গরু মেরে জুতা দান by ফারুক মঈনউদ্দীন
সারা
বিশ্বের আর্থজগতে সাড়া জাগানো বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ
চুরির পর ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) পক্ষ
থেকে ক্ষমা চাওয়া হয়েছে অবশেষে। কী নিদারুণ পরিহাসের মতো শোনাচ্ছে, না!
ছোটবেলায় স্কুলের পাঠ্য ব্যাকরণের বাগ্ধারায় অনেকেরই পড়া আছে ‘গরু মেরে
জুতা দান’, যার অর্থ বড় ক্ষতি করে সামান্য ক্ষতিপূরণ। বাংলাদেশের
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুইফট সিস্টেমে ঢুকে সাড়ে ৮০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ
ডলার সরিয়ে ফেলার কর্মটি ধরতে পারার পর বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক
ফিলিপাইনের ব্যাংকটিকে জানিয়েছিল, যাতে টাকাগুলো সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ
দেওয়া না হয়, তারা সেই অনুরোধে সাড়া দেয়নি। বরং জানার পরও এই বিশাল
অঙ্কের অর্থ সরিয়ে নিতে সুযোগ করে দিয়েছিল আরসিবিসি। তবে মজার ব্যাপার,
পরবর্তী সময়ে ফিলিপাইনের ব্যাংকটি ক্ষমা প্রার্থনা করলেও এই অপরাধের কোনো
দায় স্বীকার করেনি। সর্বশেষ খবরে জানা যাচ্ছে, মূল সন্দেহভাজনদের একজন
ফিলিপাইনের ক্যাসিনো মালিক কিম ওয়ং, যাঁকে নাটের গুরু বলে ভাবা হচ্ছে,
ফিলিপাইনের সিনেটের কাছে শুনানিতে বলেছেন, তিনি তাঁর ক্যাসিনো অ্যাকাউন্ট
থেকে সরিয়ে ফেলা যায়নি এমন যে ৪৬ লাখ ডলার পড়ে আছে, সেটা তিনি বাংলাদেশকে
ফেরত দিতে চান। ইতিমধ্যে এই অর্থ নগদে তিনি ফিলিপাইনের মানি লন্ডারিং
প্রতিরোধ কাউন্সিলের কাছে ফেরতও দিয়েছেন। তাঁর কাছে নাকি তাঁর কোনো এক
ব্যবসায়ী সহযোগীর ঋণ শোধের আরও ৯৭ লাখ ডলার আছে, সেটাসহ মোট ১ কোটি ৪৩
লাখ ডলার তিনি বাংলাদেশকে ফেরত দিতে চান। কী মহান বাংলাদেশ-‘হিতৈষী’ এই
ওয়ং! তিনি কিন্তু হলফ করে বলেছেন যে এ ঘটনার সঙ্গে তিনি জড়িত নন। তিনি যদি
জড়িত না-ই হয়ে থাকেন, তাহলে এই বিশাল অঙ্কের অর্থ ফেরত দিতে চাইছেন কোন
মহানুভবতায়? সবশেষ খবরে জানা যাচ্ছে, ফিলিপাইনে পাচার হয়ে যাওয়া ৮ কোটি ১০
লাখ ডলারের মধ্যে ৩ কোটি ৪০ লাখ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। অন্যদিকে,
শ্রীলঙ্কায় পাঠানো দুই কোটি ডলার আটকানো গেছে, তবে সেটি কারও বদান্যতায়
নয়, কেবল ‘ফাউন্ডেশন’ শব্দটির ইংরেজি বানান ভুলের কারণে। অবশ্য সে দেশের
আদালত শালিকা ফাউন্ডেশন নামের এনজিওটির পরিচালকদের দেশত্যাগের ওপর
নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। কিন্তু কেবল টাকা ফেরত পাওয়াই যথেষ্ট নয়, এমনকি
হোতাদের বিচার হোক, জেল-জরিমানা হোক, তাতে আমাদের তেমন কিছু আসে-যায় না।
তার চেয়ে বেশি দরকার কী প্রক্রিয়ায় এ রকম দুর্ধর্ষ চুরি ঘটতে পারে, সেটা
বিশ্লেষণ করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া, যাতে ভবিষ্যতে এ রকম ঘটনা আর ঘটতে না
পারে। ফিলিপাইনের মানি লন্ডারিং আইনের ভাষায় ‘মানি লন্ডারিং একটা অপরাধ,
যার মাধ্যমে বেআইনি কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রাপ্ত সম্পদ এমনভাবে লেনদেন হয়,
যাতে মনে হয়, এসব এসেছে কোনো বৈধ উৎস থেকে। এসব সংঘটিত হয় নিম্নোক্ত
উপায়ে: কোনো ব্যক্তি জ্ঞাতসারে যদি কোনো বেআইনি উৎস থেকে প্রাপ্ত কিংবা
বেআইনি উৎসের সঙ্গে সম্পর্কিত অর্থ কিংবা সম্পদ লেনদেন করেন কিংবা
লেনদেনের চেষ্টা করেন, কোনো ব্যক্তি যদি জ্ঞাতসারে কোনো বেআইনি
কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো অর্থ বা সম্পদ এই আইনের অধীনে
অ্যান্টিমানি লন্ডারিং কাউন্সিলের কাছে পেশ ও প্রকাশ করতে ব্যর্থ হন’
ইত্যাদি। সারা বিশ্বে অর্থ পাচার কিংবা অর্থ ধোলাইয়ের যে সংজ্ঞা, এমনকি
ব্যাংকগুলোর কেওয়াইসির (know your customer) যা অর্থ, তাতে ফিলিপাইনের
আরসিবিসির দায় কোনোভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ব্যাংকগুলোয় গ্রাহকের
অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য কেওয়াইসি নীতিমালা সারা বিশ্বেই প্রায় অভিন্ন। এই
নীতিমালায় কেবল অ্যাকাউন্ট খোলার সময় যে গ্রাহকের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ তথ্য
সংগ্রহ করতে হবে তা-ই নয়, অ্যাকাউন্টটি পরিচালনার সময়ও গ্রাহকের হিসাবে
লেনদেনের ওপর রাখতে হয় সদা সজাগ দৃষ্টি। কোনো ব্যাংক যদি গ্রাহকের
পরিচিতি সম্পর্কে সন্তোষজনক তথ্য সংগ্রহ করতে না পারে, সে ক্ষেত্রে ব্যাংক
সেই অ্যাকাউন্ট খোলা থেকে বিরত থাকবে। অ্যাকাউন্ট খোলার সময় ব্যাংকের
কাছে প্রমাণ সাপেক্ষে গ্রাহকের পেশা বা আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ লেনদেনের
সম্ভাব্য পরিমাণের ঘোষণা থাকতে হবে এবং অ্যাকাউন্টে লেনদেন সেই ঘোষিত
পরিমাণের সীমা লঙ্ঘন করছে কি না, সেটিও পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখতে হবে।
কোনো অ্যাকাউন্ট খোলার পর সামান্য কিছু লেনদেন হওয়ার পর আচমকা সেই
অ্যাকাউন্টে হঠাৎ অস্বাভাবিক বড় অঙ্কের টাকা জমা হলে সেটি তাৎক্ষণিকভাবে
যাচাই করতে হবে। জমাকৃত অর্থের উৎস সম্পর্কে কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ
পাওয়া না গেলে সেটিকে সন্দেহজনক লেনদেন হিসেবে শনাক্ত করে কেন্দ্রীয়
ব্যাংকের কাছে রিপোর্ট (সাসপিসিয়াস ট্রানজেকশন রিপোর্টিং—এসটিআর) পাঠাতে
হবে। এ সবই হচ্ছে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধের খুব সাধারণ নীতিমালা। আমরা
জানি আরসিবিসির যে অ্যাকাউন্টগুলোর মাধ্যমে চুরি করা অর্থ বের করে নিয়ে
যাওয়া হয়েছে, সেই অ্যাকাউন্টগুলো খোলা হয়েছিল ৫০০ ডলার প্রাথমিক জমা
দিয়ে। তারপর থেকে এসব অ্যাকাউন্টে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চুরি করা কয়েক
কোটি ডলার করে জমার আগ পর্যন্ত আর কোনো ধরনের লেনদেন হয়নি, কিন্তু তবু
ব্যাংক থেকে পাঠানো হয়নি এসটিআর। এই তথ্য থেকে দুটি বিষয় স্পষ্ট: এক,
অ্যাকাউন্টগুলো খোলার সময় কেওয়াইসির কোনো নীতিমালা মানা হয়নি। দুই,
অ্যাকাউন্ট খোলার সময় যে সম্ভাব্য ট্রানজেকশন প্রোফাইল (টিপি) রাখতে হয়
পরবর্তী নজরদারির জন্য, তার কোনো বালাইই ছিল না। ফিলিপাইনের মানি
লন্ডারিং আইনে যা-ই লেখা থাকুক না কেন, বাস্তবে সেই আইন যে কত দুর্বল, সেটা
এ দুটি বিষয় থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়। ফিলিপাইন স্টার পত্রিকার এক
প্রতিবেদনে (২০ মার্চ) বলা হয়েছে, ফিলিপাইনের কঠোর ‘ব্যাংক সিক্রেসি আইন’
দেশটির দুনীতি, কর ফাঁকি ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধব্যবস্থার নাজুক অবস্থার
জন্য দায়ী, কারণ এ আইনের কারণে এখানে এ-বিষয়ক তদন্ত অত্যন্ত কঠিন। প্রেসিডেন্ট
মার্কোসের আমলে করা এ আইন দেশটিকে আর্থ-ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে
পরিচিত করার জন্য বলা হলেও বাস্তবে তা ঘটেনি, বরং এ আইনের সম্ভাব্য কারণ
ছিল মার্কোস ও তাঁর দোসরদের অবৈধ অর্থ ধোলাই করে বিদেশে পাচার করার
সুযোগ তৈরি করা। পত্রিকাটি সে দেশের কর কমিশনারের ভাষ্যে জানায়, পৃথিবীর
মাত্র তিনটি দেশে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বিভাগকে কর ফাঁকির অভিযোগসংবলিত
ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে তদন্ত চালানোর সুযোগ দেওয়া হয় না,
দেশগুলো হচ্ছে সুইজারল্যান্ড, লেবানন ও ফিলিপাইন। উপরন্তু, ফিলিপাইনে
ক্যাসিনো, ভূসম্পত্তি ও জুয়েলারি-সম্পর্কিত আর্থিক লেনদেন সে দেশের মানি
লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের আওতাভুক্ত নয়। ফিলিপাইনের মানি লন্ডারিং আইনে
যা-ই থাক না কেন, অ্যাকাউন্টগুলোয় জমা হওয়া ডলার আটকানোর জন্য বাংলাদেশের
অনুরোধও আরসিবিসি রক্ষা করেনি, যা দেশটির আইন ও ব্যাংকগুলোর ভঙ্গুর
নীতিমালারই পরিচায়ক। আরসিবিসি যেখানে কেবল ক্ষমা প্রার্থনা করে খালাস,
সেখানে ফেডারেল রিজার্ভ কিংবা সুইফট—কেউই ঘটনার দায় স্বীকার করেনি।
অন্যদিকে, তদন্তকারীরা বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফ থেকে কারও সম্পৃক্ততার প্রমাণ
পায়নি এখনো। সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে রয়টারের ধারণা, যদি
ভেতরের কেউ জড়িত না-ই থাকে, তাহলে ধরে নিতে হবে, হ্যাকার তথা চোরেরা
ব্যাংকিং খাতের খুব ঘনিষ্ঠ কারও সহায়তা নিয়েছে। হয়তো তারা ওয়্যার
ট্রান্সফার-প্রক্রিয়া ও অন্যান্য কর্মপদ্ধতির খুঁটিনাটি জানার জন্য
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করছিল। এ
প্রসঙ্গে দ্য এশিয়ান ব্যাংকার তাদের এক প্রকাশনায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন
রেখেছে, ‘হ্যাকাররা কীভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো একটা প্রতিষ্ঠানের
প্রামাণিক দলিলপত্র পেল এবং আমেরিকার বৃহত্তম ব্যাংকগুলো ও সুইফটের
পূর্ণাঙ্গ স্টিয়ারিং সিস্টেমের ভেতর দিয়ে গিয়ে ১০ কোটি ডলার ভিনদেশে
পাঠিয়ে দিতে সফল হলো? ম্যালওয়্যারকে মূল অপরাধী বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে,
কিন্তু কিছু জায়গায় সাধারণ বুদ্ধি হয়তো এই চুরি ঠেকাতে পারত।’ এটা যে কেবল
এশিয়ান ব্যাংকারের প্রশ্ন তা নয়, এটি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষেরও প্রশ্ন।
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি রিজার্ভ রয়েছে চীনের (৩ হাজার ৮৮৮ বিলিয়ন ডলার), তারপর
জাপানের (১ হাজার ২৬১ বিলিয়ন ডলার), এরপর সৌদি আরব, সুইজারল্যান্ড,
তাইওয়ান, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রাজিল, হংকং এবং দশম স্থান ভারতের (৩২০
বিলিয়ন ডলার)। সে তুলনায় বাংলাদেশের রিজার্ভ নগণ্যই বলা যায়, ২৭ বিলিয়ন
ডলার। অথচ সেই সামান্য সঞ্চয়ের ওপরই কেন চোখ পড়েছিল চোরদের? আমাদের
নিরাপত্তাব্যবস্থা নড়বড়ে বলে? আমরা কি নিরাপত্তা-সম্পর্কিত সুইফটের সব
নির্দেশনা মেনে চলছিলাম? আমাদের আন্তর্জাতিক লেনদেনের নিরাপত্তাব্যবস্থা
যদি সত্যিই বিশ্বমানের হয়, তাহলে পৃথিবীর আর কোনো দেশেরই তো তাদের
রিজার্ভ নিয়ে নিরাপদে ঘুমাতে পারার কথা নয়। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে তারা
নিরাপদেই ঘুমাচ্ছে। সুইফটের নিরাপত্তাব্যূহ ভেদ করা যদি এতই সহজ হতো অথবা
ফেডারেল রিজার্ভের সিন্দুকে সিঁধ কাটা যদি সম্ভব হতো, তাহলে এত বছরের
ইতিহাসে এ ধরনের চুরি একবারও ঘটল না কেন? চাইলেই কি এ রকম ডিজিটাল চুরি করে
ফেলা যায়? বোঝাই যাচ্ছে, দীর্ঘদিনের গবেষণা, গোয়েন্দাগিরি ও সুযোগ
সন্ধানের পর এবং ফিলিপাইনের মতো কালো টাকার একটা স্বর্গরাজ্যের সহায়তা
নিয়ে ঘটনাটা ঘটানো হয়েছে। ফলে একটা শুষ্ক ক্ষমা প্রার্থনাকে গরু মেরে জুতা
দান ছাড়া আর কীই-বা বলা যায়?
No comments