ভারত ছেড়ে চীনের দিকে ঝুঁকছে ভুটান
ভারত, ভুটান ও চীনের সীমানা যেখানে মিশেছে, সেই দোকলাম উপত্যকায় অব্যাহত সামরিক উত্তেজনার মধ্যেই দিল্লি ও থিম্পুর কর্তৃপক্ষের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক কোনদিকে গড়াচ্ছে - তা নিয়ে ভারতের মধ্যেই নানা মহলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ভারত ও ভুটানের 'বিশেষ সম্পর্ক' প্রায় ৭০ বছরের পুরনো। কিন্তু সেই সম্পর্কে চীনের ছায়া পড়ছে বলে সম্প্রতি ভারতেই অনেক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক মনে করছেন। চীনের সাথে ভুটানের কোনো কূটনৈতিক সংযোগ না-থাকলেও ইদানীং বেজিং-এর কর্তৃপক্ষ যে নানাভাবে থিম্পুর সাথে সম্পর্ক গড়তে চাচ্ছে, সেই ইঙ্গিতও স্পষ্ট। এই পটভূমিতে হিমালয়ের পার্বত্য দেশ ভুটানকে ঘিরে দুশ্চিন্তা বাড়ছে ভারতেও। চীন-ভারত সামরিক সঙ্ঘাতকে কেন্দ্র করে গত মাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ যখন পার্লামেন্টে বিবৃতি দেন, তখন বিরোধীদের সমালোচনা ছিল বর্তমান সরকারের আমলে সব প্রতিবেশীর সাথেই ভারতের সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে। জবাবে তিনি যে দুই প্রতিবেশীর সাথে ভারতের বন্ধুত্বের দৃষ্টান্ত দেন, তার একটি ছিল বাংলাদেশ আর অপরটি ভুটান। ভুটানকে ভারতের প্রিয়তম বন্ধু বলে বর্ণনা করেন তিনি। তিন বছর আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার প্রথম বিদেশ সফরে যে এই ভুটানেই গিয়েছিলেন, সে কথাও মনে করিয়ে দেন। দুই দেশের মধ্যেকার 'ফ্রেন্ডশিপ ট্রিটি' অনুযায়ী ভুটানের প্রতিরক্ষা, বিদেশনীতি ও বাণিজ্যে ভারতের প্রভাব দ্বিপাক্ষিকভাবেই স্বীকৃত। এবং এই মুহূর্তে দোকলাম উপত্যকায় যে ভারতীয় সেনারা চীনা ফৌজের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আছে, তারাও দাঁড়িয়ে আছে ভুটানের মাটিতেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতের বর্তমান সরকার ভুটানের সাথে ঐতিহাসিক মৈত্রীর সম্পর্ককে দুর্বল করে ফেলেছে বলেই মনে করেন সিনিয়র কংগ্রেস নেতা, সাবেক এমপি ও কূটনীতিক মণিশঙ্কর আইয়ার। তিনি বলছিলেন, "একটি প্রাণোচ্ছল গণতন্ত্র হিসেবে ভুটানের বিবর্তন হয়েছে খুব দ্রুত। ফলে তাকে আর আগের মতো শুধু একটি রাজতন্ত্র-শাসিত দেশ হিসেবে দেখলে চলবে না, সেখানেও যে বিবিধ রাজনৈতিক মতামত জন্ম নিচ্ছে সেটাকেও স্বীকৃতি দিতে হবে।" "বন্ধু হিসেবে ভুটান যাতে দূরে সরে না-যায় সে জন্য আমাদের কূটনীতিকে হতে হবে বহুমাত্রিক। আর আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে চাপিয়ে দেয়া চলবে না মোটেই, কারণ ভুটানেও অনেকেই সেটা পছন্দ করেন না।" ভুটানের সাথে ভারতের বন্ধুত্ব নিয়ে যে কোনো প্রশ্ন উঠতে পারে, বছরকয়েক আগেও তা ভাবাই যেত না। কিন্তু এখন যাচ্ছে। আর তার মূলে আছে ভুটানের সাথে সম্পর্ক তৈরি করার জন্য চীনের মরিয়া প্রয়াস। ভারতের খ্যাতনামা স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালিস্ট রাহুল বেদীর কথায়, "আমি মনে করি দোকলাম সঙ্কট থেকে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস স্পষ্ট হয়ে যাবে,
সেটা হল ভুটান কি ভারতের সাথে তাদের পরীক্ষিত সম্পর্কই টিকিয়ে রাখবে, না কি চীনের সাথে আলাদা একটি সম্পর্ক গড়ে তুলবে। সম্ভবত এই মুহূর্তে ভুটান নিজেও এর উত্তর জানে না।" "তবে চীন এ ব্যাপারে প্রায় নাছোড়বান্দা, দোকলাম সঙ্কটের ঠিক আগে ভারতে চীনা রাষ্ট্রদূতের স্ত্রী পর্যন্ত থিম্পু গিয়ে ভুটানের রাজমাতার সাথে দেখা করে এসেছেন, চীনারা গত ২০ বছর ধরে দিল্লিতে ভুটানের দূতাবাসে গিয়ে তাদের সাথে দেখা করে আসছেন," জানাচ্ছেন রাহুল বেদী। তবে শেষ পর্যন্ত পছন্দটা যদি হয় চীন আর ভারতের মধ্যে, তাহলে ভুটানের রায় ভারতের দিকেই ঝুঁকবে বলে মনে করেন মণিশঙ্কর আইয়ার। তিনি বলছেন, "দালাই লামার নির্বাসনের পর থেকেই ভুটানে একটা আশঙ্কা আছে, চীনারা তিব্বতে বৌদ্ধ সংস্কৃতির যে হাল করেছে একই জিনিস তাদের সাথেও করার চেষ্টা করতে পারে।" "সে জন্যই উত্তরের চীনের তুলনায় দক্ষিণের ভারতের সাথেই তারা মানসিকভাবে বেশি একাত্ম ও নিরাপদ বোধ করে।" "কিন্তু এটাও ঠিক, ভুটান আমাদের স্বার্থের প্রতি এতদিন যে সংবেদনশীলতা দেখিয়েছে ভারতকেও তাদের প্রতি তার চেয়েও অনেক বেশি দেখাতে হবে," অভিমত মণিশঙ্করের। ভারত সরকার ভুটানকে শুধু তাদের প্রিয়তম বন্ধু বলেই মনে করে না - স্ট্র্যাটেজিক দৃষ্টিতেও ভুটানের গুরুত্ব যে অপরিসীম স্বীকার করে সেটাও। ৭০ বছরের এই পুরনো বন্ধুকে নিয়ে অন্যদের টানাটানি তারা এখন কীভাবে সামলায় - সেটাই হবে দেখার বিষয়।
No comments