জনগণই ক্যারিশমা দেখিয়েছেন by কাফি কামাল ও জাহিদ হাসান
বিএনপি
মনোনীত প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন
কুসিকের নগরপিতা। এ বিজয়কে জনগণের ক্যারিশমা মনে করেন তিনি। কুসিকের
উন্নয়নে প্রত্যাশা করেন সরকার, স্থানীয় এমপি, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীসহ
সবার সহযোগিতা। সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেই এগিয়ে নিতে চান কুসিকের উন্নয়ন।
জলাবদ্ধতা নিরসনের পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে শুরু করতে চান দ্বিতীয় মেয়াদের
কর্মকাণ্ড। প্রাধান্য দিতে চান সদর দক্ষিণের ৯ ওয়ার্ডের প্রতি। দলের প্রতি
আনুগত্য রেখেই পথ চলতে চান আগামী দিনের রাজনীতিতে। নির্বাচিত হওয়ার পর
প্রথম সাক্ষাৎকারে তিনি দৈনিক মানবজমিনের নানা প্রশ্নের জবাব দেন।
দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে তার ক্যারিশমা কি জানতে চাইলে মনিরুল হক সাক্কু বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনো ক্যারিশমা নেই। নির্বাচনে জনগণই আসল ক্যারিশমা দেখিয়েছে। কুসিক নির্বাচনের ওপর পুরো দেশবাসীর দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। আমার প্রাপ্ত ভোটের একটিও কিন্তু ফলস ভোট না। আমার কর্মীরা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও কষ্ট করে নিজের ভোটটি দিয়ে এসেছেন। তারা নিজেরা কোনো জাল ভোট দেয়নি, কোনো ভোটারের ওপর প্রভাব বিস্তারও করেনি। আমি আমার কর্মী-সমর্থকদের তেমন নির্দেশনাও দেইনি। আমি কুমিল্লার মানুষের সঙ্গে যে আত্মার সম্পর্ক রেখেছি, দিন-রাত মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি, তারা সেটা মনে রেখেছেন। নগরবাসী যে আমাকে পছন্দ করেন, নির্বাচনে তার প্রতিফলন ঘটেছে।
নির্বাচনে বিজয়ের অনুভূতি প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমাকে দ্বিতীয়বারের জন্য নির্বাচিত করায় আমি কুমিল্লাবাসীকে অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানাই। তারা আমাকে দ্বিতীয়বার মেয়র পদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে দিয়েছেন। আসলে প্রথমবার যখন মেয়র নির্বাচন করেছিলাম সেটা দলীয় নির্বাচন ছিল না। এবারের নির্বাচন ছিল আসলেই অন্যরকম। লোকজনের সঙ্গে কথা বলে দেখছি, তারা সবাই চায় সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে কুসিকের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকুক। দ্বিতীয়বার বিজয়ী হয়ে অনুভব করতে পারছি দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। আমাকে নগরবাসী দ্বিতীয়বারের মতো যে সুযোগ দিয়েছেন তার প্রতি সম্মান রাখতে, তাদের আস্থা ধরে রেখে দায়িত্ব পালনে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।
দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়র হিসেবে প্রথম কোন কাজটি করবেন জানতে চাইলে সাক্কু বলেন, প্রথমেই আমি জলাবদ্ধতা নিরসনের উদ্যোগ নেবো। যথাশিগগিরই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবো। তারপর পর্যায়ক্রমে যানজট নিরসনসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেবো। কয়েকটি বড় প্রকল্প রয়েছে, সেগুলো দ্রুতগতিতে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবো। এছাড়া নগরীর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতাগুলো তো রয়েছেই।
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কাছে কোনো সহযোগিতা চান বা নেবেন কিনা জানতে চাইলে নবনির্বাচিত মেয়র সাক্কু বলেন, আমার প্রথম দিনই তার বাড়িতে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমার মন খারাপ। আমার নির্বাচনী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে গিয়ে অনেক কর্মী এখনো জেলে আছে। তবে দায়িত্বভার গ্রহণ করে প্রথম মিটিংয়েই আমি তাকে ডাকবো। কুমিল্লা শহর আমাদের সবার। আমি চাই সে আমার সঙ্গে থাকুক। আমরা দুজন মিলে বুদ্ধি-পরামর্শ করে কাজ করলে নিশ্চয়ই কুসিকের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীসহ সবার সহযোগিতা নিয়ে কাজ করতে চাই। এ ব্যাপারে আমার কোনো সমস্যা নেই।
বিরোধীদলীয় রাজনীতি করায় মেয়র হিসেবে সরকারের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি বা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত ঘটার আশঙ্কা করেন কিনা জানতে চাইলে মনিরুল হক সাক্কু বলেন, আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পরোক্ষভাবে দলীয় সমর্থন থাকলেও এবার দলীয় মনোনয়ন ও প্রতীকে নির্বাচন হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত সরকারের। কিন্তু আমি কুসিকের উন্নয়নের স্বার্থে সবার কাছে যাবো। আগেও সরকারের মন্ত্রীরা আমাকে সহযোগিতা করেছেন। আশা করি ভবিষ্যতেও সেই সহযোগিতা পাবো। এ ব্যাপারে আমার কোনো আশঙ্কা নেই। এছাড়া কুসিকের উন্নয়নের দায়ভার তাদেরও রয়েছে। কারণ, তাদের নির্বাচনী এলাকা ও ভোট রয়েছে কুসিকে। তাই সরকার তো আমাকে সহযোগিতা করবে না, করবে জনগণকে। এখানে আমি উন্নয়নের একটি মাধ্যম মাত্র।
কুমিল্লা সদর আসনের এমপির সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণে নির্বাচনে একটি পরোক্ষ সমর্থন পেয়েছেন। ভবিষ্যতে এ সুসম্পর্ক থাকবে কিনা জানতে চাইলে সাক্কু বলেন, তিনি একটি পার্টি করেন। আওয়ামী লীগের দৃষ্টিতে হয়তো তিনি নিষ্ক্রিয় ছিলেন। কেন নিষ্ক্রিয় ছিলেন সেটা উনার নিজের ব্যাপার। কিন্তু আমরা দেখেছি তিনি তার দলের পক্ষেই কাজ করেছেন। উনার মেয়েও নির্বাচনে প্রচারণা চালিয়েছেন। এটা সত্য যে, কুসিকের উন্নয়নে আমি প্রথম দিকে এমপি সাহেবের সঙ্গে কথা বলেছি। বলেছি, আপনি এখানে জাতীয় নির্বাচন করেছেন, ভবিষ্যতেও করবেন। কুসিকের জনগণের স্বার্থে আপনার ভূমিকা রাখা উচিত।
কুমিল্লা সদর আসনের বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার ও বিএনপির হাজী আমিনুল রশিদ ইয়াছিন দুজনই জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী। সিটি নির্বাচনে আগে কিভাবে তাদের সঙ্গে সমন্বয় করেছেন এবং ভবিষ্যতে কিভাবে করবেন জানতে চাইলে সাক্কু বলেন, রাজনীতিতে আসলে কেউ কাউকে ছাড় দেয় না। ২০১৪ সালে বাসায় তল্লাশির নামে র্যাব আমার সরকারি কর্মকর্তা ভাতিজি জামাইসহ সবাইকে ব্যাপক মারধর করেছে। আমার দুই ভাইকে গ্রেপ্তার করেছে। তখন তো স্থানীয় এমপি আমাকে কোনো সহযোগিতা করেননি। আসলে রাজনৈতিকভাবে কেউ কাউকে সাহায্য করতে পারে না। সামনে জাতীয় নির্বাচন হলে আমি আমার দলের সঙ্গে বেইমানি করতে পারবো না। আমাকে ধানের শীষের পক্ষে নির্বাচন করতে হবে। আমি ইয়াছিন ভাইয়ের জন্য ম্যাডামের কাছে বলবো। কোনোভাবেই তো ধানের শীষ প্রতীক থেকে সরতে পারবো না।
বিএনপির আন্দোলন সংগ্রামে কিভাবে ভূমিকা রাখবেন জানতে চাইলে সাক্কু বলেন, আমি ১৯৭৮ সাল থেকে রাজনীতি করি। দলের যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামের জন্যও প্রস্তুত। বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ছিলাম। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আমরা যেমন মার খেয়েছি, আওয়ামী লীগের লোকজনও মার খেয়েছে। আবার আওয়ামী লীগের আমলে ১৯৯৬ সালে আমার নামে ১২টি মামলা হলেও আমি আন্দোলন থেকে পিছপা হইনি। কিন্তু আমি কোনোদিন মানুষ হত্যা বা সম্পদের ক্ষতিসাধনের আন্দোলন করিনি। সোজা কথা, গণতন্ত্রের পক্ষে যে আন্দোলন সেটাতে আমি আছি।
বিএনপি মনোনীত মেয়র হিসেবে মামলা-মোকদ্দমা বা সম্ভাব্য প্রতিকূল পরিস্থিতি সম্পর্কে সাক্কু বলেন, আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে যদি কোনো মামলা হয় সেটা আমি ফেস করবো। কিন্তু সরকার যদি আন্দোলনের কারণে কোনো ফৌজদারি মামলা দিতে চায় দিতেই পারে। রাজনীতি যখন করি মামলা হতে পারে, জেলেও যেতে পারি- এ নিয়ে আমি ভীতসন্ত্রস্ত না। আমি জেলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। সরকার যদি আমাকে দিয়ে কাজ না করায় আমাকে সরে যেতে হবে। আমি তো বারবারই বলি, সরকার যদি আমাকে দিয়ে কুসিকের উন্নয়ন না করে অন্যকে দিয়ে করাতে চায় তাহলে তো সরাতেই পারে।
সদর দক্ষিণের ৯টি ওয়ার্ডের উন্নয়ন বঞ্চনা নিয়ে নির্বাচনের আগে অস্বস্তিতে ছিলেন। দ্বিতীয়বার দায়িত্ব পেয়ে কি করবেন জানতে চাইলে সাক্কু বলেন, আসলে মানুষ বুঝতে চেষ্টা করে না। জাইকা, বিশ্বব্যাংকসহ যারা টাকা দেয় তাদের কিছু নির্দেশনা আছে। তারা বলে, যেখানে লোকসংখ্যা বেশি সেখানেই কাজ করতে হবে। টাকাটা তো আমার না। তাই তাদের নির্দেশনা ও পরামর্শ বিবেচনায় রেখেই কাজ করতে হয়। তারপরও বলবো, সদর দক্ষিণের ৯টি ওয়ার্ডে অনেক কাজ হয়েছে। জাইকার দ্বিতীয় প্রকল্পের আওতায় সেখানে বেশ কিছু উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের উদ্যোগ নেয়া হবে। এবার অবশ্যই সেই ৯টি ওয়ার্ডকে সমান গুরুত্ব দিয়ে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিয়ে উন্নয়নের উদ্যোগ নেবো।
কুসিকের রাজনৈতিক সম্প্রীতি নিয়ে তিনি বলেন, কুমিল্লার রাজনীতি ও সামাজিক পরিবেশে একটি সম্প্রীতির ভাব থাকুক এটা আমি সবসময় চাই। রাজনীতি সারা পৃথিবীতে আছে, থাকবে। কুমিল্লা কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। রাজনীতি না থাকলে আবার সবই স্বৈরাচার হয়ে যায়। যে যার রাজনীতি করবে, হিন্দু-মুসলমান সবাই যার যার ধর্ম পালন করবে কিন্তু সবার মধ্যে মিলেমিশে থাকার মনোভাবটা থাকতে হবে। আমরা যদি হিংসাত্মক মনোভাবের দিকে যাই, তাহলে তো ছোট্ট এ শহরের পরিবেশ ঠিক রাখা কোনোভাবেই সম্ভব না। আমরা আশা করি, যে যেই দল করি না কেন, কারো মধ্যে যেন হিংসাত্মক মনোভাবটা না থাকে।
কুমিল্লাবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে নবনির্বাচিত মেয়র বলেন, রাস্তাঘাট, ড্রেনসহ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অবশ্যই সিটি করপোরেশন করবে। আমরা যে শপথ নিয়েছে আমাদের কাজ অবশ্যই আমরা করবো। কিন্তু রাস্তাঘাট রক্ষণাবেক্ষণ, ড্রেনেজ পরিষ্কার রাখাসহ নানা বিষয়ে নগরবাসীর ভূমিকা রয়েছে। এ নগর আমাদের সবার। আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করলেই এ নগরী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবে, সমস্যা কমে যাবে। উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। নগরবাসীর অনেকেই ড্রেনে ময়লা ফেলে ড্রেনেজ সিস্টেমে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। নগরবাসী অসচেতন হলে তো নগরের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন করা কঠিন। আমি নগরবাসীর আন্তরিক সহযোগিতা চাই।
নির্বাচিত হলেও প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে সাক্কু বলেন, এবার আওয়ামী লীগের লোকজনের আচরণে ভোটাররা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ায় প্রায় ৮০ হাজার ভোট কাস্ট হয়নি। আমি কারো বিরুদ্ধে বলবো না। সবকিছুই জনগণ দেখেছেন। তবে আমার যে জেনুইন ভোট, সে পরিমাণ ভোটও আমি পাইনি। এটা আসলে ভোট হয়নি। আওয়ামী লীগের লোকজন বিভিন্ন কেন্দ্রে রিগিং করে ভোটটা নিয়ে গেছে। সাধারণ ভোটার কম আসার কারণে আমার প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা কমে গেছে। সত্যিকার অর্থে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সুষ্ঠু ভোট হলে আমি সেভেনটি পারসেন্ট ভোট পেতাম।
নির্বাচনের পরিবেশ ও কমিশনের ভূমিকা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে মনিরুল হক সাক্কু বলেন, নির্বাচন কমিশন চেষ্টা করেছে। র্যাব-বিজিবি-পুলিশের তৎপরতায়ও কমতি ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগের লোকজনের ঝটিকা দুর্বৃত্তায়নের কারণে নানা জায়গায় গণ্ডগোল হয়েছে। বিশেষ করে দুপুর ১২টা থেকে তারা নানা কেন্দ্রে এ ঝটিকা দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে জাল ভোট দিয়েছে, ব্যালেট ছিনতাই করেছে, কেন্দ্র দখলের চেষ্টা করেছে। এতে জনগণ ভীতসন্ত্রস্ত হয়েছে। এ কারণে এবারের নির্বাচনে ভোট কাস্ট হয়েছে মাত্র ৬০ ভাগ। তবে নির্বাচন কমিশন যখনই অভিযোগ পেয়েছে অনেক জায়গায় ত্বরিত পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু একের পর এক কেন্দ্রে সরকারদলীয় লোকজন আচমকা গণ্ডগোল করলে তারা কয়টি রক্ষা করতে পারবে। নির্বাচনের আগের দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কুসিকে সন্দেহভাজন একটি জঙ্গি আস্তানা ঘিরে রাখার ঘটনা নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে কিনা জানতে চাইলে সাক্কু বলেন, এটি আসলে সরকারি ব্যাপার। এ ব্যাপারে কিছু বলা ঠিক হবে না। তবে এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন যে ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে জন্য আমি ধন্যবাদ জানাই। নির্বাচনের আগের দিন আস্তানাটির সন্ধান পাওয়া গেলেও নির্বাচনের দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অ্যাকশনে যায়নি। সেদিন অ্যাকশনে গেলে সেখানে গোলাগুলি হলে নিশ্চয় মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হতো, যা বিঘ্নিত করতো নির্বাচনী পরিবেশ।
দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে তার ক্যারিশমা কি জানতে চাইলে মনিরুল হক সাক্কু বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনো ক্যারিশমা নেই। নির্বাচনে জনগণই আসল ক্যারিশমা দেখিয়েছে। কুসিক নির্বাচনের ওপর পুরো দেশবাসীর দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। আমার প্রাপ্ত ভোটের একটিও কিন্তু ফলস ভোট না। আমার কর্মীরা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও কষ্ট করে নিজের ভোটটি দিয়ে এসেছেন। তারা নিজেরা কোনো জাল ভোট দেয়নি, কোনো ভোটারের ওপর প্রভাব বিস্তারও করেনি। আমি আমার কর্মী-সমর্থকদের তেমন নির্দেশনাও দেইনি। আমি কুমিল্লার মানুষের সঙ্গে যে আত্মার সম্পর্ক রেখেছি, দিন-রাত মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি, তারা সেটা মনে রেখেছেন। নগরবাসী যে আমাকে পছন্দ করেন, নির্বাচনে তার প্রতিফলন ঘটেছে।
নির্বাচনে বিজয়ের অনুভূতি প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমাকে দ্বিতীয়বারের জন্য নির্বাচিত করায় আমি কুমিল্লাবাসীকে অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানাই। তারা আমাকে দ্বিতীয়বার মেয়র পদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে দিয়েছেন। আসলে প্রথমবার যখন মেয়র নির্বাচন করেছিলাম সেটা দলীয় নির্বাচন ছিল না। এবারের নির্বাচন ছিল আসলেই অন্যরকম। লোকজনের সঙ্গে কথা বলে দেখছি, তারা সবাই চায় সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে কুসিকের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকুক। দ্বিতীয়বার বিজয়ী হয়ে অনুভব করতে পারছি দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। আমাকে নগরবাসী দ্বিতীয়বারের মতো যে সুযোগ দিয়েছেন তার প্রতি সম্মান রাখতে, তাদের আস্থা ধরে রেখে দায়িত্ব পালনে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।
দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়র হিসেবে প্রথম কোন কাজটি করবেন জানতে চাইলে সাক্কু বলেন, প্রথমেই আমি জলাবদ্ধতা নিরসনের উদ্যোগ নেবো। যথাশিগগিরই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবো। তারপর পর্যায়ক্রমে যানজট নিরসনসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেবো। কয়েকটি বড় প্রকল্প রয়েছে, সেগুলো দ্রুতগতিতে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবো। এছাড়া নগরীর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতাগুলো তো রয়েছেই।
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কাছে কোনো সহযোগিতা চান বা নেবেন কিনা জানতে চাইলে নবনির্বাচিত মেয়র সাক্কু বলেন, আমার প্রথম দিনই তার বাড়িতে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমার মন খারাপ। আমার নির্বাচনী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে গিয়ে অনেক কর্মী এখনো জেলে আছে। তবে দায়িত্বভার গ্রহণ করে প্রথম মিটিংয়েই আমি তাকে ডাকবো। কুমিল্লা শহর আমাদের সবার। আমি চাই সে আমার সঙ্গে থাকুক। আমরা দুজন মিলে বুদ্ধি-পরামর্শ করে কাজ করলে নিশ্চয়ই কুসিকের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীসহ সবার সহযোগিতা নিয়ে কাজ করতে চাই। এ ব্যাপারে আমার কোনো সমস্যা নেই।
বিরোধীদলীয় রাজনীতি করায় মেয়র হিসেবে সরকারের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি বা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত ঘটার আশঙ্কা করেন কিনা জানতে চাইলে মনিরুল হক সাক্কু বলেন, আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পরোক্ষভাবে দলীয় সমর্থন থাকলেও এবার দলীয় মনোনয়ন ও প্রতীকে নির্বাচন হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত সরকারের। কিন্তু আমি কুসিকের উন্নয়নের স্বার্থে সবার কাছে যাবো। আগেও সরকারের মন্ত্রীরা আমাকে সহযোগিতা করেছেন। আশা করি ভবিষ্যতেও সেই সহযোগিতা পাবো। এ ব্যাপারে আমার কোনো আশঙ্কা নেই। এছাড়া কুসিকের উন্নয়নের দায়ভার তাদেরও রয়েছে। কারণ, তাদের নির্বাচনী এলাকা ও ভোট রয়েছে কুসিকে। তাই সরকার তো আমাকে সহযোগিতা করবে না, করবে জনগণকে। এখানে আমি উন্নয়নের একটি মাধ্যম মাত্র।
কুমিল্লা সদর আসনের এমপির সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণে নির্বাচনে একটি পরোক্ষ সমর্থন পেয়েছেন। ভবিষ্যতে এ সুসম্পর্ক থাকবে কিনা জানতে চাইলে সাক্কু বলেন, তিনি একটি পার্টি করেন। আওয়ামী লীগের দৃষ্টিতে হয়তো তিনি নিষ্ক্রিয় ছিলেন। কেন নিষ্ক্রিয় ছিলেন সেটা উনার নিজের ব্যাপার। কিন্তু আমরা দেখেছি তিনি তার দলের পক্ষেই কাজ করেছেন। উনার মেয়েও নির্বাচনে প্রচারণা চালিয়েছেন। এটা সত্য যে, কুসিকের উন্নয়নে আমি প্রথম দিকে এমপি সাহেবের সঙ্গে কথা বলেছি। বলেছি, আপনি এখানে জাতীয় নির্বাচন করেছেন, ভবিষ্যতেও করবেন। কুসিকের জনগণের স্বার্থে আপনার ভূমিকা রাখা উচিত।
কুমিল্লা সদর আসনের বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার ও বিএনপির হাজী আমিনুল রশিদ ইয়াছিন দুজনই জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী। সিটি নির্বাচনে আগে কিভাবে তাদের সঙ্গে সমন্বয় করেছেন এবং ভবিষ্যতে কিভাবে করবেন জানতে চাইলে সাক্কু বলেন, রাজনীতিতে আসলে কেউ কাউকে ছাড় দেয় না। ২০১৪ সালে বাসায় তল্লাশির নামে র্যাব আমার সরকারি কর্মকর্তা ভাতিজি জামাইসহ সবাইকে ব্যাপক মারধর করেছে। আমার দুই ভাইকে গ্রেপ্তার করেছে। তখন তো স্থানীয় এমপি আমাকে কোনো সহযোগিতা করেননি। আসলে রাজনৈতিকভাবে কেউ কাউকে সাহায্য করতে পারে না। সামনে জাতীয় নির্বাচন হলে আমি আমার দলের সঙ্গে বেইমানি করতে পারবো না। আমাকে ধানের শীষের পক্ষে নির্বাচন করতে হবে। আমি ইয়াছিন ভাইয়ের জন্য ম্যাডামের কাছে বলবো। কোনোভাবেই তো ধানের শীষ প্রতীক থেকে সরতে পারবো না।
বিএনপির আন্দোলন সংগ্রামে কিভাবে ভূমিকা রাখবেন জানতে চাইলে সাক্কু বলেন, আমি ১৯৭৮ সাল থেকে রাজনীতি করি। দলের যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামের জন্যও প্রস্তুত। বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ছিলাম। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আমরা যেমন মার খেয়েছি, আওয়ামী লীগের লোকজনও মার খেয়েছে। আবার আওয়ামী লীগের আমলে ১৯৯৬ সালে আমার নামে ১২টি মামলা হলেও আমি আন্দোলন থেকে পিছপা হইনি। কিন্তু আমি কোনোদিন মানুষ হত্যা বা সম্পদের ক্ষতিসাধনের আন্দোলন করিনি। সোজা কথা, গণতন্ত্রের পক্ষে যে আন্দোলন সেটাতে আমি আছি।
বিএনপি মনোনীত মেয়র হিসেবে মামলা-মোকদ্দমা বা সম্ভাব্য প্রতিকূল পরিস্থিতি সম্পর্কে সাক্কু বলেন, আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে যদি কোনো মামলা হয় সেটা আমি ফেস করবো। কিন্তু সরকার যদি আন্দোলনের কারণে কোনো ফৌজদারি মামলা দিতে চায় দিতেই পারে। রাজনীতি যখন করি মামলা হতে পারে, জেলেও যেতে পারি- এ নিয়ে আমি ভীতসন্ত্রস্ত না। আমি জেলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। সরকার যদি আমাকে দিয়ে কাজ না করায় আমাকে সরে যেতে হবে। আমি তো বারবারই বলি, সরকার যদি আমাকে দিয়ে কুসিকের উন্নয়ন না করে অন্যকে দিয়ে করাতে চায় তাহলে তো সরাতেই পারে।
সদর দক্ষিণের ৯টি ওয়ার্ডের উন্নয়ন বঞ্চনা নিয়ে নির্বাচনের আগে অস্বস্তিতে ছিলেন। দ্বিতীয়বার দায়িত্ব পেয়ে কি করবেন জানতে চাইলে সাক্কু বলেন, আসলে মানুষ বুঝতে চেষ্টা করে না। জাইকা, বিশ্বব্যাংকসহ যারা টাকা দেয় তাদের কিছু নির্দেশনা আছে। তারা বলে, যেখানে লোকসংখ্যা বেশি সেখানেই কাজ করতে হবে। টাকাটা তো আমার না। তাই তাদের নির্দেশনা ও পরামর্শ বিবেচনায় রেখেই কাজ করতে হয়। তারপরও বলবো, সদর দক্ষিণের ৯টি ওয়ার্ডে অনেক কাজ হয়েছে। জাইকার দ্বিতীয় প্রকল্পের আওতায় সেখানে বেশ কিছু উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের উদ্যোগ নেয়া হবে। এবার অবশ্যই সেই ৯টি ওয়ার্ডকে সমান গুরুত্ব দিয়ে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিয়ে উন্নয়নের উদ্যোগ নেবো।
কুসিকের রাজনৈতিক সম্প্রীতি নিয়ে তিনি বলেন, কুমিল্লার রাজনীতি ও সামাজিক পরিবেশে একটি সম্প্রীতির ভাব থাকুক এটা আমি সবসময় চাই। রাজনীতি সারা পৃথিবীতে আছে, থাকবে। কুমিল্লা কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। রাজনীতি না থাকলে আবার সবই স্বৈরাচার হয়ে যায়। যে যার রাজনীতি করবে, হিন্দু-মুসলমান সবাই যার যার ধর্ম পালন করবে কিন্তু সবার মধ্যে মিলেমিশে থাকার মনোভাবটা থাকতে হবে। আমরা যদি হিংসাত্মক মনোভাবের দিকে যাই, তাহলে তো ছোট্ট এ শহরের পরিবেশ ঠিক রাখা কোনোভাবেই সম্ভব না। আমরা আশা করি, যে যেই দল করি না কেন, কারো মধ্যে যেন হিংসাত্মক মনোভাবটা না থাকে।
কুমিল্লাবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে নবনির্বাচিত মেয়র বলেন, রাস্তাঘাট, ড্রেনসহ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অবশ্যই সিটি করপোরেশন করবে। আমরা যে শপথ নিয়েছে আমাদের কাজ অবশ্যই আমরা করবো। কিন্তু রাস্তাঘাট রক্ষণাবেক্ষণ, ড্রেনেজ পরিষ্কার রাখাসহ নানা বিষয়ে নগরবাসীর ভূমিকা রয়েছে। এ নগর আমাদের সবার। আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করলেই এ নগরী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবে, সমস্যা কমে যাবে। উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। নগরবাসীর অনেকেই ড্রেনে ময়লা ফেলে ড্রেনেজ সিস্টেমে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। নগরবাসী অসচেতন হলে তো নগরের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন করা কঠিন। আমি নগরবাসীর আন্তরিক সহযোগিতা চাই।
নির্বাচিত হলেও প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে সাক্কু বলেন, এবার আওয়ামী লীগের লোকজনের আচরণে ভোটাররা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ায় প্রায় ৮০ হাজার ভোট কাস্ট হয়নি। আমি কারো বিরুদ্ধে বলবো না। সবকিছুই জনগণ দেখেছেন। তবে আমার যে জেনুইন ভোট, সে পরিমাণ ভোটও আমি পাইনি। এটা আসলে ভোট হয়নি। আওয়ামী লীগের লোকজন বিভিন্ন কেন্দ্রে রিগিং করে ভোটটা নিয়ে গেছে। সাধারণ ভোটার কম আসার কারণে আমার প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা কমে গেছে। সত্যিকার অর্থে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সুষ্ঠু ভোট হলে আমি সেভেনটি পারসেন্ট ভোট পেতাম।
নির্বাচনের পরিবেশ ও কমিশনের ভূমিকা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে মনিরুল হক সাক্কু বলেন, নির্বাচন কমিশন চেষ্টা করেছে। র্যাব-বিজিবি-পুলিশের তৎপরতায়ও কমতি ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগের লোকজনের ঝটিকা দুর্বৃত্তায়নের কারণে নানা জায়গায় গণ্ডগোল হয়েছে। বিশেষ করে দুপুর ১২টা থেকে তারা নানা কেন্দ্রে এ ঝটিকা দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে জাল ভোট দিয়েছে, ব্যালেট ছিনতাই করেছে, কেন্দ্র দখলের চেষ্টা করেছে। এতে জনগণ ভীতসন্ত্রস্ত হয়েছে। এ কারণে এবারের নির্বাচনে ভোট কাস্ট হয়েছে মাত্র ৬০ ভাগ। তবে নির্বাচন কমিশন যখনই অভিযোগ পেয়েছে অনেক জায়গায় ত্বরিত পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু একের পর এক কেন্দ্রে সরকারদলীয় লোকজন আচমকা গণ্ডগোল করলে তারা কয়টি রক্ষা করতে পারবে। নির্বাচনের আগের দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কুসিকে সন্দেহভাজন একটি জঙ্গি আস্তানা ঘিরে রাখার ঘটনা নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে কিনা জানতে চাইলে সাক্কু বলেন, এটি আসলে সরকারি ব্যাপার। এ ব্যাপারে কিছু বলা ঠিক হবে না। তবে এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন যে ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে জন্য আমি ধন্যবাদ জানাই। নির্বাচনের আগের দিন আস্তানাটির সন্ধান পাওয়া গেলেও নির্বাচনের দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অ্যাকশনে যায়নি। সেদিন অ্যাকশনে গেলে সেখানে গোলাগুলি হলে নিশ্চয় মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হতো, যা বিঘ্নিত করতো নির্বাচনী পরিবেশ।
No comments