আমার সব সময়ের শিক্ষক by আবুল মাল আবদুল মুহিত
খান সারওয়ার মুরশিদ |
ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫১ সালে আমি ইংরেজি বিভাগে স্নাতক (সম্মান) কোর্সে ভর্তি
হই। শিক্ষকদের মধ্যে কতিপয় আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। অন্তত তিনজনের নাম
আমাকে বলতেই হবে। অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ, অধ্যাপক জ্যোতির্ময়
গুহঠাকুরতা ও অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী।
খান সারওয়ার মুরশিদ আমাদের ক্লাসে মাত্র বছর দেড়েক পড়িয়েছিলেন। তিনি সপ্তদশ শতাব্দীর ইংরেজি সাহিত্য আমাদের পড়াতেন এবং উচ্চশিক্ষার জন্য সম্ভবত ১৯৫২ সালেই বিলেত চলে যান। তাঁর ক্লাস সম্বন্ধে সামান্য কিছুই মনে আছে। আমাদের ধারণা, তাঁর ক্লাসে আমরা বুদ্ধিবৃত্তির একটি উচ্চ মার্গে চলে যেতাম। আমরা আরও ভাবতাম, তিনি বোধ হয় ছাত্রদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে আমরা বুঝতে পারলাম, তিনি অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পেলাম প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ও সংস্কৃতি সংসদ এবং এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন তিনি।
তারপরে জানলাম এবং দেখলাম, নিউ ভ্যালুজ নামক একটি অত্যন্ত উঁচুমানের ইংরেজি জার্নালের তিনি সম্পাদক। এই ত্রৈমাসিক প্রায় ১৭ বছর টিকে থাকে এবং তা সম্ভব হয় স্যারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং নিবেদনের ফলে। নিউ ভ্যালুজ-এ স্যারের উন্নত চিন্তাভাবনা, প্রগতিশীল সমাজচিন্তা, আধুনিকতা ও সংস্কারমুক্ত অবস্থানের পরিচয় পাওয়া যায়। প্রায় চার যুগ পরে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধ সংকলন কালের কথাতেও সেই চিন্তাশীল ব্যক্তির আরও পরিশীলিত মতামত ও জীবনদর্শনের পরিচয় মেলে।
১৯৫১ সালের শেষ মাসে স্যারের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সূচনা হয়। উপলক্ষ ছিল আমাদের বিভাগের বার্ষিক বনভোজন। আমরা মুন্সিগঞ্জ হয়ে ঐতিহাসিক সোনারগাঁ ভ্রমণ করি। মুন্সিগঞ্জ থেকে সোনারগাঁ আমরা রওনা হই তিন দল। এক দলে নেতৃত্ব দেন অধ্যাপক টার্নার, আরেক দলের খান সারওয়ার মুরশিদ এবং অন্য দলে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা।
খান সারওয়ার মুরশিদের স্ত্রী নূরজাহান মুরশিদ রাজনীতি করেছেন, শিক্ষকতা করেছেন এবং সাহিত্যসেবা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় তিনি প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন। স্যার কিন্তু চিরদিনই শিক্ষক ছিলেন। আমার ধারণা, তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, শিক্ষক যদি সার্থকভাবে শিক্ষার্থীর মনে জ্ঞানস্পৃহা সৃষ্টি করতে পারেন, তাহলেই তাঁর কর্তব্য সম্পাদন হবে। নিজের জীবনে তিনি মনে হয় তা-ই করে গেছেন এবং সে জন্য আমি আজীবন তাঁর একজন ছাত্র।
তাঁর সম্পর্কে অধ্যাপক গোলাম মুরশিদ খুব চমৎকার একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার কিছুদিনের জন্য উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে তিনি ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ স্থাপন করলেন। সেখানে নামকরা পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে যেতেন, তাঁদের বক্তব্য শুনতেন এবং তাঁদের শিক্ষক ও ছাত্রমহলে পরিচয় করিয়ে দিতেন। এই উদ্যোগ গোলাম মুরশিদকে খুবই অভিভূত ও প্রভাবিত করে। এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে স্যার শিক্ষক এবং ছাত্রদের যুগপৎ চিন্তার বাতায়ন উন্মুক্ত করে দিতেন এবং অনেককেই গবেষণার পথে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিতেন। গোলাম মুরশিদ তাঁর প্রবন্ধে বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও শিক্ষকদের বৃহত্তর পৃথিবীতে সেতুবন্ধে স্যার সফল উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি নিজে তাঁর চিন্তার দিগন্ত বিস্তৃত করেন এবং গবেষণার ক্ষেত্রে আগ্রহ পান।
ষাটের দশকের প্রথমার্ধে স্যার যখন হার্ভার্ডে কিছুদিন গবেষণায় রত ছিলেন, তখন আমিও সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতাম। স্যার সেখানে সপরিবারে অবস্থান নেন এবং আমি ও আমার স্ত্রী তাঁদের সান্নিধ্য ও সখ্য অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করি। তাঁর সঙ্গে আবার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে সত্তরের দশকে বাংলাদেশে। পরবর্তীকালে নব্বইয়ের দশক থেকে স্যারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা অনেক বেশি হয়। তাঁর একটি বিশেষত্ব হচ্ছে, তিনি কঠোর সত্যকথনে কখনো পিছপা হন না। এ জন্য হয়তো অনেক সময় এবং অনেকের কাছে তিনি নির্বিবাদে গ্রহণযোগ্য নন।
রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৬১ সালে স্যার একটি সাহসী ভূমিকা পালন করেন। আমি এই ভূমিকা সম্বন্ধে প্রতিপক্ষ হিসেবে অবহিত ছিলাম এবং গভীরভাবে তাঁকে শ্রদ্ধা করতে শিখি। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের জন্য ঢাকায় ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু অনুষ্ঠানটি যাতে না হয়, সে জন্য তদানীন্তন সরকার সচেষ্ট ছিল। আমি সেই সরকারের একজন কর্মকর্তা হিসেবে ব্যাপারটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে যাই। জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন কমিটি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠান করার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করে। তখন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে কোনো অনুষ্ঠান করার জন্য সরকারের সম্মতি লাগত। সেই সম্মতি আমি তাঁদের প্রদান করি। কিন্তু পরবর্তীকালে আমার দেওয়া এই অনুমতিপত্র বাতিল করে দেওয়া হয়। ২০১১ সালে আমরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রবীন্দ্র সার্ধশতবার্ষিকী উদ্যাপন করেছি। আমি নিশ্চিত জানি, অধ্যাপক মুরশিদ তখন বয়সের ভারে গৃহবন্দী হলেও এতে খুবই আনন্দ উপভোগ করেছেন।
খান সারওয়ার মুরশিদ ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন, মাঝখানে ১৯৭২ সালে রাজশাহীতে উপাচার্য হন এবং ১৯৭৫ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রদূত ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক দায়িত্ব পালন করে আবার শিক্ষকতায় প্রত্যাবর্তন করেন ১৯৮২ সালে। ১৯৮৪ সালে অবসর নেওয়ার পর ২০০৩ সাল পর্যন্ত নিয়মিত শিক্ষক হিসেবেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেন। আমরা জানি, খান সারওয়ার মুরশিদ মুক্তিযুদ্ধের সময় মূল্যবান অবদান রাখেন। ১৯৭১-এর উত্তাল মার্চে বঙ্গবন্ধু যেসব বুদ্ধিজীবীর পরামর্শ গ্রহণ করেন, তাঁদের মধ্যে তিনিও ছিলেন একজন। মুক্তিযুদ্ধে মুরশিদ দম্পতি গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। স্যার প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এ ছাড়া মুজিবনগর সরকার ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে যখন একটি পরিকল্পনা কমিশন গঠন করে, তখন তিনি হন সেই কমিশনের অন্যতম সদস্য।
আইউবের সামরিক শাসন আমল তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে শিক্ষাঙ্গনের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেন শিক্ষক সমিতির সম্পাদক হিসেবে। এহেন ব্যক্তি যে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখবেন, তা ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। ১৯৭১ সালে তিনি সপরিবারে সীমানা অতিক্রম করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। অধ্যাপক মুরশিদ চেহারায় যেমন ছিলেন সুশ্রী, তেমনি ব্যবহারে অমায়িক। শিক্ষার প্রতি যেমন নিবেদিত, তেমনি ছিলেন একজন অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন জীবনের অধিকারী।
তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি রইল একজন বিমোহিত ছাত্রের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আবুল মাল আবদুল মুহিত: বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী। সংসদ সদস্য।
খান সারওয়ার মুরশিদ আমাদের ক্লাসে মাত্র বছর দেড়েক পড়িয়েছিলেন। তিনি সপ্তদশ শতাব্দীর ইংরেজি সাহিত্য আমাদের পড়াতেন এবং উচ্চশিক্ষার জন্য সম্ভবত ১৯৫২ সালেই বিলেত চলে যান। তাঁর ক্লাস সম্বন্ধে সামান্য কিছুই মনে আছে। আমাদের ধারণা, তাঁর ক্লাসে আমরা বুদ্ধিবৃত্তির একটি উচ্চ মার্গে চলে যেতাম। আমরা আরও ভাবতাম, তিনি বোধ হয় ছাত্রদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে আমরা বুঝতে পারলাম, তিনি অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পেলাম প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ও সংস্কৃতি সংসদ এবং এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন তিনি।
তারপরে জানলাম এবং দেখলাম, নিউ ভ্যালুজ নামক একটি অত্যন্ত উঁচুমানের ইংরেজি জার্নালের তিনি সম্পাদক। এই ত্রৈমাসিক প্রায় ১৭ বছর টিকে থাকে এবং তা সম্ভব হয় স্যারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং নিবেদনের ফলে। নিউ ভ্যালুজ-এ স্যারের উন্নত চিন্তাভাবনা, প্রগতিশীল সমাজচিন্তা, আধুনিকতা ও সংস্কারমুক্ত অবস্থানের পরিচয় পাওয়া যায়। প্রায় চার যুগ পরে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধ সংকলন কালের কথাতেও সেই চিন্তাশীল ব্যক্তির আরও পরিশীলিত মতামত ও জীবনদর্শনের পরিচয় মেলে।
১৯৫১ সালের শেষ মাসে স্যারের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সূচনা হয়। উপলক্ষ ছিল আমাদের বিভাগের বার্ষিক বনভোজন। আমরা মুন্সিগঞ্জ হয়ে ঐতিহাসিক সোনারগাঁ ভ্রমণ করি। মুন্সিগঞ্জ থেকে সোনারগাঁ আমরা রওনা হই তিন দল। এক দলে নেতৃত্ব দেন অধ্যাপক টার্নার, আরেক দলের খান সারওয়ার মুরশিদ এবং অন্য দলে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা।
খান সারওয়ার মুরশিদের স্ত্রী নূরজাহান মুরশিদ রাজনীতি করেছেন, শিক্ষকতা করেছেন এবং সাহিত্যসেবা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় তিনি প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন। স্যার কিন্তু চিরদিনই শিক্ষক ছিলেন। আমার ধারণা, তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, শিক্ষক যদি সার্থকভাবে শিক্ষার্থীর মনে জ্ঞানস্পৃহা সৃষ্টি করতে পারেন, তাহলেই তাঁর কর্তব্য সম্পাদন হবে। নিজের জীবনে তিনি মনে হয় তা-ই করে গেছেন এবং সে জন্য আমি আজীবন তাঁর একজন ছাত্র।
তাঁর সম্পর্কে অধ্যাপক গোলাম মুরশিদ খুব চমৎকার একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার কিছুদিনের জন্য উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে তিনি ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ স্থাপন করলেন। সেখানে নামকরা পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে যেতেন, তাঁদের বক্তব্য শুনতেন এবং তাঁদের শিক্ষক ও ছাত্রমহলে পরিচয় করিয়ে দিতেন। এই উদ্যোগ গোলাম মুরশিদকে খুবই অভিভূত ও প্রভাবিত করে। এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে স্যার শিক্ষক এবং ছাত্রদের যুগপৎ চিন্তার বাতায়ন উন্মুক্ত করে দিতেন এবং অনেককেই গবেষণার পথে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিতেন। গোলাম মুরশিদ তাঁর প্রবন্ধে বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও শিক্ষকদের বৃহত্তর পৃথিবীতে সেতুবন্ধে স্যার সফল উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি নিজে তাঁর চিন্তার দিগন্ত বিস্তৃত করেন এবং গবেষণার ক্ষেত্রে আগ্রহ পান।
ষাটের দশকের প্রথমার্ধে স্যার যখন হার্ভার্ডে কিছুদিন গবেষণায় রত ছিলেন, তখন আমিও সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতাম। স্যার সেখানে সপরিবারে অবস্থান নেন এবং আমি ও আমার স্ত্রী তাঁদের সান্নিধ্য ও সখ্য অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করি। তাঁর সঙ্গে আবার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে সত্তরের দশকে বাংলাদেশে। পরবর্তীকালে নব্বইয়ের দশক থেকে স্যারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা অনেক বেশি হয়। তাঁর একটি বিশেষত্ব হচ্ছে, তিনি কঠোর সত্যকথনে কখনো পিছপা হন না। এ জন্য হয়তো অনেক সময় এবং অনেকের কাছে তিনি নির্বিবাদে গ্রহণযোগ্য নন।
রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৬১ সালে স্যার একটি সাহসী ভূমিকা পালন করেন। আমি এই ভূমিকা সম্বন্ধে প্রতিপক্ষ হিসেবে অবহিত ছিলাম এবং গভীরভাবে তাঁকে শ্রদ্ধা করতে শিখি। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের জন্য ঢাকায় ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু অনুষ্ঠানটি যাতে না হয়, সে জন্য তদানীন্তন সরকার সচেষ্ট ছিল। আমি সেই সরকারের একজন কর্মকর্তা হিসেবে ব্যাপারটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে যাই। জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন কমিটি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠান করার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করে। তখন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে কোনো অনুষ্ঠান করার জন্য সরকারের সম্মতি লাগত। সেই সম্মতি আমি তাঁদের প্রদান করি। কিন্তু পরবর্তীকালে আমার দেওয়া এই অনুমতিপত্র বাতিল করে দেওয়া হয়। ২০১১ সালে আমরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রবীন্দ্র সার্ধশতবার্ষিকী উদ্যাপন করেছি। আমি নিশ্চিত জানি, অধ্যাপক মুরশিদ তখন বয়সের ভারে গৃহবন্দী হলেও এতে খুবই আনন্দ উপভোগ করেছেন।
খান সারওয়ার মুরশিদ ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন, মাঝখানে ১৯৭২ সালে রাজশাহীতে উপাচার্য হন এবং ১৯৭৫ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রদূত ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক দায়িত্ব পালন করে আবার শিক্ষকতায় প্রত্যাবর্তন করেন ১৯৮২ সালে। ১৯৮৪ সালে অবসর নেওয়ার পর ২০০৩ সাল পর্যন্ত নিয়মিত শিক্ষক হিসেবেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেন। আমরা জানি, খান সারওয়ার মুরশিদ মুক্তিযুদ্ধের সময় মূল্যবান অবদান রাখেন। ১৯৭১-এর উত্তাল মার্চে বঙ্গবন্ধু যেসব বুদ্ধিজীবীর পরামর্শ গ্রহণ করেন, তাঁদের মধ্যে তিনিও ছিলেন একজন। মুক্তিযুদ্ধে মুরশিদ দম্পতি গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। স্যার প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এ ছাড়া মুজিবনগর সরকার ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে যখন একটি পরিকল্পনা কমিশন গঠন করে, তখন তিনি হন সেই কমিশনের অন্যতম সদস্য।
আইউবের সামরিক শাসন আমল তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে শিক্ষাঙ্গনের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেন শিক্ষক সমিতির সম্পাদক হিসেবে। এহেন ব্যক্তি যে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখবেন, তা ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক। ১৯৭১ সালে তিনি সপরিবারে সীমানা অতিক্রম করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। অধ্যাপক মুরশিদ চেহারায় যেমন ছিলেন সুশ্রী, তেমনি ব্যবহারে অমায়িক। শিক্ষার প্রতি যেমন নিবেদিত, তেমনি ছিলেন একজন অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন জীবনের অধিকারী।
তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি রইল একজন বিমোহিত ছাত্রের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আবুল মাল আবদুল মুহিত: বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী। সংসদ সদস্য।
No comments