এই সংকটের প্রেক্ষিত ও সমাধান সম্পর্কে দুটি কথা
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পেয়েছে। সরকার আপিল বিভাগের এ রায় মেনে নিলে ল্যাঠা চুকে গেল; কিন্তু না মানতে পারলে কী হবে? যে সমস্যাটি ছিল সরল, তা জটিল হয়ে দাঁড়াতে পারে। মহামান্য আদালত কী সিদ্ধান্ত দিলেন, আর সরকার সে সম্পর্কে কী করবে, তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আমার আশঙ্কা, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে এই মতভেদকে কেন্দ্র করে একটি তৃতীয়পক্ষ অশুভ ষড়যন্ত্রে মেতে উঠতে পারে। যেমন তারা মেতে উঠেছিল ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে। সেবার তারা আওয়ামী লীগেরই মনোনীত রাষ্ট্রপতি জাস্টিস সাহাবুদ্দীনের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। এবারেও সামনে এগিয়ে আসছে একটি সাধারণ নির্বাচন। জুডিশিয়ারির ক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে একেক দেশে একেক নিয়ম। আমেরিকায় জুডিশিয়ারি নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের একাধিক এক্সিকিউটিভ অর্ডার বাতিল করেছেন। ব্রিটেনে এখন উচ্চ আদালতের বিচারপতিরাও আর সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। তাদের রায়ের সমালোচনা করলে আর আদালত অবমাননা হয় না। কিছুদিন আগে এক ধর্ষণ মামলায় এক বিচারপতি যে রায় দিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে নারীরা লন্ডনের রাজপথে মিছিল করে প্রতিবাদ করেছেন এবং বিচারপতির অপসারণ দাবি করেছেন। আরেকটি মামলায় বিচারকের রায়ের তীব্র সমালোচনা হয়েছে (গার্ডিয়ানসহ) সংবাদপত্রে। পার্লামেন্টে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব পাস হয়েছে। ইউরোপের দেশগুলোতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু সেই স্বাধীনতাতেও সীমাবদ্ধতা আছে। বাংলাদেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কাগজপত্রে আছে। বাস্তবে সেই স্বাধীনতা আইন মন্ত্রণালয়ের আমলাতন্ত্রের লালফিতায় বন্দি। আমাদের বর্তমান প্রধান বিচারপতি জাস্টিস সিনহা অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে সেই লালফিতায় বন্দি স্বাধীনতা উদ্ধার করতে চেয়েছেন। পাকিস্তানে জাস্টিস কায়ানি আইয়ুব আমলের সরকারি ব্যবস্থা সম্পর্কে যেসব কথা প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর গ্রহণের পর বলেছেন, বাংলাদেশে জাস্টিস সিনহা সেসব কথা তার বর্তমান পদে অবস্থান করেই বলেছেন। আইনমন্ত্রীর উচিত ছিল, তার পরামর্শকে গুরুত্ব দেয়া। আলোচনার মাধ্যমে একটা সমঝোতায় পৌঁছা। তিনি তা করেননি। তিনি ক্রমাগত পাশ কাটানোর নীতি অনুসরণ করেছেন। গত ৯ মাসে ঢাকায় প্রধান বিচারপতি জাস্টিস সিনহার সঙ্গে তার বাসভবনে আমার দু’বার সাক্ষাৎ হয়েছে। আলোচনা হয়েছে দু’বারই দু’ঘণ্টার ওপর। তার সরলতা, আইন সম্পর্কিত জ্ঞান এবং স্বাধীনচেতা মনোভাব আমাকে অভিভূত করেছে।
বাজারে তার সম্পর্কে যে প্রচার ও অপপ্রচার চালানো হচ্ছিল, তা যে সত্য নয়, তা বুঝতে আমার দেরি হয়নি। এ প্রচারণাও ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক। বাংলাদেশের আর কোনো প্রধান বিচারপতিকে পদে বসেই এ ধরনের অপপ্রচারের শিকার হতে হয়নি। পৃথিবীর সব দেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এক ধরনের নয়। যেসব দেশে গণতন্ত্র শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল, সেসব দেশে বিচার বিভাগ প্রকৃতই স্বাধীন। কিন্তু সে স্বাধীনতাও নিরঙ্কুশ নয়। যেসব দেশে গণতন্ত্রের অবস্থা নাজুক, সেসব দেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অবস্থাও নাজুক। বাংলাদেশে গণতন্ত্র বহুদিন স্থিতিশীলতা লাভ না করায় বিচার বিভাগও তার প্রতিক্রিয়া থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। আওয়ামী লীগ দীর্ঘকাল পর ক্ষমতায় এসে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠাদানের চেষ্টা করছে এবং বিচার বিভাগকেও ধীরে ধীরে স্বাধীনতা দানের পদক্ষেপ নিয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় সরকার ও বিচার বিভাগ উভয়ের পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব আছে। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও রক্ষায় নির্বাহী ও বিচার বিভাগ পরস্পরের সহযোগী না হলে গণতন্ত্রের এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সুরক্ষা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের বর্তমান যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, যে পরিস্থিতিতে গণতন্ত্র এখনও নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত দ্বারা বিপন্ন, সেখানে বিচার বিভাগের যেমন উন্নত ইউরোপিয়ান দেশের মতো অবাধ স্বাধীনতা রাতারাতি লাভ করার আশা করা উচিত নয়, তেমনি গণতান্ত্রিক সরকারেরও উচিত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ঔপনিবেশিক আমলের মতো আমলাদের লালফিতায় বন্দি করে না রেখে ধীরে ধীরে পূর্ণ প্রতিষ্ঠাদানের পথে এগোনো। সুতরাং বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিচারকদের অপসারণের প্রক্রিয়াটি সংসদ ও বিচার বিভাগের যুক্ত তত্ত্বাবধানে রাখা যায় কিনা সে বিষয়টি সরকার ও মহামান্য আদালত কি বিবেচনা করে দেখতে পারেন না? একটি সরল সমস্যা এখন জটিল সংকটে পরিণত হয়েছে। বিচারকদের অপসারণের কার্যবিধি সম্পর্কে সরকার ও বিচার বিভাগ ঐকমত্যে পৌঁছতে পারছে না। সুতরাং বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দ্বন্দ্বে লিপ্ত না হয়ে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই সরকার ও বিচার বিভাগের মধ্যে একটা সমঝোতা প্রয়োজন। আমার মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপও প্রয়োজন। তিনি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সরাসরি বৈঠকে বসলে অবশ্যই দেশ এ সমস্যা থেকে মুক্ত হবে। প্রধান বিচারপতির প্রতি যেহেতু আমার বিশাল আস্থা ও সম্মান, সেজন্যই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সম্পর্কে মহামান্য আদালতের রায় সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন না তুলে তাকে জানাচ্ছি, এই রায় দেয়ার পাশাপাশি দেশের রাজনীতি, সরকার, পার্লামেন্ট ইত্যাদি সবকিছু সম্পর্কে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ (যা রায়ের অংশ নয়) মোটেই প্রাসঙ্গিক নয়। এ মন্তব্য দেশে গণতন্ত্রের মিত্র নয় এমন একটি চক্রান্তকারী মহল ব্যবহার করতে পারে (ইতিমধ্যেই ব্যবহার করে বর্তমান সরকারের পদত্যাগ দাবি করেছে)। গত নির্বাচনে একটি অসাধু সুশীল সমাজ (যার নেতা ড. কামাল হোসেন, ড. ইউনূস প্রমুখ) যেভাবে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীনকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন, বর্তমানে আরেকটি সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যকেও তারা ব্যবহার করতে উৎসাহিত হয়েছেন। প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আমি সহমত পোষণ করি না, একথা তাকে সবিনয়ে জানাই। বাংলাদেশে এখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের যুগ। কিন্তু পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয়ের ছবিটি খুবই খারাপ। কিন্তু তা এখনও প্রতিকারের বাইরে চলে যায়নি। বর্তমান সরকার অনেক দোষত্রুটি সত্ত্বেও এ অবস্থার প্রতিকারের চেষ্টা চালাচ্ছে। এ সরকার ক্ষমতায় না থাকলে দেশের যে অবস্থা দাঁড়াবে, মহামান্য প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণে বরং সেই চিত্রটিরই আভাস পাওয়া যায়। দেশে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় ফিরে এলে বিচার বিভাগ শুধু বর্তমানের কেতাবি স্বাধীনতাই হারাবে না, আবার স্বৈরাচারী শাসনের রাবার স্ট্যাম্পে পরিণত হতে পারে। বর্তমানে বিশ্বের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়া এবং ব্রিটেনে ব্রেক্সিট প্রশ্নে পার্লামেন্ট, সরকার, সর্বোপরি রাজনীতির যে বেহাল অবস্থা চলছে, তার সঙ্গে বরং বাংলাদেশের অবস্থা নিয়ে জাস্টিস সিনহার পর্যবেক্ষণের মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। ব্রিটেনের এ অবস্থা সত্ত্বেও বিচার বিভাগ তেরেসা মে’র টোরি সরকারকে তাদের নানা সিদ্ধান্ত ও কার্যকলাপ সংশোধনের পরামর্শ দিচ্ছেন; কিন্তু তাদের দায়িত্বের সীমার বাইরে গিয়ে দেশের সরকার, পার্লামেন্ট বা রাজনৈতিক অবস্থার কোনো সমালোচনা করছেন না। ব্রিটেনের নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যে এই সমঝোতাটি অনুসরণীয়। ব্রিটেন ও বাংলাদেশের রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য এই যে, ব্রিটেনে সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয় গণতান্ত্রিক বিরোধিতার দ্বারা। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারকে উচ্ছেদের চেষ্টা করা হয় গণতান্ত্রিক বিরোধিতার আবরণে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র দ্বারা। বর্তমানে লন্ডনে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও তার পুত্র তারেক রহমান একত্রে যে তৎপরতা চালাচ্ছেন, তা আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য যতটা বিপজ্জনক নয়, তার চেয়ে অনেক বিপজ্জনক দেশের মাটিতে একটি সুশীল সমাজ ও তাদের সহযোগী একটি মিডিয়া গ্রুপের প্রচারণা ও চক্রান্ত। ইতিমধ্যে এই সুশীল সমাজ ও মিডিয়া গ্রুপ প্রধান বিচারপতির বক্তব্যকে নানা ব্যাখ্যা-অপব্যাখ্যা দিয়ে ব্যবহারের চেষ্টা শুরু করেছে। এদের অশুভ তৎপরতা ব্যর্থ করার জন্য সরকার ও বিচার বিভাগের মধ্যে একটি সুস্থ সমঝোতা জরুরি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ধৈর্য, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতায় আমি আস্থা রাখি। পাকিস্তানে আইয়ুব খানের মতো একজন সামরিক শাসক তার কঠোর সমালোচক জাস্টিস কায়ানিকে শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখিয়েছিলেন। আর শেখ হাসিনা তো একজন গণতান্ত্রিক নেত্রী। তিনি নিশ্চয়ই বিচারপতি সিনহার স্বাধীনচেতা, সাহসী মনোভাবকে সম্মান দেখাবেন এবং বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে সৃষ্ট মনোমালিন্য দূর করার ব্যাপারে তার প্রভাব খাটাবেন ও সফল হবেন। এটা আমার প্রত্যাশা ও প্রার্থনা।
লন্ডন, ৬ আগস্ট, রবিবার ২০১৭
লন্ডন, ৬ আগস্ট, রবিবার ২০১৭
No comments