সমুদ্র অভিযানে দুই দিন
জেটি
থেকে স্পিডবোটে উঠতেই শুরু হলো দুলুনি। এই ডানে তো এই বাঁয়ে। ফৌজি পোশাক
পরা বোটচালক তোফাজ্জল হোসেন নির্বিকার। সাগরের দিকে মুখ করে বললেন, ‘সিটে
বসে পড়েন। সামনে আরও বড় ঢেউ আছে।’ জেটির দুলুনিতে যে আতঙ্ক শুরু হয়েছিল,
চালকের কথায় তা আরও বেড়ে গেল। হোটেল থেকে গোছগাছ করে বের হতেই মাঝরাত হয়ে
গিয়েছিল। সৈকতে এসে দেখি আধখানা চাঁদ আকাশে হেলে পড়েছে। জেটিতে কয়েকজন
কর্মকর্তা ওয়াকিটকি হাতে ব্যস্ত। একটু দূরে সারি সারি স্পিডবোট বাঁধা।
কর্মকর্তাদের একজন সবাইকে সারিবদ্ধ করে নিজ নিজ গন্তব্যের বোট দেখিয়ে
দিলেন। তিনি হাতের ইশারা দিতেই যাত্রা শুরু হলো। কক্সবাজারের ইনানী সৈকতের
রিজু খাল বেয়ে ২৭ নভেম্বর গভীর রাতে আমরা চলেছি সাগরের দিকে, যুদ্ধজাহাজে
উঠব বলে। জাহাজ নোঙর করা আছে সৈকত থেকে সাত কিলোমিটার দূরের পোতাশ্রয়ে। সে
পর্যন্ত যেতে হবে স্পিডবোটে। চারদিকে বেশ অন্ধকার, দূরে নোঙর করা জাহাজের
আলো ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। কক্সবাজারে এসে রিজু খাল নিয়ে অনেক গল্প
শুনেছি। কিছুদিন আগে রোহিঙ্গাদের একটি নৌকা এ খালে ডুবে যায়। খালটি যেখানে
সাগরের সঙ্গে মিশেছে, সেখানে দিনরাত প্রচণ্ড ঢেউ। আবহাওয়া খারাপ হলে তো
কথাই নেই। সারাক্ষণ পানি পাক খায়। স্পিডবোট মিনিট পাঁচেক চলার পর হঠাৎ
চালকের চিৎকার, ‘ঢেউ আসছে ঢেউ আসছে...। বলতে বলতেই প্রকাণ্ড একটা ঢেউয়ে
তলিয়ে গেল আমাদের ছোট স্পিডবোটটি। পানি স্পিডবোটের ওপরে আর আমরা বোটের
ভেতরে। পানি ছাড়া কোনো কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ভেবেছিলাম মরে যাচ্ছি।
দোয়া–দরুদ পড়তে শুরু করেছি। হঠাৎ বোটের গতি বাড়িয়ে দিলেন চালক। দক্ষ হাতে
গোঁয়ার বোটটিকে টেনে তুললেন পানির ওপরে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আমার অবস্থা
দেখে চালক হাসতে হাসতে বললেন, এই বোটের নাম ‘মেটাল শার্ক’, মেড ইন আমেরিকা।
হেই জিনিস ডুবতে জানে না। ‘মাল্টিল্যাটারাল মেরিটাইম সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ
এক্সারসাইজ (ইমসারেক্স)’ নামে দুই দিনের (২৮-২৯ নভেম্বর) সমুদ্র মহড়ায়
আটটি বিদেশি জাহাজসহ ৪১টি জাহাজ অংশ নেয়। আমরা যাচ্ছিলাম মহড়া দেখতে।
আমাদের জাহাজে নেওয়ার যাবতীয় সরকারি অনুমোদন আগেই হয়ে গেছে। মহড়া শুরুর আগে
সাগরের ভেতরে সব জাহাজ এক সারিতে রাখা হয়। ইনানীর টিউলিপ হোটেলের
অনুষ্ঠানস্থল থেকে আলোকসজ্জা করা জাহাজগুলোকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। কিন্তু
ঘন অন্ধকারে দূরের জাহাজের আলো ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ঝোড়ো গতি
নিয়ে স্পিডবোট চলেছে সাগরের বুক চিরে। কোথাও ঢেউ কম কোথাও বেশি। ৩০ মিনিট
চলার পর পৌঁছে গেলাম জাহাজের কাছে। কিন্তু এত উঁচু জাহাজে উঠব কী করে?
জাহাজে ওঠার জন্য বিশেষ ধরনের সিঁড়ি আছে। যেদিকে সিঁড়ি আছে সেদিকে প্রচণ্ড
ঢেউ। ছোট স্পিডবোটের পক্ষে কাছে ভেড়া সম্ভব না। বোটের চালক নিচ থেকে চিৎকার
করে ক্যাপ্টেনকে বললেন, ‘স্যার, এরা নামতে গেলে পড়ে যাবেন, ল্যাডার লাগাতে
হবে।’ স্পিডবোট থেকে জাহাজের পাটাতন দোতলা সমান উঁচু। এই পথ উঠতে হবে রশির
সঙ্গে লাগানো মই দিয়ে। সামনে দুটি পথ—হয় ফিরে যেতে হবে, না হলে রশি দিয়ে
জাহাজে উঠতে হবে। আগে রশি দিয়ে বেঁধে মালপত্র তোলা হলো। তারপর আমরা উঠলাম
সেই রশির মই বেয়ে। ছোটবেলায় গাছে চড়ার অভ্যাসটা কাজে দিল। জাহাজের ডেকে
নেমে দেখি, এ যেন একটা ফুটবল মাঠ। সাদা গোল দাগ দেখে এক নৌ সদস্যকে
জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি জানালেন, এখানে হেলিকপ্টার নামে। জাহাজের ক্যাপ্টেন
কমান্ডার মনিরুজ্জামান ডেকের ওপরে সবাইকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানালেন।
আমরা যে জাহাজে উঠেছি তার নাম ‘বিএনএস সমুদ্র অভিযান’। এই দলে জনাবিশেক
সাংবাদিক আর নৌবাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তা। এটি দেশের সবচেয়ে বড় যুদ্ধজাহাজ।
হ্যামিলটন ক্লাসের ৩ হাজার ৩০০ টনের এই জাহাজ লম্বায় ৩৭৮ ফুট, আর প্রস্থে
৪৩ ফুট। সাততলা বাড়ির সমান উঁচু জাহাজে তিন শতাধিক মানুষের একসঙ্গে থাকার
সুবিধা আছে। তবে বর্তমানে ২০ জন কর্মকর্তাসহ নৌবাহিনীর দুই শতাধিক সদস্য
জাহাজে কাজ করছেন। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছ থেকে পাওয়া জাহাজটির কমিশনিং
হয় ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ। এতে একটি সামরিক হেলিকপ্টারসহ নানা ধরনের যুদ্ধ
সরঞ্জাম রাখার ব্যবস্থা আছে। জাহাজের পেছনে আছে হেলিপ্যাড ও হ্যাঙ্গার।
কর্মকর্তারা জানালেন, জাহাজটি একবার জ্বালানি ও রসদ নিলে ১৬ হাজার মাইল পথ
পাড়ি দিতে পারে। আমরা জাহাজে উঠলাম রাত সাড়ে ১২টার দিকে। জানানো হলো নোঙর
করা সব জাহাজ রাতভর পোতাশ্রয়েই থাকবে। সকালে নোঙর তোলা হবে। ডেক থেকে একটি
লম্বা করিডর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো শোবার ঘর ‘গান রুম’-এ। সকালে বাইরে উঁকি
দিয়ে দেখি আমাদের জাহাজ পোতাশ্রয়েই আছে। আশপাশে নোঙর করা আছে আরও ৪০টি
জাহাজ। এর মধ্যে ২৩টি যাবে গভীর সমুদ্রে, বাকি জাহাজগুলো দাপ্তরিক দায়িত্ব
পালন করবে। ২৮ নভেম্বর সকাল সাড়ে সাতটায় একই সময়ে সব জাহাজের নোঙর তোলা
হলো। সাড়ে নয়টার মধ্যে জাহাজগুলো এক সারিতে চলতে শুরু করল গভীর সমুদ্রের
দিকে। একসঙ্গে এতগুলো যুদ্ধজাহাজ আগে কখনো দেখিনি। আমরা যে জাহাজটিতে উঠেছি
সেটা থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছিল পুরো সমুদ্র মহড়ার কার্যক্রম। নৌবাহিনীর
ভাষায় এটি ‘ফ্ল্যাগশিপ’ বা কমান্ড জাহাজ। সহকারী নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার
অ্যাডমিরাল শাহিন ইকবাল আমাদের সঙ্গে জাহাজে ছিলেন। তিনি ব্রিজে (যে স্থান
থেকে জাহাজ চালানো হয়) বসে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। তাঁকে সহায়তা করছিলেন
ফ্লিট কমান্ডার রিয়ার অ্যাডমিরাল আশরাফুল হক। কমান্ড জাহাজের নির্দেশনা
অনুযায়ী সকাল সাড়ে নয়টার মধ্যে জাহাজগুলো তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। এরপর
সেগুলো একই গতিতে এগিয়ে যেতে থাকল গভীর সমুদ্রের দিকে। মঙ্গলবার
মধ্যাহ্নভোজের পর বেলা দেড়টার দিকে শুরু হলো প্রথম মহড়া। এর আগে চিফ স্টাফ
অফিসার ক্যাপ্টেন রাশেদ সাত্তার মহড়া সম্পর্কে আমাদের ধারণা দিলেন। কীভাবে
মহড়া হবে, কোন স্থান থেকে ভালো করে দেখা যাবে—সবকিছু বুঝিয়ে দেন। প্রথম
মহড়ায় দেখানো হলো গভীর সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে আগুন লাগার পর কী করে উদ্ধার
করা হয়। দ্বিতীয় মহড়াটি শুরু হলো মঙ্গলবার বিকেলে। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে
সাগরে ভেসে যাওয়া একটি মাছ ধরা ট্রলার ও তার লোকজনকে উদ্ধার করা হলো এতে।
তৃতীয় মহড়াটি ছিল সাগরে নিখোঁজ হওয়া বিমান উদ্ধারের। ২৯ নভেম্বর দুপুরের
মধ্যে শেষ হয়ে যায় সর্বশেষ মহড়া। মহড়া করতে করতে গাঢ় নীল জলরাশি কেটে জাহাজ
চলেছে ঝড়ের গতিতে। আমরা চলেছি সমুদ্রের দিকে, গভীর থেকে গভীরে। ভূমি থেকে
দূরত্ব বাড়ছেই। ডেকে বসে মহড়া দেখার ফাঁকে ফাঁকে কথা হয় জাহাজের নানা পদের
কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে। ভাসমান কর্মজীবনের নানা অভিজ্ঞতার ঝুলি তাঁরা
খুলে দেন আমাদের সামনে। কিছু অভিজ্ঞতা ছিল গা শিউরে ওঠার মতো। যেমন
ঘূর্ণিঝড় বা যেকোনো বড় ঝড়ঝাপটার সময় জাহাজকে কোনোভাবেই জেটিতে রাখা যাবে
না। তাতে ক্ষতির আশঙ্কা বেশি। ওই সময় জাহাজ রাখতে হয় অগভীর চ্যানেলে অথবা
সাগরে। নৌবাহিনীর সদস্যরা তখন পরিবার ছেড়ে জাহাজে এসে ওঠেন জাহাজকে
ভালোভাবে হেফাজতে রাখতে। সঙ্গে থাকতে হয় পুরো দলকে। তখন একেকটি ঢেউ
তিন-চারতলার সমান উঁচু হয়। খড়কুটোর মতো দুলতে থাকে জাহাজ। জাহাজের মানুষের
সব গল্পের ভেতরেই আছে ঢেউয়ের কথা। ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকার গল্প।
আছে কষ্ট ও বেদনার কথাও। এক কর্মকর্তা বললেন, দূরে দেখুন, যে ঢেউগুলো ভেঙে
যাচ্ছে, তার সাদা অংশকে মনে হচ্ছে দৌড়ানো ঘোড়ার মাথা। এভাবে ঢেউ ভাঙার নাম
‘সি-হর্স’। মন খারাপ হলে আমরা ডেকে বসে সি-হর্স দেখি। এতক্ষণে আমরা
বাংলাদেশের সমুদ্রসীমানার খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। এবার বিদেশি জাহাজের
বিদায় নেওয়ার পালা। বিদেশি জাহাজকে বিদায় দেওয়ার প্রথা হলো বাঁশি বাজানো।
এর নাম ‘ফ্ল্যাগ হোয়েস্ট ড্রিল’। পতাকা নাড়িয়ে এক দেশ অন্য দেশকে শুভেচ্ছা ও
বিদায় জানায়। দূরত্বের কারণে মুখের কথা নয়, কথা হয় পতাকার ভাষায়।
বিদেশি জাহাজকে বিদায় জানিয়ে আমরা ফিরতে থাকি ইনানীর দিকে। ২৯ নভেম্বর রাত
নেমে আসে সাগরে। জাহাজ আবার পোতাশ্রয়ে ফেরে। তবে এবার আর ঢেউ নেই। শান্ত
সাগর। ‘সমুদ্র অভিযান’ থেকে নেমে পড়ি সিঁড়ি দিয়ে। সেই মেটাল সার্কের পিঠে।
এর পেটের ভেতরে বসে আমরা চলি ইনানীর পথে। পেছনে তখন যুদ্ধজাহাজ ‘সাগর
অভিযান’ আর সঙ্গী দুই দিনের সাগর-বাসের মধুর স্মৃতি।
কী আছে যুদ্ধজাহাজে
জাহাজের সব কম্পার্টমেন্টেরই একটি করে নাম আছে। নামগুলোও বেশ মজার। শোবার ঘরের নাম গান রুম। কেন? এক কর্মকর্তা বললেন, জাহাজটি তৈরির সময় এসব কক্ষে অস্ত্র রাখা হতো। এখন আর রাখা হয় না, কিন্তু গান রুম নামটা রয়ে গেছে। নৌবাহিনীর জাহাজগুলোর এসব ঘরে সাধারণত জুনিয়র কর্মকর্তারা বসবাস করেন। জাহাজের ভেতরে শোবার ব্যবস্থাটি অনেকটা রেলগাড়ির বার্থের মতো। ওপর নিচে দুটি সিট, দুজন ঘুমাতে পারেন। ছোট ছোট কম্পার্টমেন্টের কোথাও ১০ জনের, আবার কোথাও ২০ জনের শোবার ব্যবস্থা। বিছানাপত্র বেশ আরামদায়ক হলেও এগুলো প্রস্থে এতই কম যে নড়াচড়া করলেই মনে হয় পড়ে যাব। নাবিকেরা এ রকম পরিবেশে দিনের পর দিন থাকেন। শোবার ঘরের পাশেই সারি সারি বাথরুম। সেখানে গোসল করার আলাদা ব্যবস্থা। বাথরুমের পুরো ব্যবস্থা বিমানের মতো। হাওয়ার চাপে ময়লা–আবর্জনা নিচে চলে যায়। সমুদ্রে জাহাজের কার্যক্রম সব বাঁধাধরা সময়ে। শুরু হয় ভোর সাড়ে চারটায় জাহাজে বাবুর্চির চুলায় আগুন জ্বালানোর মধ্য দিয়ে। যদিও এখনকার আধুনিক যুদ্ধজাহাজে আর চুলায় অগ্নিসংযোগ করতে হয় না। তবু পুরোনো শব্দগুলো রয়ে গেছে। এখন রান্না হয় বৈদ্যুতিক চুলায়। ভোর সাড়ে পাঁচটায় জাহাজে সবার জন্য রয়েছে ‘জাগরণাদেশ’। জাহাজের এক কোণে রয়েছে পিতলের ঘণ্টা যার নাম ‘শিপস বেল’। ঠিক সকাল আটটায় এটি বাজানো হয়, নৌ পরিভাষায় এর নাম ‘কলার্স’। এ সময় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। জাহাজের যে যেখানে যে অবস্থায় থাকেন, সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে জাতীয় পতাকার প্রতি দাঁড়িয়ে সম্মান দেখান। এভাবেই জাহাজে দিনের কর্মকাণ্ড শুরু হয়। ওপরের যে ঘর থেকে জাহাজ পরিচালনা করা হয়, তার নাম ব্রিজ। তার পাশে স্টার ডেক। ব্রিজে বসে পুরো জাহাজ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ব্রিজ নানা ধরনের যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। এসব যন্ত্রপাতি দিয়ে যেমন পানির গভীরতা মাপা যায়, তেমনি জানা যায় আশপাশে কোন কোন জাহাজ অবস্থান করছে। জাহাজ কোন দিকে যাবে, কীভাবে যাবে—সবই ঠিক করা হয় ব্রিজ থেকে। জাহাজে একতলা থেকে অন্য তলায় ওঠানামার যে খাড়া সিঁড়ি, তার নাম ‘গ্যাংওয়ে’। প্রতিটি তলায় অনেক গ্যাংওয়ে আছে। গোলাবারুদ রাখার স্থানটির নাম ‘ম্যাগাজিন’ আর অস্ত্র রাখার স্থানের নাম ‘গানডেক’। জাহাজের সব স্থানে আছে মাইকের ব্যবস্থা। যেকোনো স্থান থেকে ঘোষণা দিলে সবাই তা শুনতে পান। যে স্থান থেকে হেলিকপ্টার ওড়ে তার নাম ‘ফ্লাইট ডেক’, আর হেলিকপ্টার যেখানে রাখা হয় তার নাম হ্যালো ‘হ্যাঙ্গার’। নৌবাহিনীর সদস্যদের পরিবার–পরিজন ছেড়ে দিনের পর দিন জাহাজে থাকতে হয়। তাই জাহাজ পোতাশ্রয় ছাড়ার আগে শুকনো ও তাজা খাবারের মজুত রাখা হয়। একঘেয়েমি কাটানোর জন্য জাহাজের খাবারের পরিবেশনাতেও রয়েছে ভিন্নতা। অতিথি হওয়ায় আমাদের জন্য বিশেষ খাবার আয়োজন করেন অধিনায়ক। নৌবাহিনীর খাবারের সুনাম সবখানে। রান্নাঘরকে বলে ‘গ্যালি’। রান্নার জন্য রয়েছে আলাদা বাবুর্চি, তবে খাবার পরিবেশন করে ‘স্টুয়ার্ড’। কর্মকর্তারা যে স্থানে বসে খাবার খান ও অফিসের বিভিন্ন কাজকর্ম করেন সেটা ‘ওয়ার্ড রুম’। আর নাবিকেরা সাধারণত খাবার খান মেস ডেকে। জাহাজে নৌ সদস্যদের সকালের নাশতা চা, মধ্যাহ্নভোজ, বিকেলের চা, রাত্রের খাবার সবই হয় নির্দিষ্ট সময়ে। রাত ১০টায় জাহাজের সমস্ত আলো নিভে যায়, আসে ‘নিদ্রাদেশ।’ জাহাজে আরও আছে ব্যায়ামাগার ও ক্যানটিন। একটি ছোট হাসপাতালও আছে। আছে ছোটখাটো অস্ত্রোপচার করার ব্যবস্থা। একজন চিকিৎসক ও কয়েকজন সহকারী সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন। জাহাজে প্রতিদিন যত পানি লাগে তার সবই জাহাজে পরিশোধন করা হয়। সমুদ্রের লোনা পানি পরিশোধন করে খাবার উপযোগী করা হয়। সমুদ্র অভিযান প্রতি ঘণ্টায় ৪০০ লিটার পানি পরিশোধন করতে পারে। দূর থেকে যেকোনো জাহাজের ওপরের দিকে মাস্তুলের মতো যে দণ্ডটি দেখা যায় তাতে রয়েছে সাধারণ রাডার, ফায়ার কন্ট্রোল রাডার, জিপিএস, বাতাসের গতিবেগ দেখার ব্যবস্থা, পানির গভীরতা দেখার ব্যবস্থাসহ নানা ধরনের নেভিগেশন সরঞ্জাম। জাহাজ চলার সময় সবগুলোকেই সচল রাখা হয়।
কী আছে যুদ্ধজাহাজে
জাহাজের সব কম্পার্টমেন্টেরই একটি করে নাম আছে। নামগুলোও বেশ মজার। শোবার ঘরের নাম গান রুম। কেন? এক কর্মকর্তা বললেন, জাহাজটি তৈরির সময় এসব কক্ষে অস্ত্র রাখা হতো। এখন আর রাখা হয় না, কিন্তু গান রুম নামটা রয়ে গেছে। নৌবাহিনীর জাহাজগুলোর এসব ঘরে সাধারণত জুনিয়র কর্মকর্তারা বসবাস করেন। জাহাজের ভেতরে শোবার ব্যবস্থাটি অনেকটা রেলগাড়ির বার্থের মতো। ওপর নিচে দুটি সিট, দুজন ঘুমাতে পারেন। ছোট ছোট কম্পার্টমেন্টের কোথাও ১০ জনের, আবার কোথাও ২০ জনের শোবার ব্যবস্থা। বিছানাপত্র বেশ আরামদায়ক হলেও এগুলো প্রস্থে এতই কম যে নড়াচড়া করলেই মনে হয় পড়ে যাব। নাবিকেরা এ রকম পরিবেশে দিনের পর দিন থাকেন। শোবার ঘরের পাশেই সারি সারি বাথরুম। সেখানে গোসল করার আলাদা ব্যবস্থা। বাথরুমের পুরো ব্যবস্থা বিমানের মতো। হাওয়ার চাপে ময়লা–আবর্জনা নিচে চলে যায়। সমুদ্রে জাহাজের কার্যক্রম সব বাঁধাধরা সময়ে। শুরু হয় ভোর সাড়ে চারটায় জাহাজে বাবুর্চির চুলায় আগুন জ্বালানোর মধ্য দিয়ে। যদিও এখনকার আধুনিক যুদ্ধজাহাজে আর চুলায় অগ্নিসংযোগ করতে হয় না। তবু পুরোনো শব্দগুলো রয়ে গেছে। এখন রান্না হয় বৈদ্যুতিক চুলায়। ভোর সাড়ে পাঁচটায় জাহাজে সবার জন্য রয়েছে ‘জাগরণাদেশ’। জাহাজের এক কোণে রয়েছে পিতলের ঘণ্টা যার নাম ‘শিপস বেল’। ঠিক সকাল আটটায় এটি বাজানো হয়, নৌ পরিভাষায় এর নাম ‘কলার্স’। এ সময় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। জাহাজের যে যেখানে যে অবস্থায় থাকেন, সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে জাতীয় পতাকার প্রতি দাঁড়িয়ে সম্মান দেখান। এভাবেই জাহাজে দিনের কর্মকাণ্ড শুরু হয়। ওপরের যে ঘর থেকে জাহাজ পরিচালনা করা হয়, তার নাম ব্রিজ। তার পাশে স্টার ডেক। ব্রিজে বসে পুরো জাহাজ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ব্রিজ নানা ধরনের যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। এসব যন্ত্রপাতি দিয়ে যেমন পানির গভীরতা মাপা যায়, তেমনি জানা যায় আশপাশে কোন কোন জাহাজ অবস্থান করছে। জাহাজ কোন দিকে যাবে, কীভাবে যাবে—সবই ঠিক করা হয় ব্রিজ থেকে। জাহাজে একতলা থেকে অন্য তলায় ওঠানামার যে খাড়া সিঁড়ি, তার নাম ‘গ্যাংওয়ে’। প্রতিটি তলায় অনেক গ্যাংওয়ে আছে। গোলাবারুদ রাখার স্থানটির নাম ‘ম্যাগাজিন’ আর অস্ত্র রাখার স্থানের নাম ‘গানডেক’। জাহাজের সব স্থানে আছে মাইকের ব্যবস্থা। যেকোনো স্থান থেকে ঘোষণা দিলে সবাই তা শুনতে পান। যে স্থান থেকে হেলিকপ্টার ওড়ে তার নাম ‘ফ্লাইট ডেক’, আর হেলিকপ্টার যেখানে রাখা হয় তার নাম হ্যালো ‘হ্যাঙ্গার’। নৌবাহিনীর সদস্যদের পরিবার–পরিজন ছেড়ে দিনের পর দিন জাহাজে থাকতে হয়। তাই জাহাজ পোতাশ্রয় ছাড়ার আগে শুকনো ও তাজা খাবারের মজুত রাখা হয়। একঘেয়েমি কাটানোর জন্য জাহাজের খাবারের পরিবেশনাতেও রয়েছে ভিন্নতা। অতিথি হওয়ায় আমাদের জন্য বিশেষ খাবার আয়োজন করেন অধিনায়ক। নৌবাহিনীর খাবারের সুনাম সবখানে। রান্নাঘরকে বলে ‘গ্যালি’। রান্নার জন্য রয়েছে আলাদা বাবুর্চি, তবে খাবার পরিবেশন করে ‘স্টুয়ার্ড’। কর্মকর্তারা যে স্থানে বসে খাবার খান ও অফিসের বিভিন্ন কাজকর্ম করেন সেটা ‘ওয়ার্ড রুম’। আর নাবিকেরা সাধারণত খাবার খান মেস ডেকে। জাহাজে নৌ সদস্যদের সকালের নাশতা চা, মধ্যাহ্নভোজ, বিকেলের চা, রাত্রের খাবার সবই হয় নির্দিষ্ট সময়ে। রাত ১০টায় জাহাজের সমস্ত আলো নিভে যায়, আসে ‘নিদ্রাদেশ।’ জাহাজে আরও আছে ব্যায়ামাগার ও ক্যানটিন। একটি ছোট হাসপাতালও আছে। আছে ছোটখাটো অস্ত্রোপচার করার ব্যবস্থা। একজন চিকিৎসক ও কয়েকজন সহকারী সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন। জাহাজে প্রতিদিন যত পানি লাগে তার সবই জাহাজে পরিশোধন করা হয়। সমুদ্রের লোনা পানি পরিশোধন করে খাবার উপযোগী করা হয়। সমুদ্র অভিযান প্রতি ঘণ্টায় ৪০০ লিটার পানি পরিশোধন করতে পারে। দূর থেকে যেকোনো জাহাজের ওপরের দিকে মাস্তুলের মতো যে দণ্ডটি দেখা যায় তাতে রয়েছে সাধারণ রাডার, ফায়ার কন্ট্রোল রাডার, জিপিএস, বাতাসের গতিবেগ দেখার ব্যবস্থা, পানির গভীরতা দেখার ব্যবস্থাসহ নানা ধরনের নেভিগেশন সরঞ্জাম। জাহাজ চলার সময় সবগুলোকেই সচল রাখা হয়।
No comments