তিস্তাই এখন আসল পরীক্ষা
সুহাসিনী হায়দার * শেখ হাসিনা যখন ২০১০ সালে শেষবার দ্বিপক্ষীয় সফরে দিল্লিতে আসেন, তখন আপনি হাইকমিশনার ছিলেন। সাত বছর পর এবারের সফরের সম্ভাব্য ফলাফল কী হবে বলে আপনার মূল্যায়ন?
তারিক করিম * আপনার মনে থাকার কথা, সেবার কিন্তু হাসিনা নির্বাচিত হওয়ার পুরো এক বছর পর দিল্লি সফর করেন। এমনকি তখনো এই সফরের সূচি প্রণয়ন করতে বলা হলে আমরা বলেছিলাম, যখন সফর থেকে দুই পক্ষের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু পাওয়ার অবকাশ সৃষ্টি হবে, তখনই সফরটি হওয়া উচিত। ওই সফর আমাদের সম্পর্কের ধারা বদলে দেয়। সেই সফরে উভয় প্রধানমন্ত্রী রূপরেখা প্রণয়ন করেছিলেন। আর মনমোহন সিং যখন ফিরতি সফরে ঢাকায় গেলেন, তখন কিন্তু ঘোষণা অনুসারে অনেক কিছুই করা হয়ে গেছে। তবে ইউপিএ সরকার রাজনৈতিক ক্ষমতা হারানোয় মোদি সরকার আসা পর্যন্ত অনেক কিছুই বাস্তবায়ন করা যায়নি, সেটা ভিন্ন ব্যাপার। কিন্তু লক্ষ্যটা সব সময়ই ছিল। মোদি সেই সুযোগ নিয়ে এগিয়ে যেতে পেরেছেন। ২০১৫ সালে মোদির সফর এই সবকিছুর স্বাভাবিক পরিণতিই ছিল। এখন স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়িত হয়ে গেছে এবং যোগাযোগও স্থাপিত হয়েছে। বাকি আছে শুধু তিস্তা চুক্তি। আর মোদি ভবিষ্যৎ পথপরিক্রমার গতিমুখও নির্ধারণ করেছেন।
সুহাসিনী * তিস্তা চুক্তি এখনো বাস্তবায়িত হচ্ছে না কেন?
তারিক * একসময় শীর্ষ পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ছিল। এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা গওহর রিজভী সাবেক ভারতীয় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননের সঙ্গে প্রতি মাসে একবার দেখা করতেন। সেখানে তাঁরা মূল্যায়ন করতেন, কী হয়েছে আর কী হয়নি। কিন্তু সেটা পরবর্তীকালে আর চলেনি। এটাও মনে রাখা দরকার, শেখ হাসিনার শাসনকালের দ্বিতীয় ভাগ চলছে। পৃথিবীর যেকোনো দেশের সরকারের জন্যই এটা সমস্যাজনক। বাংলাদেশে গেলে দেখবেন, আমি দেখেছি, ব্যাপারটা হলো, মানুষকে বললাম শতাধিক চুক্তির মধ্যে ৯০-এর বেশি বাস্তবায়িত হয়েছে, আরও ৫০টি পাইপলাইনে আছে। কিন্তু তারা শুধু বলে, ‘তিস্তা চুক্তি কেন হচ্ছে না?’
সুহাসিনী * ২০১৪ সালের এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন, তিস্তা ভারত-বাংলাদেশ সরকারের লিটমাস টেস্ট। কেন?
তারিক * এটা আমাদের অতীতের ধারাবাহিকতা। আমরা তিস্তা চুক্তি করে ফেলতে পারলে ৫৪টি অভিন্ন নদীর অববাহিকা ব্যবস্থাপনার দিকে যেতে পারব। শেখ হাসিনা শুধু নদী ‘ভাগাভাগির’ কথা বলবেন না, তার ব্যবস্থাপনার কথা বলবেন। আপনি জমি ভাগ করতে পারেন, কিন্তু পানি বা বাস্তুতন্ত্র ভাগ করতে পারবেন কি? আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সৃষ্ট সার্বভৌমত্বের নয়া ধারণানির্ভর (ওয়েস্টফালীয়) ব্যবস্থার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছি। আমরা অতি উৎসাহী হয়ে জাতীয়তা রক্ষার চেষ্টা করতে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাজটি করতে ভুলে যাই, যা আমার জাতীয় সীমা অতিক্রম করে যায়। তিস্তা এখন সে রকমই একটি আবেগের ব্যাপার।
সুহাসিনী * এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তিস্তা চুক্তি ছাড়া ফেরত যাওয়া কতটা কঠিন হবে?
তারিক * রাজনৈতিকভাবে ব্যাপারটা কঠিন হবে, খুবই কঠিন। তিস্তা ইস্যু দিয়ে বিরোধীরা তাঁকে গুঁতো দেয়। তারা বলে, হাসিনার যদি ভারত ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এত ভালো সম্পর্ক থাকে, তাহলে তিনি তিস্তা চুক্তি করতে পারেন না কেন? সাত বছর পর এসে তাঁর তো অবশ্যই কিছু নিয়ে যেতে পারা উচিত। দেখুন, তিস্তা সমস্যার তালিকায় না থাকলে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে আর তো ঝগড়া থাকবে না। ২০১১ সালেই তো তিস্তা চুক্তি হয়ে যেত, যেমন আমাদের মধ্যে মতৈক্য হয়েছিল। অর্থাৎ নদীটি জীবিত রাখতে একটি রূপরেখা করা হয়েছিল। উভয় পক্ষই একমত হয়েছিল, নদীটি বহমান রাখতে হবে। পানির নির্দিষ্ট একটি প্রবাহ রাখতে হবে, এরপর যা থাকে তার আধাআধি ভাগ হবে। এই উদ্যোগ শুরুও হয়েছিল, শুধু চুক্তিটা সই হওয়া বাকি ছিল।
সুহাসিনী * তাহলে তখন সেটা হয়নি কেন?
তারিক * এখানেই ভারতের ‘কো-অপারেটিভ ফেডারেলিজম’ নীতি ক্রিয়াশীল হয়। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সম্মতি ছাড়া শুধু নির্বাহী
আদেশ দিয়ে তারা এটা করতে পারে না। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কো-অপারেটিভ ফেডারেলিজমের মন্ত্র দিয়ে যদি বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের তুরুপ খেলা যায়, তাহলে সহযোগিতামূলক উপ-আঞ্চলিকতাবাদ দিয়ে কেন এটাকে তুরুপ করে দেওয়া যাবে না? পরিসর বড় করতে হবে, কারণ এর লাভ এত বেশি যে তা সব উদ্বেগ আড়াল করে দেবে।
সুহাসিনী * এখন ভারতের কেন্দ্র সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মধ্যকার সমস্যার সমাধান না হওয়ায় সরকার বিকল্প কী
করতে পারে?
তারিক * এই সফর কার্যকর করার একটি তরিকা হচ্ছে শেখ হাসিনা অন্য কী নিয়ে যেতে পারেন, তার সন্ধান করা। বাংলাদেশ দুটি জিনিস চায়: পানির নিরাপত্তা ও জ্বালানি নিরাপত্তা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভারত যদি বলে এটা বাংলাদেশের জন্য সহায়ক হবে, তাহলে ব্যাপারটা এক রকম। গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প সব সময় আটকে গেছে, কারণ আমাদের সেই টাকা ছিল না। অন্যদিকে দাতারাও টাকা দিতে চায়নি, কারণ পর্যাপ্ত পানির প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি থাকা প্রয়োজন। তখনকার রাজনৈতিক জোট এটা যাতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করেছে। এই সফরে এটা হয়ে গেলে শেখ হাসিনা ঢাকায় ফিরে গিয়ে বলতে পারেন, এটা তাঁর বাবার স্বপ্ন ছিল। তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে ফারাক্কা ব্যারাজ পেয়েছিলেন, কিন্তু সব সময় গঙ্গা ব্যারাজ চেয়েছেন। তিনি যদি বলতে পারেন এটা হয়ে গেছে এবং আমরা অববাহিকা ব্যবস্থাপনা চুক্তি করতে পারি, তাহলে আরও উৎপাদনশীল কিছু করা সম্ভব।
সুহাসিনী * আপনি তো অনেক বিকল্পের কথা বললেন। ওদিকে শেখ হাসিনার উপদেষ্টা তো ওপরের দেশ হিসেবে চীনকেও এর মধ্যে আনার পরামর্শ দিয়েছেন।
তারিক * ভারত এটা গ্রহণ করবে না। অকপটে বলছি, চীন হয়তো আমাদের কথা শুনবে না। কিন্তু তারা যা-ই করুক বা তাদের অংশের নদীতে যা-ই করুক না কেন, নদীর ৭০ শতাংশ পানি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে। আমাদের ভেবে দেখতে হবে, কীভাবে এর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। কারণ, এখন পর্যন্ত ৬০ শতাংশ পানি সমুদ্রে চলে যায়। আমরা যা করতে পারি, তা আমাদের করাই উচিত। আর বাধাগুলো অপসারিত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সার্কের ক্ষেত্রে আমরা তা-ই করেছি, কারণ আমরা যোগাযোগের জন্য বিবিআইএন (বাংলাদেশ, ভুটান, ইন্ডিয়া, নেপাল) নামের আঞ্চলিক জোট গঠন করেছি।
সুহাসিনী *এই গত মার্চ মাসে শেখ হাসিনা এক রেডিও অনুষ্ঠানে ভারতের এক গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন, তারা ২০০১ সালে বাংলাদেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে, যে নির্বাচনে তিনি হেরেছিলেন। তাঁর এই ধারণা হলো কেন?
তারিক * এটা রাজনীতি, খুবই সাধারণ ব্যাপার। তিনি বিএনপিকে বললেন, তিনি ভারতের তঁাবেদার নন। অর্থাৎ তিনি ভারতকে বলতে পারেন, ২০০১ সালে তারা ভুল করেছিল। আমাদের এই অঞ্চলে নেতৃত্বের এ রকম সাহস দেখাতে হয়।
সুহাসিনী * নয়াদিল্লি তো বাংলাদেশকে শতভাগ সমর্থন দিয়েছে, তা সে ২০১৪ সালের নির্বাচন হোক বা যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ফাঁসিতে ঝোলানো হোক। এখন ভারত সরকার ২৫ মার্চ বিশ্ব গণহত্যা দিবস পালনে বাংলাদেশের দাবিতে সমর্থন দিতে ইচ্ছুক। তাহলে বাংলাদেশে এখনো কেন এত ভারতবিরোধিতা?
তারিক * দেখুন, বাংলাদেশের ২০০১ সালের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন আছে। সেটা মোকাবিলা করতে হবে। আবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক বিবাদও আছে, কখনো যাকে ‘বেগমদের লড়াই’ নামে অভিহিত করা হয়। এ কারণে ভারতবিষয়ক এই মনোভাব হালে পানি পায়। কিন্তু সত্য হচ্ছে, এর পরিবর্তন হচ্ছে। সম্প্রতি বিএনপির অনেক প্রতিনিধিদল ভারতে গিয়েছে। তারা সেখানে ভারতীয় নেতা, কর্মকর্তা ও মানুষের সঙ্গে আলোচনা করেছে। তাই মনে হয়, ভারতবিষয়ক ধারণা বদলাচ্ছে। এ ছাড়া ভারতবিষয়ক আরও অনেক দ্বিদলীয় মতৈক্য আছে। এই প্রক্রিয়া চলছে, তবে এতে আরও কিছু সময় হয়তো লেগে যাবে।
সুহাসিনী হায়দার * আপনাকে ধন্যবাদ।
তারিক করিম * আপনাকেও ধন্যবাদ।
দ্য হিন্দু থেকে নেওয়া, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
তারিক করিম * আপনার মনে থাকার কথা, সেবার কিন্তু হাসিনা নির্বাচিত হওয়ার পুরো এক বছর পর দিল্লি সফর করেন। এমনকি তখনো এই সফরের সূচি প্রণয়ন করতে বলা হলে আমরা বলেছিলাম, যখন সফর থেকে দুই পক্ষের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু পাওয়ার অবকাশ সৃষ্টি হবে, তখনই সফরটি হওয়া উচিত। ওই সফর আমাদের সম্পর্কের ধারা বদলে দেয়। সেই সফরে উভয় প্রধানমন্ত্রী রূপরেখা প্রণয়ন করেছিলেন। আর মনমোহন সিং যখন ফিরতি সফরে ঢাকায় গেলেন, তখন কিন্তু ঘোষণা অনুসারে অনেক কিছুই করা হয়ে গেছে। তবে ইউপিএ সরকার রাজনৈতিক ক্ষমতা হারানোয় মোদি সরকার আসা পর্যন্ত অনেক কিছুই বাস্তবায়ন করা যায়নি, সেটা ভিন্ন ব্যাপার। কিন্তু লক্ষ্যটা সব সময়ই ছিল। মোদি সেই সুযোগ নিয়ে এগিয়ে যেতে পেরেছেন। ২০১৫ সালে মোদির সফর এই সবকিছুর স্বাভাবিক পরিণতিই ছিল। এখন স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়িত হয়ে গেছে এবং যোগাযোগও স্থাপিত হয়েছে। বাকি আছে শুধু তিস্তা চুক্তি। আর মোদি ভবিষ্যৎ পথপরিক্রমার গতিমুখও নির্ধারণ করেছেন।
সুহাসিনী * তিস্তা চুক্তি এখনো বাস্তবায়িত হচ্ছে না কেন?
তারিক * একসময় শীর্ষ পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ছিল। এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা গওহর রিজভী সাবেক ভারতীয় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননের সঙ্গে প্রতি মাসে একবার দেখা করতেন। সেখানে তাঁরা মূল্যায়ন করতেন, কী হয়েছে আর কী হয়নি। কিন্তু সেটা পরবর্তীকালে আর চলেনি। এটাও মনে রাখা দরকার, শেখ হাসিনার শাসনকালের দ্বিতীয় ভাগ চলছে। পৃথিবীর যেকোনো দেশের সরকারের জন্যই এটা সমস্যাজনক। বাংলাদেশে গেলে দেখবেন, আমি দেখেছি, ব্যাপারটা হলো, মানুষকে বললাম শতাধিক চুক্তির মধ্যে ৯০-এর বেশি বাস্তবায়িত হয়েছে, আরও ৫০টি পাইপলাইনে আছে। কিন্তু তারা শুধু বলে, ‘তিস্তা চুক্তি কেন হচ্ছে না?’
সুহাসিনী * ২০১৪ সালের এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন, তিস্তা ভারত-বাংলাদেশ সরকারের লিটমাস টেস্ট। কেন?
তারিক * এটা আমাদের অতীতের ধারাবাহিকতা। আমরা তিস্তা চুক্তি করে ফেলতে পারলে ৫৪টি অভিন্ন নদীর অববাহিকা ব্যবস্থাপনার দিকে যেতে পারব। শেখ হাসিনা শুধু নদী ‘ভাগাভাগির’ কথা বলবেন না, তার ব্যবস্থাপনার কথা বলবেন। আপনি জমি ভাগ করতে পারেন, কিন্তু পানি বা বাস্তুতন্ত্র ভাগ করতে পারবেন কি? আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সৃষ্ট সার্বভৌমত্বের নয়া ধারণানির্ভর (ওয়েস্টফালীয়) ব্যবস্থার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছি। আমরা অতি উৎসাহী হয়ে জাতীয়তা রক্ষার চেষ্টা করতে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাজটি করতে ভুলে যাই, যা আমার জাতীয় সীমা অতিক্রম করে যায়। তিস্তা এখন সে রকমই একটি আবেগের ব্যাপার।
সুহাসিনী * এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তিস্তা চুক্তি ছাড়া ফেরত যাওয়া কতটা কঠিন হবে?
তারিক * রাজনৈতিকভাবে ব্যাপারটা কঠিন হবে, খুবই কঠিন। তিস্তা ইস্যু দিয়ে বিরোধীরা তাঁকে গুঁতো দেয়। তারা বলে, হাসিনার যদি ভারত ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এত ভালো সম্পর্ক থাকে, তাহলে তিনি তিস্তা চুক্তি করতে পারেন না কেন? সাত বছর পর এসে তাঁর তো অবশ্যই কিছু নিয়ে যেতে পারা উচিত। দেখুন, তিস্তা সমস্যার তালিকায় না থাকলে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে আর তো ঝগড়া থাকবে না। ২০১১ সালেই তো তিস্তা চুক্তি হয়ে যেত, যেমন আমাদের মধ্যে মতৈক্য হয়েছিল। অর্থাৎ নদীটি জীবিত রাখতে একটি রূপরেখা করা হয়েছিল। উভয় পক্ষই একমত হয়েছিল, নদীটি বহমান রাখতে হবে। পানির নির্দিষ্ট একটি প্রবাহ রাখতে হবে, এরপর যা থাকে তার আধাআধি ভাগ হবে। এই উদ্যোগ শুরুও হয়েছিল, শুধু চুক্তিটা সই হওয়া বাকি ছিল।
সুহাসিনী * তাহলে তখন সেটা হয়নি কেন?
তারিক * এখানেই ভারতের ‘কো-অপারেটিভ ফেডারেলিজম’ নীতি ক্রিয়াশীল হয়। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সম্মতি ছাড়া শুধু নির্বাহী
আদেশ দিয়ে তারা এটা করতে পারে না। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কো-অপারেটিভ ফেডারেলিজমের মন্ত্র দিয়ে যদি বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের তুরুপ খেলা যায়, তাহলে সহযোগিতামূলক উপ-আঞ্চলিকতাবাদ দিয়ে কেন এটাকে তুরুপ করে দেওয়া যাবে না? পরিসর বড় করতে হবে, কারণ এর লাভ এত বেশি যে তা সব উদ্বেগ আড়াল করে দেবে।
সুহাসিনী * এখন ভারতের কেন্দ্র সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মধ্যকার সমস্যার সমাধান না হওয়ায় সরকার বিকল্প কী
করতে পারে?
তারিক * এই সফর কার্যকর করার একটি তরিকা হচ্ছে শেখ হাসিনা অন্য কী নিয়ে যেতে পারেন, তার সন্ধান করা। বাংলাদেশ দুটি জিনিস চায়: পানির নিরাপত্তা ও জ্বালানি নিরাপত্তা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভারত যদি বলে এটা বাংলাদেশের জন্য সহায়ক হবে, তাহলে ব্যাপারটা এক রকম। গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প সব সময় আটকে গেছে, কারণ আমাদের সেই টাকা ছিল না। অন্যদিকে দাতারাও টাকা দিতে চায়নি, কারণ পর্যাপ্ত পানির প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি থাকা প্রয়োজন। তখনকার রাজনৈতিক জোট এটা যাতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করেছে। এই সফরে এটা হয়ে গেলে শেখ হাসিনা ঢাকায় ফিরে গিয়ে বলতে পারেন, এটা তাঁর বাবার স্বপ্ন ছিল। তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে ফারাক্কা ব্যারাজ পেয়েছিলেন, কিন্তু সব সময় গঙ্গা ব্যারাজ চেয়েছেন। তিনি যদি বলতে পারেন এটা হয়ে গেছে এবং আমরা অববাহিকা ব্যবস্থাপনা চুক্তি করতে পারি, তাহলে আরও উৎপাদনশীল কিছু করা সম্ভব।
সুহাসিনী * আপনি তো অনেক বিকল্পের কথা বললেন। ওদিকে শেখ হাসিনার উপদেষ্টা তো ওপরের দেশ হিসেবে চীনকেও এর মধ্যে আনার পরামর্শ দিয়েছেন।
তারিক * ভারত এটা গ্রহণ করবে না। অকপটে বলছি, চীন হয়তো আমাদের কথা শুনবে না। কিন্তু তারা যা-ই করুক বা তাদের অংশের নদীতে যা-ই করুক না কেন, নদীর ৭০ শতাংশ পানি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে। আমাদের ভেবে দেখতে হবে, কীভাবে এর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। কারণ, এখন পর্যন্ত ৬০ শতাংশ পানি সমুদ্রে চলে যায়। আমরা যা করতে পারি, তা আমাদের করাই উচিত। আর বাধাগুলো অপসারিত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সার্কের ক্ষেত্রে আমরা তা-ই করেছি, কারণ আমরা যোগাযোগের জন্য বিবিআইএন (বাংলাদেশ, ভুটান, ইন্ডিয়া, নেপাল) নামের আঞ্চলিক জোট গঠন করেছি।
সুহাসিনী *এই গত মার্চ মাসে শেখ হাসিনা এক রেডিও অনুষ্ঠানে ভারতের এক গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন, তারা ২০০১ সালে বাংলাদেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে, যে নির্বাচনে তিনি হেরেছিলেন। তাঁর এই ধারণা হলো কেন?
তারিক * এটা রাজনীতি, খুবই সাধারণ ব্যাপার। তিনি বিএনপিকে বললেন, তিনি ভারতের তঁাবেদার নন। অর্থাৎ তিনি ভারতকে বলতে পারেন, ২০০১ সালে তারা ভুল করেছিল। আমাদের এই অঞ্চলে নেতৃত্বের এ রকম সাহস দেখাতে হয়।
সুহাসিনী * নয়াদিল্লি তো বাংলাদেশকে শতভাগ সমর্থন দিয়েছে, তা সে ২০১৪ সালের নির্বাচন হোক বা যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ফাঁসিতে ঝোলানো হোক। এখন ভারত সরকার ২৫ মার্চ বিশ্ব গণহত্যা দিবস পালনে বাংলাদেশের দাবিতে সমর্থন দিতে ইচ্ছুক। তাহলে বাংলাদেশে এখনো কেন এত ভারতবিরোধিতা?
তারিক * দেখুন, বাংলাদেশের ২০০১ সালের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন আছে। সেটা মোকাবিলা করতে হবে। আবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক বিবাদও আছে, কখনো যাকে ‘বেগমদের লড়াই’ নামে অভিহিত করা হয়। এ কারণে ভারতবিষয়ক এই মনোভাব হালে পানি পায়। কিন্তু সত্য হচ্ছে, এর পরিবর্তন হচ্ছে। সম্প্রতি বিএনপির অনেক প্রতিনিধিদল ভারতে গিয়েছে। তারা সেখানে ভারতীয় নেতা, কর্মকর্তা ও মানুষের সঙ্গে আলোচনা করেছে। তাই মনে হয়, ভারতবিষয়ক ধারণা বদলাচ্ছে। এ ছাড়া ভারতবিষয়ক আরও অনেক দ্বিদলীয় মতৈক্য আছে। এই প্রক্রিয়া চলছে, তবে এতে আরও কিছু সময় হয়তো লেগে যাবে।
সুহাসিনী হায়দার * আপনাকে ধন্যবাদ।
তারিক করিম * আপনাকেও ধন্যবাদ।
দ্য হিন্দু থেকে নেওয়া, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
No comments