ফেসবুক বন্ধের উপকারিতা by আনিসুল হক
সরকার
দেশে ফেসবুক বন্ধ করে দিয়েছে। দেশে নাকি ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা দেড়
কোটি। এই বিপুলসংখ্যক মানুষ একদিন হঠাৎ করে দেখল, তাদের হাতে অঢেল সময়। দিন
আগে ছিল ২৪ ঘণ্টার, সেই ২৪ ঘণ্টায় ২৪০ বার চেক ইন দিতে হতো, নোটিফিকেশন
চেক করতে হতো, স্ট্যাটাস হালনাগাদ করতে হতো, লাইক দিতে হতো, সেলফি তুলতে
হতো আর সেটা প্রকাশ করতে হতো,
ইনবক্স চেক করতে হতো, বার্তা আদান-প্রদান করতে হতো—লিখে, বলে, ভিডিও চ্যাটের মাধ্যমে। আর এখন? কোনো কাজ নেই। নদী যদি হয় রে ভরাট, কানায় কানায়, হয়ে গেলে শূন্য হঠাৎ তাকে কি মানায়? সব শূন্য, সব ফাঁকা। এখন দিন যেন আর কাটতেই চায় না। দিন যেন হয়ে পড়েছে ৪৮ ঘণ্টার।
ফেসবুক বন্ধ থাকার ফলে কী কী উপকার পাওয়া যাচ্ছে:
১. ঘাড়ে ব্যথার রোগী কমে গেছে। মাথা গুঁজে স্মার্টফোন কিংবা ল্যাপটপে ঝুঁকে থাকতে হয় না বলে স্পাইনাল কর্ডে ব্যথা নিয়ে আর আগের মতো রোগী আসছে না!
২. কলেজে-ইউনিভার্সিটিতে সকালবেলার ক্লাসগুলোতে ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষক-শিক্ষিকার উপস্থিতি বেড়ে গেছে। আর আগের মতো তাদের চোখ লাল, চুল উষ্কখুষ্ক নয়।
৩. বিবাহবিচ্ছেদের মামলা কমে যাচ্ছে। চিকিৎসকদের কাছেও বিবদমান দম্পতিদের আগমনের হার আগের চেয়ে কম।
৪. হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসের রোগীর সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। কারণ, সম্ভাব্য রোগীরা আর স্মার্টফোন বা কম্পিউটারে উবু হয়ে নেই, তাঁদের হাতে এখন অগাধ সময়, ফলে তাঁরা হাঁটছেন, দৌড়াচ্ছেন, খেলাধুলা করছেন, বাগান করছেন, ঘর মুছছেন, টেবিল গোছাচ্ছেন। তাঁদের শরীর ও স্বাস্থ্য তাই আগের চেয়ে ঢের ভালো।
৫. পরিবারে পরিবারে শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য দেখা যাচ্ছে। ছেলে মায়ের কপালে হাত দিয়ে বলছে, মা, তোমার গা তো বেশ গরম, কাজ করতে হবে না, বিশ্রাম নাও। মা ছেলের হাত ধরে কেঁদে ফেলছেন। তুই কত মাস পরে আমার মুখের দিকে তাকালি, বলতে পারিস?
৬. পাড়ার মাঠে আবার ছেলেপুলেদের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ভবিষ্যৎ খেলোয়াড় তৈরির পাইপলাইন ধীরে ধীরে পূর্ণ হয়ে উঠছে।
৭. বইয়ের দোকানে, পাঠাগারে আবার লোকজন আসতে শুরু করেছে। বিক্রি বেড়েছে পত্রিকার হার্ড কপির।
৮. ফটো স্টুডিওতে ফটোর প্রিন্ট নেওয়ার লোক আস্তে আস্তে আসতে শুরু করেছে।
৯. টেবিলের খাবারদাবারের আয়োজন দেখে লোকে আর বলছে না, ভাবি, খুব সুন্দর রান্না হয়েছে, ছবি তুলি; বরং বলছে, বাহ্, দারুণ টেস্টি হয়েছে তো! আরেকটু নিই!
ফেসবুক বন্ধ থাকার ফলে কী কী অসুবিধা হচ্ছে?
১. যাঁরা ফেসবুকের মাধ্যমে প্রচার চালিয়ে ব্যবসা করতেন, তাঁদের ব্যবসা মাঠে মারা যাচ্ছে। অনেকেই অনলাইন শপ চালান, চুড়ি, ফিতা, গয়নাগাটি, শাড়ি থেকে শুরু করে প্লট, গাড়ি, বাড়ি বিক্রি করার জন্য ফেসবুকে প্রচারের সুবিধা গ্রহণ করেন, তাঁদের ব্যবসা কার্যত বন্ধের উপক্রম।
২. কেউ কেউ আছেন, আউটসোর্সিং করতেন ফেসবুকে, লাইক কেনাবেচাও করতেন, তাঁদেরও ব্যবসা বন্ধ।
৩. কেউ কেউ আছেন ফেসবুকজীবী, ফেসবুক আছে তো তিনি আছেন, ফেসবুক নাই তো, তিনিও নাই, তাঁদের অস্তিত্ব এখন হুমকির সম্মুখীন।
৪. স্মার্টফোনের বিক্রি কমে গেছে।
সবদিক বিবেচনা করলে দেখা যায়, ফেসবুক বন্ধের উপকারিতাই বেশি।
তবে আসল কথা হলো নিরাপত্তা। বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য আমরা যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত আছি। সরকার যদি নাগরিকদের বোঝাতে পারে, ফেসবুক বন্ধের ফলে তারা কীভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে, তাহলে সবাই সরকারকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছে। অন্যদিকে, যারা রাষ্ট্রের ও নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য আসলে হুমকি, তারা সাধারণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের চেয়ে দক্ষ। বিকল্প পদ্ধতিতে বাংলাদেশে বন্ধ সাইটগুলো যদি সাধারণ নাগরিকেরাই ব্যবহার করতে পারে, এসব দক্ষ ব্যক্তি পারবে না, তা হওয়ার কারণ নেই।
সে ক্ষেত্রে আমাদের স্মরণ করতে হবে দুটো গল্প।
১. রোমের জ্ঞানী ব্যক্তিরা একবার ঠিক করলেন পাখি পুষবেন। তাঁরা বাগানের চারদিকে উঁচু দেয়াল তুলে ভেতরে পাখি রাখলেন। সব পাখি উড়ে চলে গেল। জ্ঞানী ব্যক্তিরা আবার সেমিনার করে পাখির উড়াল দেওয়ার কারণ আবিষ্কার করলেন, আমরা আমাদের দেয়াল যথেষ্ট উঁচু করিনি।
২. রবীন্দ্রনাথের জুতা আবিষ্কারের গল্প। ধুলা দূর করতে ঝাড়ু দেওয়া হলো জগৎজুড়ে। রাজা বললেন, জগৎ হতে করিতে ধুলা দূর, জগৎ হলো ধুলায় ভরপুর। তখন আবার পানি সেচা হলো। রাজা বললেন, এমনি সব গাধা, ধুলারে মারি করিয়া দিল কাদা। তারপর ঠিক হলো, পুরো পৃথিবী চামড়া দিয়ে মোড়া হবে। এক বৃদ্ধ মুচি এসে বলল, নিজের দুটি চরণ ঢাকো তবে, ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।
দুষ্কৃতকারীদের চেয়ে রাষ্ট্রকে বেশি স্মার্ট হতে হবে। আমাদের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব যাঁরা নিয়েছেন, তাঁদের বুদ্ধিমান, দক্ষ, সুসজ্জিত ও সুপ্রশিক্ষিত হতে হবে। তাঁদের লোকবল দরকার হবে, যন্ত্রবল দরকার হবে, দরকার হবে প্রযুক্তিবল।
আর নাগরিকদেরও ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, মানুষের জীবন মূল্যবান, নিরাপত্তা হলো প্রথম অগ্রাধিকার।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
ইনবক্স চেক করতে হতো, বার্তা আদান-প্রদান করতে হতো—লিখে, বলে, ভিডিও চ্যাটের মাধ্যমে। আর এখন? কোনো কাজ নেই। নদী যদি হয় রে ভরাট, কানায় কানায়, হয়ে গেলে শূন্য হঠাৎ তাকে কি মানায়? সব শূন্য, সব ফাঁকা। এখন দিন যেন আর কাটতেই চায় না। দিন যেন হয়ে পড়েছে ৪৮ ঘণ্টার।
ফেসবুক বন্ধ থাকার ফলে কী কী উপকার পাওয়া যাচ্ছে:
১. ঘাড়ে ব্যথার রোগী কমে গেছে। মাথা গুঁজে স্মার্টফোন কিংবা ল্যাপটপে ঝুঁকে থাকতে হয় না বলে স্পাইনাল কর্ডে ব্যথা নিয়ে আর আগের মতো রোগী আসছে না!
২. কলেজে-ইউনিভার্সিটিতে সকালবেলার ক্লাসগুলোতে ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষক-শিক্ষিকার উপস্থিতি বেড়ে গেছে। আর আগের মতো তাদের চোখ লাল, চুল উষ্কখুষ্ক নয়।
৩. বিবাহবিচ্ছেদের মামলা কমে যাচ্ছে। চিকিৎসকদের কাছেও বিবদমান দম্পতিদের আগমনের হার আগের চেয়ে কম।
৪. হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসের রোগীর সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। কারণ, সম্ভাব্য রোগীরা আর স্মার্টফোন বা কম্পিউটারে উবু হয়ে নেই, তাঁদের হাতে এখন অগাধ সময়, ফলে তাঁরা হাঁটছেন, দৌড়াচ্ছেন, খেলাধুলা করছেন, বাগান করছেন, ঘর মুছছেন, টেবিল গোছাচ্ছেন। তাঁদের শরীর ও স্বাস্থ্য তাই আগের চেয়ে ঢের ভালো।
৫. পরিবারে পরিবারে শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য দেখা যাচ্ছে। ছেলে মায়ের কপালে হাত দিয়ে বলছে, মা, তোমার গা তো বেশ গরম, কাজ করতে হবে না, বিশ্রাম নাও। মা ছেলের হাত ধরে কেঁদে ফেলছেন। তুই কত মাস পরে আমার মুখের দিকে তাকালি, বলতে পারিস?
৬. পাড়ার মাঠে আবার ছেলেপুলেদের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ভবিষ্যৎ খেলোয়াড় তৈরির পাইপলাইন ধীরে ধীরে পূর্ণ হয়ে উঠছে।
৭. বইয়ের দোকানে, পাঠাগারে আবার লোকজন আসতে শুরু করেছে। বিক্রি বেড়েছে পত্রিকার হার্ড কপির।
৮. ফটো স্টুডিওতে ফটোর প্রিন্ট নেওয়ার লোক আস্তে আস্তে আসতে শুরু করেছে।
৯. টেবিলের খাবারদাবারের আয়োজন দেখে লোকে আর বলছে না, ভাবি, খুব সুন্দর রান্না হয়েছে, ছবি তুলি; বরং বলছে, বাহ্, দারুণ টেস্টি হয়েছে তো! আরেকটু নিই!
ফেসবুক বন্ধ থাকার ফলে কী কী অসুবিধা হচ্ছে?
১. যাঁরা ফেসবুকের মাধ্যমে প্রচার চালিয়ে ব্যবসা করতেন, তাঁদের ব্যবসা মাঠে মারা যাচ্ছে। অনেকেই অনলাইন শপ চালান, চুড়ি, ফিতা, গয়নাগাটি, শাড়ি থেকে শুরু করে প্লট, গাড়ি, বাড়ি বিক্রি করার জন্য ফেসবুকে প্রচারের সুবিধা গ্রহণ করেন, তাঁদের ব্যবসা কার্যত বন্ধের উপক্রম।
২. কেউ কেউ আছেন, আউটসোর্সিং করতেন ফেসবুকে, লাইক কেনাবেচাও করতেন, তাঁদেরও ব্যবসা বন্ধ।
৩. কেউ কেউ আছেন ফেসবুকজীবী, ফেসবুক আছে তো তিনি আছেন, ফেসবুক নাই তো, তিনিও নাই, তাঁদের অস্তিত্ব এখন হুমকির সম্মুখীন।
৪. স্মার্টফোনের বিক্রি কমে গেছে।
সবদিক বিবেচনা করলে দেখা যায়, ফেসবুক বন্ধের উপকারিতাই বেশি।
তবে আসল কথা হলো নিরাপত্তা। বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য আমরা যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত আছি। সরকার যদি নাগরিকদের বোঝাতে পারে, ফেসবুক বন্ধের ফলে তারা কীভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে, তাহলে সবাই সরকারকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছে। অন্যদিকে, যারা রাষ্ট্রের ও নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য আসলে হুমকি, তারা সাধারণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের চেয়ে দক্ষ। বিকল্প পদ্ধতিতে বাংলাদেশে বন্ধ সাইটগুলো যদি সাধারণ নাগরিকেরাই ব্যবহার করতে পারে, এসব দক্ষ ব্যক্তি পারবে না, তা হওয়ার কারণ নেই।
সে ক্ষেত্রে আমাদের স্মরণ করতে হবে দুটো গল্প।
১. রোমের জ্ঞানী ব্যক্তিরা একবার ঠিক করলেন পাখি পুষবেন। তাঁরা বাগানের চারদিকে উঁচু দেয়াল তুলে ভেতরে পাখি রাখলেন। সব পাখি উড়ে চলে গেল। জ্ঞানী ব্যক্তিরা আবার সেমিনার করে পাখির উড়াল দেওয়ার কারণ আবিষ্কার করলেন, আমরা আমাদের দেয়াল যথেষ্ট উঁচু করিনি।
২. রবীন্দ্রনাথের জুতা আবিষ্কারের গল্প। ধুলা দূর করতে ঝাড়ু দেওয়া হলো জগৎজুড়ে। রাজা বললেন, জগৎ হতে করিতে ধুলা দূর, জগৎ হলো ধুলায় ভরপুর। তখন আবার পানি সেচা হলো। রাজা বললেন, এমনি সব গাধা, ধুলারে মারি করিয়া দিল কাদা। তারপর ঠিক হলো, পুরো পৃথিবী চামড়া দিয়ে মোড়া হবে। এক বৃদ্ধ মুচি এসে বলল, নিজের দুটি চরণ ঢাকো তবে, ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।
দুষ্কৃতকারীদের চেয়ে রাষ্ট্রকে বেশি স্মার্ট হতে হবে। আমাদের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব যাঁরা নিয়েছেন, তাঁদের বুদ্ধিমান, দক্ষ, সুসজ্জিত ও সুপ্রশিক্ষিত হতে হবে। তাঁদের লোকবল দরকার হবে, যন্ত্রবল দরকার হবে, দরকার হবে প্রযুক্তিবল।
আর নাগরিকদেরও ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, মানুষের জীবন মূল্যবান, নিরাপত্তা হলো প্রথম অগ্রাধিকার।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments