জঙ্গিবাদের ডামাডোলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন উপেক্ষিত না হয়

অতিবর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢলে দেশে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। নদ-নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। লাখো মানুষ পানিবন্দি। দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। বন্যা উপদ্রুত এলাকার হাজার হাজার মানুষ এখন উদ্বাস্তুর মতো সড়কে ও বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বন্যার পানি বৃদ্ধির কারণে অনেক জায়গায় মেহনতি মানুষের কাজ নেই। ঘরে খাবার না থাকায় তাদের পরিবার-পরিজনসহ উপোস থাকতে হচ্ছে। অনেক জায়গায় নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বাঁধ। বিভিন্ন জায়গায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যা ও নদীভাঙনকবলিত মানুষের মাঝে চাল, শুকনো খাবার ও নগদ টাকা বিতরণ করা হয়েছে; কিন্তু চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল। তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদ-নদীর পানি অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। এতে ৭টি ইউনিয়নের ২২টি চর প্লাবিত হয়ে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ওইসব এলাকায় খাদ্য, ওষুধপত্র, বিশুদ্ধ পানিসহ গো-খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
বন্যাদুর্গতরা ত্রাণের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। দুর্গত এলাকার কৃষকের উৎপন্ন শাক-সবজি, অসংখ্য বীজতলা, উঠতি আখ ও পাট ফসল তলিয়ে গেছে। বস্তুত বন্যাদুর্গত মানুষের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বেড়েই চলেছে। অতীতে বন্যার সময় আমরা দুর্গত মানুষের দুঃখ ও ক্ষয়ক্ষতির সচিত্র খবর পত্রিকার পাতাজুড়ে দেখেছি। এখন তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। অধিকাংশ সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় বন্যার খবর নেই। জায়গা পেয়েছে শেষের পৃষ্ঠায়। যেন বন্যা বড় কোনো সমস্যা নয়! বন্যায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন কৃষক ও দরিদ্র মানুষ। সমাজের রথী-মহারথী ও বিত্তবানদের তেমন স্পর্শ করে না বন্যা। তাই কি বন্যাকে কম গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে? এ প্রশ্নের জবাবও আমাদের খুঁজতে হবে। তবে এ মুহূর্তে জরুরি করণীয় হল দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানো। বন্যাদুর্গতদের সাহায্যে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে অতীতের মতো। সরকারি ত্রাণ তৎপরতা বাড়াতে হবে, পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকেও। সন্ত্রাস প্রতিরোধে জাতীয় ঐক্য তো সৃষ্টি হল না, বরং আমরা লক্ষ্য করেছি ব্লেমগেম। বন্যাদুর্গতদের সাহায্যে এমন মন্দ সংস্কৃতি থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারি কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।
দেশে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার পর জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে সরকারসহ সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকায় বন্যাকবলিত মানুষের দিকে সেভাবে কেউ দৃষ্টি দিচ্ছে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়ে যে ফসল ও সম্পদসহ লাখ লাখ মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে, সেদিকে কারও খেয়াল নেই। এর ফলে বন্যার্তদের আরও বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর কারও হাত নেই এটা সত্য। তবে দুর্যোগকবলিত মানুষকে উদ্ধারে দ্রুত ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তুতি থাকাটা আবশ্যক। আজকাল বন্যাদুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে সরকারসহ বেসরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে গড়িমসি লক্ষ্য করা যায়। যতক্ষণ অবস্থা ভয়াবহ আকার ধারণ না করে, ততক্ষণ যেন তাদের টনক নড়ে না। ঢিমেতালে ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করায় তা দিয়ে বন্যার্তদের একবেলা খাবারের সংস্থান করা দুরূহ হয়ে পড়ে। এটা সবারই জানা, বন্যায় বিশেষ করে বন্যার পর খাদ্য, ওষুধ, বিশুদ্ধ পানির সংকট শুরুর পাশাপাশি বিভিন্ন রোগবালাই দেখা দেয়। এ সমস্যা চিরকালের। অথচ এ সমস্যা মোকাবেলায় সরকারের তরফ থেকে যে ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার, শুরুতে তা দেখা যায় না।
এমনকি বেসরকারি কোনো সংস্থাকেও এগিয়ে আসতে দেখা যায় না। বস্তুত বন্যাকবলিত মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে কোনো রকমে আশ্রয়ের সংস্থান করতে পারলেও জীবন বাঁচানোর যেসব মৌলিক উপকরণ রয়েছে, তা থেকে বঞ্চিত হয়। এ সময়েই জরুরি ভিত্তিতে তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। এবারের বন্যা স্বাভাবিক নয়। বন্যায় নিম্ন ও চরাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি ভয়াবহ নদীভাঙন দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে তিস্তা অববাহিকায় যেসব চরে মানুষের বসবাস রয়েছে, সেসব অঞ্চলে এ ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। এ ধরনের ভাঙন অন্য কোনো সময় দেখা যায় না। সাধারণত বন্যায় মানুষ স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়ার পর বন্যা শেষে নিজেদের বাড়িঘরে ফিরে যায়। এবার বন্যার পর দেখা যাবে ভাঙনের কারণে অনেকেরই বাড়িঘর ও ফসলি জমি নেই। ফলে এসব মানুষ সর্বহারা হয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। কর্মসংস্থানের অভাবে অমানবিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে। আশ্রয় ও সম্বলহারা এ ধরনের হাজার হাজার মানুষের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের আগাম চিন্তাভাবনা ও উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশে শুষ্ক মৌসুমে নদ-নদীতে তীব্র পানি সংকট ও বর্ষায় বন্যা দেখা দেয়ার মূল কারণ ভারতের বিদ্যমান পানিনীতি। শুষ্ক মৌসুমে বাঁধ ও গ্রোয়েন নির্মাণ করে ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেয়, আর বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেয়। এর ফলে বাংলাদেশে বন্যা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে আমাদের সরকারেরও ব্যর্থতা রয়েছে। আমরা ভারতের সব চাহিদা পূরণ করলেও বাংলাদেশের জীবনমরণ পানি সমস্যার সমাধান করেনি ভারত। এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো উদ্যোগও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কিছুদিন তিস্তা চুক্তি নিয়ে হবে-হচ্ছে বলে আওয়াজ তোলা হলেও শেষ পর্যন্ত সবই আষাঢ়ে তর্জন-গর্জনে পরিণত হয়। এই চুক্তি এখন পুরোপুরি ভারতের ওপর নির্ভর করছে। পানি সমস্যার সমাধান না হলে বর্ষায় বন্যা এবং শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে শুকিয়ে মরা বাংলাদেশের নিয়তি হয়েই থাকবে। পানি সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান হলে বাংলাদেশকে আর এ দুর্ভাগ্য বরণ করতে হবে না। বর্তমান সরকারের সঙ্গে যেহেতু ভারত সরকারের অত্যন্ত সুসম্পর্ক রয়েছে, তাই এ সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে পানি সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করা সম্ভব। পানি সমস্যার সমাধান করতে পারলে বাংলাদেশকে আর বছর বছর পানি সংকটে পড়তে হবে না, বন্যায়ও কষ্ট পেতে হবে না দেশের মানুষকে। কাজেই পানি সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান জরুরি।
এমএইচ খান মঞ্জু : প্রাবন্ধিক
samoynews24@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.