সরাইলে কলেজছাত্র ইকরাম হত্যা: নাটের গুরু শিমুল, নির্মম বর্ণনা by মাহবুব খান বাবুল

ইকরাম
কলেজছাত্র ইকরাম হত্যার নাটের গুরু শিমুল। শিমুল একতরফা প্রেমে ছিল মাতাল। ইকরামের ভাগ্নি স্কুলছাত্রী সুমাইয়াকে নিয়মিত ইভটিজিং করতো প্রতিবেশী শিমুল (২৮) নামের ওই বখাটে। এর প্রতিবাদ করতো ইকরাম। তাই পরিকল্পিত ভাবে ইকরামকে হত্যা করে। এর আগে ইভটিজিংয়ের দায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত ৮ মাস কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছিল শিমুলের বিরুদ্ধে। জেলে যাওয়ার সময় শিমুল ইকরামকে কুপিয়ে শেষ করে ফেলার হুমকিও দিয়েছিল। কথা রেখেছে বখাটে শিমুল।
গত ১০ই আগস্ট শনিবার গভীর রাতে ঘুমন্ত ইকরামকে নির্মম ভাবে হত্যা করে বস্তায় ভরে খাটের নিচে রেখে পালিয়ে যায় শিমুল ও তার সহযোগীরা। পরের দিন রোববার সকালে পুলিশ ইকরামের বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করে। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় পুলিশ প্রথমে আটক ও পরে গ্রেপ্তার করে শিমুলের মামা সাবেক ইউপি সদস্য মো. নাজিম উদ্দিন (৫৫), খালাম্মা নাজমা বেগম (৪৫) ও ইকরামের এক ভাগিনা ইমরানুল হাসান সাদী (১৯)কে। ১১ই আগস্ট ইকরামের বাবা হাফেজ মো. শহিদুল ইসলাম (৫২) বাদী হয়ে শিমুলকে প্রধান আসামি করে ৫ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা আরো ৫-৬ জনের বিরুদ্ধে সরাইল থানায় একটি মামলা করেছেন। আসামি ৫ জন হলেও একটি ফোনের সূত্র ধরে জব্বর মিয়ার স্ত্রী রঞ্জিনা বেগম (৩৬) ও তার মেয়ে তারিনের (১৭) থানায় দুইদিন আটকের বিষয়টি ছিল একেবারেই গোপন। এ বিষয়টিও আলোচিত হচ্ছে সর্বত্রই। তবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। গত সোমবার আদালতে ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে পরিকল্পিত চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের আদ্যোপান্ত বর্ণনা করেছে ঘটনার অন্যতম সহযোগী সাদী। পলাতক রয়েছে হত্যাকাণ্ডের মূলনায়ক শিমুল ও তার আরেক সহযোগী আপন ছোট ভাই সোহাগ (২৪)।
সূত্র জানায়, শহিদুল ইসলামের বাড়ি জয়ধরকান্দি গ্রামে (বড়বাড়ি)। ২০ বছর আগে জায়গা ক্রয় করে বারৈইজীবী পাড়ায় বাড়ি করেছেন। তার জ্যেঠসের মেয়ে লাভলী বেগম (৫০)-এর স্বামী সৌদি প্রবাসী বাহার উদ্দিনের বাড়ি কসবা উপজেলায়। তিনিও এখানে এসে বাড়ি করেছেন। শহিদুলের বাড়ি থেকে লাভলীর বাড়ির দূরত্ব ১ শ’ গজ। লাভলী বেগমের দুই মেয়ে ও এক ছেলে। ইকরাম ২০১৯ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় কালিকচ্ছ পাঠশালা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৩.৯৪ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। এ বছর সরাইল সরকারি কলেজের বিএম শাখায় উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল। পড়ালেখার পাশাপাশি বড় ভাইকে রাজমিস্ত্রির কাজে সহযোগিতা করতো ইকরাম। দরিদ্র পরিবারের ছাত্র ইকরামের সকল স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দিলো শিমুল বাহিনী। বাড়িতে ভগ্নিপতি না থাকায় উত্তর ভিটার ছোট একটি টিনের ঘরে থেকে পড়ালেখা করতো ইকরাম। মামা-ভাগ্নি পড়তোও একই ক্লাসে। আর সংলগ্ন পশ্চিম ভিটার ঘরে মেয়েদের নিয়ে থাকতেন লাভলী বেগম। লাভলী বেগমের পাশের ঘরই হচ্ছে প্রয়াত রবিউল্লাহর ছেলে শিমুলের। বখাটে শিমুল গত ২-৩ বছর আগে থেকেই ইকরামের স্কুলপড়ুয়া ভাগ্নি সুমাইয়াকে উত্ত্যক্ত করে আসছিল। উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করতো ইকরাম। এ কারণেই ইকরামের ওপর ক্ষুব্ধ হয় শিমুল। তাদের দুজনের মধ্যে মারধরের ঘটনাও ঘটেছে। একাধিকবার পড়ালেখা ছেড়ে দিতে চেয়েছে ছাত্রীর। পরিবার দুটি এখানকার স্থানীয় না হওয়ায় শিমুলের অভিভাবকদের কাছে একাধিকবার নালিশ করেও কোনো প্রতিকার পায়নি। উল্টো বকাঝকা শুনতে হয়েছে তাদের। ওদিকে ময়নাতদন্ত শেষে ১১ই অক্টোবর রাতেই ইকরামের লাশ দাফন করেছে তার স্বজনরা। আর সোমবার ৫ আসামিকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। নাজমা বেগম ও নাজিম উদ্দিনকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করা হয়েছে।
যেভাবে হয় হত্যার পরিকল্পনা: স্কুলছাত্রী সুমাইয়াকে উত্ত্যক্তের দায়ে কারাভোগের পর গত দুই/তিন মাস আগে ছাড়া পায় শিমুল। জেল থেকে এসে একতরফা প্রেমিক শিমুল দেখেন সুমাইয়া অন্যের স্ত্রী। সুমাইয়াকে পেতেই হবে তার। প্রয়োজনে সুমাইয়ার পরিবারকে শেষ করে দিতে হবে। যে কোনো বাধা অতিক্রম করতে হবে। কিন্তু শিমুলের সকল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাঝপথে বাধা ইকরাম। কারণ সুমাইয়ার পিতা বাহার উদ্দিন থাকেন প্রবাসে। এই পরিবারে এখন পুরুষ বলতে শুধু ইকরামই। যে করেই হউক ইকরামকে চিরদিনের জন্য সরিয়ে ফেলতে হবে। শিমুল তার সহযোগীদের নিয়ে পরিকল্পনা আঁটতে থাকেন। ইকরামকে ঘায়েল করার রাস্তা খুঁজতে থাকেন। ইকরামের আরেক খালাতো বোন শিবলী বেগমের (লাভলীর ছোট বোন) ছেলে সরাইল সদর ইউনিয়নের বড্ডা পাড়া গ্রামের মজনু মিয়ার ছেলে সাদীকে হাতে নেয় শিমুল বাহিনী। তার সঙ্গে মিশে ভালো ব্যবহার করে সম্পর্ক গড়ে তুলে। হত্যাকাণ্ডে সাদীকে ব্যবহার করা হয়েছে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে। ইকরাম ও সাদী সম্পর্কে মামা-ভাগিনা হলেও চলতো বন্ধুর মতো। একসঙ্গে ঘুরতে যেত। ছবি তুলতো। ভিডিও করতো। খালা লাভলীর বাড়িতে যেত সাদী। রাতে ওই বাড়িতে ইকরামের সঙ্গে ঘুমাতো। সম্প্রতি দুষ্টমির ছলে মামা-ভাগিনার মধ্যে হাতাহাতি হয়। এ নিয়ে সাদী ইকরামের ওপর চরমভাবে ক্ষুব্ধ হয়। আর এ সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়েছে শিমুল বাহিনী। তারা সাদীকে কুপরামর্শ দিয়ে বশে নিয়ে হত্যাকাণ্ডের পথে এগিয়ে যায়। 
লোমহর্ষক বর্ণনা সাদীর: নিহত ইকরাম ও সাদী সম্পর্কে মামা-ভাগিনা। আর লাভলী বেগম সাদীর আপন খালা। সাদী ও ইকরাম লাভলী বেগমের ঘরেই থাকতো। কিছু নিয়ে কথা কাটাকাটি হলে ইকরাম প্রায়ই সাদীর গায়ে হাত তুলতো। এ জন্য ইকরামের ওপর সাদীর রাগ ছিল। লাভলী আক্তারের স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে শিমুল উত্ত্যক্ত করতো। এ নিয়ে গত কয়েক মাস আগে ইকরাম শিমুলকে মেরেছে। তাই শিমুলেরও ইকরামের ওপর রাগ ছিল। গত ১০ই অক্টোবর শনিবার রাত ১১টা-১২টার দিকে ইকরাম ও সাদী হেঁটে যাচ্ছিল। এমন সময় ইকরামের নাম্বারে একটি ফোন আসে। রাত ১২টার সময় ইকরাম বের হয়ে যায়। রাত সোয়া ১২টার দিকে সাদী শিমুলের মুুরগির ফার্মে যায়। সেখানে গিয়ে সাদী দেখে শিমুল ও সোহাগ বসে আছে।
এরা দুইজন সাদীকে বলে ইকরামকে মেরে ফেলবে। সাদী বলে ইকরামকে মারার দরকার নেই। না মেরে হাত-পা ভেঙে দিলেই হবে। সাদী যথারীতি ইকরামের সঙ্গে থাকতে যায়। রাত তখন ১টা ৩০ মিনিট। ইকরাম ঘুমোচ্ছে। আর সাদী বসে ভিডিও দেখছে। ঘরের দরজা খোলা। এর ৩০-৪০ মিনিট পর সোহাগ ও শিমুল ছুরি, দড়ি, বস্তা নিয়ে ঘরে ঢুকে। তাদের কথামতো সাদী ঘুমন্ত ইকরামের পা চেপে ধরে। সোহাগ ইকরামের দুই হাত চেপে ধরে। আর শিমুল ঘরে থাকা দা দিয়ে প্রথমে ইকরামের গলা কাটে। পরে দা-ছুরি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে পোঁচ মারে। দেহকে ছোট করার জন্য পা দুটিকে বিভিন্ন ভাবে বাধার চেষ্টা করে। বস্তায় ঢুকিয়ে ফেলে রেখে শিমুল ও সোহাগ পালিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর সাদীও বের হয়ে যায়। সকালে পুলিশ সাদীর নানা বাড়ি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে।

No comments

Powered by Blogger.