নায়কের পতন
গত
অর্ধশতকে বিশ্বের যে কয়েকজন রাজনীতিক আমাদের কল্পনায় নায়কের স্থান করে
নিয়েছেন, তাঁদের একজন ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও দা সিলভা।
সবার কাছে তিনি পরিচিত লুলা নামে। একসময় জুতা পালিশ করতেন, রাস্তায় ফেরি
করে বেড়াতেন, মেকানিকের কাজ করেছেন। শ্রমিকনেতা হিসেবে আন্দোলন করে একসময়ের
নিঃস্ব লুলা লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে বড় দেশটির প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। পরপর
দুবার। একসময় সবাই ব্রাজিলকে নিয়ে হাসাহাসি করত। বলত, দেশটি শুধু সম্ভাবনার
দেশ রয়ে গেল, কিন্তু সেই সম্ভাবনা কখনো বাস্তব হলো না। সেই ব্রাজিলকে তিনি
দারিদ্র্য থেকে উদ্ধার করে অভাবিত সমৃদ্ধির পথে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন।
২০১০ সালে ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার সময় লুলার জনসমর্থন ছিল ৮৩ শতাংশ। অনেকেই
সে সময় বলেছিলেন, লুলা হচ্ছেন বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিক।
প্রেসিডেন্ট ওবামা লুলার পিঠে হাত রেখে সবাইকে দেখিয়ে বলেছিলেন, দিস ইজ দ্য
ম্যান—এই হচ্ছে সেই লোক, যাঁকে দেখে আমাদের শিখতে হবে। সেই লুলা এখন
দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত। তিনি আদালত ও পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য
দেশের নতুন প্রেসিডেন্টের ক্যাবিনেটে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন, কিন্তু
তা করেও রক্ষা পাননি। তাঁর মামলা এখন দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত
পৌঁছেছে। আদালতই ঠিক করবেন মন্ত্রী হিসেবে লুলার শপথ আইনের চোখে সিদ্ধ কি
না। যদি না হয়, অভিযোগ প্রমাণিত হলে লুলাকে হয়তো কারাগারে যেতে হবে।
জনপ্রিয় রাষ্ট্রপ্রধান থাকার সময় থেকেই দুর্নীতির মামলা লুলাকে তাড়া করে
ফিরছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল কোম্পানি পেট্রোবাসে বিলিয়ন ডলারের
দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে সেই মামলা এখন লুলার উত্তরাধিকারী প্রেসিডেন্ট
দিলমা রুসেফকে প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে। দেশজুড়ে প্রবল বিক্ষোভ উঠেছে তাঁর
পদত্যাগ দাবি করে। দেশের আইন পরিষদে তাঁর অভিশংসনের প্রস্তাব নিয়ে বিতর্ক
চলছে। বলাই বাহুল্য, রুসেফের চাকরি নাকচ হলে লুলা তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য
হয়েও নিজেকে বাঁচাতে পারবেন না। অভিযোগ উঠেছে, প্রেসিডেন্ট থাকাকালে লুলা
তাঁর ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছেন। হাতেনাতে যে
ঘটনাটি ধরা পড়েছে তা হলো, লুলা তাঁর গ্রামের বাড়ি ও গুয়ারুজাতে সমুদ্রতটে
একটি অবকাশনিবাস নির্মাণের কাজে অবৈধ সুবিধা নিয়েছেন। সরকারি কাজ পাইয়ে
দেওয়ার বদলে একটি ঠিকাদারি কোম্পানিকে দিয়ে তিনি নিখরচায় বাড়ি দুটি সংস্কার
করিয়ে নিয়েছেন। খুব বড় ধরনের কোনো উৎকোচ নয়, তবু কাজটা অবৈধ। লুলা বারবার
বলে এসেছেন, অবকাশনিবাসটির মালিক তিনি নন, এক বন্ধুর সেই বাড়িতে মাঝেমধ্যে
তিনি গিয়েছেন। কিন্তু বিচার বিভাগ বলছে ভিন্ন কথা। এই সামান্য অপরাধ থেকে
বাঁচার জন্য লুলাকে কেন বাঁকা পথে এসে নতুন করে মন্ত্রীর পদ নিতে হলো, তা
স্পষ্ট নয়। মন্ত্রিত্বের ব্যাপারটি নিয়ে তিনি প্রেসিডেন্ট রুসেফের সঙ্গে
সলা-পরামর্শ করেছেন, তাঁদের আলাপ-আলোচনার গোপন রেকর্ড দুর্নীতি তদন্তে
দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারক নিজেই ফাঁস করে দিয়েছেন। লুলা অভিযোগ করেছেন,
প্রেসিডেন্ট রুসেফের বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই তাঁকে মামলায়
জড়ানো হয়েছে। তাঁর কথায়, এটা একধরনের ‘অভ্যুত্থান’। আইন মোতাবেক নির্বাচিত
সরকারকে তাঁর মেয়াদ পূরণের আগেই ক্ষমতা থেকে সরানো সম্পূর্ণ অবৈধ, তিনি
দাবি করেছেন। রুসেফ সরকারের বিরুদ্ধে ব্রাজিলজুড়ে এক বছর ধরে প্রবল আন্দোলন
জমাট বেঁধেছে। সন্দেহ নেই, ক্ষমতাসীন ওয়ার্কার্স পার্টির প্রতিপক্ষ সব
রাজনৈতিক দল সেই বিক্ষোভ থেকে ফায়দা নিতে চাইবে, কিন্তু এর পেছনে যে একটি
নাগরিক অসন্তোষ কাজ করছে, তাকেও অস্বীকার করা যায় না। ২০১০ সালে লুলার
প্রস্থানের পর ব্রাজিলের অর্থনীতি ক্রমশ নিম্নমুখী। তেলের দাম কমে যাওয়ায়
দেশের আয় কমেছে। মুখ্যত, চীনের কাঁধে বন্দুক রেখে সামনে এগোতে চেয়েছিল
ব্রাজিল, সেই চীন নিজেই এখন চোরাবালিতে গোত্তা খাচ্ছে। অর্থনৈতিক মন্দার
মুখে বেসামাল রুসেফ সরকারের কী করা উচিত, তা ঠাওর করে উঠতে পারছে না। এর
সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিলিয়ন ডলার বেহাত হওয়ার ঘটনা। সরকারের ভেতরে ও বাইরে
অনেক রাঘববোয়াল সেই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত
ব্রাজিলের সাধারণ নাগরিক, যারা একদিন দল বেঁধে লুলা ও তাঁর দলের পক্ষে
ঝান্ডা উঁচিয়েছিল, এখন তারাই রুসেফের পদত্যাগ দাবি করছে। লুলা দুর্নীতি ও
অর্থনৈতিক অব্যবস্থার বিষয়টি পুরো চেপে গেছেন। সম্প্রতি বিদেশি সাংবাদিক
ডেকে তিনি প্রায় দুই ঘণ্টা এক বক্তব্য দেন। মুখে প্রায় ফেনা তুলে তিনি
বারবার বললেন, তিনি ও রুসেফ এক বড় ধরনের ষড়যন্ত্রের শিকার। যিনি একসময়
একালের একজন নায়ক হিসেবে সম্মানিত হয়েছেন, সেই তিনি দেশের মানুষের
বিক্ষোভকে দক্ষিণপন্থী অভ্যুত্থানের চেষ্টা বলে বর্ণনা করলেন। বোঝা কঠিন
নয়, ডুবন্ত মানুষের মতো খড়কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টা করছেন লুলা। সাম্প্রতিক
সময়ে লুলাই একমাত্র জনপ্রিয় ও সফল নেতা নন, যাঁকে দুর্নীতির অভিযোগে
অভিযুক্ত করা হয়েছে। জিম্বাবুয়ের মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রনায়ক রবার্ট মুগাবে,
নিকারাগুয়ার একসময়ের বামপন্থী গেরিলা নেতা, এখন প্রেসিডেন্ট দানিয়েল
ওরতেগা, রাশিয়ার বিপুল জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন—এঁরা সবাই এখন
আকাশছোঁয়া দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত। এমনকি ফিদেল কাস্ত্রো, যাঁকে এত দিন
সব ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাচারের ঊর্ধ্বে রাখার চেষ্টা হয়েছে, এখন দেখা যাচ্ছে
তাঁরও সম্পদের লোভ রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে আটলান্টিকের পারে কাইয়ো পিয়েদ্রোতে
তাঁর নিজের ব্যবহারের জন্য রয়েছে একটি ব্যক্তিগত দ্বীপ। তিনি ও তাঁর
নিকটজনদেরই সেই দ্বীপ ভ্রমণের সুযোগ রয়েছে। যাঁর সব আছে, বিশেষত দেশের
মানুষের অগাধ ভালোবাসা, তাঁকে কেন ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিগতভাবে
দেশের সম্পদ হাতাতে হবে? বিজ্ঞজনেরা এই প্রশ্নের ব্যাখ্যা নানাভাবে করেছেন।
ক্ষমতার একধরনের নিজস্ব মাদকতা আছে, যা ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে বন্দী করে
ফেলে। ক্ষমতা অবশ্যই ভালো কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করে। ভালো কাজ করার
অজুহাতে ক্ষমতাধর মানুষ ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত স্বার্থের তফাতটাও বোঝার
ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। ক্ষমতার দাপট যত বাড়ে, ক্ষমতার অপব্যবহারের পরিমাণও
তত বাড়ে। বস্তুত, ক্ষমতার অপব্যবহার ক্রমেই অভ্যাসে পরিণত হয়, কোনো আইন বা
নৈতিকতার প্রতিবন্ধকতা বিবেচনায় নেওয়ার প্রয়োজন দেখে না ক্ষমতাধর নেতা।
জায়ারের (সাবেক কঙ্গো) রাষ্ট্রপ্রধান মবুতু নিজ গ্রামের বাড়িতে ব্যক্তিগত
বিমান অবতরণের ক্ষেত্র বানিয়েছিলেন। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, শুধু নিজের
জন্য নয়, গ্রামের মানুষের যাতে উপকার হয়, সে জন্য এই আয়োজন। ফিলিপাইনের
ফার্স্ট লেডি ইমেলদা মার্কোস তাঁর তিন হাজার জোড়া জুতার জন্য বিখ্যাত।
বিদেশে যেখানেই গেছেন, লাখ লাখ টাকার কেনাকাটা করেছেন। ইমেলদার যুক্তি ছিল,
তাঁর মতো মানুষকে দেখে অন্যরা স্বপ্ন দেখার সুযোগ পায়। ফলে তাঁকে তো
সুন্দর থাকতেই হবে। ‘দামি পোশাক পরা দরকার, কারণ আমার তো একটা “ক্লাস” আছে।
জনতা “ক্লাস”কে অনুসরণ করে, “ক্লাস” কখনো জনতার অনুসারী হয় না।’ এটা
ইমেলদার নিজের কথা। সরকারি কোষাগারকে ব্যক্তিগত মানিব্যাগ হিসেবে ব্যবহারে
অবশ্য ইমেলদাকেও ছাড়িয়ে গেছেন জিম্বাবুয়ের ফার্স্ট লেডি গ্রেস মুগাবে। ২০০২
সালে প্যারিসে এক দিনের কেনাকাটায় তিনি ১ লাখ ২০ হাজার ডলার খরচ করেছিলেন।
ক্ষমতাধরের ছায়ায় থেকে লাভবান হয়েছেন, এমন লোকেরা তাঁর পক্ষে সাফাই গাইতে
সর্বদাই প্রস্তুত। নিজের জন্য নয়, দেশের মানুষের কল্যাণেই তিনি ক্ষমতার
(অপ)ব্যবহার করেছেন, এই যুক্তি তো হরহামেশাই শোনা যায়। অথবা তিনি নন, তাঁর
কাছের লোকেরা নেতার দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে, এ কথাও আমরা শুনেছি। (উদাহরণ
হিসেবে বাংলাদেশের এক জেনারেল রাষ্ট্রপতির কথা ভাবুন)। ক্ষমতাধর মাত্রই
সর্বদা একদল স্তাবক নিয়ে ঘোরেন, তাঁদের কেউ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, কেউ চাটুকার।
তিনি ক্ষমতাধর, সে কথা বুঝবেন কীভাবে, যদি চাটুকারদের সন্তুষ্ট করতে না
পারেন? (বঙ্গবন্ধু কি এদেরই ‘চাটার দল’ বলে গাল দিয়েছিলেন?) তুষ্ট স্তাবকের
চোখে নিজের স্তুতি দেখে ক্ষমতাধর শুধু তৃপ্তিই পান না, তিনি ক্রমেই নিজেকে
দেবতাসমতুল্য ভাবা শুরু করেন। ইংরেজিতে একেই বলা হয় ‘রিফ্লেকটেড গ্লোরি’।
ইতিহাসে ক্ষমতাধরের হাতে ক্ষমতার এই অপব্যবহার আমরা বারবার দেখেছি।
দেশপ্রেমিক ভেবে যাকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছি, চোখ খুলে দেখি, এ তো আস্ত চোর। এই
দুর্ভোগ থেকে মুক্তি কোথায়? রাজা চন্দ্রগুপ্তের প্রধান উপদেষ্টা কৌটিল্য
রাজাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, রাজকোষ থেকে ধন যাতে খোয়া না যায়, সে জন্য দরকার
জোরদার পাহারার ব্যবস্থা করা। কিন্তু স্বয়ং রাজাই যখন চোর, তখন সেখানে
পাহারা বসাবে কে? আমাদের সৌভাগ্য, এখন আর রাজরাজড়া নেই, দেশটা আর কারও
ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। ফলে রাজা চান বা না চান, আমরা সবাই দেশের ধন, যা
আসলে আমাদের সবার সমষ্টিগত ধন, তা রক্ষার জন্য পাহারাদারের ভূমিকা নিতে
পারি। একজন মুগাবে বা একজন লুলা হয়তো ভাবতে পারেন, দেশের জন্য তাঁরা যা
করেছেন, এর পরিবর্তে দু-দশ কোটি টাকা পকেটস্থ করার পুরো অধিকার তাঁর রয়েছে।
এই উপরিটুকু তাঁর পাওনা। দেশের মানুষ জেগে উঠলে কোনো নায়ক বা বীরের পক্ষেই
আর সেই বাহানা দিয়ে পার পাওয়া সম্ভব নয়। ব্রাজিলে এখন ঠিক সে ঘটনাই ঘটছে।
লুলা তাঁর শাসনামলে যে সাফল্য অর্জন করেছেন, তা অস্বীকার করার প্রশ্ন ওঠে
না। কিন্তু সেই সাফল্য তাঁকে ব্যক্তিগত পতন থেকে রক্ষা করতে পারে না। আইনের
লম্বা হাত থেকে নিস্তারের জন্য ইঁদুরের গর্ত খোঁজার বদলে যদি নিজের
শুদ্ধতা প্রমাণে আদালতের মুখোমুখি হতেন, তাহলেই বোধ হয় লুলা অধিক সম্মানের
কাজ করতেন।
No comments