স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও মুক্তিযোদ্ধার সনদ মিলেনি : গৃহহীন পরিবার
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশ্বনাথবাসীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা আজ
ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ অঞ্চলের প্রায় দেড় শতাধিক বীরসন্তান
অংশগ্রহন করেন সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধে শহীদ বিশ্বনাথের ৬
কৃতিন্তানদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন শহীদ সিপাহী মোবাশ্বের আলী। কিন্ত
সিপাহী মোবাশ্বের আলী নামে যে বিশ্বনাথে একজন গর্বিত সন্তান মুক্তিযোদ্ধে
শহীদ হয়েছিলেন তা এখনো জানেন না এ অঞ্চলের অনেকেই। স্বামীর স্মৃতিকে
বুকে আকড়ে ধরে বেঁচে আছেন শহীদ সিপাহী মোবাশ্বের আলীর স্ত্রী সুনু বিবি।
তিনি অভাবের তাড়নায় স্বামীর ভিটেমাটি বিক্রি করে গৃহহীন হয়ে বসবাস করছেন
অন্যত্র। স্বাধীনতার ৪৬বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো মিলেনি শহীদ মুক্তিযোদ্ধার
সনদ। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন নং
মুবিম/প্রঃ৩/মুক্তিযোদ্ধা/গেজেট/২০০৩/৪৭৯ তারিখ ৪ সেপ্টেম্বর ২০০৩ ইং
মোতাবেক ২০০৪ সালের ১৫জুন প্রকাশিত শহীদ গেজেট’র ৪৯৩ নম্বারে এবং বিডিআর’র
শহীদ তালিকায় ১১০১১ নাম্বারে নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে শহীদ মোবাশ্বের আলীর। জাতির
গর্বিত সন্তান শহীদ সিপাহী মোবাশ্বের আলী বিশ্বনাথ উপজেলার অলংকারী
ইউনিয়নের রামপুর গ্রামের মরহুম তাখরেছ আলী ও মরহুমা পাকি বিবির পুত্র। তিনি
১৯৩১ সালের ২ জুন জন্মগ্রহন করেন। ১৯৫৮ (সম্ভাব্য) সালে তৎকালীন
পাকিস্তান সরকারের বেঙ্গল রেজিমেন্ট (বিডিআর) এ তিনি যোগদেন। ১৯৬৩ সালে আপন
চাচাতো বোন সুনু বিবির সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন মোবাশ্বের আলী। ১৯৭১
সালে বাঙালী জাতির উপর যখন পাকহানাদার বাহিনী অতর্কিত ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে,
তখন স্ত্রী, ৭বছর বয়সী এক কন্যা ও ২বছরের এক পুত্র সন্তানের মায়া ত্যাগ করে
দেশ প্রেমিক মোবাশ্বের আলী জীবনের ঝুকি নিয়ে সশ্রস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ
গ্রহন করেন। ১৯৭১ সালের ১৫ই এপ্রিল কুমিল্লা গঙ্গাসাগর মিরাসানী সরকারি
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে সিপাহী
মোবাশ্বের আলী’সহ ১৪জন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাতবরণ করেন। মিরাসানী বধ্যভূমিতে
স্থাপিত স্মৃতিস্তম্ভে শহীদ মোবাশ্বের আলী’সহ ১৪জন শহীদের নাম লিখা রয়েছে। এদিকে,
দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে মুক্তিযোদ্ধারা নিজ নিজ
বাড়িতে ফিরে আসেন।
কিন্ত সিপাহী মোবাশ্বের আলী বাড়িতে ফিরে না আসায় এবং তার
কোন সন্ধান না পাওয়ায় পরিবারের সদস্যরা ব্যাকুল হয়ে পড়েন। এর কিছুদিন পর
পরিবারের সদস্যরা একই গ্রামের কৃতিসন্তান মুক্তিযোদ্ধে বীরবিক্রম খেতাব
প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার (অবঃ) আব্দুল মালিকের মাধ্যমে জানতে পারেন
মুক্তিযোদ্ধে শহীদ হয়েছেন সিপাহী মোবাশ্বের আলী। ১৯৭১ সালের
মুক্তিযোদ্ধের প্রায় ৫মাস পর চিকিৎসার অভাবে তাদের ২বছর বয়সী একমাত্র পুত্র
মারা যায়। এরপর একমাত্র কন্যা সন্তানকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন সুনু বিবি।
তিনি দীর্ঘদিন মানষিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় ছিলেন। মেয়ের বয়স ১৭ পূর্ণ
হওয়ার পর তাকে পাড়া প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদের সহযোগীতায় নিজ গ্রামেরই
যুবক সিরাজুল ইসলামের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়। অভাবের তাড়নায় একপর্যায়ে নিজের
ভিটে মাটি বিক্রি করে মেয়ের শশুর বাড়িতে আশ্রয় নেন সুনু বিবি। সেখানেই তিনি
বসবাস করে আসছেন। আলাপকালে সুনু বিবি দৈনিক নয়া দিগন্তকে জানান,
স্বামীর রেখে যাওয়া স্মৃতিকে বুকে নিয়ে তিনি আজও বেঁচে আছেন। অশ্রুসিক্ত
চোঁখে তিনি বলেন ‘আমার স্বামী দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন। এতে আমি গর্বিত।
২০১৫ সালে বার্ডর গার্ড বাংলাদেশ সদর দপ্তরের রেকর্ড অফিসার-২ এস এম শামীম
রেজা স্বাক্ষরিত শহীদ সিপাহী মোবাশ্বের আলীর মুক্তিযোদ্ধা প্রত্যয়নপত্র
বুকে জড়িয়ে ধরে সুনু বিবি বলেন, স্বাধীনতার ৪৬বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো আমি
আমার স্বামীর মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটটি পাইনি। পেনশন ও মুক্তিযোদ্ধার
সম্মানী ভাতা পেলেও শহীদ ভাতা এবং রেশন আমি পাচ্ছি না। তাছাড়া আমার মাথা
গুজার ঠাই না থাকায় আমি মেয়ে জামাইর বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। এদিকে, শহীদ
সুলেমানের নামে বিশ্বনাথের একটি গ্রামের নামকরণ করা হলেও এখনো শহীদ সিপাহী
মোবাশ্বের আলী’সহ অপর ৪ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামে কিছুই হয়নি। তবে সম্প্রতি
উপজেলার রামপুর গ্রামে শহীদ সিপাহী মোবাশ্বের আলীর বাড়ির সামনে তাঁর
স্মৃতিতে একটি নামফলক স্থাপন করা হয়েছে। আর এই নামফলকটি শহীদ সিপাহী
মোবাশ্বের আলীর জামাতা সিরাজুল ইসলাম ও চাচাতো ভাই সিরাজুল ইসলামের উদ্যোগে
করা হয়েছে।
No comments