মানুষ কেন এখন বর্বরতা ঠেকাতে এগিয়ে আসে না: নূর খানের ব্যাখ্যা
বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যার ঘটনা নৃশংস বর্বর। তবে
প্রকাশ্যে এ ধরনের বর্বর ঘটনার প্রতিবাদ বা প্রতিরোধে সাধারণ মানুষ এগিয়ে
আসছে না কারণ মানুষ ভয়ার্ত এবং বিচারহীনতার মধ্যে রয়েছেন। রেডিও তেহরানকে
দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট মানবাধিকার
কর্মী নূর খান লিটন।
তিনি আরও বলেন, বরগুনার ঘটনা যারা ঘটিয়েছেন তাদেরকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ্যভাবে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা লালন-পালন করেছে।
সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
- বিচারহীনতা ও ভয়ার্ত পরিবেশের মধ্যে থাকায় সাধারণ মানুষ কোনো অপরাধের প্রতিবাদ বা প্রতিরোধে এগিয়ে আসছে না।
- ক্রসফায়ার অপরাধ সমস্যার সমাধান না করে বরং নৃশংস বর্বর ঘটনার জন্ম দিচেছ।
- বন্দুকযুদ্ধের মতো কোনো পদ্ধতি দিয়ে ন্যায় বিচার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই
- রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অবহেলার কারণে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে, বিচারের উর্ধ্বে থাকছে
- বিচারহীনতার ফলশ্রুতিতে সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি বহমান থাকছে
- দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সংকুচিত হয়ে এসেছে এবং মানুষের কন্ঠরোধ করা হচ্ছে
রেডিও তেহরান: বরগুনার আলোচিত
রিফাত শরীফ হত্যা নিয়ে এখনো সারা বাংলাদেশে আলোচনা চলছে। দিনের আলোয় কুপিয়ে
হত্যা করে বীরদর্পে চলে গেছে হত্যাকারীরা। এরইমধ্যে হত্যা মামলার প্রধান
আসামী নয়ন বন্ড বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। তো হত্যাকাণ্ড এবং প্রধান আসামির
বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার বিষয়ে কি বলবেন আপনি?
নূর খান লিটন: দেখুন,
বরগুনায় রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ড নিয়ে যে আলোচনা হচ্ছে সে ঘটনাটিকে আমি চরম
বর্বর ঘটনা বলতে চাই। কারণ স্ত্রীর সামনে তার স্বামীকে কয়েকজন মিলে কুপিয়ে
নৃশংসভাবে হত্যা করল। ওই বর্বর ঘটনাটি আসলে ভাষায় প্রকাশের মতো কোনো বিষয়
না। এধরনের হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করার ভাষাও আমার জানা নেই। একটি সমাজে
স্ত্রীর সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে তার স্বামীকে কুপিয়ে হত্যা করা করবে
সন্ত্রাসীরা অথচ সাধারণ মানুষ তার প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধে এগিয়ে আসবে না
এমনটি আমাদের সমাজে বিগত দিনে ছিল না। বিগত দিনগুলোতে আমরা দেখেছি একে
অপরের বিপদে ঝাপিয়ে পড়তে এবং রক্ষা করতে।
অথচ সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অবস্থা এমন যে
সারাদেশ একটা ভয়ার্ত পরিবেশের মধ্যে আছে। বিচারহীনতার চাদরে মুড়ে আছে গোটা
দেশ। একের বিপদে অপরে এগিয়ে আসতে পারছে না একটা ভয়ার্ত পরিবেশ ও
বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে।
বরগুনার রিফাত হত্যা কাণ্ডের যে ঘটনাটি
গোটা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করল ওই ঘটনার একটু পূর্বাপর যদি আমি আমার বিবেচনায়
আনি তাহলে দেখতে পাব এই ধরনের অপরাধীরা কোনো না কোনোভাবে প্রত্যক্ষ বা
পরোক্ষভাবে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আশ্রয়-প্রশয় পেয়ে থাকে। বরগুনার ওই
ঘটনায়ও নয়ন বন্ডদের গডফাদার সরকারি দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা। তারাই
নয়ন বন্ড গংদের লালন-পালন ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছে এমন আভাস আমরা পাচ্ছি।
বরগুনায় নৃশংসভাবে রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় |
এছাড়া সাধারণ মানুষ এমন এক ভয়ার্ত
পরিবেশের মধ্যে আছে যেখানে যৌক্তিক কথা বলার কারণে তাদের বিপদে পড়তে হয়।
প্রকাশ্যে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে নানাধরনের
বাধা- বিপত্তি ভয় রয়েছে মানুষের মধ্যে। আর সে কারণেই প্রকাশ্যে কুপিয়ে
হত্যার পরও সেখানে কাউকে প্রতিবাদ বা প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে দেখছি না এবং এ
ধরনের অপরাধের ঘটনা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষযের কথা বলব সেটি হচ্ছে, বরগুনার মতো ঘটনার ক্ষেত্রে
ক্রসফায়ারের নামে যারা সংক্ষিপ্ত পথে এ সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজছেন তারাও
কিন্তু নৃশংস বর্বর ঘটনা ঘটাচ্ছেন এবং আইন বহির্ভূত কাজের সঙ্গে যুক্ত
হচ্ছেন। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে একটি অপরাধ আরেকটি অপরাধকে আমন্ত্রণ জানায়।
একটি অপরাধ নাগরিক ঘটালেও যেভাবে বিবেচ্য হবে সেই একই ঘটনা যদি
রাষ্ট্রপক্ষ ঘটায় বা রাষ্ট্রীয় কোনো বাহিনী ঘটায় তখন তার সেই অপরাধটাকে আরও
বড় করে দেখা উচিত।
আমাদের দুর্ভাগ্য প্রতিনিয়ত ক্রসফায়ারের
নামে কোড-আনকোড বন্দুক যুদ্ধের নামের একের পর এক প্রতিনিয়ত হত্যার ঘটনা
ঘটছে এবং রাষ্ট্র সেটাকে থামিয়ে দেয়ার জন্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ
করছে না। গত এক দশকে কয়েক হাজার মানুষ এভাবে নিহত হয়েছেন। প্রায় পাঁচশতাধিক
মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন। গুমের শিকার হওয়া মানুষগুলোর তথ্য উদঘাটনের
ব্যাপারে কার্যকর কোনো তদন্ত এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে
অবহেলার কারণে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে, বিচারের উর্ধ্বে থাকছে।
বিচারহীনতার ফলশ্রুতিতে সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি বহমান থাকছে।
রেডিও তেহরান: এ ঘটনাকে নিতান্তই নৈতিক অবক্ষয় হিসেবে দেখবেন নাকি আইনের শাসনের ঘাটতি হিসেবেও দেখবেন?
নূর খান লিটন: দেখুন,
এঘটনাকে একদিকে যেমন নৈতিক অবক্ষয় বলব পাশাপাশি আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর
প্রবণতাও বলব। আর এমনটি লক্ষ্য করছি রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায় থেকে।
বিশেষ করে আপনারা জানেন বাংলাদেশে
গণতান্ত্রিক অবস্থা ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। এখানে মানুষের সংঘটিত
অধিকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হচ্ছে। প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে
মানুষকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। বাগস্বাধীনতাকে ক্রমান্বয়ে কণ্ঠরোধ
করা হচ্ছে। এমনই একটা অবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি। সেক্ষেত্রে
রাষ্ট্রের নির্লিপ্ততা প্রছন্নভাবে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে
রাষ্ট্রের ইন্ধনের কথাই আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয়।
রেডিও তেহরান: আপনার কী মনে হয় এ ধরনের বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনা ন্যায়বিচারের পথে বাধা?
নূর খান লিটন: দেখুন,
যখন সমাজে যখন বিচার থাকে না এবং বিচার ব্যবস্থার সংকট দেখা দেয় তখন এই
ধরনের পথ কোনো কোনো গোষ্ঠী বেছে নেয়। অবশ্য সেটি কখনই কাম্য নয় এবং এ ধরনের
বিষয় বিচার ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাগুলি দেখানোরই নামান্তর মাত্র। এসব ঘটনার
মধ্য দিয়ে বিচারের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা দেখা যাচ্ছে। সরকারের যে
বাহিনী বা যারা এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটাচ্ছেন তাদের
প্রতি কোথাও না কোথাও আস্থার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।
রেডিও তেহরান: যদি বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনা ন্যায়বিচারের পথে বাধা হয় তাহলে এই মামলার ন্যায়বিচার কীভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হবে?
নূর খান লিটন: দেখুন,
বন্দুকযুদ্ধের মতো কোনো পদ্ধতি দিয়ে ন্যায় বিচার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
একমাত্র জনবিক্ষোভের মুখে হয়তো কোনো একদিন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে বলে
আমি আশা করি। সমাজের এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে যে নীতি নৈতিকতার
অবক্ষয় আমরা লক্ষ্য করছি এমনটি কোনো গণতান্ত্রিক দেশে চলমান থাকতে পারে না।
বন্দুকযুদ্ধে নিহত সন্ত্রাসী নয়ন বন্ড |
No comments