মতবিরোধ এখনো মেটেনি
নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আইন চালু হতে আর মাত্র তিন মাস বাকি। কিন্তু ১৫ শতাংশ মূসক হার নিয়ে এখনো ব্যবসায়ী ও সরকারের মধ্যে মতবিরোধ রয়েই গেছে। সম্প্রতি দুই পক্ষের মধ্যে এক দফা সভা হলেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। আর নতুন আইন চালু হলে প্রায় ৪ হাজার ৮০০ পণ্যে সরাসরি ১৫ শতাংশ মূসক আরোপ হবে। আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও সম্পূরক শুল্ক আইন বাস্তবায়ন শুরু হবে। এই ঘোষণা আগেই দিয়েছে সরকার। ইতিমধ্যে নতুন মূসক আইনকে কেন্দ্র করেই আগামী বাজেটে রাজস্ব আদায়ের সব হিসাব-নিকাশ হচ্ছে। ইতিমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সব ব্যবসায়ী সংগঠনকে জানিয়ে দিয়েছে, নতুন আইনের আলোকেই যেন বাজেট প্রস্তাব দেওয়া হয়। এনবিআর মনে করে, আইনটি বাস্তবায়িত হলে প্রায় ১৫-২০ শতাংশের মতো মূসক আদায় বাড়বে। প্রতিবছর জাতীয় বাজেটের আকার বাড়াচ্ছে সরকার।
আগামী অর্থবছরেও প্রায় সাড়ে চার লাখ কোটি টাকার বাজেট দিতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। প্রতিবারের মতো সিংহভাগ অর্থের জোগান দেবে এনবিআর। বর্তমান সরকার প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১ লাখ ১৩ হাজার ৮১৯ কোটি টাকার বাজেট দেওয়া হয়েছিল। গত আট বছরে বাজেটের আকার তিন গুণ বেড়েছে। সরকার উন্নয়ন বাজেটও বাড়িয়েছে কয়েক গুণ। বাজেটের বিশাল অর্থের জোগান দেয় এনবিআর। দিন দিন বাজেটে এনবিআরের আনুপাতিক অংশও বাড়ছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাজেটের ৫৩ শতাংশ অর্থ দিয়েছে এনবিআর। চলতি অর্থবছরে তা বেড়ে ৬০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তাই এনবিআরকে গত আট বছরে বার্ষিক রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ৬১ হাজার কোটি টাকা থেকে ২ লাখ কোটি টাকায় বাড়াতে হয়েছে। তবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) উদারীকরণ ব্যবস্থার কারণে রাজস্ব আদায়ে আমদানিনির্ভর শুল্ক আদায়ের সুযোগ কমে যাচ্ছে। আয়করের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ উৎস, বিশেষ করে মূসক খাত থেকে রাজস্ব আদায়ে বেশি মনোযোগী হতে বাধ্য হচ্ছে এনবিআর। মূসক খাত থেকেই সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় করে এনবিআর। এনবিআরের মোট রাজস্ব আদায়ের অর্ধেকই আসে মূসক ও সম্পূরক শুল্ক থেকে।
এ প্রেক্ষাপটেই এবার এনবিআর সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে নতুন ভ্যাট আইনকে। এই আইনে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করার পাশাপাশি করদাতাদের হয়রানি এড়াতে অনলাইনভিত্তিক কর পরিশোধের সুযোগ রাখা হয়েছে। নতুন আইনটি নিয়ে প্রায় দুই বছর ধরেই ব্যবসায়ী ও এনবিআরের মধ্যে মতবিরোধ চলছে। মূল মতবিরোধটি হলো, নতুন আইনে ১৫ শতাংশ হারে মূসক দিতে হবে। প্যাকেজ মূসক, নির্ধারিত মূল্যে কিংবা সংকুচিত ভিত্তিমূল্যে (১৫ শতাংশের পরিবর্তে রেয়াতি হারে) মূসক ব্যবস্থা উঠে যাবে, যা ব্যবসায়ীরা মানতে রাজি নন। ব্যবসায়ীদের দাবি হলো, মূসক হার সাড়ে ৭ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে রাখা। এ অবস্থায় গত ২৩ মার্চ শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদসহ এনবিআরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় দুই পক্ষই নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকায় কোনো সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়নি। আবারও সভা হবে। সভার নতুন তারিখ ঠিক হয়নি। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ১৫ শতাংশ নয়, ৭ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে একাধিক হারে মূসক চাই। তা না হলে ভোক্তাকে বেশ ভুগতে হবে। যেমন বিদ্যুৎ বিলের ওপর এখন ৫ শতাংশ মূসক আছে। এটি তখন ১৫ শতাংশ হয়ে যাবে। তাঁর মতে, আইনটি নিয়ে সরকার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে যে আলোচনা চলমান আছে, তা থেকে যদি ইতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত না আসে;
তবে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থা সংকট দেখা দেবে, যা বিনিয়োগে প্রভাব পড়বে।’ এই ব্যবসায়ী নেতা আরও বলেন, এনবিআরের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, হিসাব রাখতে হবে না; শুধু পণ্যের চালান রসিদ দিয়েই রেয়াত নেওয়া যাবে। কিন্তু নতুন আইনে এর কোনো আইনি ভিত্তি নেই। বরং এতে হয়রানি বাড়বে। তবে এনবিআরের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্যাকেজ মূসকের আইনগত কোনো সমর্থন নেই, এটি আর ফিরে আসবে না, এটি ব্যবসায়ীরা অনুধাবন করেছেন। ব্যবসায়ীদের আরেকটি দাবি, টার্নওভার করের সীমা বৃদ্ধি করা। সেটিও ২৪ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৩০ লাখ টাকা করা হয়েছে। তবে ১৫ শতাংশ মূসক হার হবে নাকি ভিন্ন হার হবে—সেটা নিয়ে আলোচনা চলছে। শিগগিরই অর্থমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এ নিয়ে আবারও আলোচনা করে সিদ্ধান্ত দেবেন। এনবিআর চেয়ারম্যান আরও বলেন, মূসক আইন বাস্তবায়নের জটিলতা কাটাতে এনবিআর ও এফবিসিসিআইয়ের যৌথ কমিটির সুপারিশের আলোকেই এখন আলোচনা চলছে। মূসক আদায়ের সম্ভাবনা নিয়ে সম্প্রতি এনবিআর একটি সমীক্ষা করেছে। সেই সমীক্ষা অনুযায়ী, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে এখনো ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ মূসক আদায় করা যায়নি। এটি বলা হচ্ছে ‘ভ্যাট গ্যাপ’। ২০১২-১৩ অর্থবছরকে ভিত্তি ধরে এই সমীক্ষাটি করা হয়েছে। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ওই অর্থবছরে ৯৪ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা মূসক আদায়ের সুযোগ ছিল। কিন্তু আদায় হয়েছে মাত্র ৪১ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা। আদায় করা যায়নি ৫২ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। সার্বিকভাবে ‘ভ্যাট গ্যাপ’ ৫৬ শতাংশ। ৫ শতাংশ কমবেশি ধরে হিসাব করলে ৫০-৬০ শতাংশ ‘ভ্যাট গ্যাপ’ আছে। নতুন আইনে যা থাকবে: আইনেই মৌলিক খাদ্য, নির্ধারিত জীবন রক্ষাকারী ওষুধ,
গণপরিবহন সেবা, গণস্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, কৃষি, মৎস্য চাষ, দাতব্য প্রতিষ্ঠানের অবাণিজ্যিক কার্যক্রম, অলাভজনক সাংস্কৃতিক সেবা—এসব ক্ষেত্রে মূসক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বাকি সব ক্ষেত্রেই আমদানি, উৎপাদন কিংবা বিক্রি পর্যায়ে মূসক বসবে। এ ছাড়া বর্তমানে স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে ৮৫টি পণ্যে ট্যারিফ মূল্যের ওপর ভিত্তি করে মূসক আরোপ করা হয়। ২০ ধরনের সেবার ওপর সংকুচিত ভিত্তিমূল্যে দেড় থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত মূসক আরোপ হয়। এখন থেকে এসব পণ্য ও সেবায় ১৫ শতাংশ হারেই মূসক বসবে। এনবিআরের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, নতুন মূসক আইন হলে ট্যারিফ লাইনের ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ হারে মূসক আরোপ হবে। বর্তমানে ট্যারিফ লাইনে ৬ হাজার ৪৪১ ধরনের পণ্য আছে। সেই হিসাবে ৪ হাজার ৭৯২ ধরনের পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ হারে মূসক বসবে। ১৯৯১ সাল থেকে এই পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে এনবিআর প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমদানি, উৎপাদন ও বিক্রি পর্যায়ে ১ হাজার ৮৭৪টি পণ্য ও সেবাকে মূসক অব্যাহতি দিয়েছে। এ ছাড়া বিদ্যমান আইনটি চালু সময়েই বিশেষ আদেশে ৮৯ ধরনের পণ্য ও সেবায় মূসক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে ট্যারিফ লাইনের ১ হাজার ৯৮৩টি পণ্য ও সেবায় মূসক দিতে হয় না। নতুন আইন হলে এনবিআর প্রজ্ঞাপন দিয়ে মূসক কমাতে পারবে না। তাই সব আলোচনা মূসক আইন চালুর আগেই শেষ করতে হবে।
No comments