উগ্র সহিংসতার প্রতি নিরব সমর্থন দিয়ে অপরাধবোধ ঘুচাচ্ছে ভারতীয় সমাজ by অজয় গুদাভারতী
ইহুদি
রাজনৈতিক দার্শনিক হান্নাহ আরেন্ত একটা ধারণা তুলে ধরেছেন যেটাকে তিনি
বলেছেন ‘ব্যানালিটি অব ইভিল’। লেফটেন্যান্ট কর্নেল অ্যাডলফ আইখম্যান যে সব
অপরাধ করেছিল, সেগুলোর উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি এই শব্দ ব্যবহার করেছেন। তার
মতে, আইখম্যান কোন ‘দৈত্য’ বা ইহুদিবিরোধী ছিল না বরং আদর্শহীন ক্যারিয়ার
গড়ার জন্য এক ধরনের বাধ্যবাধকতা থেকে সে এই কাজ করেছিল।
আরেন্তের যুক্তি হলো ‘ভালো মৌলবাদী হতে পারে। অশুভ শক্তি কখনও মৌলবাদী হতে পারে না, তারা শুধু চরমতর হতে পারে, কারণ তাদের মধ্যে কোন গভীরতা বা অন্য কোন মাত্রা নেই। এরপরও – এবং এটাই আতঙ্কের বিষয় যে – পৃথিবী পৃষ্ঠে এটা ব্যাঙের ছাতার তো ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং পুরো পৃথিবীকে নোংরা করে দিতে পারে। চিন্তার ব্যর্থতা থেকেই এই অশুভ আসে”।
এর আরেকটি মাত্রা রয়েছে। সহিংসতার কাজটা গতানুগতিক হতে পারে, কিন্তু এ ধরনের কাজের ব্যাপারে যে সমর্থন তৈরি হয়েছে, সেটা চিন্তা করে ঠিক করা হয়েছে। গত পাঁচ বছরে আমরা ভারতে যে সহিংসতা দেখেছে, তার ক্ষেত্রে এটা সত্য: ভারতজুড়ে উগ্র সহিংসতা, জম্মু ও কাশ্মীরে আট বছর বয়সী বালিকাকে ধর্ষণ, দেশের বিভিন্ন জায়গায় দলিতদের উপর নির্যাতন। এমনকি সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক মানুষদের বিরুদ্ধে আপত্তিকর ভাষা ব্যবহার এবং তাদের হয়রানি করার যে মাত্রা বেড়ে গেছে, সেটার ব্যাপারেও এক ধরনের সমর্থন তৈরি হয়েছে।
সম্মিলিত কৃতজ্ঞতা
বহু ঘটনায় যারা এ ধরনের সহিংসতা ঘটাচ্ছে, তারা কোন ধরনের বিতর্কের মুখে পড়ছে না, বরং তাদের প্রতি যেন সম্মিলিতভাবে কৃতজ্ঞতা জানানো হচ্ছে। এই ধরনের সহিংসতার স্বীকৃতি এবং এমনকি সেটা উদযাপন পর্যন্ত করা হচ্ছে। অপরাধীরা যখন জামিনে মুক্ত হচ্ছে, তখন উদযাপন করা হচ্ছে অথবা তারা মারা গেলে কফিনে জাতীয় পতাকায় মুড়ে দেয়া হচ্ছে। তাদের কর্মকাণ্ডকে যদি সম্প্রদায়ের বড় একটা অংশ শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে না দেখতো, তাহলে এগুলো সম্ভব হতো না। এই কৃতজ্ঞতার কারণ হলো যাদের তরফ থেকে তারা এই সহিংসতা চালিয়েছে, তারা এক ধরনের দায়মুক্তি বোধ করেছেন।
যদিও নিজেদের অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রক্রিয়া চলছে, কিন্তু এখনও এটা স্পষ্ট নয় যে, এই সম্মতি জানানোর মাত্রাটা কতটা ব্যাপক ও গভীর। এখানে সুষ্পষ্ট চিহ্ন বা প্রমাণ কি হতে পারে?
২০১৫ সালে আমি যখন নাৎসি কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্প পরিদর্শন করি, তখন যাদুঘরের একজন তরুণ কিউরেটরের সাথে কথা বলেছিলাম আমি। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, নাৎসীরা যে ইহুদিদের হত্যা করেছিল, সেটা না হয় বোঝা গেলো, কিন্তু নাৎসীদের হাতে নিজেদের প্রতিবন্ধী শিশুদের হত্যার বিষয়টি জার্মানির মানুষেরা কিভাবে মেনে নিয়েছিল?
কিউরেটর বললেন, তাদের গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই প্রতিবন্ধী শিশুদের হত্যার ব্যাপারে তাদের বাবা-মায়েদের এক ধরনের নিরব সম্মতি ছিল। হত্যাকারীদের তারা ত্রাতা হিসেবে দেখেছিল।
সহিংসতার স্বাভাবিকীকরণ
আজকের ভারতে যেভাবে সহিংসতাকে স্বাভাবিক করে তোলা হচ্ছে, সেখানে এই মনোভাবের একটা প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে। মুসলিম, দলিত, নারী, অভিবাসী, শহুরে দরিদ্র মানুষ ও শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে যেভাবে ঘন ঘন সহিংসতার ঘটনা ঘটছে, সেগুলোর ব্যাপারে যেন এক ধরনের নিরব সমর্থন দেয়া হচ্ছে। শুধুমাত্র আতঙ্ক দিয়ে এই বিষয়টির ব্যাখ্যা করা যাবে না। এই ধরনের সহিংসতার সাথে যারা জড়িত, তাদেরকে সম্মান জানানো, উদযাপন করা, নির্বাচনে তাদেরকে বড় ব্যাবধানে বিজয়ী করা এবং এমনকি তাদেরকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি শুধুমাত্র ভীতির সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। এটা সহিংসতার প্রতি এক ধরনের ছাড়পত্র দিয়ে দেয়া। যারা এ ধরনের সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েছে, তাদের প্রতি যেন এখানে এক ধরনের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হচ্ছে, কারণ তারা যেন আমাদের সম্মিলিত আত্মপরিচয় রক্ষায় যারা হুমকি, তাদের রক্তপাত করে সবার পক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করছে।
আরেন্তের যুক্তি হলো ‘ভালো মৌলবাদী হতে পারে। অশুভ শক্তি কখনও মৌলবাদী হতে পারে না, তারা শুধু চরমতর হতে পারে, কারণ তাদের মধ্যে কোন গভীরতা বা অন্য কোন মাত্রা নেই। এরপরও – এবং এটাই আতঙ্কের বিষয় যে – পৃথিবী পৃষ্ঠে এটা ব্যাঙের ছাতার তো ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং পুরো পৃথিবীকে নোংরা করে দিতে পারে। চিন্তার ব্যর্থতা থেকেই এই অশুভ আসে”।
এর আরেকটি মাত্রা রয়েছে। সহিংসতার কাজটা গতানুগতিক হতে পারে, কিন্তু এ ধরনের কাজের ব্যাপারে যে সমর্থন তৈরি হয়েছে, সেটা চিন্তা করে ঠিক করা হয়েছে। গত পাঁচ বছরে আমরা ভারতে যে সহিংসতা দেখেছে, তার ক্ষেত্রে এটা সত্য: ভারতজুড়ে উগ্র সহিংসতা, জম্মু ও কাশ্মীরে আট বছর বয়সী বালিকাকে ধর্ষণ, দেশের বিভিন্ন জায়গায় দলিতদের উপর নির্যাতন। এমনকি সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক মানুষদের বিরুদ্ধে আপত্তিকর ভাষা ব্যবহার এবং তাদের হয়রানি করার যে মাত্রা বেড়ে গেছে, সেটার ব্যাপারেও এক ধরনের সমর্থন তৈরি হয়েছে।
সম্মিলিত কৃতজ্ঞতা
বহু ঘটনায় যারা এ ধরনের সহিংসতা ঘটাচ্ছে, তারা কোন ধরনের বিতর্কের মুখে পড়ছে না, বরং তাদের প্রতি যেন সম্মিলিতভাবে কৃতজ্ঞতা জানানো হচ্ছে। এই ধরনের সহিংসতার স্বীকৃতি এবং এমনকি সেটা উদযাপন পর্যন্ত করা হচ্ছে। অপরাধীরা যখন জামিনে মুক্ত হচ্ছে, তখন উদযাপন করা হচ্ছে অথবা তারা মারা গেলে কফিনে জাতীয় পতাকায় মুড়ে দেয়া হচ্ছে। তাদের কর্মকাণ্ডকে যদি সম্প্রদায়ের বড় একটা অংশ শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে না দেখতো, তাহলে এগুলো সম্ভব হতো না। এই কৃতজ্ঞতার কারণ হলো যাদের তরফ থেকে তারা এই সহিংসতা চালিয়েছে, তারা এক ধরনের দায়মুক্তি বোধ করেছেন।
যদিও নিজেদের অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রক্রিয়া চলছে, কিন্তু এখনও এটা স্পষ্ট নয় যে, এই সম্মতি জানানোর মাত্রাটা কতটা ব্যাপক ও গভীর। এখানে সুষ্পষ্ট চিহ্ন বা প্রমাণ কি হতে পারে?
২০১৫ সালে আমি যখন নাৎসি কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্প পরিদর্শন করি, তখন যাদুঘরের একজন তরুণ কিউরেটরের সাথে কথা বলেছিলাম আমি। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, নাৎসীরা যে ইহুদিদের হত্যা করেছিল, সেটা না হয় বোঝা গেলো, কিন্তু নাৎসীদের হাতে নিজেদের প্রতিবন্ধী শিশুদের হত্যার বিষয়টি জার্মানির মানুষেরা কিভাবে মেনে নিয়েছিল?
কিউরেটর বললেন, তাদের গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই প্রতিবন্ধী শিশুদের হত্যার ব্যাপারে তাদের বাবা-মায়েদের এক ধরনের নিরব সম্মতি ছিল। হত্যাকারীদের তারা ত্রাতা হিসেবে দেখেছিল।
সহিংসতার স্বাভাবিকীকরণ
আজকের ভারতে যেভাবে সহিংসতাকে স্বাভাবিক করে তোলা হচ্ছে, সেখানে এই মনোভাবের একটা প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে। মুসলিম, দলিত, নারী, অভিবাসী, শহুরে দরিদ্র মানুষ ও শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে যেভাবে ঘন ঘন সহিংসতার ঘটনা ঘটছে, সেগুলোর ব্যাপারে যেন এক ধরনের নিরব সমর্থন দেয়া হচ্ছে। শুধুমাত্র আতঙ্ক দিয়ে এই বিষয়টির ব্যাখ্যা করা যাবে না। এই ধরনের সহিংসতার সাথে যারা জড়িত, তাদেরকে সম্মান জানানো, উদযাপন করা, নির্বাচনে তাদেরকে বড় ব্যাবধানে বিজয়ী করা এবং এমনকি তাদেরকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি শুধুমাত্র ভীতির সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। এটা সহিংসতার প্রতি এক ধরনের ছাড়পত্র দিয়ে দেয়া। যারা এ ধরনের সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েছে, তাদের প্রতি যেন এখানে এক ধরনের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হচ্ছে, কারণ তারা যেন আমাদের সম্মিলিত আত্মপরিচয় রক্ষায় যারা হুমকি, তাদের রক্তপাত করে সবার পক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করছে।
No comments