মুজিব গ্রাফিক নভেল: কীভাবে হলো, কেন হলো by পার্থ শঙ্কর সাহা
গ্রাফিক্সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমানের বাবা শেখ লুৎফর রহমানের তরুণ বয়সের কোনো ছবি নেই। অথচ
ছবিটি দরকার। শিশু মুজিবের সঙ্গে তরুণ পিতা লুৎফর রহমানের নানা ঘটনার
বর্ণনা আছে ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। ‘মুজিব গ্রাফিক নভেল’ মূলত
এই বইটির ওপর ভিত্তি করেই তৈরি। এই বইটির জন্য লুৎফর রহমানের ছবি আঁকা হলো
তাঁর পরিণত বয়সের ছবি দেখে। তবে এটি পছন্দ করলেন না প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা। তাঁর আপত্তি দাদার দাড়ির দৈর্ঘ্যে। এত বড় তো দাদার দাড়ি ছিল না,
কমাতে হবে। নয়তো বাস্তবতার কাছাকাছি যাবে না। অঙ্কনশিল্পী আবার মুজিব-জনকের
ছবি আঁকলেন। শেষতক পছন্দ হলো প্রধানমন্ত্রীর।
মুজিব গ্রাফিক নভেলের প্রতিটি সংখ্যা খুঁটিনাটি দেখে দেন শেখ হাসিনা। এই নভেলের প্রকাশক আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)। এর নির্বাহী পরিচালক সাব্বির বিন শামসের কাছেই ঘটনাটি শোনা। সাব্বির শামসের কথা, ‘গ্রাফিক নভেলের স্বাভাবিক প্রয়োজনে সংলাপ জুড়ে দেওয়া হয়েছে, নতুন করে ছবি আঁকতে হয়েছে। কিন্তু তা যেন “অসমাপ্ত আত্মজীবনী”র বর্ণনাকে কোনোভাবেই বিকৃত না করে, এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা নেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি সিরিয়াসলি দেখেন।’
বঙ্গবন্ধুর জীবনের অসামান্য দলিল ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সালে কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দী হিসেবে থাকার সময় নিরিবিলি সময়ে আত্মজীবনী লিখেছেন তিনি। তবে তাঁর লেখা চারটি খাতা হারিয়ে গিয়েছিল! দীর্ঘ সময় পর ২০০৪ সালে এগুলো শেখ হাসিনার হাতে আসে। এর কিছুদিন আগেই শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা হয়েছে। হামলায় নিহত হন আওয়ামী লীগের ২২ নেতা-কর্মী। চারটি খাতা পাওয়ার পর তাঁর প্রবল উচ্ছ্বাসের কথা বইটির ভূমিকায় লিখেছেন শেখ হাসিনা, ‘খাতাগুলো পেয়ে আমি তো প্রায় বাকরুদ্ধ। এ হাতের লেখা আমার অতি চেনা। ছোট বোন রেহানাকে ডাকলাম। দুই বোন চোখের পানিতে ভাসলাম। হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে পিতার স্পর্শ অনুভব করার চেষ্টা করলাম। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। তার পরই এই প্রাপ্তি। মনে হলো যেন পিতার আশীর্বাদের পরশ পাচ্ছি।’
বাংলাদেশের স্থপতির এই আশীর্বাদ দুই মুজিব-কন্যা শুধু নিজেদের জন্য রাখেননি। একে বই আকারে প্রকাশ করে সবার জন্য দিয়েছেন। কিন্তু এই বইকে শিশু-কিশোর উপযোগী করে গ্রাফিক নভেল করার উদ্যোগ কেন? সিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক সাব্বির বিন শামস বলছিলেন, ‘নতুন প্রজন্মের কাছে তাদের পছন্দের ফরম্যাটে বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরার উদ্দেশ্যেই মুজিব গ্রাফিক নভেল। এখানে নতুন প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া হয়েছে। আত্মজীবনীতে বর্ণিত নানা ঘটনা নাটকীয় আকারে তুলে ধরা হয়েছে। করা হয়েছে শিশুদের জন্য চিত্তাকর্ষক।’
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার মুজিব একটু একটু করে নিজেকে তৈরি করেছেন। কিশোরবেলা থেকেই তাঁর নানা কর্মকাণ্ডে প্রকাশ পায় ভবিষ্যৎ বঙ্গবন্ধু হওয়ার ইঙ্গিত। তাঁর জীবনটাই কেটেছে আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে। তবে সেই মানুষটিরও ছিল দুরন্ত শৈশব, কৈশোর। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে সেসবের নানা বর্ণিল বর্ণনা।
কেন মুজিব গ্রাফিক নভেল
কিশোর মুজিব বাবা লুৎফর রহমানের বিরুদ্ধে ফুটবল খেলেছিলেন বার কয়েক। সত্যি। তখন বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের ফুটবল দলে অধিনায়ক। আর বাবা লুৎফর রহমান অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি। মাঠে খেলার পোশাকে বাপ-ছেলের লড়াই। গ্রাফিক নভেলে দেখা যাচ্ছে বাবা লুৎফর বলছেন, ‘কী মুজিব, ভয়ে তো আজ খেলতেই চাইছিলে না।’
কিশোর মুজিবের জবাব, ‘আব্বা, আপনি জানেন ভয় আমরা পাই না। আপনারা বাইরের প্লেয়ার নিয়ে এসেও তো এ বছর আমাদের সাথে জিততে পারেননি।’
নভেলে দেখা যায়, এ জেড খান কাপের টানা কয়েক ম্যাচে অফিসার্স ক্লাবকে হারিয়ে ফাইনালের আগে সময় চান মুজিব। কিন্তু অফিসার্স ক্লাবের সেই সময় নেই। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের অনুরোধে শেষে মুজিবের দল খেলতে রাজি হয়। তবে এক গোলে বাবার দলের কাছে হারে মুজিবের স্কুলের দল। খেলা শেষে ক্লান্ত, মন খারাপ করে থাকা মুজিবের মনে পড়ে প্রধান শিক্ষকের কথা, ‘বাবার কাছে হার মানো। বাপের কাছে হার মানলে মান যায় না কখনো।’
নিজের অবস্থানে সব সময় দৃঢ় ছিলেন মুজিব। একগুঁয়ে হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু মানুষের কষ্ট শুনলেও সেই কঠোর ছেলেটি জীবন বাজি রাখতেন। এগিয়ে যেতেন বুক চিতিয়ে। সেই বাবাকে বলা কথার মতোই, ‘আপনি জানেন ভয় আমরা পাই না।’
মানুষ অন্তঃপ্রাণ মুজিবের পরিচয় মেলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই সময়ে। যুদ্ধের দামামায় খাদ্যসংকট প্রবল। রাস্তায় মানুষ-কুকুর খাবারের জন্য লড়াই করছে। কী করলেন মুজিব তখন? নিজের জীবনীতে লিখেছেন, ‘আমি লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপ দিলাম। লঙ্গরখানা থেকে দিনে একবার খাবার দেওয়া হতে থাকল।’
এ পর্যন্ত মুজিব গ্রাফিক নভেলের বাংলা ভাষায় ছয়টি, ইংরেজিতে তিনটি এবং জাপানি ভাষায় দুটি সংখ্যা বেরিয়েছে। জাপানের অনুবাদ করেছেন মাসাকি ওহাসি। সিআরআই সূত্র জানায়, বাংলায় সপ্তম সংখ্যার কাজ চলছে। সব মিলিয়ে সংখ্যা হবে ১০টি। আর ইংরেজিতে তিনটি পর্ব বের হয়েছে। আগামী ঢাকা লিট ফেস্টে বের হবে চতুর্থ সংখ্যা। ইংরেজিটি সাধারণত ঢাকা লিট ফেস্টে বের হয়। গ্রাফিক নভেলের প্রকাশক দুজন। বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। ২০১৫ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীতে বের হয় প্রথম সংখ্যা।
বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে অনেক বই আছে। কিন্তু ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ তাঁর নিজের লেখা। তাই বইটিকে যখন শিশু-কিশোর উপযোগী করার চেষ্টা করা হলো, তখন বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠল। কারণ, ঘটনার অনুপুঙ্খ বর্ণনা তো নভেল না। এখানে কাহিনি আছে, বিভিন্ন চরিত্র আছে। তাদের মুখের সংলাপ জুড়ে দেওয়ার বিষয় আছে। আবার সেসব সংলাপ, ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা, সেই সময়ের আবহ তুলে ধরা এবং সেগুলোকে আবার কিশোর-উপযোগী করাটাও কঠিন কাজ। এসব কাজ করতে গ্রাফিক নভেলের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বিস্তর গবেষণা করেছেন। মুজিব গ্রাফিক নভেলের সম্পাদনা করেছেন শিবু কুমার শীল। তাঁর কাছে শোনা গেল সম্পাদনার সময়কার জটিলতার কথা। শিবু শীল বললেন, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বর্ণিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র যেমন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বা শেরেবাংলা ফজলুল হকের মতো চরিত্রদের ছবি সহজেই পাওয়া যায়। কিন্তু এমন সব কম গুরুত্বপূর্ণ পার্শ্বচরিত্র, যাঁরা বঙ্গবন্ধুর বর্ণনায় এসেছেন তাঁদের ছবি আঁকতে গিয়ে বা তাঁদের সংলাপ তৈরি ছিল চ্যালেঞ্জিং।
শিবু শীল জানান, সম্পাদনার আগে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র কাহিনির একটা বড় অংশ জুড়ে থাকা গোপালগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা তিনি ঘুরেছেন।
গ্রাফিক নভেলে ছবি এঁকেছেন সৈয়দ রাশাদ ইমাম তন্ময়। তাঁর কথা, ‘পুরো বইটা থেকে চরিত্রগুলোকে খুঁজে বের করতে হয়েছে। তারপর কাহিনির বিন্যাস হয়েছে।’
ছবি আঁকার ক্ষেত্রে জটিলতার প্রসঙ্গ তুলে তন্ময় বললেন, ‘হয়তো কোনো চরিত্রের একটি পাসপোর্ট সাইজ ছবি এসেছে। এখন সেটাকে পূর্ণাঙ্গ মানুষের রূপ দিতে হয়েছে। এখন পাসপোর্ট সাইজের ছবির মানুষকে যখন পূর্ণাঙ্গ আকারে দেখা হয়, তখন তাঁর পোশাকপরিচ্ছদ একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সে হিন্দু হলে ধুতি কেমন করে পরে, মুসলিম হলে লুঙ্গি বা পাজামা-পাঞ্জাবি কীভাবে পরত বা সেই সময় সম্ভাব্য কী পোশাক পরা সম্ভব ছিল, সব গবেষণার বিষয় ছিল। এসব দিকে খেয়াল রাখতে হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে উঠে এসেছে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তাঁর জীবনের নানা ঘটনার কথা। এরপর কিন্তু আরও অনেক, বলা যায় বাংলাদেশের ইতিহাসের আলোকোজ্জ্বল সব ঘটনা ঘটেছে একের পর এক। আর সেসবের ঘটনায় হিরে হয়ে দ্যুতি ছড়িয়েছেন বঙ্গবন্ধু। মুজিব ধীরে ধীরে মুজিব ভাই হয়েছেন, বঙ্গবন্ধু হয়েছেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক হয়েছেন, জাতির জনক হয়েছেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী ও পরে রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। ১৯৭৫-এর মধ্য আগস্টে বাঙালির অসম সাহসী এই বীরকে হত্যা করা হয়েছে।
সিআরআই সূত্র বলছে, গ্রাফিক নভেলে কিন্তু এসবই তুলে ধরা হবে। আর তা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু-সম্পর্কিত নানা ঐতিহাসিক দলিল, ইতিহাসের বইয়ের পাঠ চলছে। নিকটজনদের সঙ্গে আলাপচারিতাও।
গ্রাফিক নভেল যারা পড়েছে
গ্রাফিক নভেল ইতিমধ্যে যারা পড়েছে তাদের কাছে শোনা গেল কিছু কথা।
তাহিয়া তাসমিম মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। গ্রাফিক নভেল কিনেছে বাংলা একাডেমির বইমেলা থেকে। তাহিয়া বলছিল, ‘বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। ছবি দিয়ে দেওয়ায় আরও সহজ হয়ে গিয়েছে আমার জন্য।’
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী মারিয়া জামান দিয়ার কথা, ‘অনেক কিছু জানলাম। এত মজা করে ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে, তাই ভালো লেগেছে।’
তাহিয়া ও দিয়ার মতো শিশুদের জন্যই যে বইটি, তা জানালেন বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র রাদওয়ান মুজিব। তাঁর কথা, ‘বিশ্বাসের জন্য এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে কখনো বঙ্গবন্ধু ভয় পাননি। তিনি বলতেন, যে কাজ ঠিক মনে করি, তা কেউ সঙ্গে না এলেও আমি করব। এই ছাপ বইটিতে আছে। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের নতুন নাগরিকদের মনে তাঁর অমিত সেই সাহস ও নৈতিকতার ছাপ পড়ুক, “মুজিব গ্রাফিক নভেল” সে জন্যই লেখা হয়েছে।’
মুজিব গ্রাফিক নভেলের প্রতিটি সংখ্যা খুঁটিনাটি দেখে দেন শেখ হাসিনা। এই নভেলের প্রকাশক আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)। এর নির্বাহী পরিচালক সাব্বির বিন শামসের কাছেই ঘটনাটি শোনা। সাব্বির শামসের কথা, ‘গ্রাফিক নভেলের স্বাভাবিক প্রয়োজনে সংলাপ জুড়ে দেওয়া হয়েছে, নতুন করে ছবি আঁকতে হয়েছে। কিন্তু তা যেন “অসমাপ্ত আত্মজীবনী”র বর্ণনাকে কোনোভাবেই বিকৃত না করে, এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা নেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি সিরিয়াসলি দেখেন।’
বঙ্গবন্ধুর জীবনের অসামান্য দলিল ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সালে কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দী হিসেবে থাকার সময় নিরিবিলি সময়ে আত্মজীবনী লিখেছেন তিনি। তবে তাঁর লেখা চারটি খাতা হারিয়ে গিয়েছিল! দীর্ঘ সময় পর ২০০৪ সালে এগুলো শেখ হাসিনার হাতে আসে। এর কিছুদিন আগেই শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা হয়েছে। হামলায় নিহত হন আওয়ামী লীগের ২২ নেতা-কর্মী। চারটি খাতা পাওয়ার পর তাঁর প্রবল উচ্ছ্বাসের কথা বইটির ভূমিকায় লিখেছেন শেখ হাসিনা, ‘খাতাগুলো পেয়ে আমি তো প্রায় বাকরুদ্ধ। এ হাতের লেখা আমার অতি চেনা। ছোট বোন রেহানাকে ডাকলাম। দুই বোন চোখের পানিতে ভাসলাম। হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে পিতার স্পর্শ অনুভব করার চেষ্টা করলাম। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। তার পরই এই প্রাপ্তি। মনে হলো যেন পিতার আশীর্বাদের পরশ পাচ্ছি।’
বাংলাদেশের স্থপতির এই আশীর্বাদ দুই মুজিব-কন্যা শুধু নিজেদের জন্য রাখেননি। একে বই আকারে প্রকাশ করে সবার জন্য দিয়েছেন। কিন্তু এই বইকে শিশু-কিশোর উপযোগী করে গ্রাফিক নভেল করার উদ্যোগ কেন? সিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক সাব্বির বিন শামস বলছিলেন, ‘নতুন প্রজন্মের কাছে তাদের পছন্দের ফরম্যাটে বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরার উদ্দেশ্যেই মুজিব গ্রাফিক নভেল। এখানে নতুন প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া হয়েছে। আত্মজীবনীতে বর্ণিত নানা ঘটনা নাটকীয় আকারে তুলে ধরা হয়েছে। করা হয়েছে শিশুদের জন্য চিত্তাকর্ষক।’
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার মুজিব একটু একটু করে নিজেকে তৈরি করেছেন। কিশোরবেলা থেকেই তাঁর নানা কর্মকাণ্ডে প্রকাশ পায় ভবিষ্যৎ বঙ্গবন্ধু হওয়ার ইঙ্গিত। তাঁর জীবনটাই কেটেছে আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে। তবে সেই মানুষটিরও ছিল দুরন্ত শৈশব, কৈশোর। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে সেসবের নানা বর্ণিল বর্ণনা।
কেন মুজিব গ্রাফিক নভেল
কিশোর মুজিব বাবা লুৎফর রহমানের বিরুদ্ধে ফুটবল খেলেছিলেন বার কয়েক। সত্যি। তখন বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের ফুটবল দলে অধিনায়ক। আর বাবা লুৎফর রহমান অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি। মাঠে খেলার পোশাকে বাপ-ছেলের লড়াই। গ্রাফিক নভেলে দেখা যাচ্ছে বাবা লুৎফর বলছেন, ‘কী মুজিব, ভয়ে তো আজ খেলতেই চাইছিলে না।’
কিশোর মুজিবের জবাব, ‘আব্বা, আপনি জানেন ভয় আমরা পাই না। আপনারা বাইরের প্লেয়ার নিয়ে এসেও তো এ বছর আমাদের সাথে জিততে পারেননি।’
নভেলে দেখা যায়, এ জেড খান কাপের টানা কয়েক ম্যাচে অফিসার্স ক্লাবকে হারিয়ে ফাইনালের আগে সময় চান মুজিব। কিন্তু অফিসার্স ক্লাবের সেই সময় নেই। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের অনুরোধে শেষে মুজিবের দল খেলতে রাজি হয়। তবে এক গোলে বাবার দলের কাছে হারে মুজিবের স্কুলের দল। খেলা শেষে ক্লান্ত, মন খারাপ করে থাকা মুজিবের মনে পড়ে প্রধান শিক্ষকের কথা, ‘বাবার কাছে হার মানো। বাপের কাছে হার মানলে মান যায় না কখনো।’
নিজের অবস্থানে সব সময় দৃঢ় ছিলেন মুজিব। একগুঁয়ে হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু মানুষের কষ্ট শুনলেও সেই কঠোর ছেলেটি জীবন বাজি রাখতেন। এগিয়ে যেতেন বুক চিতিয়ে। সেই বাবাকে বলা কথার মতোই, ‘আপনি জানেন ভয় আমরা পাই না।’
মানুষ অন্তঃপ্রাণ মুজিবের পরিচয় মেলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই সময়ে। যুদ্ধের দামামায় খাদ্যসংকট প্রবল। রাস্তায় মানুষ-কুকুর খাবারের জন্য লড়াই করছে। কী করলেন মুজিব তখন? নিজের জীবনীতে লিখেছেন, ‘আমি লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপ দিলাম। লঙ্গরখানা থেকে দিনে একবার খাবার দেওয়া হতে থাকল।’
এ পর্যন্ত মুজিব গ্রাফিক নভেলের বাংলা ভাষায় ছয়টি, ইংরেজিতে তিনটি এবং জাপানি ভাষায় দুটি সংখ্যা বেরিয়েছে। জাপানের অনুবাদ করেছেন মাসাকি ওহাসি। সিআরআই সূত্র জানায়, বাংলায় সপ্তম সংখ্যার কাজ চলছে। সব মিলিয়ে সংখ্যা হবে ১০টি। আর ইংরেজিতে তিনটি পর্ব বের হয়েছে। আগামী ঢাকা লিট ফেস্টে বের হবে চতুর্থ সংখ্যা। ইংরেজিটি সাধারণত ঢাকা লিট ফেস্টে বের হয়। গ্রাফিক নভেলের প্রকাশক দুজন। বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। ২০১৫ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীতে বের হয় প্রথম সংখ্যা।
বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে অনেক বই আছে। কিন্তু ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ তাঁর নিজের লেখা। তাই বইটিকে যখন শিশু-কিশোর উপযোগী করার চেষ্টা করা হলো, তখন বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠল। কারণ, ঘটনার অনুপুঙ্খ বর্ণনা তো নভেল না। এখানে কাহিনি আছে, বিভিন্ন চরিত্র আছে। তাদের মুখের সংলাপ জুড়ে দেওয়ার বিষয় আছে। আবার সেসব সংলাপ, ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা, সেই সময়ের আবহ তুলে ধরা এবং সেগুলোকে আবার কিশোর-উপযোগী করাটাও কঠিন কাজ। এসব কাজ করতে গ্রাফিক নভেলের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বিস্তর গবেষণা করেছেন। মুজিব গ্রাফিক নভেলের সম্পাদনা করেছেন শিবু কুমার শীল। তাঁর কাছে শোনা গেল সম্পাদনার সময়কার জটিলতার কথা। শিবু শীল বললেন, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বর্ণিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র যেমন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বা শেরেবাংলা ফজলুল হকের মতো চরিত্রদের ছবি সহজেই পাওয়া যায়। কিন্তু এমন সব কম গুরুত্বপূর্ণ পার্শ্বচরিত্র, যাঁরা বঙ্গবন্ধুর বর্ণনায় এসেছেন তাঁদের ছবি আঁকতে গিয়ে বা তাঁদের সংলাপ তৈরি ছিল চ্যালেঞ্জিং।
শিবু শীল জানান, সম্পাদনার আগে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র কাহিনির একটা বড় অংশ জুড়ে থাকা গোপালগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা তিনি ঘুরেছেন।
গ্রাফিক নভেলে ছবি এঁকেছেন সৈয়দ রাশাদ ইমাম তন্ময়। তাঁর কথা, ‘পুরো বইটা থেকে চরিত্রগুলোকে খুঁজে বের করতে হয়েছে। তারপর কাহিনির বিন্যাস হয়েছে।’
ছবি আঁকার ক্ষেত্রে জটিলতার প্রসঙ্গ তুলে তন্ময় বললেন, ‘হয়তো কোনো চরিত্রের একটি পাসপোর্ট সাইজ ছবি এসেছে। এখন সেটাকে পূর্ণাঙ্গ মানুষের রূপ দিতে হয়েছে। এখন পাসপোর্ট সাইজের ছবির মানুষকে যখন পূর্ণাঙ্গ আকারে দেখা হয়, তখন তাঁর পোশাকপরিচ্ছদ একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সে হিন্দু হলে ধুতি কেমন করে পরে, মুসলিম হলে লুঙ্গি বা পাজামা-পাঞ্জাবি কীভাবে পরত বা সেই সময় সম্ভাব্য কী পোশাক পরা সম্ভব ছিল, সব গবেষণার বিষয় ছিল। এসব দিকে খেয়াল রাখতে হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে উঠে এসেছে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তাঁর জীবনের নানা ঘটনার কথা। এরপর কিন্তু আরও অনেক, বলা যায় বাংলাদেশের ইতিহাসের আলোকোজ্জ্বল সব ঘটনা ঘটেছে একের পর এক। আর সেসবের ঘটনায় হিরে হয়ে দ্যুতি ছড়িয়েছেন বঙ্গবন্ধু। মুজিব ধীরে ধীরে মুজিব ভাই হয়েছেন, বঙ্গবন্ধু হয়েছেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক হয়েছেন, জাতির জনক হয়েছেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী ও পরে রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। ১৯৭৫-এর মধ্য আগস্টে বাঙালির অসম সাহসী এই বীরকে হত্যা করা হয়েছে।
সিআরআই সূত্র বলছে, গ্রাফিক নভেলে কিন্তু এসবই তুলে ধরা হবে। আর তা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু-সম্পর্কিত নানা ঐতিহাসিক দলিল, ইতিহাসের বইয়ের পাঠ চলছে। নিকটজনদের সঙ্গে আলাপচারিতাও।
গ্রাফিক নভেল যারা পড়েছে
গ্রাফিক নভেল ইতিমধ্যে যারা পড়েছে তাদের কাছে শোনা গেল কিছু কথা।
তাহিয়া তাসমিম মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। গ্রাফিক নভেল কিনেছে বাংলা একাডেমির বইমেলা থেকে। তাহিয়া বলছিল, ‘বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। ছবি দিয়ে দেওয়ায় আরও সহজ হয়ে গিয়েছে আমার জন্য।’
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী মারিয়া জামান দিয়ার কথা, ‘অনেক কিছু জানলাম। এত মজা করে ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে, তাই ভালো লেগেছে।’
তাহিয়া ও দিয়ার মতো শিশুদের জন্যই যে বইটি, তা জানালেন বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র রাদওয়ান মুজিব। তাঁর কথা, ‘বিশ্বাসের জন্য এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে কখনো বঙ্গবন্ধু ভয় পাননি। তিনি বলতেন, যে কাজ ঠিক মনে করি, তা কেউ সঙ্গে না এলেও আমি করব। এই ছাপ বইটিতে আছে। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের নতুন নাগরিকদের মনে তাঁর অমিত সেই সাহস ও নৈতিকতার ছাপ পড়ুক, “মুজিব গ্রাফিক নভেল” সে জন্যই লেখা হয়েছে।’
No comments