আলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল কাজে লাগাতে চায় বিএনপি
বিরল
ও বোচাগঞ্জ উপজেলা নিয়ে দিনাজপুর-২ আসনটি বরাবরই আওয়ামী লীগের। দিনাজপুর-১
আসনের মতো এ আসনও আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি। স্বাধীনতার পর ১৯৮৮ ও ২০০১ সাল
বাদে প্রতিবারই এ আসন থেকে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। দলীয় কোন্দল
সামাল দেয়া সম্ভব হলে আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের পাল্লাই ভারি।
কোন্দলের কারণেই ২০০১ সালে আসনটি আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হয় এবং বিজয়ী হন
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক সেনা প্রধান লে. জেনারেল (অব.)
মাহবুবুর রহমান। তবে দলীয় কোন্দলের সুযোগ নিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে
ফের আঘাত হানতে চায় বিএনপি।
এদিকে জাতীয় পার্টিও আসনটি দখলে নিতে কাজ করছে।
১৯৭৩ সালে এ আসনে জয়লাভ করেন স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠকারী আ’লীগ নেতা
অধ্যাপক মো. ইউসুফ আলী। পরে ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে এ
আসন থেকে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের সতীশচন্দ্র রায়। ১৯৮৮ সালে বিজয়ী হন জাতীয়
পার্টির রিয়াজুল হক চৌধুরী এবং ২০০১ সালের ভোটে আওয়ামী লীগের প্রার্থী
সতীশচন্দ্র রায়কে হারিয়ে বিজয়ী হন বিএনপির লে. জেনারেল (অব.) মো. মাহবুবুর
রহমান। ২০০৮ সালে মাহবুবুর রহমানকে হারিয়ে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের উদীয়মান
রাজনীতিক ও সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। পরের বছর ২০১৪ সালেও
খালিদ মাহমুদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হন। টানা দু’বার খালিদ মাহমুদ
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। দুই দফায়
এমপি হওয়ার পর রেললাইন সম্প্রসারণ, বিরল স্থলবন্দর পর্যন্ত মহাসড়কের
সম্প্রসারণ ও রাবার ড্যাম নির্মাণসহ ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন তিনি। তবে
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে গ্রুপিং এখন প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে।
এলাকাটি আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হলেও বিরল উপজেলায় ২০১৪ সালের উপজেলা পরিষদ
নির্বাচনে চেয়ারম্যান ও দুটি ভাইস চেয়ারম্যান পদের একটিতেও জয়লাভ করতে
পারেনি আওয়ামী লীগ। গ্রুপিং এখনও আছে। ফলে ২৮ ডিসেম্বর বিরল পৌরসভার
নির্বাচনে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকসহ একাধিক নেতা শৃঙ্খলা
ভেঙে ভোট করছেন। এরই জেরে সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুল আজাদ মণিসহ কয়েকজনকে
বৃহস্পতিবার দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়। শুধু তাই নয়, বিরল উপজেলার ১২নং
রাজারামপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে।
প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নির্বাচন করছে একই দলের আরেক বিদ্রোহী
প্রার্থী। স্থানীয় এমপি ও সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে
স্থানীয় রাজনীতিতে সময় না দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে কথা হয় খালিদ মাহমুদ
চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘তৃণমূলে আমি কেমন সময় দিচ্ছি তা
তৃণমূল পর্যায়ের নেতারাই ভালো জানেন। বিরল ও বোচাগঞ্জের প্রতিটি কর্মসূচিতে
এবং মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে থাকার চেষ্টা করছি। কেন্দ্রে অবস্থান করলেও
যে কোনো দুর্যোগে আমি এলাকার মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি।’ বিভিন্ন সূত্রে
কথা বলে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর মনোনয়ন লাভের
সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত। এছাড়া মনোনয়ন চাইবেন ৪ বারের এমপি ও আওয়ামী লীগের
উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সাবেক প্রতিমন্ত্রী সতীশচন্দ্র রায়ের ছেলে কেন্দ্রীয়
আওয়ামী লীগ নেতা ডা. মানবেন্দ্র রায় (মানব)। তিনি মাঠে-ঘাটে প্রচার চালিয়ে
যাচ্ছেন। কথা হয় ডা. মানবেন্দ্র রায়ের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে জানান,
‘আমার বাবা সতীশচন্দ্র রায় এমপি এবং প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে বিরল-বোচাগঞ্জের
মানুষের সঙ্গে মিশে ছিলেন এবং এখনও আছেন। বাবার বয়স হওয়ায় তার কাজটি এখন
আমি করে যাচ্ছি। গত বন্যাসহ বিরল ও বোচাগঞ্জের মানুষের সুখে-দুঃখে মানুষের
পাশে ছিলাম- আছি।
আগামী নির্বাচনে মনোনয়নের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করে
তিনি বলেন, মনোনয়ন দেয়া হলে বাবার মতো আমিও আসনটি আওয়ামী লীগকে উপহার দিতে
পারব।’ এদিকে এ আসনে বিরল উপজেলায় বিএনপির মধ্যে কোন্দল লেগেই আছে। বিরল
পৌরসভা নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপি দুই ভাগে বিভক্ত। আগামী নির্বাচনকে সামনে
রেখে এ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন- কেন্দ্রীয়
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, বোচাগঞ্জ
উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাদিক রিয়াজ চৌধুরী পিনাক এবং বিরল উপজেলা
চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আ.ন.ম বজলুর রশিদ। স্বচ্ছ
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সাবেক এমপি লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান আগামী
নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশী। তার বিরুদ্ধে স্থানীয়দের অভিযোগ, তিনি এলাকায়
বেশি সময় দেন না। তবে বিএনপির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, ২০০১ সালে তিনি
দিনাজপুর-২ থেকে এমপি নির্বাচিত হলেও আগামী নির্বাচনে তাকে দিনাজপুর সদর-৩
থেকে প্রার্থী করা হতে পারে। তিনি ছাড়াও বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীর
তালিকায় রয়েছেন বোচাগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাদিক রিয়াজ চৌধুরী পিনাক
এবং বিরল উপজেলা চেয়ারম্যানের পদে থেকে কাজ করে যাচ্ছেন বিরল উপজেলা
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আ.ন.ম বজলুর রশিদ। নির্বাচনী ভাবনা নিয়ে জানতে
ফোন করা হলে লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমানকে পাওয়া যায়নি। তবে কথা হয়
তারই ঘনিষ্ঠ বিরল উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক প্রভাষক মিজানুর রহমানের
সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে জানান, বড় দল হিসেবে বিএনপি থেকে যে কেউ মনোনয়ন
চাইতেই পারে। কিন্তু বিএনপিকে জয়লাভ করানোর জন্য লে. জেনারেল (অব.)
মাহবুবুর রহমানের বিকল্প নেই। কারণ, স্বাধীনতার পর ২০০১ সালে তিনিই প্রথম
আওয়ামী লীগকে পরাজিত করে আসনটি বিএনপিকে উপহার দিয়েছিলেন। এলাকায় কম সময়
দেয়ার ব্যাপারে মিজানুর রহমান জানান, মাহবুবুর রহমান বিএনপির স্থায়ী কমিটির
সদস্য। সেজন্য কেন্দ্রীয় রাজনীতিতেই তাকে বেশি সময় দিতে হয়। এলাকায় কম
এলেও তিনি সার্বিক খোঁজখবর রাখেন। এলাকার রাজনৈতিক কোনো সিদ্ধান্ত তাকে
বাদ দিয়ে নেয়া হয় না বলে জানান মিজানুর রহমান। জানতে চাইলে সাদিক রিয়াজ
চৌধুরী পিনাক যুগান্তরকে জানান, তার বাবা ১৯৮৮ সালে এ আসন থেকে এমপি হয়ে
মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। এলাকার উন্নয়নের সূচনা মূলত তার বাবার আমল
থেকেই। তার বাবার মৃত্যুর পর তিনি এলাকার সামাজিক-সাংস্কৃতিকসহ দুস্থ
মানুষের সেবায় কাজ করে যাচ্ছেন। বিএনপির একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে মানুষের
কাজ করে যাওয়ার জন্য বোচাগঞ্জ বিএনপি তাকে সভাপতি নির্বাচিত করেছে। আগামী
নির্বাচনে তাকে মনোনয়ন দেয়া হলে তিনি আসনটি বিএনপিকে উপহার দিতে পারবেন।
তিনি বলেন, দল যাকে মনোনয়ন দেবে তার পক্ষেই বিএনপির একজন পরীক্ষিত কর্মী
হিসেবে কাজ করে যাব। বিএনপির আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী আ.ন.ম বজলুর রশিদ বলেন,
তিনি দু’বার বিপুল ভোটে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৪
সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি বিএনপির প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী
লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করে বিরল উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পেলে জনগণ তাকে নির্বাচিত করবেন বলে
আশা প্রকাশ করেন তিনি। এছাড়া মহাজোটে থাকার পরও জাতীয় পার্টি সব আসনে
প্রার্থী দেয়ার ঘোষণা দেয়ায় চাঙ্গা দিনাজপুর-১ আসনের দলীয় প্রার্থীরা। দলের
কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ড. আনোয়ার চৌধুরী জীবন এবং বোচাগঞ্জ উপজেলা
জাতীয় পার্টির সভাপতি ও জাতীয় যুব সংহতি কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক
অ্যাডভোকেট মো. জুলফিকার হোসেন মনোনয়ন দৌঁড়ে রয়েছেন। ২০১৪ সালে উপজেলা
পরিষদ নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর এলাকায় আনোয়ার চৌধুরীর তৎপরতা বন্ধ হয়ে
গেছে। অপর প্রার্থী অ্যাডভোকেট জুলফিকার হোসেন মাঠে কাজ শুরু করেছেন। জানতে
চাইলে অ্যাডভোকেট জুলফিকার হোসেন জানান, এলাকার মানুষের যে কোনো সমস্যায়
তিনি তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। গ্রামপর্যায়ে এখনও পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক
রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদের যে ইমেজ রয়েছে তা এবং নিজের কর্মকাণ্ডকে কাজে
লাগিয়ে আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন পেলে বিজয় নিশ্চিত। তিনি আশা
ব্যক্ত করে বলেন, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে অবশ্যই এ আসনটিতে
তিনি জাতীয় পার্টির জন্য বিজয় বয়ে নিয়ে আসতে পারবেন।
No comments