ফরিদপুরে দুই ভাইয়ের ত্রাসের রাজত্ব by মোহাম্মদ ওমর ফারুক
এক
রাজ্যে দুই রাজা। গোটা রাজত্বেই চলছে তাদের খবরদারি। কুশাসন আর নির্যাতন।
ভয়ে-আতঙ্কে নীরব সবাই। এ দুই রাজা হলেন- আপন দুই ভাই। এখন রাজ্য শাসন করলেও
এক সময় তারা বাস-ট্রাকের হেলপারের কাজ করেছেন। ছিলেন অন্যের দোকানের
কর্মচারি। কোন মতে জীবন চলতো তাদের।
আর এখন তাদের আলিশান জীবন। চলেন দামি গাড়িতে। তাদের কথার বাইরে যাওয়ার সাহস নেই কারও। বলতে গেলে পুরো জেলা শহর তাদের নিয়ন্ত্রণে। নানা অপকর্ম জোর জবরদস্তি করে নিজেদের কব্জায় নিয়েছেন অন্যের বাড়ি, দোকান, জমি। তাদের ইশারা ছাড়া ফরিদপুর শহরে কিছুই নড়ে না। সাধারণ জীবন থেকে রাজনীতির ছোঁয়ায় ক্ষমতাধর হয়ে উঠা এই দুই ভাই হলেন ফরিদপুর শহর যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও ইমতিয়াজ হাসান রুবেল। অর্থ আর সম্পদের লোভে এক সময় বিএনপির রাজনীতিতে জড়ান এ দুই ভাই। পরে ক্ষমতা বদলের পর তারাও রূপ বদলান। রাজনীতিকে ব্যবহার করে ত্রাস হয়ে ওঠেন ফরিদপুরের। তাদের দাপটে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও এখন কোনঠাসা। কেউ কেউ অপমানে, অভিমানে রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন। আর যারা আছেন তারা দুই ভাগে বিভক্ত। এই দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ অনেক। এসব অভিযোগ জমা হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে। অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে। এছাড়া একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাও তাদের বিষয়ে অনুসন্ধান করছে।
বরকত ও রুবেলের বাবা আবদুস সালাম মন্ডল ছিলেন বিএডিসির চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। অভাবের সংসারের কারণে পড়ালেখা বেশিদূর করতে পারেননি তারা। এরশাদের জমানায় ফরিদপুর শহরের রাজবাড়ী মোড়ে পরিবহনে চাঁদা উঠাতেন দুই ভাই। ’৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে পরিচয় হয় স্থানীয় বিএনপির এক প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে। এরপর থেকে ওই নেতার ঘনিষ্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। ওই সময় কোমরপুর এলাকার জাকির নামের এক যুবকের দুই হাত কেটে প্রথম আলোচনায় আসেন দুই ভাই। পরে ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক এডভোকেট মহিউদ্দিন খোকনকে হত্যার অভিযোগ উঠে দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে। মামলা হয় তাদের বিরুদ্ধে। আসামি করা হয় ১ ও ৩ নম্বর। এরপর গ্রেপ্তার এড়াতে গা-ঢাকা দেন তারা। তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা নিহত খোকনের বাড়িতে যান সমবেদনা জানাতে। অভিযোগ রয়েছে অদৃশ্য ইশারায় পার পেয়ে যান এই দুই ভাই। হত্যা মামলার রায়েও খালাস পান তারা। ফের প্রকাশ্যে এসে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন।
ক্ষমতার পালা বদলে তারা ভিড়েন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। সান্নিধ্যে আসেন ফরিদপুর আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতার। এরপরই ভাগ্য খুলে যায় দুই ভাইয়ের। জড়িয়ে পড়েন টেন্ডারবাজিতে। দুই ভাইয়ের টেন্ডারবাজির কারণেই এলজিইডি অফিস ঝিলটুলী থেকে তাদের নিজবাড়ি বদরপুরে স্থানান্তর করার অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে ওই সময় জেলা যুবদল নেতা আফজাল হোসেন খান পলাশ মামলাও করেন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো পলাশকে একাধিক মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়। একসময় ফরিদপুরের টেন্ডারবাজির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন দুই ভাই। এলজিইডির সব টেন্ডারে নির্ধারিত ভাগ দিতে হয় তাদের। ওদিকে টেন্ডারবাজির পাশাপাশি মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণের জন্য তৈরি করেন আলাদা সিন্ডিকেট। তাদের মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেন ভাগিনা সিদ্দিক ও জুয়েলকে। একধিকবার সিদ্দিক ও জুয়েল অস্ত্র ও মাদকসহ গ্রেপ্তার হন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শহর আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, আমার ছয়টি ঠিকাধারী লাইসেন্স বাতিল করেছি। নিজের দল ক্ষমতায় থাকতে কাউকে একটা চাঁদা দিয়ে আমি ঠিকাদারী করবো না। বিরোদীদল যখন ছিলো তখনই তো আমি কাউকে চাঁদা দেইনি। আর এখন দিবো? এই দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে ফরিদপুরে শহরে সংখ্যালগু সম্প্রদায়ের বাড়ি দখল ও নির্যাতনের। শহরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের দক্ষিণ পাশে অরুণ গুহ নামে এক ব্যক্তিকে নির্যাতনের মাধ্যমে বিশাল বাড়ি দখল করে নেন তারা। পরে বাড়ির পাশে প্রধান কালী মন্দিরটিও ভেঙ্গে তাদের জায়গাটি দখল করে নেন। বাড়ি দখলের প্রতিবাদে ২০১৬ সালে ফরিদপুর প্রেসক্লাবে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের ব্যানারে মানবন্ধন প্রতিবাদ করার কারণে সংগঠনটির সাধারন সম্পাদক আলোক সেনকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। তিনি এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। সরেজমিন গিয়ে বাড়ি দখল করার সত্যতা পাওয়া যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকার একজন বাসিন্দা বলেন, বাড়িটি প্রথম একেবারে দখল করে নেয় বরকতের লোকজন। পরে যখন লেখালেখি হয়েছে, নামমাত্র মূল্য দিয়ে বাড়িটি তারা কিনেছে। এই বাড়ি হারানোর কষ্টে অরুণ গুহ বেশী দিন বাঁচেননি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ফরিদপুর রাজবাড়ির চার রাস্তা মোড় সংলগ্ন বাইপাস রোডের পাশে এক কিলোমিটারজুড়ে নতুন একটি মার্কেট তৈরী করছেন বরকত। নাম মন্ডল মার্কেট। অভিযোগ রয়েছে এসব জমি তিনি অনেকের কাছ থেকে নামমাত্র টাকা দিয়ে কিনেছেন। কেউ জমি বিক্রি না করতে চাইলে, জমিটিতে মাটি দিয়ে ভরাট করে ফেলা হয়। তারপর জোর করে নামমাত্র মূল্য দিয়ে জমিটি তার নামে করে ফেলেন। মার্কেটটিতে স্বর্নলতা কনফেকশনারীতে কথা হয় একজনের সাথে। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, বরকত সাব যা চায়, তাই হয়। গত এক বছরের মধ্যে তিনি এই মার্কেটি করেছেন। সব দোকান নতুন। শহরে প্রবেশ করতেই কথা হয় আলাউদ্দিন নামে এক রিকশা চালকের সঙ্গে। বরকত আর রুবেলের কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলেন, মাস খানেক আগে ব্যাটারী চালিত রিকশা বন্ধ করে দিয়েছে শহরে। শুনেছি বরকত আর রুবেল নাকি নতুন গাড়ি নামাবে। আমাদের পেটে এভাবে লাথি মেরেছে তারা। এদিকে দুই ভাইয়ের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে কথা বলার সময় তাদের নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরাও ভয়ে কথা বলতে চাননি। যারা কথা বলেন তারাও নাম প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেন।
বরকতের সম্পদের যতটুকু খোঁজ পাওয়া গেছে তার মধ্যে রয়েছে- ঝিলটুলী এলাকায় ১০তলা বাড়িসহ ১০ শতাংশ জমি, ধুলদিতে পাথর ভাঙ্গা কারখানাসহ ১৫ একর জমি, চন্ডিপুরে ১০ একর জমি, সিবরামপুরে ৩ একর জমি, চন্ডিপুরে পাম্পসহ ২ একর জমি, গঙ্গাবর্দিতে ২ একর জমি, বোয়ালমারীতে ১৫ শতাশ জমি, নর্থ চ্যানেলে ৩৩ একর জমি, বদরপুরে ১ একর ৫০ শতাংশ জমি। অভিযোগ উঠেছে, ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ওয়ারলেছ পাড়ার মিজান চৌধুরী ও জামানের ১ একর ৪ শতাংশ জমি লিখে দিতে বাধ্য করেন বরকত। এছাড়া রুবেলের রয়েছে ঝিলটুলী টেলিগ্রাম অফিসের সামনে ৪৫ শতাংশ, জনতা ব্যাংকের মোড়ে ৫.৫ শতাংশ, মুন্সীবাজারে ৩ একর, বাইপাসে ১৫ একর, ব্রাহ্মণকান্দায় ১০ একর, পাট গবেষণা কেন্দ্রের পাশে ৬ একর, চন্ডিপুরে ইট ভাটাসহ মাচ্চরে ১১ একর, মাচ্চর ইউনিয়ন পরিষদের পাশে ৬ একর, চন্ডিপুর বাবু বাড়ির পাশে ২ একর, নর্থ চ্যানেলে ১০০ একর, ধুলদিতে ১৫ একর, রাজবাড়ি রাস্তার মোড়ে ১ একর ৫০ শতাংশসহ মোট ১৮২ একর জমি। স্থানীয়রা জানান, দুই ভাইয়ের নেশা জমি করার। যেখানে যেভাবে পারেন অন্যের জমি নিজেদের কব্জায় নেন। ফরিদপুরের সবচেয়ে বিলাশবহুল গাড়ী সাউথ লাইন পরিবহনের মালিক এই বরকত , রুবেল । যার গাড়ীর সংখ্যা প্রায় ৬০টি। যেগুলো ঢাকা-আরিচা -খুলনা, ঢাকা- বরিশাল রুটে চলে।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ঢাকা, দিনাজপুর, গাজীপুর, সাতক্ষীরায় রয়েছে তাদের জমি, ফ্ল্যাট বাড়ি। চা বাগান, মাছের ঘের, গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি ও মহাখালী ডিওএইচএস, সেগুনবাগিচায় রয়েছে একাধিক অত্যাধুনিক ফ্ল্যাট। বিএমডব্লিউ, হ্যারিয়ার, লেক্সাসসহ মোট ৫টি অত্যাধুনিক গাড়ি ব্যবহার করেন তারা। সাউথ লাইনে পরিবহনে রয়েছে ৬০টি বাস। রয়েছে অসংখ্য ট্রাক-ভেকু। এছাড়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় আবাসিক হোটেল, চরে রয়েছে কলা ও মাল্টার বাগান, একাধিক পেট্রোল পাম্প, ইটভাটা, রাজবাড়ী রাস্তার মোড়ে ব্যক্তিগত ২টি অফিস, বাইপাসে অসংখ্য দোকান। ফরিদপুর নিউ মার্কেটে রয়েছে ৪৪টি দোকান। যার সর্বনিম্ন মূল্য ১১ কোটি টাকা। সুইডেন, দুবাই ও মালয়েশিয়ার তাদের সম্পত্তি রয়েছে বলেও অভিযোগ এসেছে। সম্প্রতি বরকতকে ফরিদপুর শহর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা বাস মালিক গ্রুপের সভাপতি করা হয়। বড় বাস মালিক গ্রপের সাবেক সভাপতি মুকুলকে কৌশলে সরিয়ে সেখানকার পদটি ভাগিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। মুকুলের সাথে কথা বল্লে তিনি বলেন, এখন আর ওখানে পরিবেশ নেই। তাই আমি আর এখন ফরিদপুর যাইনা। আমি ঢাকায় থাকি। এই বিষয়ে আর কথা বলতে চাই না।
অভিযোগ রয়েছে, আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার ৫নং আসামি, সাবেক জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ক্যাপ্টেন নুর মো. বাবুল, ফরিদুপর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক নির্বাহী কমিটির সদস্য, সাবেক জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ, সদর উপজেলার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যাম ভোলা মাস্টারসহ অনেকেই এই দুই ভাইয়ের হয়রানির শিকার হয়েছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ বলেন, ফরিদপুর বণিক সমিতির সভাপতি ছিলাম। সেখান থেকে আমাকে সরানোর জন্য দোকানদাররে ওপর নানান অত্যাচার করতো ।পরে আমি নিজেই সরে গেছি। অথচ এখানে আমি এক যুগের বেশি ছিলাম। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলে আমার মতো নিরীহ মানুষের ওপর নেমে আসবে নির্যাতন। তার চেয়ে ভালো চুপ থাকি। শহর আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, দুই চ্যাংরা আমাদেরকে শাসাতে আসে। তাদের ক্ষমতার জোর কোথায় সবাই জানে। ভয়ে কেউ কিছু বলে না।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুই ভাইয়ের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে দুদক। দুদক ইতিমধ্যে তাদের সম্পদ অর্জনের বিষয়ে জানতে চেয়ে চিঠি দিয়েছে। ফরিদপুর দুদক অফিসের কর্মকর্তা দুদকের অভিযোগ রহস্যজনক কারণে আড়াল করে রাখেন। ওই কর্মকর্তা রুবেল-বরকতের আমন্ত্রিত অতিথি হওয়ার ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। এরপর ওই কর্মকর্তাকে ফরিদপুর থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। এদিকে জানা গেছে, দুদক ঢাকা থেকে অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখছে। দুদকের সেই অভিযোগ পত্র থেকে জানা যায়, গত চার পাঁচ বছরে এলজিইডির অধিকাংশ কার্যাদেশ হয়েছে সাজ্জাদ হোসেন বরকতের এসবি কনস্ট্রাকশন এবং ইমতিয়াজ হাসান রুবেলের রাফেয়া কনস্ট্রাকশন এর নামে। এদিকে ফরিদপুর চর এলাকায় জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে কমপক্ষে পাচঁশ একর খাস জমি দখলে নেয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় নিজেদের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নামে কোটি কোটি টাকা জমা রেখেছেন বরকত ও তার ভাই রুবেল। এর মধ্যে এইচএসবিসি ব্যাংকে ৪৫ কোটি টাকা, ওরি ব্যাংকে ২৬ কোটি, স্ট্যান্ডাট চার্টাড ব্যাংকে ১৬ কোটি, কর্মাশিয়াল ব্যাংক অব সিলনে ২২ কোটি টাকা, হাবিব ব্যাংকে ৩০ কোটি টাকা জমা রয়েছে। এছাড়া দেশীয় কয়েকটি ব্যাংকে আড়াইশ কোটি টাকা জমা থাকার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও নিউজিল্যান্ড ও দুবাইয়ে তাদের সেকেন্ড হোম আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য বিপুল ঘোষ বলেন, দলে অনুপ্রবেশকারীদের জন্য এখন আমরা আর আওয়ামী লীগ করতে পারছি না। দলের দুঃসময়ে আওয়ামী লীগ করেছি, এখন অবসরে আছি। আওয়ামী লীগের আবার দুঃসময় হলে আমি এবং জেলার যারা দলের জন্য নিবেদিত তারা আবার সক্রিয় হয়ে কাজ করবো। প্রধানমন্ত্রী যে কথা বলেছেন তার জন্য তাকে সাধুবাদ জানাই। টেন্ডারবাজি ও নানা অপকর্ম করে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট যারা করেছে এদের আইনের মাধ্যমে কঠোর বিচার হওয়া দরকার।
শহর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত তাদের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগের বিষয়ে বলেন, রাজনীতি করছি একটি পক্ষ হিংসাপরায়ন হয়ে এসব বলছে। বাড়ি দখলের ব্যাপারে তিনি বলেন, আমি কার বাড়ি কখন দখল করলাম, কোন বাড়ি দখল করলাম। পরে এই প্রতিবেদক নির্দিষ্ট বাড়িটির কথা বলার পরে তিনি বলেন অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। অন্যান্য জমি দখলের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, সেই জমানা কিন্তু এখন আর নেই। চাইলেও কারো জমি দখল করা সম্ভব নয়। আর টেন্ডারের কথা বলছেন? আপনি একটি টেন্ডার ড্রপ করে দেখেন কেউ পার্স্টেন্টিজ চায় কিনা। চর দখল নিয়ে তিনি বলেন, আমি চরে স্বল্পদামে কিছু জায়গা কিনেছি। চরে খুব অল্পদামে জমি পাওয়া যায়, তাই কিনেছি। এটা নিয়ে যদি বলে দখল করেছি, তাহলে তো হবে না। এত অল্প টাকার জমি তো দখলের প্রয়োজন পরে না। তিনি বলেন, আমি যদি রাজনীতি না করে মসজিদের ইমামতি করতাম তাহলে এই অভিযোগগুলো আসতো না। এখন রাজনীতি করছি দুদক থেকে সব জায়গায় আমাকে নিয়ে অভিযোগ। আমাদের মূল ব্যবসা হচ্ছে ঠিকাদারী ব্যবসা। তারপর আমাদের পরিবহন ব্যবসা আছে, জমি ক্রয়বিক্রয়ের ব্যবসা আছে। আপনি যা বলছেন আমার এতো টাকা পয়সা নেই। যা আছে বৈধ। তার দলের লোকজন কেনো তার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ করে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, দেখেন আমি দলের জন্য কাজ করছি, পরিশ্রম করছি। তাই ভালো জায়গায় আছি। এটাকে অনেকে সহ্য করতে পারে না। হিন্দুদের বাড়ি দখল নিয়ে তিনি বলেন এটা ষড়যন্ত্র। তিনি বলেন, আমরা কখনোই বিএনপির রাজনীতির সাথে ছিলাম না। তার প্রমাণ কেউ দিতে পারবে না। এদিকে ইমতিয়াজ হাসান রুবেল বলেন, বদনাম হবে বলেই আমি এলাকার বাইরে গিয়ে ঠিকাদারির কাজ করছি। আমার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ করা হয়েছে তা ভিত্তিহীন।
আর এখন তাদের আলিশান জীবন। চলেন দামি গাড়িতে। তাদের কথার বাইরে যাওয়ার সাহস নেই কারও। বলতে গেলে পুরো জেলা শহর তাদের নিয়ন্ত্রণে। নানা অপকর্ম জোর জবরদস্তি করে নিজেদের কব্জায় নিয়েছেন অন্যের বাড়ি, দোকান, জমি। তাদের ইশারা ছাড়া ফরিদপুর শহরে কিছুই নড়ে না। সাধারণ জীবন থেকে রাজনীতির ছোঁয়ায় ক্ষমতাধর হয়ে উঠা এই দুই ভাই হলেন ফরিদপুর শহর যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও ইমতিয়াজ হাসান রুবেল। অর্থ আর সম্পদের লোভে এক সময় বিএনপির রাজনীতিতে জড়ান এ দুই ভাই। পরে ক্ষমতা বদলের পর তারাও রূপ বদলান। রাজনীতিকে ব্যবহার করে ত্রাস হয়ে ওঠেন ফরিদপুরের। তাদের দাপটে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও এখন কোনঠাসা। কেউ কেউ অপমানে, অভিমানে রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন। আর যারা আছেন তারা দুই ভাগে বিভক্ত। এই দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ অনেক। এসব অভিযোগ জমা হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে। অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে। এছাড়া একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাও তাদের বিষয়ে অনুসন্ধান করছে।
বরকত ও রুবেলের বাবা আবদুস সালাম মন্ডল ছিলেন বিএডিসির চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। অভাবের সংসারের কারণে পড়ালেখা বেশিদূর করতে পারেননি তারা। এরশাদের জমানায় ফরিদপুর শহরের রাজবাড়ী মোড়ে পরিবহনে চাঁদা উঠাতেন দুই ভাই। ’৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে পরিচয় হয় স্থানীয় বিএনপির এক প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে। এরপর থেকে ওই নেতার ঘনিষ্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। ওই সময় কোমরপুর এলাকার জাকির নামের এক যুবকের দুই হাত কেটে প্রথম আলোচনায় আসেন দুই ভাই। পরে ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক এডভোকেট মহিউদ্দিন খোকনকে হত্যার অভিযোগ উঠে দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে। মামলা হয় তাদের বিরুদ্ধে। আসামি করা হয় ১ ও ৩ নম্বর। এরপর গ্রেপ্তার এড়াতে গা-ঢাকা দেন তারা। তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা নিহত খোকনের বাড়িতে যান সমবেদনা জানাতে। অভিযোগ রয়েছে অদৃশ্য ইশারায় পার পেয়ে যান এই দুই ভাই। হত্যা মামলার রায়েও খালাস পান তারা। ফের প্রকাশ্যে এসে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন।
ক্ষমতার পালা বদলে তারা ভিড়েন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। সান্নিধ্যে আসেন ফরিদপুর আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতার। এরপরই ভাগ্য খুলে যায় দুই ভাইয়ের। জড়িয়ে পড়েন টেন্ডারবাজিতে। দুই ভাইয়ের টেন্ডারবাজির কারণেই এলজিইডি অফিস ঝিলটুলী থেকে তাদের নিজবাড়ি বদরপুরে স্থানান্তর করার অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে ওই সময় জেলা যুবদল নেতা আফজাল হোসেন খান পলাশ মামলাও করেন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো পলাশকে একাধিক মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়। একসময় ফরিদপুরের টেন্ডারবাজির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন দুই ভাই। এলজিইডির সব টেন্ডারে নির্ধারিত ভাগ দিতে হয় তাদের। ওদিকে টেন্ডারবাজির পাশাপাশি মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণের জন্য তৈরি করেন আলাদা সিন্ডিকেট। তাদের মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেন ভাগিনা সিদ্দিক ও জুয়েলকে। একধিকবার সিদ্দিক ও জুয়েল অস্ত্র ও মাদকসহ গ্রেপ্তার হন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শহর আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, আমার ছয়টি ঠিকাধারী লাইসেন্স বাতিল করেছি। নিজের দল ক্ষমতায় থাকতে কাউকে একটা চাঁদা দিয়ে আমি ঠিকাদারী করবো না। বিরোদীদল যখন ছিলো তখনই তো আমি কাউকে চাঁদা দেইনি। আর এখন দিবো? এই দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে ফরিদপুরে শহরে সংখ্যালগু সম্প্রদায়ের বাড়ি দখল ও নির্যাতনের। শহরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের দক্ষিণ পাশে অরুণ গুহ নামে এক ব্যক্তিকে নির্যাতনের মাধ্যমে বিশাল বাড়ি দখল করে নেন তারা। পরে বাড়ির পাশে প্রধান কালী মন্দিরটিও ভেঙ্গে তাদের জায়গাটি দখল করে নেন। বাড়ি দখলের প্রতিবাদে ২০১৬ সালে ফরিদপুর প্রেসক্লাবে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের ব্যানারে মানবন্ধন প্রতিবাদ করার কারণে সংগঠনটির সাধারন সম্পাদক আলোক সেনকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। তিনি এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। সরেজমিন গিয়ে বাড়ি দখল করার সত্যতা পাওয়া যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকার একজন বাসিন্দা বলেন, বাড়িটি প্রথম একেবারে দখল করে নেয় বরকতের লোকজন। পরে যখন লেখালেখি হয়েছে, নামমাত্র মূল্য দিয়ে বাড়িটি তারা কিনেছে। এই বাড়ি হারানোর কষ্টে অরুণ গুহ বেশী দিন বাঁচেননি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ফরিদপুর রাজবাড়ির চার রাস্তা মোড় সংলগ্ন বাইপাস রোডের পাশে এক কিলোমিটারজুড়ে নতুন একটি মার্কেট তৈরী করছেন বরকত। নাম মন্ডল মার্কেট। অভিযোগ রয়েছে এসব জমি তিনি অনেকের কাছ থেকে নামমাত্র টাকা দিয়ে কিনেছেন। কেউ জমি বিক্রি না করতে চাইলে, জমিটিতে মাটি দিয়ে ভরাট করে ফেলা হয়। তারপর জোর করে নামমাত্র মূল্য দিয়ে জমিটি তার নামে করে ফেলেন। মার্কেটটিতে স্বর্নলতা কনফেকশনারীতে কথা হয় একজনের সাথে। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, বরকত সাব যা চায়, তাই হয়। গত এক বছরের মধ্যে তিনি এই মার্কেটি করেছেন। সব দোকান নতুন। শহরে প্রবেশ করতেই কথা হয় আলাউদ্দিন নামে এক রিকশা চালকের সঙ্গে। বরকত আর রুবেলের কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলেন, মাস খানেক আগে ব্যাটারী চালিত রিকশা বন্ধ করে দিয়েছে শহরে। শুনেছি বরকত আর রুবেল নাকি নতুন গাড়ি নামাবে। আমাদের পেটে এভাবে লাথি মেরেছে তারা। এদিকে দুই ভাইয়ের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে কথা বলার সময় তাদের নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরাও ভয়ে কথা বলতে চাননি। যারা কথা বলেন তারাও নাম প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেন।
বরকতের সম্পদের যতটুকু খোঁজ পাওয়া গেছে তার মধ্যে রয়েছে- ঝিলটুলী এলাকায় ১০তলা বাড়িসহ ১০ শতাংশ জমি, ধুলদিতে পাথর ভাঙ্গা কারখানাসহ ১৫ একর জমি, চন্ডিপুরে ১০ একর জমি, সিবরামপুরে ৩ একর জমি, চন্ডিপুরে পাম্পসহ ২ একর জমি, গঙ্গাবর্দিতে ২ একর জমি, বোয়ালমারীতে ১৫ শতাশ জমি, নর্থ চ্যানেলে ৩৩ একর জমি, বদরপুরে ১ একর ৫০ শতাংশ জমি। অভিযোগ উঠেছে, ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ওয়ারলেছ পাড়ার মিজান চৌধুরী ও জামানের ১ একর ৪ শতাংশ জমি লিখে দিতে বাধ্য করেন বরকত। এছাড়া রুবেলের রয়েছে ঝিলটুলী টেলিগ্রাম অফিসের সামনে ৪৫ শতাংশ, জনতা ব্যাংকের মোড়ে ৫.৫ শতাংশ, মুন্সীবাজারে ৩ একর, বাইপাসে ১৫ একর, ব্রাহ্মণকান্দায় ১০ একর, পাট গবেষণা কেন্দ্রের পাশে ৬ একর, চন্ডিপুরে ইট ভাটাসহ মাচ্চরে ১১ একর, মাচ্চর ইউনিয়ন পরিষদের পাশে ৬ একর, চন্ডিপুর বাবু বাড়ির পাশে ২ একর, নর্থ চ্যানেলে ১০০ একর, ধুলদিতে ১৫ একর, রাজবাড়ি রাস্তার মোড়ে ১ একর ৫০ শতাংশসহ মোট ১৮২ একর জমি। স্থানীয়রা জানান, দুই ভাইয়ের নেশা জমি করার। যেখানে যেভাবে পারেন অন্যের জমি নিজেদের কব্জায় নেন। ফরিদপুরের সবচেয়ে বিলাশবহুল গাড়ী সাউথ লাইন পরিবহনের মালিক এই বরকত , রুবেল । যার গাড়ীর সংখ্যা প্রায় ৬০টি। যেগুলো ঢাকা-আরিচা -খুলনা, ঢাকা- বরিশাল রুটে চলে।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ঢাকা, দিনাজপুর, গাজীপুর, সাতক্ষীরায় রয়েছে তাদের জমি, ফ্ল্যাট বাড়ি। চা বাগান, মাছের ঘের, গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি ও মহাখালী ডিওএইচএস, সেগুনবাগিচায় রয়েছে একাধিক অত্যাধুনিক ফ্ল্যাট। বিএমডব্লিউ, হ্যারিয়ার, লেক্সাসসহ মোট ৫টি অত্যাধুনিক গাড়ি ব্যবহার করেন তারা। সাউথ লাইনে পরিবহনে রয়েছে ৬০টি বাস। রয়েছে অসংখ্য ট্রাক-ভেকু। এছাড়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় আবাসিক হোটেল, চরে রয়েছে কলা ও মাল্টার বাগান, একাধিক পেট্রোল পাম্প, ইটভাটা, রাজবাড়ী রাস্তার মোড়ে ব্যক্তিগত ২টি অফিস, বাইপাসে অসংখ্য দোকান। ফরিদপুর নিউ মার্কেটে রয়েছে ৪৪টি দোকান। যার সর্বনিম্ন মূল্য ১১ কোটি টাকা। সুইডেন, দুবাই ও মালয়েশিয়ার তাদের সম্পত্তি রয়েছে বলেও অভিযোগ এসেছে। সম্প্রতি বরকতকে ফরিদপুর শহর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা বাস মালিক গ্রুপের সভাপতি করা হয়। বড় বাস মালিক গ্রপের সাবেক সভাপতি মুকুলকে কৌশলে সরিয়ে সেখানকার পদটি ভাগিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। মুকুলের সাথে কথা বল্লে তিনি বলেন, এখন আর ওখানে পরিবেশ নেই। তাই আমি আর এখন ফরিদপুর যাইনা। আমি ঢাকায় থাকি। এই বিষয়ে আর কথা বলতে চাই না।
অভিযোগ রয়েছে, আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার ৫নং আসামি, সাবেক জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ক্যাপ্টেন নুর মো. বাবুল, ফরিদুপর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক নির্বাহী কমিটির সদস্য, সাবেক জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ, সদর উপজেলার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যাম ভোলা মাস্টারসহ অনেকেই এই দুই ভাইয়ের হয়রানির শিকার হয়েছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ বলেন, ফরিদপুর বণিক সমিতির সভাপতি ছিলাম। সেখান থেকে আমাকে সরানোর জন্য দোকানদাররে ওপর নানান অত্যাচার করতো ।পরে আমি নিজেই সরে গেছি। অথচ এখানে আমি এক যুগের বেশি ছিলাম। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলে আমার মতো নিরীহ মানুষের ওপর নেমে আসবে নির্যাতন। তার চেয়ে ভালো চুপ থাকি। শহর আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, দুই চ্যাংরা আমাদেরকে শাসাতে আসে। তাদের ক্ষমতার জোর কোথায় সবাই জানে। ভয়ে কেউ কিছু বলে না।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুই ভাইয়ের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে দুদক। দুদক ইতিমধ্যে তাদের সম্পদ অর্জনের বিষয়ে জানতে চেয়ে চিঠি দিয়েছে। ফরিদপুর দুদক অফিসের কর্মকর্তা দুদকের অভিযোগ রহস্যজনক কারণে আড়াল করে রাখেন। ওই কর্মকর্তা রুবেল-বরকতের আমন্ত্রিত অতিথি হওয়ার ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। এরপর ওই কর্মকর্তাকে ফরিদপুর থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। এদিকে জানা গেছে, দুদক ঢাকা থেকে অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখছে। দুদকের সেই অভিযোগ পত্র থেকে জানা যায়, গত চার পাঁচ বছরে এলজিইডির অধিকাংশ কার্যাদেশ হয়েছে সাজ্জাদ হোসেন বরকতের এসবি কনস্ট্রাকশন এবং ইমতিয়াজ হাসান রুবেলের রাফেয়া কনস্ট্রাকশন এর নামে। এদিকে ফরিদপুর চর এলাকায় জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে কমপক্ষে পাচঁশ একর খাস জমি দখলে নেয়ার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় নিজেদের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নামে কোটি কোটি টাকা জমা রেখেছেন বরকত ও তার ভাই রুবেল। এর মধ্যে এইচএসবিসি ব্যাংকে ৪৫ কোটি টাকা, ওরি ব্যাংকে ২৬ কোটি, স্ট্যান্ডাট চার্টাড ব্যাংকে ১৬ কোটি, কর্মাশিয়াল ব্যাংক অব সিলনে ২২ কোটি টাকা, হাবিব ব্যাংকে ৩০ কোটি টাকা জমা রয়েছে। এছাড়া দেশীয় কয়েকটি ব্যাংকে আড়াইশ কোটি টাকা জমা থাকার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও নিউজিল্যান্ড ও দুবাইয়ে তাদের সেকেন্ড হোম আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য বিপুল ঘোষ বলেন, দলে অনুপ্রবেশকারীদের জন্য এখন আমরা আর আওয়ামী লীগ করতে পারছি না। দলের দুঃসময়ে আওয়ামী লীগ করেছি, এখন অবসরে আছি। আওয়ামী লীগের আবার দুঃসময় হলে আমি এবং জেলার যারা দলের জন্য নিবেদিত তারা আবার সক্রিয় হয়ে কাজ করবো। প্রধানমন্ত্রী যে কথা বলেছেন তার জন্য তাকে সাধুবাদ জানাই। টেন্ডারবাজি ও নানা অপকর্ম করে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট যারা করেছে এদের আইনের মাধ্যমে কঠোর বিচার হওয়া দরকার।
শহর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত তাদের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগের বিষয়ে বলেন, রাজনীতি করছি একটি পক্ষ হিংসাপরায়ন হয়ে এসব বলছে। বাড়ি দখলের ব্যাপারে তিনি বলেন, আমি কার বাড়ি কখন দখল করলাম, কোন বাড়ি দখল করলাম। পরে এই প্রতিবেদক নির্দিষ্ট বাড়িটির কথা বলার পরে তিনি বলেন অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। অন্যান্য জমি দখলের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, সেই জমানা কিন্তু এখন আর নেই। চাইলেও কারো জমি দখল করা সম্ভব নয়। আর টেন্ডারের কথা বলছেন? আপনি একটি টেন্ডার ড্রপ করে দেখেন কেউ পার্স্টেন্টিজ চায় কিনা। চর দখল নিয়ে তিনি বলেন, আমি চরে স্বল্পদামে কিছু জায়গা কিনেছি। চরে খুব অল্পদামে জমি পাওয়া যায়, তাই কিনেছি। এটা নিয়ে যদি বলে দখল করেছি, তাহলে তো হবে না। এত অল্প টাকার জমি তো দখলের প্রয়োজন পরে না। তিনি বলেন, আমি যদি রাজনীতি না করে মসজিদের ইমামতি করতাম তাহলে এই অভিযোগগুলো আসতো না। এখন রাজনীতি করছি দুদক থেকে সব জায়গায় আমাকে নিয়ে অভিযোগ। আমাদের মূল ব্যবসা হচ্ছে ঠিকাদারী ব্যবসা। তারপর আমাদের পরিবহন ব্যবসা আছে, জমি ক্রয়বিক্রয়ের ব্যবসা আছে। আপনি যা বলছেন আমার এতো টাকা পয়সা নেই। যা আছে বৈধ। তার দলের লোকজন কেনো তার বিরুদ্ধে এত অভিযোগ করে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, দেখেন আমি দলের জন্য কাজ করছি, পরিশ্রম করছি। তাই ভালো জায়গায় আছি। এটাকে অনেকে সহ্য করতে পারে না। হিন্দুদের বাড়ি দখল নিয়ে তিনি বলেন এটা ষড়যন্ত্র। তিনি বলেন, আমরা কখনোই বিএনপির রাজনীতির সাথে ছিলাম না। তার প্রমাণ কেউ দিতে পারবে না। এদিকে ইমতিয়াজ হাসান রুবেল বলেন, বদনাম হবে বলেই আমি এলাকার বাইরে গিয়ে ঠিকাদারির কাজ করছি। আমার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ করা হয়েছে তা ভিত্তিহীন।
No comments