রাজধানীর ‘জলাবদ্ধতা’ কোনো সুখবর নেই by সুদীপ অধিকারী
গত বছর ২৬শে জুলাই সচিবালয়ে জেলা প্রশাসকের সম্মেলনে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত এক আলোচনা সভায় পল্লী উন্নয়ন সমবায় ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঘোষণা দেন,‘ বৃষ্টির কারণে বর্তমান জলাবদ্ধতা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতিটা আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে। আমি প্রমিজ করছি, সামনের বছর থেকে আপনারা আর জলাবদ্ধতা দেখবেন না।’ এই ঘোষণার পরই ঢাকার দুই মেয়র মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। মন্ত্রীও ৮৫ শতাংশ জলাবদ্ধতা দূর করার আশ্বাস দেন। জলাবদ্ধপূর্ণ এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন ঘোষণা দেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে শিগগিরই আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। এজন্য রাজধানীর জলাবদ্ধপূর্ণ ৪৮টি এলাকাও চিহ্নিত করেন তিনি। কিছু প্রকল্প কাজও চলতে দেখা যায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়। ডিএসসিসি’র অভ্যন্তরীণ তথ্য ও সামপ্রতিক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায়, জলাবদ্ধপ্রবণ এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ধানমন্ডি-২৭, রাপা প্লাজা, ধানমন্ডি-৮/এ স্টাফ কোয়ার্টার মোড়, কাঁঠাল বাগান, গ্যাস্ট্রোলিভার গলি, কলাবাগান ডলফিন গলি, গ্রিনরোড, মাদারটেক ও মেরাদিয়া। এসব এলাকাগুলোর পানি নিষ্কাশন হয় পান্থপথ বক্স কালভার্ট-হাতিরঝিল হয়ে রামপুরা খাল দিয়ে চলে যায় বালু নদীতে। এদিকে জলাবদ্ধ এলাকা নিউমার্কেট পশ্চিম-দক্ষিণ পাশের বটতলা, বিজিবি- ৩নং ও ৪ নং গেট, নাজিমউদ্দিন রোড, হোসেনী দালান, চকবাজার, লালবাগ, কাজী আলাউদ্দিন রোড ও বংশাল এলাকার পানি নিষ্কাশন হয় বুড়িগঙ্গা স্লুইসগেট হয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে। মতিঝিল, দিলকুশা, দৈনিক বাংলা, শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক, সেগুনবাগিচা, পল্টন, বেইলী রোড, সিদ্ধেশ্বরী, সার্কিট হাউজ রোড, রাজারবাগ, শান্তিবাগ, ফকিরাপুল ও আরামবাগ এলাকার জমা পানি সেগুনবাগিচা বক্স কালভার্ট, কমলাপুর পাম্প, মানিকনগর খাল, জিরানি খাল ও মাণ্ডাখাল হয়ে বালু নদী ও বুড়িগঙ্গায় চলে যায়। কিন্তু গুলিস্তান এলাকার জমে থাকা পানির সরে যাওয়ার তেমন কোনো পথ খোলা না থাকায় একটু বৃষ্টি হলেই সচিবালয় এলাকাতে পানি জমে যেতে। এই সংকট নিরশনেই এবার বর্সা মৌসুমের আগদিয়ে শুরু হয়েছে পল্টন মোড় হয়ে সচিবালয়ের দেয়াল ঘেঁষে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তা খননের কাজ। জলাবদ্ধতার হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে রাস্তা খোঁড়ার ফলে এলাকাটিতে সাধারণ পথচারীদের ভোগান্তি বেড়েছে কয়েকগুণ। রাস্তার উপর তৈরি হওয়া কাদা-মাটির হাত তেকে বাঁচতে ফুটপাতে ওঠার ব্যবস্থাটুকু নেই সেখানে। এদিকে ফার্মগেট খামার বাড়ি এলাকায়ও চলছে সংস্কার কাজ। ব্যস্ততম এই সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির ফলে তীব্র যানযটের যন্ত্রণার সঙ্গে পোহাতে হচ্ছে জলাবদ্ধতাও। তবুও সিটি করপোরেশনের দাবি বিগত দিনের তুলনায় এ বছর পানি নিষ্কাশনে অনেকটায় সফল হয়েছেন তারা। কিন্তু নগরবাসীর ভাষ্য- আগের তুলনায় রাস্তায় জলাবদ্ধতা তেমন কিছুই কমেনি বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। সরজমিন দেখা যায়, আবাসিক এলাকা ধানমন্ডির জলাবদ্ধতা দূর করার লক্ষ্যে মাটির নিচে পানি নিষ্কাশনের ছোট পাইপ পরিবর্তন করে বড় পাইপ লাগানোসহ বিভিন্ন সংস্কার কাজ শুরু করেছে ডিএনসিসি। এক মাসের কাজ ছয় মাস গড়িয়ে কিছুদিন আগেই শেষ হয়েছে ধানমন্ডি-১৫ নম্বর বাসস্ট্যান্ড থেকে স্টাফ কোয়ার্টার হয়ে জিগাতলা নতুন রাস্তার সংস্কার কাজ। কাজ শেষে মূল রাস্তাটিতে পানি না দাঁড়ালেও, ত্রুটিপূর্ণ ড্রেনেজ ব্যবস্থার জন্য আশপাশের এলাকার পানি ঢুকে পড়ছে। দেখা যায় সামান্য বৃষ্টিতেই তলিয়ে যাচ্ছে খোদ সিটি করপোরেশনের কমিশনারের বাড়ি সংলগ্ন এলাকা। অন্যদিকে সমতা না রেখে এই এক এলাকার পাইপ বদলানোতে অন্যসব এলাকায় আগের তুলনায় এখন পানি জমছে দ্বিগুণ। একটু বৃষ্টিতেই জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড থেকে পোস্টঅফিস পর্যন্ত রাস্তাটি তলিয়ে যাচ্ছে পানির নিচে। ব্যস্ততম এই রাস্তায় পানির মধ্যে চলতে গিয়ে হরহামেশাই বিগড়ে যাচ্ছে মোটরসাইকেল, সিএনজি অটোরিকশাসহ বিভিন্ন ইঞ্জিনচালিত যানবাহন। ফলে বৃষ্টির দিন এলাকাটিতে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানযট। শবেমাত্র শেষ হয়েছে ধানমন্ডি শঙ্কর এলাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থার কাজ। কিন্তু সংস্কার কাজের দীর্ঘ ভোগান্তির পরও তেমন কোনো সুফল পায়নি এলাকবাসী। স্থানীয় বাসিন্দা লিয়াকত আলী বলেন, তিন-চার মাস ধরে এই রাস্তায় পাইপ পাল্টানোর কাজ চলছিল। যানবাহন তো দূরের কথা পায়ে হেঁটে পথ চলাও তখন দায় ছিল। কিন্তু কাজ শেষের পরও জলাবদ্ধতা তেমন কিছুই লাঘব হয়নি বলে জানান তিনি। এদিকে মোহাম্মদপুর বাসস্টান্ড হয়ে থানার সামনে দিয়ে ধানমন্ডি ঢোকার মেইন সড়কেও চলছে সংস্কার কাজ। এলাকাটিতে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও উন্নয়নের নামে রাস্তার দু’পাশই খুঁড়ে রাখা হয়েছে বেশ কিছুদিন ধরে। যার মধ্যে উন্মুক্তভাবে বসানো রয়েছে সারিবদ্ধ লোহার রড। প্রয়োজনের তাগিদে এর মধ্য দিয়েই ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন চলাচল করছে হাজার হাজার মানুষ। এবিষয়ে বিষয়ে মোহম্মদপুর সরকারি গ্রাফিক্স আর্ট কলেজের ছাত্র সুমন বিশ্বাস বলেন, এই রাখার ফলে প্রতিদিন এই যানযট হয়ে উঠছে তীব্র থেকে তীব্রতর। যানবহন তো দূরের কথা রাস্তার পাশ ঘেঁষে প্রতিদিন পায়ে হেঁটে চলাচল করাটাও যন্ত্রণার হয়ে উঠেছে। এদিকে উন্নয়নের নামে সংস্কার কাজ নিয়ে নাভিশ্বাস উঠেছে জনবহুল এলাকা ফার্মগেট, কাওরান বাজার, আজিমপুর, শ্যামলী, শেরে বাংলা নগর, হাজারীবাগ, পল্লবী, ক্যান্টনমেন্ট, যাত্রাবাড়ী, মগবাজার, বাড্ডা, খিলক্ষেত, নিকুঞ্জ, কুড়িল, বনশ্রী, কুর্মিটোলা, মিরপুর, মহাখালীসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। জানা যায় এসব এলাকার জলাবদ্ধতা দূর করতে ইতিমধ্যেই ৫৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৩টি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এর মধ্যেই কিছু এলাকার প্রকল্প কাজ শেষ হলেও এখনো চলমান রয়েছে কিছু এলাকার উন্নয়ন কাজ। এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাসকিন এ খান বলেন, সর্বক্ষণ বৃষ্টির পানি জমে না থাকায় রাজধানীর এই জলাবদ্ধতাকে ‘জলজট’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন তিনি। ঢাকা শহরকে বালতির সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, রাজধানীর সর্বত্র আমরা কংক্রিটে ছেয়ে ফেলেছি। ফলে বৃষ্টির পানি প্রাকৃতিকভাবে যে মাটি শুষে নেয়ার অবস্থা নেই। তিনি বলেন, রাজধানীর পানি সমস্যার সমাধানের জন্য ইতিমধ্যেই আমরা মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন করেছি। কিন্তু ঢাকার জলজট নিরসনে এখনো কাজ করছে সাতটি সংস্থা। আর এই কাজ এক হাতে নিয়ে এসে মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন করলেই এর সমাধান সম্ভব। ঢাকার রাস্তায় জলাবদ্ধতা নিয়ে ঢাকা ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ড্রেনেজ) এবং প্রকল্প পরিচালক মো. শওকত মাহমুদ বলেন, রাস্তায় জমে থাকা বৃষ্টির পানি সরে যাওয়ার জন্য যেই খালগুলে তৈরি করা হয়েছিল তা ময়লা-আবর্জনা ও অবৈধভাবে দখল হয়ে রয়েছে। এই জন্য ইতিমধ্যেই আমরা ঢাকার আশপাশের ৫টি খাল উদ্ধার ও সংস্কারের প্রকল্প হাতে নিয়েছি। খালগুলোয় প্রাণ ফিরে এলে ঢাকার রাস্তায় আর জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে না। কিন্তু এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের সাধারণ সম্পাদক আদিল মাহমুদ বলেন, বৃষ্টির কারণে গতবছর ঢাকার বিভিন্ন স্থানের জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল। জলাবদ্ধতা নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী কর্মকর্তা খালিদ আহমেদ বলেন, জলাবদ্ধতা দূরীকরণে ইতিমধ্যেই আমরা বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছি। সেগুলোর কাজও শুরু হয়েছে। নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবীব বলেন, বক্স কালভার্টগুলো এখন ঢাকার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেসব খাল এক সময় ঢাকা শহরের গৌরব ছিল, সেগুলো দখল করে বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। এতোদিন পর সেই খালগুলো পুনরুদ্ধার একটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত।
No comments