বাংলাদেশে গ্যাসের দাম বাড়ায় আরো যেসব খাতে খরচ বাড়বে
বাংলাদেশে ১লা জুলাই থেকে গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কার্যকর
হয়েছে, যার ফলে আবাসিক খাত থেকে শুরু করে পরিবহন, শিল্প খাতের মত অনেক
ক্ষেত্রেই গ্রাহকরা প্রভাবিত হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আবাসিক খাতে দুই চুলার খরচ ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৭৫ টাকা আর এক চুলার
খরচ ৭৫০ টাকা থেকে ৯২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গৃহস্থালি মিটারে দাম
বেড়েছে প্রতি ঘনমিটারে ৯.১০ টাকা থেকে ১২.৬০ টাকা।
সিএনজি’র ক্ষেত্রে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৪০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৩ টাকা করা হয়েছে, অর্থাৎ দাম বেড়েছে ৭.৫ শতাংশ।
এছাড়া বিদ্যুত ও সার উৎপাদনের জন্য, হোটেল ও রেস্তোঁরা, ক্যাটপিভ
পাওয়ার, শিল্প ও চা বাগানে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া
হয়েছে।
তবে অপরিবর্তিত আছে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম।
গড়ে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৭.৩৮ টাকা থেকে ২.৪২ টাকা বাড়িয়ে ৯.৮০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
গড়ে দাম বেড়েছে ৩২.০৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে
এলএনজি’র আমদানি খরচ এবং বাংলাদেশের বাজারে গ্যাস বিক্রি থেকে আসা রাজস্ব
আয়ের মধ্যে ঘাটতির পরিমাণ হবে ১৮ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা, যার মধ্যে গ্যাসের
দাম বৃদ্ধি থেকে অতিরিক্ত রাজস্ব আয় হওয়ার কথা ৮ হাজার ১৬০ কোটি টাকা।
এরপরও আরও ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ সরকারকে ভর্তুকী দিতে হবে এই খাতে।
মূল্যবৃদ্ধির যুক্তি সঠিক নয়
বাংলাদেশে যেই যুক্তিতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে, তা কতটা সঠিক
সেবিষয়ে প্রশ্ন তোলেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষক ও
অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ।
মিজ. আহমেদ বলেন, “কোনো দ্রব্যের উৎপাদন খরচ কিংবা বিতরণ খরচের ক্ষেত্রে
যুক্তিযুক্ত কোনো প্রয়োজন হলে দ্রব্যের দাম বাড়াটা স্বাভাবিক।”
“দাম বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বলছে,
আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজি’র দাম বেড়ে যাওয়ায় এলএনজি আমদানি খরচ বেড়ে
গেছে এবং তার ফলে গ্রাহক পর্যায়েও দাম বাড়াতে হচ্ছে।”
কিন্তু বাংলাদেশের গ্যাস উৎপাদনকারী এবং বিতরণকারী সংস্থাগুলো
দুর্নীতিমুক্তভাবে স্বচ্ছতার সাথে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করলে দেশে
গ্যাস আমদানির চাহিদা অনেক কমে যেত বলে মন্তব্য করেন মিজ. আহমেদ।
“গ্যাস উৎপাদনকারী এবং বিশেষ করে বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো
দুর্নীতিমুক্ত হলে, নিজেদের সিস্টেম লস কমালে এবং কার্যকরভাবে তাদের
দায়িত্ব পালন করলে বিপুল পরিমাণ এলএনজি আমদানি করা প্রয়োজন হয় না।”
মিজ. আহমেদ মনে করেন, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষ
এতটা অসন্তুষ্ট হতো না যদি উৎপাদন ও বিতরণে সিস্টেম লস বা দুর্নীতির বিষয়ে
কোনো ব্যাখ্যা বা জবাবদিহিতার প্রয়াস থাকতো কর্তৃপক্ষের।
গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গ্রাহকরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
আবাসিক খাত
গৃহস্থালির ব্যবহারে এক চুলা এবং দুই চুলা উভয় ক্ষেত্রেই মাসিক খরচ বেড়েছে ১৭৫ টাকা করে।
এর ফলে উচ্চ আয়ের মানুষের তুলনায় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের দৈনন্দিন খরচের ওপর বেশি বোঝা তৈরি করবে।
পরিবহন খাত
সিএনজি’র দাম ৭.৫ শতাংশ বাড়ায় সরাসরি প্রভাবিত হবে পরিবহন খাত।
সিএনজি চালিত অটোরিকশার মত গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধির পাশাপাশি গ্যাসচালিত সকল গাড়ির ক্ষেত্রে যাতায়াত খরচ বৃদ্ধি পাবে।
সার উৎপাদন
সার উৎপাদনের ক্ষেত্রে গ্যাসের মূল্য প্রতি ঘনমিটারে ২.৭১ টাকা থেকে
বাড়িয়ে ৪.৪৫ টাকা করা হয়েছে, দাম বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৬৫ ভাগ।
মিজ. আহমেদ বলেন, “সরকার হয়তো কৃষককে অতিরিক্ত দামে সার কিনতে বাধ্য করবে না, কিন্তু তাহলে সারের জন্য ভর্তুকীর পরিমাণ বেড়ে যাবে।”
সেক্ষেত্রে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে রাজস্ব ঘাটতি পূরণ করার যে কৌশল সরকার
অবলম্বন করতে চাচ্ছে, আরেক খাতে অতিরিক্ত ভর্তুকী দিয়ে সেই কৌশলও
ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন
বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৩.১৬ টাকা থেক বাড়িয়ে ৪.৪৫ টাকা করা হয়েছে।
এক্ষেত্রে দাম বেড়েছে প্রায় ৪১ শতাংশ।
স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করলে, এর ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়বে এবং গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দামও বাড়বে।
তবে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারনে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি হবে না।
শিল্প কারখানার পরিচালনা ব্যয়
শিল্পখাতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম প্রায় ৩৮ শতাংশ বাড়িয়ে ৭.৭৬ টাকা থেকে ১০.৭০ করা হয়েছে।
এর ফলে শিল্প কারখানার পরিচালনা ব্যয় বাড়ায় সেসব কারখানার পণ্যের দাম বৃদ্ধি হতে পারে এবং প্রভাবিত করতে পারে গ্রাহকদের।
মিজ নাজনীন আহমেদ বলেন, “গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে সাধারণ মানুষের
গৃহস্থালির খরচ বা যাতায়াত খরচ তো বাড়বেই, পাশাপাশি শিল্প কারখানায় পণ্য
উৎপাদন ব্যয় বাড়ায় সেসব পণ্যের দাম বাড়ার ফলেও চাপ পড়তে পারে তাদের
ওপর। “
No comments