প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ সুচি
এক
বছর আগে বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান
সুচির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসিকে (এনএলডি) ক্ষমতার মসনদে বসিয়েছিল
দেশটির জনগণ। সেই প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন সুচি। সামরিক শাসন হটিয়ে
শান্তিতে নোবেলজয়ী সুচির হাতে ক্ষমতা যাওয়ায় মিয়ানমারে দীর্ঘদিনের জাতিগত
দ্বন্দ্বের অবসান ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছিল। এজন্য হতাশ দেশটির সাধারণ জনগণ।
হতাশ সুচি নিজও। এজন্য জনগণ চাইলে নেতার পদ থেকে সরে যাবেন বলে ঘোষণাও
দিয়েছেন দেশটির নেতা অং সান সুচি। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ক্ষমতার
এক বছর পূর্তি উপলক্ষে স্টেট অব ইউনিয়ন ভাষণে দেশটির স্টেট কাউন্সিলর বলেন,
তার ‘সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা’ যদি যথেষ্ট না হয়, তবে তিনি পদত্যাগ করবেন।
পাশাপাশি জাতিসংঘ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ এনে যে
তদন্ত শুরু করতে যাচ্ছে তাও প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি। খবর দ্য
ইনডিপেনডেন্ট, গার্ডিয়ান ও এএফপির। নোবেল পুরস্কারজয়ী এ নেতা বলেন, ‘আমি
শুরু থেকেই বলেছি, সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। জনগণ যদি মনে করে, আমার সর্বোচ্চ
চেষ্টা তাদের জন্য যথেষ্ট নয় এবং আমাদের চেয়ে ভালো কোনো ব্যক্তি বা
প্রতিষ্ঠান থাকে তবে পদত্যাগ করতে আমরা প্রস্তুত।’ তিনি আরও বলেন, ‘শান্তি
প্রক্রিয়া এত সহজ নয়, তবে আমাদের অনেক আকাঙ্খা আছে। শান্তির পথে আমরা কিছু
দূর এগিয়ে যাই, আবার কিছুক্ষণের জন্য থামি অথবা একটু পিছিয়ে যাই। কিন্তু
আমরা স্পষ্টভাবেই আমাদের লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন এবং তা অর্জনে এগিয়ে যাব।’
রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর সহিংসতা ও
হত্যাযজ্ঞের ঘটনা তদন্তে দেশটিতে জাতিসংঘ যে মিশন পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে
তার সমালোচনাও করেছেন সুচি। গত সপ্তাহে জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থা
(ইউএনএইচআরসি) রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের অভিযোগ
তদন্তে একটি তদন্তকারী দল পাঠানোর ঘোষণা দেয়।
এর সমালোচনা করে সুচি বলেন,
‘শান্তি ও জাতীয় ঐক্যের প্রচেষ্টা বজায় রাখতে বিশ্বব্যাপী আমাদের বন্ধু
রাষ্ট্রদের সমর্থন, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার গুরুত্ব দেই আমরা। দেশের
প্রয়োজনীয়তার ওপর ভিত্তি করেই আমরা কাজ করব। দেশের কল্যাণে কোনটি মঙ্গলজনক,
সেটি আমরাই ঠিক করব।’ তিনি আরও বলেন, 'আমাদের দেশের পরিস্থিতির সঙ্গে
সংগতিপূর্ণ না হওয়ায় আমরা জাতিসংঘের এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি না। এটা
জাতিসংঘের প্রতি অসম্মান নয়।’ দীর্ঘদিন ধরেই মিয়ানমারে বৈষম্যের শিকার
রোহিঙ্গারা। জাতিসংঘ এ সম্প্রদায়টিকে বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী
হিসেবে বিবেচনা করে। গত বছরের অক্টোবরে মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন
রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে এক অভিযান শুরু করে দেশটির
সেনাবাহিনী। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবি, ‘অপারেশন ক্লিন’ নামের এ অভিযানে
দেশটির সেনাবাহিনী হত্যা, ধর্ষণ, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার মতো মানবাধিকার
লঙ্ঘন করেছে। প্রায় ৭৫ হাজার রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে
এসেছে। ২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় শতাধিক
নিহতের পরে এটাই সবচেয়ে বড় সহিংসতার ঘটনা। গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য
দিয়ে ২০১৫ সালের নভেম্বরে ক্ষমতায় আসে দেশটির গণতন্ত্রপন্থী এবং শান্তিতে
নোবেলজয়ী নেত্রী অং সান সুচির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)।
ধারণা করা হয়েছিল, তার দল ক্ষমতায় এলে রোহিঙ্গাদের অবস্থার উন্নতি হবে।
কিন্তু রাখাইন অঞ্চলে সেনা অভিযানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের
প্রেক্ষাপটে সেনাদের পক্ষেই সাফাই গেয়েছেন তিনি। এতে সমালোচিত হয়েছেন
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। জাতিসংঘ প্রকাশিত প্রতিবেদনকেও অতিরঞ্জিত বলে উল্লেখ
করেছে দেশটির সরকার।
সুচির জনপ্রিয়তার প্রথম পরীক্ষা : ক্ষমতার এক বছর পর
জনপ্রিয়তার প্রথম পরীক্ষার মুখোমুখি সুচি। তার শাসনে শনিবার প্রথম স্থানীয়
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ধীর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সীমান্তে সশস্ত্র
জাতিগত গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারের ক্রমবর্ধমান লড়াইয়ের মাঝে দেশটির
পার্লামেন্টের ১৯টি আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনকে সুচির জন্য
অগ্নিপরীক্ষা হিসেবে দেখা হচ্ছে। সুচির নেতৃত্বের প্রতি মানুষের
দৃষ্টিভঙ্গিরও ইঙ্গিত মিলবে। দেশটির জাতীয় এবং আঞ্চলিক পার্লামেন্টের ১৯টি
আসনে এমন একসময় অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন আকাশচুম্বী প্রত্যাশার সঙ্গে খাপ
খাওয়ার লড়াই করছেন সুচি। ১৯টি আসনের মধ্যে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের ৩টি,
নিন্মকক্ষের ৯টি এবং বাকি ৭টি আসন সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক এলাকায় জাতীয় এবং
আঞ্চলিক পার্লামেন্টের জন্য। দেশটির মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ অর্থাৎ
প্রায় ২০ লাখ মানুষ এ নির্বাচনের জন্য নিবন্ধিত। ফল আজ প্রকাশ করা হবে। এ
নির্বাচনের ফল পার্লামেন্টে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ সুচির এনএলডির ক্ষমতার
ভারসাম্যে তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না। তবে এটি প্রশাসনের জনপ্রিয়তা
যাচাইয়ের একটি সুযোগ। মিয়ানমারে মতামত ভোটের কোনো সুযোগ নেই।
No comments