মাছের পটকা ও পাখনায় ভর করে আসছে টাকা
মাছ
কাটার সময় আঁশের সঙ্গে এমনিতেই পাখনা ফেলে দেওয়া হয়। আবার মাছের পটকা
(ফুলকা) খেতে চান না অনেকে। ফলে বাসার ময়লার ঝুড়িতে পাখনার সঙ্গে পটকারও
জায়গা হয়। কিন্তু এই দুটি জিনিসের মূল্য কত, তা প্রকাশ রঞ্জন দাশগুপ্তের
চেয়ে ভালো কে আর বোঝেন! তাঁর ব্যবসার মূল উপকরণই তো এই দুটি। মাছের ফেলে
দেওয়া পাখনা আর পটকা রপ্তানি করে চট্টগ্রামের এই ব্যবসায়ী এ পর্যন্ত ১৪ বার
বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা সিআইপির মর্যাদা পেয়েছেন। প্রকাশ
রঞ্জন দাশগুপ্তের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ‘ফেক্সিনকো’ ১৯৮৯ সাল থেকে এ
পর্যন্ত সাতবার জাতীয় রপ্তানি ট্রফি পেয়েছে। এর মধ্যে ছয়বারই স্বর্ণপদক
পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এই ব্যবসায়ী প্রথম সিআইপি হন ১৯৮২ সালে। সর্বশেষ গত
অক্টোবর মাসে ঘোষণা করা সিআইপি (২০১৪ সালের জন্য) তালিকাতেও তাঁর নাম
রয়েছে। চট্টগ্রাম নগরের দেওয়ানজি পুকুরপাড়ের বাসিন্দা প্রকাশ রঞ্জন তাঁর
মেজ ভাই শৈলেশ রঞ্জন দাশগুপ্তের (এখন প্রয়াত) কাছে প্রথম শোনেন, মাছের ফেলে
দেওয়া পটকা ও পাখনা রপ্তানি করা সম্ভব। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর,
হংকংসহ কয়েকটি দেশে পটকা-পাখনা শুকানোর পর একধরনের স্যুপ বানানো হয়। এর
স্বাদ কেমন তা ভাই না বললেও অপ্রচলিত পণ্যের এই ব্যবসা করার জন্য প্রচণ্ড
আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। সে আগ্রহ এতটাই বেপরোয়া ছিল যে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) লেখাপড়া ছেড়ে দিতে একটুও দ্বিধা করেননি
তিনি। বুয়েটে ভর্তির দুই বছর পরই ১৯৭৭ সালে লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে ঢাকা থেকে
চট্টগ্রাম চলে আসেন প্রকাশ রঞ্জন। এরপর ভাইয়ের সঙ্গে ফ্রোজেন ফুডসের
(হিমায়িত খাদ্য) ব্যবসায় নেমে পড়েন। তাঁরা দুই ভাই যখন শুরু করেন, তখন হাতে
গোনা দু-একজন জানতেন দেশের বাইরে মাছের পটকা ও পাখনা বিক্রি করা সম্ভব।
উদ্যোগ ও পরিশ্রমের মাধ্যমে ধীর ধীরে নিজেদের ব্যবসাকে শক্ত ভিত্তির ওপর
দাঁড় করান দুই ভাই। সিঙ্গাপুর, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া রপ্তানি শুরু করেন
তাঁরা। এক দশকের বেশি সময় পর আরও কয়েকজন সীমিত আকারে এই ব্যবসায় যুক্ত হন।
প্রকাশ রঞ্জন দাশগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, ফেলে দেওয়া পণ্যের ব্যবসা করে
দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পেরে সন্তুষ্ট তিনি। যাঁর হাত ধরে তিনি এই
ব্যবসায় এসেছিলেন, সেই মেজ ভাই শৈলেশ রঞ্জন মারা যান ১৯৯০ সালে। তাঁর প্রতি
কৃতজ্ঞতার শেষ নেই এই ব্যবসায়ীর। তিনি বলেন, পটকা ও পাখনা দিয়ে বানানো
স্যুপ জাপান ও সিঙ্গাপুরে দারুণ জনপ্রিয়, এটি প্রথম শোনার পর বিস্মিত
হয়েছিলেন। এই ব্যবসায়ীর বিষয়ে চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি আলী আহমেদ
প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে অনেকটা নীরবেই অপ্রচলিত পণ্যের
ব্যবসা করে আসছেন প্রকাশ রঞ্জন। দেশে এ ধরনের ব্যবসার ক্ষেত্রে অগ্রগামীদের
একজন তিনি। প্রকাশ রঞ্জনের স্ত্রী মহুয়া দাশগুপ্ত এবং ছেলে প্রিয়ম
দাশগুপ্তও তাঁর প্রতিষ্ঠান ফেক্সিনকোর পরিচালক। ছেলে প্রিয়ম বছরের বেশির
ভাগ সময় লন্ডনে থেকে আমদানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। তিনি এখন
রয়েছেন কানাডায়। গত রোববার রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রাম,
কক্সবাজার ও পটুয়াখালীসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে লাক্কা, কামিলা, কোরাল, লাল
কোরালসহ বিভিন্ন বড় মাছের পটকা ও পাখনা সংগ্রহ করেন তাঁরা। এসব এলাকার বড়
বাজারের মাছ কাটার সঙ্গে যুক্ত লোকজন এবং মাছ বিক্রেতাদের কাছ থেকে সংগ্রহ
করা পটকা ও পাখনা প্রক্রিয়াজাত করেন কারখানায়। এরপর তা প্যাকেটে ভরে
রপ্তানি করেন তাঁরা। তিনি বলেন, কাঁচা পটকা ও পাখনা সংগ্রহের পর প্রথমে
রোদে শুকানো হয়। কয়েক দিন শুকানোর পর তা শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে পরিষ্কার করা
হয়। এরপর তা ওজন করে প্যাকেট করা হয়। কারখানার কর্মীরা জানান, বিভিন্ন
এলাকার বাজার থেকে মাছের কাঁচা পটকা (একটি) ২০ থেকে ১০০ টাকা দরে কেনেন
তাঁরা। মাছ ও মাছের আকারভেদে শুকনা পটকা কেজি দরেও কেনেন তাঁরা। দাম পড়ে ১০
হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা। আর শুকনো পাখনার কেজি সর্বোচ্চ ২০
হাজার টাকা। চট্টগ্রাম নগরের দেওয়ানজি পুকুরপাড়ে নিজের বাসার সঙ্গেই প্রকাশ
রঞ্জন দাশগুপ্তের ব্যবসায়িক কার্যালয়, কারখানা ও গুদাম। গত রোববার তাঁর
কারাখানার মেঝেতে পটকা শুকানোর কাজ চলছিল। কয়েকজন কর্মী শুকনো পটকা ওজন করে
প্যাকেটজাত করছেন। প্রকাশ রঞ্জন নিজেই এসব তদারক করছেন। তিনি বলেন, কাঁচা
পটকা এনে শুকানোর পর ফিমিউগেশন (ধোঁয়া দিয়ে শোধন) করা হয়। এরপর প্যাকেটে
ভরে রপ্তানি করা হয়। কামিলা মাছের পটকার প্রতি কেজির রপ্তানিমূল্য প্রায়
৪০০ ডলার। লাক্কার রপ্তানিমূল্য কেজিপ্রতি ১০ ডলার। বছরে ১৫ কোটি টাকার
পটকা-পাখনা রপ্তানি করেন তাঁরা। তিনি বলেন, দেশে এখন পাঁচ থেকে ছয়জন
ব্যবসায়ী পটকা-পাখনা রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত। বছরে এই খাতে রপ্তানির পরিমাণ
প্রায় ২৩ কোটি টাকা।
No comments