজনে। তখন প্যাকেজ অনুষ্ঠান নির্মাণের হাওয়া চলছে। ইমপ্রেস টেলিফিল্ম প্রচুর অনুষ্ঠান বানাচ্ছে। প্রচারের জায়গা বলতে একটি দু’টি। বিটিভিই মূল ক্ষেত্র। এত অনুষ্ঠান হচ্ছে। প্রচার হবে কোথায়? ফরিদুর রেজা সাগর বরাবরের মতো অভিনব কিছু করতে চান। চ্যালেঞ্জ নিলেন। বললেন, আমাদের নিজস্ব একটি চ্যানেল থাকা দরকার। নামও প্রস্তাব করলেন। তা হবে, ‘চ্যানেল আই’। শাইখ সিরাজ তো ছিলেনই। পূর্ণতা দিতে আরো এগিয়ে এলেন আবদুর রশিদ মজুমদার, এনায়েত হোসেন সিরাজ, জহির উদ্দিন মাহমুদ মামুন, মুকিত মজুমদার বাবু, রিয়াজ আহমেদ খান ও রবিউল ইসলাম। গঠিত হলো বোর্ড অব ডিরেক্টরস। আর পিছে ফেরা নয়। জয়যাত্রা শুরু সেখান থেকেই।
এক হাজার স্কয়ার ফিটের তিন রুম- বেডরুম, ড্রয়িং, আর ডাইনিং এই ছিল অফিস। সিদ্ধেশ্বরীর সেই বাড়িটি আজও আছে। সেখানে জায়গার প্রয়োজনে রান্নাঘরে বসাতে হয়েছে এডিটিং প্যানেল। বহুদিন পর্যন্ত দুই বন্ধুকে এক রুমে বসতে হয়েছে। খাবার ঘরে রেকর্ডিং স্টুডিও আর টয়লেট ভেঙে আর্কাইভ এই ছিল শুরু।
অথচ এই চ্যানেলটিই দেশের মিডিয়ায় অনেক শুরুর কারিগর। জোয়ার-ভাটার মতো প্রতিদিনের ধারাবাহিক নাটক, হৃদয়ে মাটি ও মানুষ, ফিরে চল মাটির টানে, আবৃত্তি ছন্দে আনন্দে, তৃতীয় মাত্রা, সংবাদপত্র নিয়ে মধ্যরাতের আয়োজন ‘আজকের সংবাদপত্র’, প্রকৃতি ও জীবন, তারকাকথন, দেশ-বিদেশের রান্না, খুদে গানরাজ, শুভরাত, দিন প্রতিদিন, ছাদ কৃষির মতো অসাধারণ সব আইডিয়া নিয়ে কাজ করে চলেছে দুই দশক ধরে। দেশ-বিদেশের অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার আর দিনব্যাপী টেলিভিশনে সরাসরি মেলার আয়োজন চ্যানেল আই-ই এদেশে প্রচলন করে। একের পর এক রেকর্ড গড়ে চ্যানেলটি আজ শীর্ষ শিখরে।
লাল সবুজ। দেশমাতৃকা। সবার আগে দেশ। দেশপ্রেমই মূল ভিত্তি। হৃদয়ে বাংলাদেশ। প্রবাসেও বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে পাঠ করেছেন, যা প্রচারিত হয়েছে একমাত্র চ্যানেল আইতেই। অংশ নিয়েছেন চ্যানেল আই আয়োজিত অনুষ্ঠানেও। এক সকালে শত ব্যস্ততাতেও প্রধানমন্ত্রী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে সরাসরি অনুষ্ঠানে ফোনে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন জন্মদিনের। এটি একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। বিরলতম ঘটনা। ঝুলিতে একের পর এক রেকর্ড। ২০০১ সালে শুরু হয় খবর প্রচার। সেবারই নির্বাচন কভার করতে চ্যানেল আই প্রথমবারের মতো হেলিকপ্টার নিয়ে সংবাদ প্রচার করে। প্রতি মুহূর্তের আপডেট জানায় দর্শকদের। একটু একটু করে চ্যানেলটির আজকের এই পথচলা দৃঢ় হয়েছে। গণ আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছেছে আজ এই চ্যানেল। বিশ্বময় বাংলা ভাষাভাষীর স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা আর জীবনধারার প্রিয়সঙ্গী চ্যানেল আই পথচলার বিশ বছর পার করেছে। একুশে পা দিয়েছে।
তারুণ্য পেরিয়ে পরিণত চ্যানেলটি নিয়ে এর কর্ণধার ফরিদুর রেজা সাগর বলেন, টেলিভিশন সঙ্গী করেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছি। চ্যানেল আই কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নয়- সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য সবকিছুর সমাহার। চ্যানেল আই একটি ‘কালচারাল হাব’।
তিনি যোগ করেন, এ ধরনের প্রতিষ্ঠান কোনো মালিকানার বিষয় নয়, দর্শকরাই এর প্রকৃত মালিক। দর্শক পছন্দ করলে হিরো আর না করলে জিরো।
চ্যানেল আইয়ের পরিচালক ও বার্তা প্রধান, কৃষি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ মনে করিয়ে দিলেন মিডিয়ার আগামী দিনের চ্যালেঞ্জের কথা। বললেন, আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অনেক বেশি সৃষ্টিশীল হতে হবে। এক সময় ছিল টেলিভিশন আর অনলাইন একে অন্যের পরিপূরক কিন্তু বর্তমানে তা প্রতিদ্বন্দ্বী। আর অনলাইনে প্রতিমুহূর্তে ব্যক্তি পর্যায় থেকে যে ধরনের কনটেন্ট আপ করা হয় তার কোনো সেন্সর নেই। যে কারও সম্পর্কে যা খুশি লিখে অনলাইনে প্রচার করা যায়, মন্তব্য লিখে দেয়া যায়। আর মানুষ সেন্সরবিহীন বিষয়বস্তু দেখতেই সহনশীল হয়ে উঠছে। এর একটি বড় রকমের ক্ষতিকর দিকও আছে। কিন্তু টেলিভিশন চাইলেই যা খুশি প্রচার করতে পারে না। নীতি মেনে চলতে হয়। সময় বদলাচ্ছে। ফেসবুক প্রধান জাকারবার্গকেও নীতি-নৈতিকতাবিরোধী কনটেন্টের জন্য জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
শাইখ সিরাজ বলেন, বিভিন্ন দেশে নির্বাচনের ফল পরিবর্তনেও হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ উঠছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিরুদ্ধে। অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের চেয়ে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফরম এখন অনেক বেশি শক্তিশালী, এটা তো হতে পারে না। কাজেই লাগাম টেনে ধরা দরকার। টেলিভিশন তার গৌরব নিয়ে ফিরে আসবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু এই স্রোতকে টেনে ধরা দরকার সত্যিকার আদর্শ, মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ বিনির্মাণের স্বার্থেই। দুই দশক। শুধু সময় পরিক্রমা নয়। চ্যানেল আই কুটির শিল্প থেকে মহীরুহ হয়েছে। এক হাজার স্কয়ার ফিট থেকে ৫০ হাজার স্কয়ার ফিট। খাবার ঘরে রেকর্ডিং স্টুডিও থেকে বিশাল আকৃতির সাত স্টুডিও। সিদ্ধেশ্বরীর ভাড়া বাড়ি থেকে তেজগাঁওয়ের সুপরিসর বিশাল ভবন। কর্মী সংখ্যা ৫ জন থেকে পাঁচশ’ ছাড়িয়েছে। ক্ষুদ্র স্টুডিওর ধারণকৃত অনুষ্ঠান ৫৬ হাজার বর্গমাইলের লাল সবুজের আকাশ ছাড়িয়ে ছয়টি মহাদেশে কোটি কোটি দর্শকের অন্তরে পৌঁছেছে।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ দিয়ে শুরু করেছিলাম শেষও করতে চাই তাকে নিয়েই একটি ঘটনার উল্লেখ করে। ২০০১ সালে চ্যানেল আই খবর প্রচারের অনুমতি চাইলে আপত্তি জানায় একুশে টেলিভিশন। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। সে সময় চ্যানেল আইয়ের পাশে দাঁড়ান বিশিষ্টজনেরা। খবর প্রচারে চ্যানেল আইকে সমর্থন জানিয়ে একটি বিবৃতিও প্রচার করেন তারা। তাদের মধ্যে ছিলেন প্রয়াত সব্যসাচী কবি সৈয়দ শামসুল হক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। বিষয়টি নিয়ে একুশে টেলিভিশনের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী সাইমন ড্রিং-এর সঙ্গে বাক্যুদ্ধে জড়িয়ে ছিলেন দুজনেই।
শামসুল হককে সাইমন ড্রিং বলেছিলেন, চ্যানেল আইয়ের পক্ষে বিবৃতি দিয়ে আপনি একটি দরজা বন্ধ করলেন। প্রত্যুত্তরে সৈয়দ হক বলেছিলেন, হকের জন্য কখনো দরজা বন্ধ হয় না। শামসুল হক নিজেই একটি দরজা। একই বিষয়ে ইটিভিতে বসে সাইমন ড্রিং কথা বলছিলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গেও। তিনি বলেছিলেন, চ্যানেল আই এমন একটি চ্যানেল, যেখানে সাগর নিজের চেয়ার ছেড়ে দেয় সকলের জন্য। যেখানে আমি এমন সম্মান পাবো সেটিই আমার চ্যানেল।
দর্শকদের ভালোবাসাই মূল পুঁজি। যা নিয়ে এগিয়ে যেতে চায় চ্যানেল আই। পাড়ি দিতে চায় সাফল্যের পথ। প্রতিষ্ঠা লগ্নে এ প্রত্যাশাই ব্যক্ত করলেন ফরিদুর রেজা সাগর ও শাইখ সিরাজ।
No comments