পুতুলনাচের রঙ্গশালার ভাবসম্প্রসারণ! by গোলাম মাওলা রনি
গোলাম মাওলা রনি |
সম্প্রতি
কে বা কারা যেন হঠাৎ করেই পুতুলনাচের রঙ্গশালা বা নাট্যশালা-জাতীয় একটি
শব্দমালা জাতির সামনে উপস্থাপন করলেন। তেমনি শুরু হয়ে গেল মহা তর্ক-বিতর্ক,
হুমকি-ধমকি এবং সমযোগ নাচন-কুর্দন। যাদেরকে বলা হলো তারা সরাসরি বললেন না
যে, আমরা পুতুল নই এবং আমরা পুতুলের মতো নাচি না। অথবা আমাদের স্থানটি
রঙ্গশালা বা নাট্যশালা নয়। আমরা মানুষ এবং এখানে বসে মানুষের মতো মানবিক
কর্ম করি। এসব না বলে তারা ভীষণ অভিমানী হয়ে পড়লেন- অনেকে ভীষণ ক্ষুব্ধ এবং
উত্তেজিত হয়ে নানা রকম হুমকি-ধমকি দেয়া শুরু করলেন। কেউ কেউ মারাত্মক
চরমপন্থা অবলম্বনের জন্য সুপারিশ পর্যন্ত করলেন। হতাশা ও নিরাশার সাগরে
হাবুডুবু খাওয়া লোকজন অল্প সময়ের জন্য হলেও উদ্ভূত তর্ক-বিতর্কের কারণে মজা
পেলেন। তারা বাংলা অভিধান বের করে পুতুলনাচ, রঙ্গশালা, নাট্যশালা ইত্যাদি
শব্দের অর্থ খুঁজতে আরম্ভ করলেন এবং মাধ্যমিক স্তরের স্কুলবালকের মতো
শব্দমালার ভাবসম্প্রসারণ করে শব্দসমষ্টির অন্তর্নিহিত আদিরসের সম্মান করতে
আরম্ভ করলেন।
আজকের নিবন্ধের শুরুতে আমরা প্রথমে শব্দগুলোর অর্থ, বৈশিষ্ট্য ও প্রকারভেদ সম্পর্কে আলোকপাত করব। এরপর শব্দগুলো দিয়ে যে বাক্য রচিত হয়েছে, সেই বাক্যের ভাবসম্প্রসারণ করে বুঝতে চেষ্টা করব, কেন একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান অন্য একটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে এমনতরো বাক্যের বাণ মারল! তারপর দৃশ্যায়ন করা বাক্যবাণের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কিছু ঘটনাবলি। প্রথমে পুতুল সম্পর্কে কিছু বলে নেই। অভিধানে পুতুল সম্পর্কে বলা হয়েছে- প্রাণহীন বস্তু, যা কিনা নির্মিত হয় অদ্ভুত অদ্ভুত আকৃতি, রঙ ও বৈশিষ্ট্য দিয়ে। সাধারণত ক্রীড়নকরূপে অর্থাৎ খেলাধুলার সামগ্রী হিসেবে পুতুল ব্যবহৃত হয়। প্রধানত শিশুতোষ ক্রীড়া কৌতুক এবং যুদ্ধবিগ্রহ, দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত, খেলাধুলা ইত্যাদির ঝুঁকিপূর্ণ স্থানের নিশানা হিসেবে পুতুলগুলোকে কাজে লাগানো হয়। তীর-ধনুক, তলোয়ার চালানো; মুষ্টিযুদ্ধ; বন্দুকের গুলিবর্ষণের নিশানা নিখুঁত করার ক্ষেত্রে পুতুলের ব্যবহার সেই অনাদিকাল থেকেই হয়ে আসছে।
বাংলা অভিধানে পুতুল-পুতুলি এবং প্রতিমা শব্দেরও রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ, পুতুল বলতে সাধারণত জীবজন্তু, জানোয়ার, রাক্ষস, খোক্ষস, পাখি, মাছ, সাপ, ব্যাঙ প্রভৃতির মূর্তিকে বুঝায়। অন্য দিকে সাধারণ মানুষ আকৃতির প্রতিমূর্তিকে বলে পুত্তলি। প্রতিমা বলতে সাধারণত সেই সব নারীমূর্তিকে বুঝায়, যাকে কেউ গভীরভাবে ভালোবাসত, শ্রদ্ধা করত এবং স্মরণ করত। আদিকালে মাটি, পাথর, চুন, কাঠ, বাঁশ, গোবর-কুড়া-কুটা প্রভৃতির মিশ্রণ দিয়ে পুতুল বানানো হতো এবং এখনো হচ্ছে। তবে ইদানীং প্লাস্টিকের পুতুলের যন্ত্রণাই বেশি। তিন ধরনের প্লাস্টিকের পুতুল আমাদের সমাজে দেখা যাচ্ছে ম্যানুয়াল, ব্যাটারিচালিত আধা যান্ত্রিক এবং বিদ্যুৎ চালিত সর্বাংশ যান্ত্রিক। আধা যান্ত্রিক কিংবা সর্বাংশ যান্ত্রিক পুতুলেরা মানুষের সেখানো বুলি আওড়ায়, টুকটাক লাফালাফি করে এবং বাচ্চাকাচ্চা, বুড়োবুড়ি ও পাগলা রোগে আক্রান্ত লোকদের ব্যাপক আনন্দ দেয়।
উপরোল্লিখিত শ্রেণীর পুতুল ছাড়াও আরো দুই শ্রেণীর পুতুল রয়েছে। একটিকে বলা হয় ভার্চুয়াল বা অ্যানিমেটেড পুতুল। সোজা বাংলায় এগুলোকে বলে কার্টুন। কার্টুন নিয়ে নাটক, সিনেমা, গল্প-উপন্যাস ইত্যাদি রচিত হচ্ছে। কার্টুন অভিনীত নাটক-সিনেমার খরচ যেমন বেশি, তেমনি এগুলোর দর্শক-স্রোতার সংখ্যা দিনকে দিন মারাত্মকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। ফলে কার্টুনের ব্যবসায়ীরা রাতারাতি আঙুল ফুলে তালগাছ বনে যাচ্ছেন। কার্টুন ছাড়া আরেক শ্রেণীর পুতুল ইদানীং মহামারী আকারে মানুষ্যসমাজকে আক্রান্ত করছে। এগুলোকে বলা হয় সেক্সডল। বিভিন্ন পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, বাংলাদেশের বাজারগুলোতে অত্যাধুনিক সেক্সডলের রমরমা ব্যবসা চলছে এবং একশ্রেণীর বিকৃত রুচির নারী-পুরুষ সেসব পুতুল কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। ফলে বিভিন্ন পতিতালয় এবং ভ্রাম্যমাণ পতিতারা খদ্দের সঙ্কটে পড়েছে। পতিতা ও পতিতালয় থেকে সমাজের প্রভাবশালী যে চক্রটি নিয়মিত চাঁদা আদায় করে, সাম্প্রতিক সময়ে সেই চাঁদার পরিমাণ কমে যাওয়ায় চক্রটি কারণ খুঁজতে গিয়ে সেক্সডল নামক পুতুলের কাহিনী বের করে ফেলে।
এবার আমরা নাচ সম্পর্কে দু-একটি কথা বলার চেষ্টা করব। প্রমিত বাংলায় নাচের অপর নাম নৃত্য। শব্দ, ছন্দ, সুর, তাল ও লয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে অঙ্গভঙ্গি করার নাম নৃত্য। শুধু মানুষই নৃত্য করে না- প্রকৃতির সব প্রাণী, বৃক্ষলতা, মেঘমালা, সমুদ্র, নদনদী ও আলোকবর্তিকাগুলো মনের আনন্দে কিংবা বিষাদে নৃত্য করে। নাচের অন্য অর্থও রয়েছে। হাস্যকর অঙ্গভঙ্গি, লাফালাফি, অস্থিরতা, দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত, যুদ্ধ ইত্যাদিকেও নাচ বলা হয়। নাচের ধরন দুই প্রকার। যথা- নিজের ইচ্ছায় নাচ এবং অন্যের ইচ্ছায় নাচ। নাচের ধরন দুই প্রকার- হর্ষনৃত্য ও বিষাদনৃত্য। নাচের উদ্দেশ্য কয়েক ধরনের। যথা- নিজেকে আনন্দ দেয়া, অপরকে তুষ্ট করা, পয়সা উপার্জন, লোকজনকে বিরক্ত করা, ক্ষেপিয়ে দেয়া, দর্শকদের প্রলুব্ধ করা ইত্যাদি। মানুষ এবং অন্যান্য ইতর প্রাণী নিজের ইচ্ছা কিংবা অন্যের হুকুমে নাচানাচি করে। প্রকৃতির অন্য সব উপাদান নাচে প্রকৃতির ইচ্ছা ও চিরায়ত নিয়মে।
নাচের উল্লিখিত প্রকারভেদের মধ্যে পুতুলনাচ পড়ে না। আধুনিক কালের কার্টুন কিংবা রোবটের নৃত্য সম্পর্কে লিখতে গেলে নিবন্ধের পরিধি ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হয়ে যাবে। তাই ওই দিকে না গিয়ে আমরা কেবল আবহমান বাংলার পুতুলনাচ নিয়ে আলোচনা করব। যেসব পুতুল দিয়ে নাচ দেখানো হয়, সেগুলো সাধারণত বিশেষভাবে তৈরি করা হয়। সবার আগে তৈরি করা হয় একটি গল্প বা কাহিনী। তারপর স্থিরনাট্যের জন্য তৈরি হয় সংলাপ। চিত্রনাট্যের বিভিন্ন চরিত্রের আদলে পুতুলগুলো বানানো হয়। সেই সব পুতুলের হাত, পা, মাথা, কোমর, বুক, গলা, চোখ প্রভৃতি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চিকন সুতায় বাঁধা হয়। তারপর সুতাগুলোর মাথা বা অপর প্রান্ত থাকে একজন নিয়ন্ত্রকের হাতে। পর্দার অন্তরাল থেকে একজন মানুষ বা মানুষের রেকর্ডকৃত কণ্ঠে বাজানো হয় চিত্রনাট্যের সংলাপ। অন্য দিকে পুতুলের হাত-পা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সুতার বন্ধন দিয়ে নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি পুতুলগুলোর সংলাপের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নাচাতে থাকেন।
পুতুলনাচ নিয়ে অনেক গল্প-উপন্যাস রচিত হয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুলনাচের ইতিকথা রীতিমতো ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। বাংলার পথেঘাটে, প্রান্তরে যেসব পুতুলনাচ প্রদর্শিত হয় সেগুলোর আকার-আকৃতি, পোশাক এবং নাচের ধরন ও সংলাপ দর্শকদের খুবই আনন্দ দেয় বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের। যিনি বা যারা পুতুলগুলোকে নাচান, তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা উল্লেখ করার মতো। তারা একটি পুতুলের শরীরের যেকোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দোলাতে পারেন। অন্য দিকে, পুতুলনাচের মাধ্যমে পুতুলের মুখ দিয়ে এমন সব সংলাপ বের করে আনা হয়, যা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই আমাদের সমাজের ব্যক্তিত্বহীন, রুচিহীন, মেরুদণ্ডহীন দাসদাসীরা যখন তাদের নিয়োগকর্তার কথামতো অন্ধের মতো বিবেকহীন কর্মকাণ্ড করে এবং নিয়োগকর্তার শিখিয়ে দেয়া বুলি আওড়াতে থাকে, তখন লোকজন তাদের পুতুল এবং তাদের কর্মকাণ্ডকে পুতুলনাচ বলে আখ্যা দেয়।
রঙ্গশালা বলতে এমন একটি ঘর বা স্থানকে বোঝায়, যেখানে বসে মানুষ রঙ-তামাশা করে। রঙ্গশালায় নাটক হয়, বাঈজীরা নাচে এবং কেউ বা গান করে। অনেকে তাস-পাশা খেলে। কেউ কেউ মদ-গাঁজা ইত্যাদি সেবন করে। তিন ধরনের রঙ্গশালায় রঙ্গিলা নাগরদের বাহারি কর্মকাণ্ড নিয়ে কত যে রঙ-তামাশার গল্প প্রচলিত রয়েছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। এমনটিকে বলা হয় গণরঙ্গশালা। গণরঙ্গশালা আবার তিন ধরনের, যথা- নিষিদ্ধ, অসিদ্ধ ও সাধারণ। নিষিদ্ধ রঙ্গশালাগুলো সাধারণত নিষিদ্ধ পল্লীতে হয়ে থাকে। সমাজের নীচু জাতের বিকৃত মানসিকতার রঙ্গপ্রিয় দুরাচাররা এসব রঙ্গশালার খদ্দের। এখানে হয় না এমন কুকর্ম নেই। অন্য দিকে, অসিদ্ধ রঙ্গশালাগুলো বিভিন্ন নামধাম ধারণ করে লোকালয়ে অবস্থান করে অতি গোপনে। এসব করে খদ্দের ও রঙ্গ-তামাশার উপকরণ বিশেষায়িত হওয়ার কারণে এগুলো নিষিদ্ধ পল্লীর রঙ্গশালা থেকে কিছুটা হলেও ভিন্ন। সাধারণ রঙ্গশালায় যৌনাচার ছাড়া সব কিছুই প্রকাশ্যে হয়ে থাকে। এগুলো আইনত সিদ্ধ। আধুনিক কালের ক্লাব সংস্কৃতি, ডিসকো, ক্যাবারে, হাউজি, বার, ক্লাব ইত্যাদিকে সাধারণ রঙ্গশালা বলা যেতে পারে।
গণরঙ্গশালার বাইরে আরেক ধরনের ব্যক্তিগত রঙ্গশালার গল্প কম-বেশি সবাই জানেন। আগেকার দিনের রাজা-বাদশাদের বাঈজী মহল, জমিদারদের বাগানবাড়ি এবং হাল আমলের ধনীদের মিসট্রেস হাউজকে ব্যক্তিগত রঙ্গশালা বলা হয়ে থাকে। ব্যক্তিগত রঙ্গশালা একজন ব্যক্তি কিংবা তার পরিবার-পরিজনের জন্য পতন, অসম্মান ও সীমাহীন দুর্ভোগ-রোগ-জরা-দারিদ্র্যের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্য দিকে গণরঙ্গশালার আধিক্যের কারণে সমাজ সংসার ও রাষ্ট্রে পচন ধরে। এগুলোর দুর্গন্ধ পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রকে অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরে। কত বড় বড় রাজবংশ, জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি এবং ক্ষমতাধররা রঙ্গশালার কবলে পড়ে কিভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছেন- তা আমরা কম-বেশি সবাই জানি।
এবার শিরোনাম প্রসঙ্গে আসা যাক। পুতুলনাচের রঙ্গশালা বলতে এমন একটি স্থানকে বুঝায়, যেখানে পুতুলেরা রঙ-তামাশা করে। এটি পুতুলনাচের চিরায়ত মঞ্চ নয়। এটি পুতুলনাচের রঙ্গমঞ্চ। এখানকার নির্জীব পুতুলেরা শুধু রঙ-তামাশা করার জন্য জীবনীশক্তিপ্রাপ্ত হয়। রঙ্গমঞ্চের পুতুলেরা যাত্রামঞ্চের পুতুলের মতো দর্শক-শ্রোতাকে বিনোদন দেয় না, বরং নিজেরা বিনোদিত হয়। পুতুলের আকার-আয়তন, গঠনপ্রণালী ইত্যাদির সাথে তার মালিকের ইচ্ছাশক্তির ওপর রঙ-তামাশার ধরন ও প্রকৃতি নির্ভর করে। পুতুলনাচের রঙ্গশালা আধুনিক চিন্তা-চেতনার নতুন এক ফিউশন। কারণ, ইতঃপূর্বে পুতুলেরা কেবল অন্যকে বিনোদন জোগাত। নিজেরা বিনোদন করার, নির্জীব থেকে জীব, নিষ্প্রণ থেকে প্রাণ লাভ এবং বাহারি রঙ-তামাশার মাধ্যমে আনন্দফুর্তি করার চিন্তা-চেতনা তাদের ডিকশনারিতে ছিল না। নতুন যুগে এসে এসব খেলনা পুতুলের যুগান্তকারী সফলতায় হয়তো তাদের মালিক যারপরনাই খুশি। তারা ঘাটে-মাঠে-বাটে নেচেগেয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষকে শুধু বিনোদিত করেনি- তামাম বিশ্বের পুতুলনাচের ইতিহাস পাল্টে দিয়েছে। ফলে তাদের মালিক তাদের একটি রঙ্গশালায় ঢুকিয়ে এজাজত দিয়েছেন- নাও বাপু! রঙ্গ করো- যা ইচ্ছে বলো- যা মনে চায় করো এবং যা ইচ্ছে খাও।
আমরা আজকের নিবন্ধের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। শিরোনামের শব্দমালার অর্থ এবং বাক্যটির সংক্ষিপ্ত ভাবসম্প্রসারণ করার পর সম্মানিত পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, পুতুলনাচের রঙ্গশালার তাৎপর্য কত বিস্তৃত ও গভীর। আপনারা এ কথাও বুঝতে পেরেছেন যে, কাদেরকে ওই নামে সম্বোধন করা হয়েছে এবং সেই সম্বোধনের মাধ্যমে উপাধিধারীদের কতটা বিশেষায়িত করা হয়েছে। অন্য দিকে, বিশেষায়িত পুতুল সম্প্রদায় বলে অভিযুক্ত লোকেরা কেন যে অস্থির প্রতিক্রিয়ায় নৃত্য করছে, তাও সম্ভবত বুঝতে পেরেছেন। আজকের এই নিবন্ধে আমি নিজের থেকে কাউকে কিছু বলিনি- কোনো মন্তব্য করিনি বা মতামত প্রদান করিনি। আমি শুধু বাংলা অভিধান মতে, একটি বাক্যের ভাবসম্প্রসারণ করেছি মাত্র।
আজকের নিবন্ধের শুরুতে আমরা প্রথমে শব্দগুলোর অর্থ, বৈশিষ্ট্য ও প্রকারভেদ সম্পর্কে আলোকপাত করব। এরপর শব্দগুলো দিয়ে যে বাক্য রচিত হয়েছে, সেই বাক্যের ভাবসম্প্রসারণ করে বুঝতে চেষ্টা করব, কেন একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান অন্য একটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে এমনতরো বাক্যের বাণ মারল! তারপর দৃশ্যায়ন করা বাক্যবাণের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কিছু ঘটনাবলি। প্রথমে পুতুল সম্পর্কে কিছু বলে নেই। অভিধানে পুতুল সম্পর্কে বলা হয়েছে- প্রাণহীন বস্তু, যা কিনা নির্মিত হয় অদ্ভুত অদ্ভুত আকৃতি, রঙ ও বৈশিষ্ট্য দিয়ে। সাধারণত ক্রীড়নকরূপে অর্থাৎ খেলাধুলার সামগ্রী হিসেবে পুতুল ব্যবহৃত হয়। প্রধানত শিশুতোষ ক্রীড়া কৌতুক এবং যুদ্ধবিগ্রহ, দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত, খেলাধুলা ইত্যাদির ঝুঁকিপূর্ণ স্থানের নিশানা হিসেবে পুতুলগুলোকে কাজে লাগানো হয়। তীর-ধনুক, তলোয়ার চালানো; মুষ্টিযুদ্ধ; বন্দুকের গুলিবর্ষণের নিশানা নিখুঁত করার ক্ষেত্রে পুতুলের ব্যবহার সেই অনাদিকাল থেকেই হয়ে আসছে।
বাংলা অভিধানে পুতুল-পুতুলি এবং প্রতিমা শব্দেরও রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ, পুতুল বলতে সাধারণত জীবজন্তু, জানোয়ার, রাক্ষস, খোক্ষস, পাখি, মাছ, সাপ, ব্যাঙ প্রভৃতির মূর্তিকে বুঝায়। অন্য দিকে সাধারণ মানুষ আকৃতির প্রতিমূর্তিকে বলে পুত্তলি। প্রতিমা বলতে সাধারণত সেই সব নারীমূর্তিকে বুঝায়, যাকে কেউ গভীরভাবে ভালোবাসত, শ্রদ্ধা করত এবং স্মরণ করত। আদিকালে মাটি, পাথর, চুন, কাঠ, বাঁশ, গোবর-কুড়া-কুটা প্রভৃতির মিশ্রণ দিয়ে পুতুল বানানো হতো এবং এখনো হচ্ছে। তবে ইদানীং প্লাস্টিকের পুতুলের যন্ত্রণাই বেশি। তিন ধরনের প্লাস্টিকের পুতুল আমাদের সমাজে দেখা যাচ্ছে ম্যানুয়াল, ব্যাটারিচালিত আধা যান্ত্রিক এবং বিদ্যুৎ চালিত সর্বাংশ যান্ত্রিক। আধা যান্ত্রিক কিংবা সর্বাংশ যান্ত্রিক পুতুলেরা মানুষের সেখানো বুলি আওড়ায়, টুকটাক লাফালাফি করে এবং বাচ্চাকাচ্চা, বুড়োবুড়ি ও পাগলা রোগে আক্রান্ত লোকদের ব্যাপক আনন্দ দেয়।
উপরোল্লিখিত শ্রেণীর পুতুল ছাড়াও আরো দুই শ্রেণীর পুতুল রয়েছে। একটিকে বলা হয় ভার্চুয়াল বা অ্যানিমেটেড পুতুল। সোজা বাংলায় এগুলোকে বলে কার্টুন। কার্টুন নিয়ে নাটক, সিনেমা, গল্প-উপন্যাস ইত্যাদি রচিত হচ্ছে। কার্টুন অভিনীত নাটক-সিনেমার খরচ যেমন বেশি, তেমনি এগুলোর দর্শক-স্রোতার সংখ্যা দিনকে দিন মারাত্মকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। ফলে কার্টুনের ব্যবসায়ীরা রাতারাতি আঙুল ফুলে তালগাছ বনে যাচ্ছেন। কার্টুন ছাড়া আরেক শ্রেণীর পুতুল ইদানীং মহামারী আকারে মানুষ্যসমাজকে আক্রান্ত করছে। এগুলোকে বলা হয় সেক্সডল। বিভিন্ন পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, বাংলাদেশের বাজারগুলোতে অত্যাধুনিক সেক্সডলের রমরমা ব্যবসা চলছে এবং একশ্রেণীর বিকৃত রুচির নারী-পুরুষ সেসব পুতুল কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। ফলে বিভিন্ন পতিতালয় এবং ভ্রাম্যমাণ পতিতারা খদ্দের সঙ্কটে পড়েছে। পতিতা ও পতিতালয় থেকে সমাজের প্রভাবশালী যে চক্রটি নিয়মিত চাঁদা আদায় করে, সাম্প্রতিক সময়ে সেই চাঁদার পরিমাণ কমে যাওয়ায় চক্রটি কারণ খুঁজতে গিয়ে সেক্সডল নামক পুতুলের কাহিনী বের করে ফেলে।
এবার আমরা নাচ সম্পর্কে দু-একটি কথা বলার চেষ্টা করব। প্রমিত বাংলায় নাচের অপর নাম নৃত্য। শব্দ, ছন্দ, সুর, তাল ও লয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে অঙ্গভঙ্গি করার নাম নৃত্য। শুধু মানুষই নৃত্য করে না- প্রকৃতির সব প্রাণী, বৃক্ষলতা, মেঘমালা, সমুদ্র, নদনদী ও আলোকবর্তিকাগুলো মনের আনন্দে কিংবা বিষাদে নৃত্য করে। নাচের অন্য অর্থও রয়েছে। হাস্যকর অঙ্গভঙ্গি, লাফালাফি, অস্থিরতা, দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত, যুদ্ধ ইত্যাদিকেও নাচ বলা হয়। নাচের ধরন দুই প্রকার। যথা- নিজের ইচ্ছায় নাচ এবং অন্যের ইচ্ছায় নাচ। নাচের ধরন দুই প্রকার- হর্ষনৃত্য ও বিষাদনৃত্য। নাচের উদ্দেশ্য কয়েক ধরনের। যথা- নিজেকে আনন্দ দেয়া, অপরকে তুষ্ট করা, পয়সা উপার্জন, লোকজনকে বিরক্ত করা, ক্ষেপিয়ে দেয়া, দর্শকদের প্রলুব্ধ করা ইত্যাদি। মানুষ এবং অন্যান্য ইতর প্রাণী নিজের ইচ্ছা কিংবা অন্যের হুকুমে নাচানাচি করে। প্রকৃতির অন্য সব উপাদান নাচে প্রকৃতির ইচ্ছা ও চিরায়ত নিয়মে।
নাচের উল্লিখিত প্রকারভেদের মধ্যে পুতুলনাচ পড়ে না। আধুনিক কালের কার্টুন কিংবা রোবটের নৃত্য সম্পর্কে লিখতে গেলে নিবন্ধের পরিধি ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হয়ে যাবে। তাই ওই দিকে না গিয়ে আমরা কেবল আবহমান বাংলার পুতুলনাচ নিয়ে আলোচনা করব। যেসব পুতুল দিয়ে নাচ দেখানো হয়, সেগুলো সাধারণত বিশেষভাবে তৈরি করা হয়। সবার আগে তৈরি করা হয় একটি গল্প বা কাহিনী। তারপর স্থিরনাট্যের জন্য তৈরি হয় সংলাপ। চিত্রনাট্যের বিভিন্ন চরিত্রের আদলে পুতুলগুলো বানানো হয়। সেই সব পুতুলের হাত, পা, মাথা, কোমর, বুক, গলা, চোখ প্রভৃতি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চিকন সুতায় বাঁধা হয়। তারপর সুতাগুলোর মাথা বা অপর প্রান্ত থাকে একজন নিয়ন্ত্রকের হাতে। পর্দার অন্তরাল থেকে একজন মানুষ বা মানুষের রেকর্ডকৃত কণ্ঠে বাজানো হয় চিত্রনাট্যের সংলাপ। অন্য দিকে পুতুলের হাত-পা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সুতার বন্ধন দিয়ে নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি পুতুলগুলোর সংলাপের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নাচাতে থাকেন।
পুতুলনাচ নিয়ে অনেক গল্প-উপন্যাস রচিত হয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুলনাচের ইতিকথা রীতিমতো ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। বাংলার পথেঘাটে, প্রান্তরে যেসব পুতুলনাচ প্রদর্শিত হয় সেগুলোর আকার-আকৃতি, পোশাক এবং নাচের ধরন ও সংলাপ দর্শকদের খুবই আনন্দ দেয় বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের। যিনি বা যারা পুতুলগুলোকে নাচান, তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা উল্লেখ করার মতো। তারা একটি পুতুলের শরীরের যেকোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দোলাতে পারেন। অন্য দিকে, পুতুলনাচের মাধ্যমে পুতুলের মুখ দিয়ে এমন সব সংলাপ বের করে আনা হয়, যা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই আমাদের সমাজের ব্যক্তিত্বহীন, রুচিহীন, মেরুদণ্ডহীন দাসদাসীরা যখন তাদের নিয়োগকর্তার কথামতো অন্ধের মতো বিবেকহীন কর্মকাণ্ড করে এবং নিয়োগকর্তার শিখিয়ে দেয়া বুলি আওড়াতে থাকে, তখন লোকজন তাদের পুতুল এবং তাদের কর্মকাণ্ডকে পুতুলনাচ বলে আখ্যা দেয়।
রঙ্গশালা বলতে এমন একটি ঘর বা স্থানকে বোঝায়, যেখানে বসে মানুষ রঙ-তামাশা করে। রঙ্গশালায় নাটক হয়, বাঈজীরা নাচে এবং কেউ বা গান করে। অনেকে তাস-পাশা খেলে। কেউ কেউ মদ-গাঁজা ইত্যাদি সেবন করে। তিন ধরনের রঙ্গশালায় রঙ্গিলা নাগরদের বাহারি কর্মকাণ্ড নিয়ে কত যে রঙ-তামাশার গল্প প্রচলিত রয়েছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। এমনটিকে বলা হয় গণরঙ্গশালা। গণরঙ্গশালা আবার তিন ধরনের, যথা- নিষিদ্ধ, অসিদ্ধ ও সাধারণ। নিষিদ্ধ রঙ্গশালাগুলো সাধারণত নিষিদ্ধ পল্লীতে হয়ে থাকে। সমাজের নীচু জাতের বিকৃত মানসিকতার রঙ্গপ্রিয় দুরাচাররা এসব রঙ্গশালার খদ্দের। এখানে হয় না এমন কুকর্ম নেই। অন্য দিকে, অসিদ্ধ রঙ্গশালাগুলো বিভিন্ন নামধাম ধারণ করে লোকালয়ে অবস্থান করে অতি গোপনে। এসব করে খদ্দের ও রঙ্গ-তামাশার উপকরণ বিশেষায়িত হওয়ার কারণে এগুলো নিষিদ্ধ পল্লীর রঙ্গশালা থেকে কিছুটা হলেও ভিন্ন। সাধারণ রঙ্গশালায় যৌনাচার ছাড়া সব কিছুই প্রকাশ্যে হয়ে থাকে। এগুলো আইনত সিদ্ধ। আধুনিক কালের ক্লাব সংস্কৃতি, ডিসকো, ক্যাবারে, হাউজি, বার, ক্লাব ইত্যাদিকে সাধারণ রঙ্গশালা বলা যেতে পারে।
গণরঙ্গশালার বাইরে আরেক ধরনের ব্যক্তিগত রঙ্গশালার গল্প কম-বেশি সবাই জানেন। আগেকার দিনের রাজা-বাদশাদের বাঈজী মহল, জমিদারদের বাগানবাড়ি এবং হাল আমলের ধনীদের মিসট্রেস হাউজকে ব্যক্তিগত রঙ্গশালা বলা হয়ে থাকে। ব্যক্তিগত রঙ্গশালা একজন ব্যক্তি কিংবা তার পরিবার-পরিজনের জন্য পতন, অসম্মান ও সীমাহীন দুর্ভোগ-রোগ-জরা-দারিদ্র্যের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্য দিকে গণরঙ্গশালার আধিক্যের কারণে সমাজ সংসার ও রাষ্ট্রে পচন ধরে। এগুলোর দুর্গন্ধ পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রকে অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরে। কত বড় বড় রাজবংশ, জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি এবং ক্ষমতাধররা রঙ্গশালার কবলে পড়ে কিভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছেন- তা আমরা কম-বেশি সবাই জানি।
এবার শিরোনাম প্রসঙ্গে আসা যাক। পুতুলনাচের রঙ্গশালা বলতে এমন একটি স্থানকে বুঝায়, যেখানে পুতুলেরা রঙ-তামাশা করে। এটি পুতুলনাচের চিরায়ত মঞ্চ নয়। এটি পুতুলনাচের রঙ্গমঞ্চ। এখানকার নির্জীব পুতুলেরা শুধু রঙ-তামাশা করার জন্য জীবনীশক্তিপ্রাপ্ত হয়। রঙ্গমঞ্চের পুতুলেরা যাত্রামঞ্চের পুতুলের মতো দর্শক-শ্রোতাকে বিনোদন দেয় না, বরং নিজেরা বিনোদিত হয়। পুতুলের আকার-আয়তন, গঠনপ্রণালী ইত্যাদির সাথে তার মালিকের ইচ্ছাশক্তির ওপর রঙ-তামাশার ধরন ও প্রকৃতি নির্ভর করে। পুতুলনাচের রঙ্গশালা আধুনিক চিন্তা-চেতনার নতুন এক ফিউশন। কারণ, ইতঃপূর্বে পুতুলেরা কেবল অন্যকে বিনোদন জোগাত। নিজেরা বিনোদন করার, নির্জীব থেকে জীব, নিষ্প্রণ থেকে প্রাণ লাভ এবং বাহারি রঙ-তামাশার মাধ্যমে আনন্দফুর্তি করার চিন্তা-চেতনা তাদের ডিকশনারিতে ছিল না। নতুন যুগে এসে এসব খেলনা পুতুলের যুগান্তকারী সফলতায় হয়তো তাদের মালিক যারপরনাই খুশি। তারা ঘাটে-মাঠে-বাটে নেচেগেয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষকে শুধু বিনোদিত করেনি- তামাম বিশ্বের পুতুলনাচের ইতিহাস পাল্টে দিয়েছে। ফলে তাদের মালিক তাদের একটি রঙ্গশালায় ঢুকিয়ে এজাজত দিয়েছেন- নাও বাপু! রঙ্গ করো- যা ইচ্ছে বলো- যা মনে চায় করো এবং যা ইচ্ছে খাও।
আমরা আজকের নিবন্ধের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। শিরোনামের শব্দমালার অর্থ এবং বাক্যটির সংক্ষিপ্ত ভাবসম্প্রসারণ করার পর সম্মানিত পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, পুতুলনাচের রঙ্গশালার তাৎপর্য কত বিস্তৃত ও গভীর। আপনারা এ কথাও বুঝতে পেরেছেন যে, কাদেরকে ওই নামে সম্বোধন করা হয়েছে এবং সেই সম্বোধনের মাধ্যমে উপাধিধারীদের কতটা বিশেষায়িত করা হয়েছে। অন্য দিকে, বিশেষায়িত পুতুল সম্প্রদায় বলে অভিযুক্ত লোকেরা কেন যে অস্থির প্রতিক্রিয়ায় নৃত্য করছে, তাও সম্ভবত বুঝতে পেরেছেন। আজকের এই নিবন্ধে আমি নিজের থেকে কাউকে কিছু বলিনি- কোনো মন্তব্য করিনি বা মতামত প্রদান করিনি। আমি শুধু বাংলা অভিধান মতে, একটি বাক্যের ভাবসম্প্রসারণ করেছি মাত্র।
No comments