মানবাধিকারের নতুন কী সংজ্ঞা দিচ্ছেন অমিত শাহ? by শুভজ্যোতি ঘোষ
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ |
পশ্চিমী দুনিয়া মানবাধিকারের যে
সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে তা ভারতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না - ভারতের
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এই মন্তব্য করার পর দেশের শীর্ষ মানবাধিকার
কর্মী ও সংগঠনগুলো তার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
বলেছেন, জঙ্গী বা মাওবাদী বিদ্রোহীদের হাতে দেশে যে সব সাধারণ মানুষ মারা
যাচ্ছেন - একটা 'ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গী' নিয়ে তাদের মানবাধিকারকেই সবচেয়ে
বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
তবে ভারতের মানবাধিকার কর্মীরা মনে
করছেন, ভারতের সংবিধান বা আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা যতক্ষণ বজায় আছে, ততক্ষণ
এভাবে মানবাধিকারের সংজ্ঞা পাল্টে দেওয়ার চেষ্টাটাই সম্পূর্ণ অনৈতিক।
সম্প্রতি
ভারতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিষ্ঠা দিবসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত
শাহ ভারতের পটভূমিতে মানবাধিকারের যে নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা রীতিমতো
আলোড়ন ফেলে দিয়েছে।
তিনি সেখানে বলেন, "হেফাজতে মৃত্যু বা পুলিশি
নির্যাতন নিয়ে মানবাধিকার কর্মীরা যত হইচই করেন, আসলে তার চেয়েও বেশি করা
উচিত নকশাল বা জঙ্গীদের হাতে নিহত সাধারণ মানুষদের মানবাধিকার লঙ্ঘন
নিয়ে।"
তিনি আরও বলেন, "আন্তর্জাতিক বিশ্ব মানবাধিকারের যে মাপকাঠি স্থির করেছে তা ভারতের জন্য উপযুক্ত হতে পারে না।"
"আমাদের
দেশের সমস্যাগুলো কী, সেটা আগে বুঝে নিয়ে সেইভাবে ভারতে মানবাধিকারকে এক
নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে, নতুন মাত্রা দিয়ে দেখতে হবে।"
দেশের সব
মানুষের মাথার ওপর ছাদ দেওয়া, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ বা রান্নার গ্যাস পৌঁছে
দেওয়া, মেয়েদের শৌচাগারের ব্যবস্থা করা - এই সব মানবাধিকার নিশ্চিত করাই
ভারতের অগ্রাধিকার, জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
এই মৌলিক
অধিকারগুলোর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করছেন না ভারতের অগ্রণী
অ্যাক্টিভিস্টরাও - কিন্তু তারা সেই সঙ্গেই বলছেন তার মানে এই নয় যে
রাষ্ট্র হিসেবে ভারত অন্য মানবাধিকারগুলো রক্ষার দায় এড়িয়ে যাবে।
ভারতের
সুপরিচিত মানবাধিকার আইনজীবী নন্দিতা হাকসার যেমন বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন,
"অমিত শাহ যা-ই বলুন ভারত কিন্তু এখনও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদে
স্বাক্ষরকারী দেশ। তিনি কি সেখান থেকেও সরে আসতে চান?"
"সংবিধানের পার্ট থ্রি-তে বা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মানবাধিকার যেভাবে সংজ্ঞায়িত হয়েছে সেটাও কি তিনি মানতে চান না?"
"ভারত
বা চীন মাঝে মাঝেই এই ধরনের যুক্তি দিয়ে থাকে বটে, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত
ভারতের একটা আন্তর্জাতিক কমিটমেন্ট আছে বা সংবিধান না-বদলানো হচ্ছে ততক্ষণ
এই সব কথার অর্থ কী?"
"কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ করার সময় এরাই
বলেছিলেন কাশ্মীরিরা না কি মানবাধিকার মানেন না। কিন্তু এখন তো এরাই দেশের
সংবিধান মানছেন না।"
দিনকয়েক আগে দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয়
আধাসামরিক বাহিনীর এক নারী জওয়ানের দেওয়া একটি ভাষণও ভাইরাল হয়েছে -
যেখানে তিনি বলেছিলেন পুলওয়ামাতে জঙ্গী হামলায় নিহত সেনাদের মানবাধিকার
লঙ্ঘন নিয়ে কে কবে ভেবেছে?
অমিত শাহ নিজেও বারবার কাশ্মীরে বা
মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় নিহতদের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে প্রশ্ন তুলে একটা
নতুন ব্যাখ্যা পেশ করতে চেয়েছেন।
তবে মানবাধিকার কর্মী ও অ্যাক্টিভিস্ট অমিত ভট্টাচার্যর মতে তার এই যুক্তিতে একটা গোড়ায় গলদ আছে।
অধ্যাপক ভট্টাচার্যর কথায়, "ভিক্টিম কাকে বলব? তার আগে ভাবুন, অস্ত্র
কাদের হাতে থাকে? স্টেট বা রাষ্ট্রের হাতে থাকে। সমস্ত অত্যাধুনিক অস্ত্র
স্টেটের হাতে থাকে, এবং তাদের চেয়ে শক্তিশালী আর কেউ নেই।"
"আর এই
সব অস্ত্রই রাষ্ট্র ব্যবহার করে থাকে এই স্টেট সিস্টেমটার অস্তিত্ত্ব
টিঁকিয়ে রাখতে। যারা এই সিস্টেম মানবে না তাদের বিরুদ্ধেই নির্বিচারে এই
সব অস্ত্রর প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।"
"এমন কী মেরে ফেলাও কোনও ব্যাপার নয় - রাষ্ট্রের হাতে ফেক বা সাজানো এনকাউন্টার তো প্রতিনিয়ত হচ্ছে।"
"কিন্তু একটা সময় মানুষও যখন পাল্টা রুখে দাঁড়ায়, আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নেয় তখনই এই প্রশ্নগুলো ওঠে।"
"দুজন
সশস্ত্র যোদ্ধার মধ্যে লড়াইটা তবু বুঝলাম, কিন্তু যখন একজন নিরস্ত্র
মানুষকে কাস্টডিতে নিয়ে টর্চার করে মেরে ফেলা হচ্ছে কিংবা নিরস্ত্র
গ্রামবাসী-আদিবাসীদের ওপর নির্যাতন করা হচ্ছে তখন সিভিল লিবার্টি
অ্যাক্টিভিস্টরা কীভাবে নীরব থাকবেন?", প্রশ্ন তুলছেন তিনি।
কিন্তু
ভারতের মানবাধিকার সংগঠনগুলো এখন এটাও উপলব্ধি করছে - দেশের সাধারণ
মানুষের কাছে মানবাধিকারের গোটা বিষয়টাকেই সরকার এখন যে ভিন্ন দৃষ্টিকোণে
উপস্থাপন করতে চাইছে, তাদের এখন লড়তে হবে সেই ন্যারেটিভের সঙ্গেও।
No comments