‘অকার্যকর’ সংসদ ভাঙতে সোচ্চার বিএনপি
‘অকার্যকর’ সংসদ ভেঙে দিয়ে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের অধীনে নতুন সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার হচ্ছে বিএনপি। এ দাবিতে দলের নেতারা উচ্চ আদালতে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় পর্যালোচনা শেষে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন দলের হাইকমান্ড। এ লক্ষ্যে রায় পর্যালোচনাও শুরু হয়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্টদের রায়ের কপি দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে একটি বৈঠক হয়েছে। শিগগিরই ফের বৈঠকে বসবে। চলছে রায়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ। দলের বাইরেও আইনজ্ঞদের পরামর্শ নেয়া হচ্ছে। এ ইস্যুকে অগ্রাধিকার দিয়ে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করছে বিএনপি। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বর্তমান সংসদকে অকার্যকর হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ১ আগস্ট মঙ্গলবার পর্যবেক্ষণসহ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, যেহেতু আদালত বর্তমান সংসদকে ডিসফাংশনাল (অকার্যকর) বলেছেন, তাই এ সংসদ বেশি দিন বহাল রাখা সরকারের জন্য কঠিন হবে। সরকার যদি শেষ পর্যন্ত আদালতের রায় অগ্রাহ্য করে তবে বিএনপি এ ইস্যুকে গুরুত্ব দেবে। সংসদকে কিভাবে ফাংশনাল করতে হবে সেই প্রশ্নের উত্তর জানতেই আদালতের শরণাপন্ন হবে। কারণ এ উত্তর ছাড়া ফের বর্তমান অকার্যকর সংসদ বহাল রেখে আরেকটি নির্বাচন হলে ওই সংসদও ডিসফাংশনাল হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। অকার্যকর সংসদ কিভাবে বহাল থাকবে এবং একটি সংসদ বহাল রেখে আরেকটি সংসদ নির্বাচন করা যাবে কিনা তা চ্যালেঞ্জ করে রিট করতে পারে দলটি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ যুগান্তরকে বলেন, আমরা সবাই বারবার বলে আসছি, সুুপ্রিমকোর্টও বলেছেন, বর্তমান সংসদ অকার্যকর। এখানে কোনো বিরোধী দল নেই। সরকারের ইচ্ছামতো যা খুশি তাই করছে। এভাবে একটি সংসদ চলতে পারে না। এ সংসদে যেসব আইন প্রণয়ন করা হবে সেগুলোও সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। আগামীতে এসব নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তাছাড়া একটি সংসদ বহাল থাকাকালীন আরেকটি সংসদ নির্বাচনÑ এটা একটি অসম্ভব ব্যবস্থা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অবশ্যই এ অবস্থার অবসান হতে হবে। এক প্রশ্নের উত্তরে মওদুদ আহমদ বলেন, বর্তমান সরকার কথায় কথায় সংবিধানের দোহাই দিচ্ছে। জনরায় নিয়ে যে সংবিধান সংশোধন করা হয়নি, সেই সংবিধানের দোহাই দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। ১৯৯১ সালে যখন বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করে নির্বাচন হয় তখন তো সংবিধানে উল্লেখ ছিল না। তাই সংবিধানের চেয়ে জনগণের মতামতকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমান ইস্যুটাও রাজনৈতিক। এটা রাজনৈতিক ভাবেই সমাধান চাই। যখন রাজনৈতিক ভাবে এর সমাধান হবে তখন সংবিধান কোনো অন্তরায় হবে না। যদি সমাধান না হয়, তখন আমরা এ বিষয়ে আর কি কি পদক্ষেপ নেয়া যায় তা নিয়ে ভাবব। বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের অপর নেতা যুগান্তরকে বলেন, এক্ষেত্রে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল চেয়ে রিটের প্রয়োজন নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ চেয়ে আবেদন করা যেতে পারে। সংবিধানের ১৩তম সংশোধনী বাতিলের রায়ের ওপর ভিত্তি করে সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনে। পঞ্চদশ সংশোধনীতে বর্তমান সংসদ বহাল রেখে নির্বাচনের বিধান যুক্ত করা হয়। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ হলে এবং রায় রিভিউর পক্ষে গেলে এমনিতেই পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হয়ে যাবে। এছাড়া আরও একটি যুক্তি বিবেচনায় নিয়ে আদালতে যাওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। সংবিধানে সবার মৌলিক অধিকার সমান বলে নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীতে এর ব্যত্যয় রয়েছে। সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হলে কেউ কেউ মন্ত্রী বা এমপি অবস্থায় নির্বাচনে অংশ নেবেন, আবার কেউ সাধারণ প্রার্থী হয়ে অংশ নেবেন। যা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। এ ইস্যুতেও সংসদ ভেঙে দিয়ে সবার সমান অধিকার বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির নির্দেশনা চেয়ে রিট করার চিন্তাভাবনা রয়েছে। তবে বিএনপির এক নীতিনির্ধারক বলেন, আদালতে যাওয়ার আগে সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন একটি সহায়ক সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকে তারা অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক সমাধানকেই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সব দলের ঐকমত্য হলে সংবিধান কোনো অন্তরায় হবে না বলে মনে করছেন ওই আইনজীবী নেতা। অতীতে এমন উদাহরণও রয়েছে। রাজনৈতিক সমাধান হলে বর্তমান সংসদ ভেঙে দেয়ার ব্যাপারে ততটা গুরুত্ব দেয়া হবে না। সূত্র জানায়, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় গভীরভাবে পর্যালোচনা করছে দলটির হাইকমান্ড। শনিবার বিকালে দলের সিনিয়র আইনজীবীদের নিয়ে বৈঠক হয়। সেখানে রায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সবাইকে রায়ের একটি করে কপি দিয়ে তা পর্যালোচনা করে মতামত দিতে বলা হয়। শিগগিরই এ নিয়ে আরেকটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। সবার মতামত পাওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে রায়ের ব্যাপারে দলটির অবস্থান তুলে ধরা হবে। জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, রায়ের পর্যবেক্ষণে সঠিক তথ্যই উঠে এসেছে। বর্তমান সংসদে কোনো বিরোধী দল নেই। যা খুশি তাই হচ্ছে।
একটি ডিসফাংশনাল সংসদ দেশকে অকার্যকর করে দিতে পারে। এ সংসদ যা করবে তা নিয়েও মানুষের প্রশ্ন থাকবে। তাই প্রয়োজন একটি কার্যকর সংসদ। তিনি বলেন, বিশ্বের গণতান্ত্রিক কোনো রাষ্ট্রে সংসদ বহাল রেখে নির্বাচনের কোনো বিধান নেই। সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করতে হয়। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংসদ বহাল রেখে নির্বাচনের বিধান করা হয়। এর ফলে আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থাটাই ভেঙে দেয়া হয়েছে। একটি সংসদ বহাল রেখে আরেক সংসদ নির্বাচন কখনও অবাধ ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এটা সংবিধান পরিপন্থী। কারণ, সংবিধানে সবার মৌলিক অধিকার সমান বলা হয়েছে। কিন্তু কেউ মন্ত্রী বা এমপি এবং কেউ সাধারণ লোক হিসেবে নির্বাচন করলে সবার অধিকার সমান হল কিভাবে। তিনি বলেন, সংসদ বহাল রেখে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে না। এ ব্যাপারে যে কেউ আদালতের আশ্রয় নিতে পারেন। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়টি ঐতিহাসিক। এ রায় নিয়ে আমরা সিনিয়র আইনজীবীরা বৈঠক করেছি। দলের পক্ষ থেকে রায়ের পর্যবেক্ষণগুলো বুঝতে বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী পর্যবেক্ষণে কি আছে সেটা জানার চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালত বর্তমান সংসদকে ডিসফাংশনাল বলেছেন। আদালত বলার আগ থেকেই আমরা একথা বারবার বলে এসেছি। আমাদের বক্তব্য আদালত থেকে এসেছে। আমাদের দাবি থাকবে, এ সংসদ ভেঙে দিয়ে নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। একটি সংসদ বহাল রেখে আরেকটি নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না। এ নিয়ে রাজপথে আন্দোলনের পাশাপাশি আইনি দিকেও এগোবো আমরা। অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া যুগান্তরকে বলেন, রায়ের পর্যালোচনা চলছে। এ ইস্যুতে আদালতে যাওয়া যায় কিনা সে ব্যাপারে মতামত নেয়া হচ্ছে। তবে আমরা এমন কিছু করব যাতে এর ফলাফল আমাদের পক্ষে আসে। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে কিছু দিকনির্দেশনা রয়েছে। সেগুলো বিবেচনা করেই আমরা একটা সিদ্ধান্তে আসতে চেষ্টা করছি। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সংসদ ভেঙে দেয়ার বিষয়ে নির্দেশনা চেয়ে বিএনপি কেন যে কেউ আদালতের আশ্রয় নিতে পারেন।
No comments