এবার ১০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা
চট্টগ্রাম বন্দরে কোকেনের চালান আটকের ঘটনায় এবার ১০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা করল খানজাহান আলী লিমিটেড, যাদের নামে এসেছিল ওই চালানটি। সানফ্লাওয়ার তেলের আড়ালে কোকেন পাঠানোয় জড়িতদের বিরুদ্ধে এ মামলা করে চট্টগ্রামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি। তাদের অভিযোগ, আমদানির কোনো প্রক্রিয়া না করা সত্ত্বেও তাদের নামে ওই চালান পাঠানো হয়। এতে দুইভাবে ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়ে তারা। খানজাহান আলী লিমিটেডের চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদের পক্ষে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আবু তৈয়ব বাদী হয়ে ২৭ জুলাই মামলাটি (মানি স্যুট মামলা নম্বর : ১৩/১৭) করেন। চট্টগ্রাম তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক আবদুল কাদের তা গ্রহণ করে অভিযুক্ত ৬ কোম্পানি ও ৩ ব্যক্তির বিরুদ্ধে সমন জারি করেছেন। আদালত সূত্র জানিয়েছে, রোববার এদের বিরুদ্ধে সমন পাঠানো হয়েছে। মামলার আসামিরা হচ্ছে- বলিভিয়া থেকে তেল রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট এলাভাইভেন এসআরএল কল, পরিবহনকারী চীনা মালিকানাধীন কসকো কনটেইনার লাইনস লিমিডেট, উরুগুয়ের লোকাল এজেন্ট সাউথফ্রেইট লজিস্টিক, কনটেইনার বহনকারী জাহাজ থর্ম স্ট্রিমের লোকাল এজেন্ট পিআইএল বাংলাদেশ লিমিটেড, খানজাহান আলী লিমেটেডের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান প্রাইম হ্যাচারির ব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তফা সোহেল, চালান পাঠানোর সমন্বয়কারী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাজ্যের নাগরিক ফজলুর রহমান ও বকুল মিয়া। বিচারক ৮ অক্টোবরের মধ্যে তাদের আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ মামলার ফলে ঘটনাটি নতুন মোড় নিতে পারে। মামলার আরজিতে বলা হয়, খানজাহান আলী লিমিটেড সানফ্লাওয়ার তেল আমদানির জন্য কোনো এলসি করেনি। আমদানি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে যে গুরুত্বপূর্ণ ৮টি ধাপ অতিক্রম করতে হয়, তার কোনো ধাপেই কোম্পানির পক্ষ থেকে কোনো প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়নি। অথচ কোম্পানির নামে একটি কনটেইনারে করে ১০৭ ড্রাম সানফ্লাওয়ার তেল পাঠিয়ে দেয়া হয়। যার মধ্যে দুটি ড্রামে পরে ল্যাব টেস্টে কোকেনের অস্তিত্ব মেলে। চট্টগ্রাম বন্দরে এসব তেলের ড্রাম এক মাস পড়ে ছিল। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ খানজাহান আলী লিমিটেডকে এ বিষয়ে চিঠি দিলেও ফিরতি চিঠিতে কোনো ধরনের সানফ্লাওয়ার তেল তারা আমদানি করেনি বলে জানিয়ে দেয়। এরপরও সানফ্লাওয়ার তেলের আড়ালে কোকেন আমদানির ঘটনায় ‘প্রাপক’ হিসেবে খানজাহান আলী লিমিটেডের নাম থাকায় এ কোম্পানির চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদকে ২ নম্বর আসামি করা হয়। পুলিশের তদন্তে নুর মোহাম্মদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা ও দালিলিক তথ্যপ্রমাণ না পাওয়ায় তাকে পুলিশের দেয়া অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেয়া হয়। পরে অধিকতর তদন্তে র্যাব নুর মোহাম্মদসহ ১০ জনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দেয়। এ মামলায় নুর মোহাম্মদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে র্যাব-৭ কার্যালয় থেকে গ্রেফতার দেখানো হয়। দেড় বছর ধরে জেলে ছিলেন নুর মোহাম্মদ। এ সময়ে তিনি নানা জটিল-কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। আরজিতে আরও বলা হয়, নুর মোহাম্মদ গ্রেফতার থাকার কারণে দেড় বছরে তার ৫০ কোটি টাকার ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া ‘মিথ্যা’ মামলায় ফেঁসে যাওয়ার কারণে কোম্পানির সুনাম ক্ষুণœ হয়েছে, যার আর্থিক মানদণ্ড ৫০ কোটি টাকা। বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফোরকান মোহাম্মদ জানান, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করছে খানজাহান আলী লিমিটেড। সরকারকে বিপুল পরিমাণ ট্যাক্স দেয়ার পাশাপাশি এ কোম্পানির মিলকারখানায় কয়েক হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। ট্রেডিং ব্যবসা করলেও কখনও তেল আমদানি করেনি এ প্রতিষ্ঠান। অথচ তারই কোম্পানিকে ‘প্রাপক’ দেখিয়ে স্পর্শকাতর এ চালান এবং এর কিছু ডকুমেন্ট পাঠিয়ে দেয়া হয়। যার খেসারত দিতে হচ্ছে খানজাহান আলী লিমেটেডকে। ফোরকান মোহাম্মদ আরও বলেন, বিদেশ থেকে যে কেউ, যে কারও নামে কোনো ধরনের কাগজপত্র ছাড়া নিষিদ্ধ পণ্য পাঠিয়ে দেবে আর যার নামে প্রেরণ করা হবে সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ফেঁসে যাবে, তা তো হয় না। এভাবে বাংলাদেশের কোনো মন্ত্রী-এমপি কিংবা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও তো যে কেউ নিষিদ্ধ পণ্য পাঠাতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় যাতে কোনো পণ্য বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে, এবং বন্দরের মতো কি পয়েন্ট ইন্সটলেশন (কেপিআই) যাতে ঝুঁকিতে না পড়ে, সেজন্যই মূলত এ মামলা করা হয়েছে। সূত্র জানায়, একটি পণ্য চালান আমদানির আগে ন্যূনতম ৮টি প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলা, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কাভার নোট দেয়া, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের ‘মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ বা চুক্তি করা, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পণ্যের প্রোফরমা ইনভয়েস পাঠানো ইত্যাদি। চালান জাহাজীকরণের আগে এসব কাগজপত্র দেখতে হয় শিপিং এজেন্টসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। অথচ খানজাহান আলী লিমিটেড বা এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান আলোচ্য পণ্য আমদানির জন্য এর কিছুই করেননি। প্রাপক হিসেবে তার প্রতিষ্ঠানের নামে এই চালানের যেসব ডকুমেন্ট বা ইমেইল পাঠানো হয়েছে, এর কোথাও খানজাহান আলী লিমেটেডের চেয়ারম্যান বা এ প্রতিষ্ঠানের কোনো প্রতিনিধির সিল-ছাপ্পর, সই এমনকি কোনো মোবাইল ফোন নম্বরও নেই। ‘হাওয়ার ওপর’ ভিত্তি করেই চোরাকারবারিরা একটি প্রতিষ্ঠানের নামে এত বড় একটি চালান পাঠিয়ে দিল আর সেই চালান শিপিং এজেন্ট গ্রহণ করল, বন্দর কর্তৃপক্ষ তা জাহাজ থেকে ইয়ার্ডে নামাল কীসের ভিত্তিতে- এমন প্রশ্নই চলে আসে সামনে। গত বছরের ৬ জুন চট্টগ্রাম বন্দরে নিষিদ্ধ পণ্য আছে- এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে একটি কনটেইনার সিলগালা করে দেয়া হয়। ৮ জুন শুল্ক গোয়েন্দা, কাস্টমসসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে কনটেইনার খুলে ড্রাম থেকে তেলের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় ২টি ড্রামে কোকেনের অস্তিত্ব মেলে। এ ঘটনায় প্রাপক হিসেবে যে প্রতিষ্ঠানের নাম আছে, সেই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানসহ দুই জন এবং অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে মামলা করে বন্দর থানা পুলিশ। কোকেন চালান আটকের এ ঘটনায় সারা দেশে তখন আলোচনার ঝড় ওঠে।
No comments