দায় এড়াতে পারেন না মহিউদ্দিন ও নাছির by বিশ্বজিৎ চৌধুরী
প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাসিম আহমেদ হত্যাকাণ্ডের পর নগরের প্রবর্তক মোড় এলাকায় গাড়ি ভাঙচুর করা হয় |
পরিবহন
ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মাঝেমধ্যে খুব সুন্দর কথা বলেন। যেমন
সম্প্রতি চট্টগ্রামে এক সভায় তিনি বলেছেন, এ দেশে পদ্মা সেতু তৈরি হচ্ছে,
কিন্তু রাজনীতিতে কোনো সেতু তৈরি হচ্ছে না।...আসলে আমাদের রাজনীতিটা ঠিক
হয়ে যেত, যদি এই বিভক্তিগুলো না থাকত। ‘বিভক্তি’ বলতে নিশ্চয় দলের
অভ্যন্তরীণ বিরোধের কথাই বলেছেন তিনি। কারণ, এমন একটি দিনে (৩০ মার্চ) তাঁর
এই অনুতপ্ত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, যার ঠিক এক দিন আগে প্রিমিয়ার
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কর্মী নাসিম আহমদ (সোহেল) খুন হয়েছেন তাঁর
সহপাঠী ও রাজনৈতিক সহকর্মীদের হাতে। কোনো রাখঢাক না রেখেই ওবায়দুল কাদের
বলেছেন, চট্টগ্রামের বর্তমান ও সাবেক মেয়রকে এর (সংঘর্ষ ও ছাত্র খুন) ‘দায়িত্ব’ নিতে হবে। ‘দায়িত্ব’ আদৌ তাঁরা কতটা নেবেন, নাকি পরস্পরকে
দোষারোপ করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করবেন, আমরা জানি না। শুধু
জানি, সোহেলের পিতার কান্না ও হাহাকারের যে ছবি আমরা পত্রিকার পাতায়
দেখেছি, সেই শোক ও বেদনার ভার তাঁকে বহন করতে হবে বাকিটা জীবন। সামান্য
বিরোধের জেরে শেষ হয়ে গেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক ছাত্রের জীবন। আন্দোলনে,
সংগ্রামে অংশ নিয়ে এ দেশে বহু ছাত্র জীবন দিয়েছেন। কিন্তু এই মৃত্যুতে সে
রকম কোনো মহৎ লক্ষ্য অর্জনের আকাঙ্ক্ষা ছিল না, কোনো স্বৈরশাসকের
অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নজিরও নয় এই মৃত্যু। একই
বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী, একই সংগঠনের সহকর্মীর হাতে এই মৃত্যুর তাহলে
সান্ত্বনা কী? সোহেলের মৃত্যুর পর বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা চট্টগ্রাম শহরজুড়ে
তাণ্ডব চালিয়েছেন। চার ঘণ্টা ধরে চলা এই তাণ্ডবে জনজীবনে নেমে আসে চরম
দুর্ভোগ। নিজেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজেরা ভাঙচুর করেছেন শিক্ষার্থীরা,
অসংখ্য যানবাহন ভাঙচুর করেছেন তাঁরা। ভয়ে-আতঙ্কে পাগলের মতো ছোটাছুটি করে
নিরাপদ আশ্রয় খুঁজেছে এ শহরের হাজার হাজার মানুষ। এই হঠকারিতার অর্থ কী?
কেন যানবাহন বা সাধারণ যাত্রী ও পথচারীরা এই অন্ধ আক্রোশের শিকার? এসব
প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কেউ নেই। না প্রশাসন, না ছাত্রলীগ বা তাদের অভিভাবক
সংগঠন আওয়ামী লীগ। ঘটনার পর নগর ছাত্রলীগের নেতারা বলেছেন, প্রিমিয়ার
বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁদের সংগঠনের কোনো শাখা নেই। সুতরাং এ ব্যাপারে তাঁদের
দায়ী করা চলবে না। কিন্তু অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না। ভুক্তভোগীরা তো
জানেন, কেন তাঁরা আক্রান্ত হলেন, কারা করেছে আক্রমণ। ওবায়দুল কাদের বলেছেন,
‘ছাত্রলীগ না করুক, ছাত্রলীগের নামে হচ্ছে। অনুপ্রবেশকারী বা যা-ই বলুন,
কিন্তু ছাত্রলীগের নামে এটা হচ্ছে। সেই বাস্তবতাকে আমরা অস্বীকার করতে পারব
না।’ ওবায়দুল কাদের নিজে একসময় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। প্রকৃত
‘বাস্তবতা’ তাঁর চেয়ে বেশি কে জানবে! জানা যায়, বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের
প্রস্তুতি নিয়ে এই বিরোধের সূত্রপাত। শিক্ষাজীবন শেষ করা বিদায়ী অগ্রজদের
সংবর্ধনা জানাতে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষার্থীরা। এই আয়োজন নিয়ে ফেসবুকে একটি পেজ খুলেছিলেন তাঁরা। সেখানে
নানাজনের মন্তব্যেও বিরোধের ব্যাপারটি আঁচ করা যাচ্ছিল। জানা যায়, এক পক্ষ
এই অনুষ্ঠানে সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন
চৌধুরীকে প্রধান অতিথি করতে চেয়েছিল, অন্য পক্ষ চেয়েছে বর্তমান মেয়র ও দলের
সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন হবেন প্রধান অতিথি। মেধাবী
শিক্ষার্থীদের বিবাদ-বিতর্কের এই ধরন দেখে সত্যি বিস্মিত হতে হয়। মহিউদ্দিন
চৌধুরী এই শহরে কত শতবার প্রধান অতিথি হয়ে মঞ্চ অলংকৃত করেছেন, হাতে গুনে
তার হিসাব করা যাবে না। কত বড় বড় জনসভায় তিনি বক্তব্য দিয়েছেন বা কতবার
তিনি সংবর্ধিত হয়েছেন, তার হিসাব রাখাও দুরূহ। আ জ ম নাছির উদ্দীনের
ক্ষেত্রেও একই কথা। সম্প্রতি মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর কয়েক মাস তিনি যত
সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান দ্বারা সংবর্ধিত হয়েছেন, সে রকম এ দেশে তো বটেই,
বিশ্বের কোনো নির্বাচিত মেয়রের ক্ষেত্রে ঘটেছে কি না আমাদের জানা নেই। তবু
কয়েক শ শিক্ষার্থীর একটি সমাবেশে তাঁদেরই একজনকে প্রধান অতিথি করা নিয়ে
সমর্থকদের এমন রক্তক্ষয়ী প্রতিযোগিতায় নামতে হলো! নগরের সবচেয়ে বড় বেসরকারি
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে ছাত্রলীগের দুই
পক্ষের মধ্যে যে বিরোধ চলছে এবং ক্রমেই তা উত্তপ্ত হচ্ছে, তা কি জানতেন না
মহিউদ্দিন চৌধুরী বা নাছির উদ্দীন? যদি না জেনে থাকেন তাহলে তাঁদের
সাংগঠনিক দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়। আর যদি জেনেও এই বিরোধ মীমাংসার কোনো
নির্দেশনা না দিয়ে থাকেন, তাহলে তাঁদের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। বিশেষত
বিরোধটি যখন তাঁদের ঘিরে। মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের
মধ্যে মাঠপর্যায়ে, বিশেষ করে ছাত্র-যুবক সমর্থকদের মধ্যে বিরোধ চলছে
দীর্ঘদিন ধরে। এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে এই বিরোধ সহিংস সংঘর্ষে রূপ
নিয়েছে। তাতে হতাহতও হয়েছেন অনেকে। সংঘর্ষে অংশগ্রহণকারীরা ক্ষমতাসীন দলের
নেতাদের সমর্থক বলে পুলিশি তৎপরতা খুব বেশি দূর এগোয় না। সাম্প্রতিককালে
রেলওয়ের টেন্ডার নিয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে সাইফুল ইসলাম ওরফে লিমনের
গ্রেপ্তারের ঘটনা ছাড়া আর তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারেনি পুলিশ।
সুতরাং আমরা ধরে নিতে পারি, এ দুই নেতার মধ্যে আলোচনা ও সমঝোতা ছাড়া এ
ধরনের সন্ত্রাস-সহিংসতার অবসান অসম্ভব। সোহেল খুন হওয়ার ঘটনার প্রতিক্রিয়া
জানিয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, ‘আমার শরীর ও মন দুটোই আজ রক্তাক্ত। নিহত
সোহেলের পিতা–মাতাই শুধু সন্তানহারা হননি, আমি নিজেও সন্তানহারা হয়েছি।’
প্রায় একই সুরে কথা বলেছেন আ জ ম নাছির উদ্দীন। তিনিও সোহেলকে মেধাবী ছাত্র
এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ বলে উল্লেখ করে তাঁর মৃত্যুতে গভীর মর্মাহত হওয়ার কথা
জানিয়েছেন। একদিকে মহিউদ্দিন চৌধুরী বলছেন, ‘কিছু হঠকারী ও ষড়যন্ত্রকারী
ব্যক্তির কারণে এই পবিত্র বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হতে পারে না।’ অন্যদিকে আ জ ম
নাছির উদ্দীন বলেছেন, ‘সোহেল হত্যার ইন্ধনদাতা ও তাদের প্রশ্রয়দাতাদের
বিচার হবে।’ এসব বক্তব্যে তাঁরা পক্ষান্তরে যে পরস্পরের দিকে আঙুল তুলেছেন,
তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সোহেল হত্যার তদন্তে নেমেছে পুলিশ।
ইতিমধ্যে সিসিটিভির ফুটেজ থেকে হত্যাকারীকে শনাক্ত করা গেছে বলে জানিয়েছে
তারা। আমরা চাই সোহেল হত্যার জন্য দায়ী ছাত্রদের অবিলম্বে বিচারের আওতায়
আনা হোক। তবে এসব ক্ষেত্রে প্রতিটি খুনের ঘটনা বন্ধু-সহকর্মীদের মধ্যে যে
ক্ষোভের জন্ম দেয়, তা নতুন সহিংস ঘটনার জন্ম দেয়। আগের বেশ কিছু অভিজ্ঞতা
তো আমাদের এ রকমই ভাবতে বলে। সে ক্ষেত্রে দ্রুত একটি সমঝোতার উদ্যোগ নিতে
হবে মহিউদ্দিন চৌধুরী ও নাছির উদ্দীনকে। কেননা, এই রক্তক্ষয়ী ঘটনার দায়
কিছুতেই এড়াতে পারেন না তাঁরা।
No comments