পদ শূন্য সোয়া তিন লাখ
মন্ত্রণালয়
ও বিভাগসহ সরকারের বিভিন্ন দফতরে শূন্য পদের সংখ্যা ৩ লাখ ২৮ হাজার ৩১১।
বিপুল সংখ্যক পদ খালি থাকায় প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সরকারি
সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের গতি হ্রাস পেয়েছে। সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন জনগণ। এ
অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সচিব সভায় দ্রুত শূন্য পদ পূরণের সিদ্ধান্ত হয়। একই
সঙ্গে নিয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা পরিহারের পরামর্শ দেয়া হয়। এর আলোকেই
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের চিঠি দেয়া হয়েছে।
শূন্য পদের বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো.
মোজাম্মেল হক খান সম্প্রতি যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রশাসনের শূন্য পদ পূরণে
শিগগিরই ৩৮তম বিসিএসের সার্কুলার দেয়া হবে। দুই হাজারের বেশি পদে এবার
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। পর্যায়ক্রমে বাকি পদও পূরণ করা হবে।’ গত ৭
মার্চ সর্বশেষ সচিব সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল
আলম সচিব সভায় সভাপতিত্ব করেন। এতে প্রায় ৭০ সচিব বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের
মত তুলে ধরেন। একপর্যায়ে শূন্য পদ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। লোকবলের অভাবে কোন
ক্ষেত্রে কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে, সে বিষয় তারা তুলে ধরেন। দেশের বেকারত্ব
দূর করার ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থানের বিষয়টি উঠে আসে। এ সময় বলা হয়, সরকারি
নিয়োগ প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতাও পদ খালি থাকার অন্যতম কারণ। এ কারণেও
বিপুল সংখ্যক পদ বছরের পর বছর শূন্যই থাকছে। দীর্ঘসূত্রতার দূর করার ওপর
গুরুত্বারোপের পরামর্শ দেয়া হয়। আলোচ্য সূচির গুরুত্ব বিবেচনায় অন্যান্য
বিষয়ের সঙ্গে শূন্য পদ পূরণের ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত হয়। ওই সভার সিদ্ধান্ত
বাস্তবায়ন করতে গত ২২ মার্চ সচিবদের চিঠি দেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ
শফিউল আলম। চিঠিতে বলা হয়, ‘দ্রুত সকল সরকারি শূন্য পদ পূরণ করতে হবে।
এক্ষেত্রে অগ্রগতি প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটিতে পর্যালোচনার
জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠাতে হবে।’
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান ও
গবেষণা সেলের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী জনপ্রশাসনে মোট অনুমোদিত পদের
সংখ্যা ১৭ লাখ ১০ হাজার ৭০৪টি। এর বিপরীতে কর্মরত আছেন ১৩ লাখ ৮২ হাজার ৩৯৩
জন। বাকি ৩ লাখ ২৮ হাজার ৩১১টি পদই খালি পড়ে রয়েছে। শূন পদগুলোর মধ্যে ৪৪
হাজার ৫৪৪টিই প্রথম শ্রেণীর, ৫৩ হাজার ১৮০টি দ্বিতীয় শ্রেণীর, ১ লাখ ৬০
হাজার ৫৩৯টি তৃতীয় শ্রেণীর এবং চতুর্থ শ্রেণীর পদ রয়েছে ৭০ হাজার ৪৮টি।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী,
বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ২২ লাখ ১৭ হাজার ৫৬৯ জন।
সূত্রমতে, ৮টি মন্ত্রণালয় বা বিভাগে মোট ১ লাখ ৯৩ হাজারের বেশি পদ শূন্য
আছে। এ তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর
অধীন বিভিন্ন দফতরের ৬৪ হাজার ১১০টি পদ শূন্য। এরপরই স্বাস্থ্য ও পরিবার
কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ৩৭ হাজার ৮৫৫টি পদ শূন্য। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ২৬
হাজার ১১টি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ১৬ হাজার একটি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে
১৩ হাজার ৪০২টি, রেলপথ মন্ত্রণালয়ে ১২ হাজার ৫৩৪টি, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে
১২ হাজার ৫২৪টি এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে ১০ হাজার ৮৪৮টি পদ শূন্য
রয়েছে। বাকি ৪৮ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অধীন বিভিন্ন দফতর-অধিদফতরে পদ শূন্য
আছে ১ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি। সাবেক সচিব ড. মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন,
প্রশাসনের কিছু পদ সব সময় খালি রাখা হয়। তবে সেটা মোট পদের সর্বোচ্চ
শতকরা ১০ ভাগ হতে পারে। এতেও বিপুলসংখ্যক পদ খালি থাকে। ফলে প্রশাসনিক
কার্যক্রম নানাভাবে ব্যাহত হয়।
তিনি বলেন, বিশেষ করে মাঠপ্রশাসনের পদ শূন্য
থাকায় সরকারের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম ব্যাহত হয়ে থাকে। সরকারের সিদ্ধান্ত
বাস্তবায়ন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শূন্য পদ পূরণ না করায় শিক্ষিত
বেকারদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বৃদ্ধি পাবে। কাজেই শূন্য পদগুলো দ্রুততম
সময়ের মধ্যে পূরণ করা উচিত বলে তিনি মনে করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা প্রায় অভিন্ন সুরে যুগান্তরকে
বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উদাসীনতার জন্যই তিন লাখের বেশি পদ ফাঁকা পড়ে
আছে। তারা বলেন, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর পদগুলোয় নিয়োগ দেয় সরকারি কর্ম
কমিশন (পিএসসি)। আর তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর পদে সরাসরি নিয়োগ দেয়
মন্ত্রণালয়। বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে বিভিন্ন কোটায় নিয়োগ
দেয়া হয় ৫৫ শতাংশ। আর মেধায় নিয়োগ দেয়া হয় মাত্র ৪৫ শতাংশ। এর মধ্যে
মুক্তিযোদ্ধার পোষ্য (ছেলেমেয়ে ও নাতি-নাতনি) ৩০, মহিলা ১০, জেলা ১০ ও
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী (উপজাতি) ৫। এছাড়া এসব কোটা পূরণ না হলে সেখানে ১ শতাংশ
বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রতিবন্ধীর জন্য। আর যদি সংশ্লিষ্ট চাকরির ক্ষেত্রে এসব
প্রাধিকার কোটা পূরণ হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে মেধা তালিকা থেকে প্রতিবন্ধীর
কোটা পূরণ করা হয়। এছাড়া নন ক্যাডার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরির
ক্ষেত্রেও একই কোটা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর
সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মেধা তালিকা থেকে ৩০ শতাংশ এবং বাকি ৭০ শতাংশ পূরণ
করা হয় কোটা থেকে।
এ কোটার মধ্যে শতাংশ হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা ৩০, মহিলা ১৫,
আনসার ও ভিডিপি ১০, অনাথ ও প্রতিবন্ধী ১০ এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য ৫।
মেধার চেয়ে কোটায় বেশি নিয়োগ দেয়ায় নানা ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। কোটায়
যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না যাওয়া পদগুলো শূন্য রাখতে হয়। পিএসসি সূত্রে জানা
গেছে, কোটার কারণে প্রশাসনে হাজার হাজার পদ খালি থাকছে। ২৮ থেকে ৩২তম ৫টি
বিসিএসের ফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, যোগ্য প্রার্থী না থাকায় বিভিন্ন
কোটায় ৪ হাজার ২৮৭টি পদ শূন্য রাখতে হয়েছে। এর মধ্যে ২৮তম বিসিএসে ৮১৩টি,
২৯তম বিসিএসে ৭৯২টি, ৩০তম বিসিএসে ৭৮৪টি, ৩১তম বিসিএসে ৭৭৩টি পদ শূন্য ছিল।
কোটার শূন্য পদগুলো পূরণ করতে মুক্তিযোদ্ধা, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও মহিলাদের
জন্য ৩২তম বিশেষ বিসিএস নেয়া হয়। কোটা ব্যবস্থার কারণে ওই বিসিএসে ১ হাজার
১২৫টি পদ শূন্য রয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ৩৩তম বিসিএসের মাধ্যমে তা পূরণের
সিদ্ধান্ত হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১২ সালে সরকারি দফতরে
পদ সৃজন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত নিয়োগ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় লাগার কারণ
অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ
সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঞাকে প্রধান করে একটি সচিব কমিটিও গঠন করা
হয়। সেই সচিব কমিটির অনুসন্ধানে জানা যায়, পদ সৃজন থেকে শুরু করে পদ পূরণ
পর্যন্ত সর্বোচ্চ সাত বছরের বেশি সময় লাগে। অবিশ্বাস্য এ সময় কমিয়ে আনতে
সচিব কমিটি ১১ দফা সুপারিশ করে। কমিটির প্রধান মোশাররাফ হোসাইন ভূঞা
বিশ্বব্যাংকে যোগদানের আগে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে প্রতিবেদন জমা দেন।
প্রতিবেদনের দেয়া সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী জনপ্রশাসন
মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন। এখন পর্যন্ত ওই সুপারিশ আলোর মুখ দেখেনি।
ফাইলবন্দি হয়েই পড়ে আছে মন্ত্রণালয়ে।
No comments