যুদ্ধের ধকল ও উত্তরাধিকারের মনস্তত্ত্ব by আবুল মোমেন
মুক্তিযুদ্ধে
জাতি হিসেবে আমরা ঐক্যবদ্ধ ছিলাম। বাঙালির এ অভূতপূর্ব ঐক্য বঙ্গবন্ধুর
রাজনৈতিক জীবনের অবিস্মরণীয় কীর্তি। কেবল কিছু চিহ্নিত ব্যক্তি এবং ক্ষুদ্র
সংগঠন সেদিন দখলদার এবং হানাদার পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছিল। তাদের
মধ্যেই অনেকে আবার মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধে জড়িয়ে পড়েছিল।
আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম স্বাধীনতার স্বপ্ন বুকে নিয়ে, দেশপ্রেমও ছিল গভীর, এসব নিয়ে অঙ্গীকার ছিল দৃঢ়। সেদিন রূপান্তরিত বাঙালি যেমন অকুতোভয় বীরত্বে যুদ্ধ করেছে, তেমনি নিঃস্বার্থভাবে সর্বোচ্চ ত্যাগেও পিছিয়ে থাকেনি। তবু আমরা জানি যুদ্ধে আক্রমণ, হানাহানি, আঘাত, হত্যা, ধ্বংস, রক্তপাতের মতো অস্বাভাবিকতাও স্বাভাবিক। এর উপজাত হয়ে ব্যক্তি ও সমষ্টির মনস্তত্ত্বে ঘৃণা, আক্রোশ, হিংসা, জিঘাংসার মতো তীব্র নেতিবাচক প্রবণতাও প্রবলভাবে সক্রিয় থাকে। এদিকে যুদ্ধের অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতাগুলো উভয় বা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের ব্যক্তি ও সমষ্টির জন্য তীব্র মানসিক ধকলের (trauma) অভিজ্ঞতা বয়ে আনে। পেছনে যদি ঘৃণা-আক্রোশ ইত্যাদির মনস্তাত্ত্বিক ইন্ধন কার্যকর থাকে, তাহলে মানসিক ধকল থেকে বেরিয়ে আসা হয়ে পড়ে কঠিন।
স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় প্রত্যাঘাতের শিকার হই আমরা। তারপর টানা ২০ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও লক্ষ্য, আদর্শকে সরিয়ে দেশকে পাকিস্তানি ধারায় চালানো হয়েছিল। সেই ২০ বছরে এ ধারার রাজনীতি এবং ধর্মান্ধ রাজনীতি, সংগঠন, সংস্কৃতি সমাজে শিকড় বিস্তার করেছে। এটি ঘটেছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। বিএনপি মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক দলের ভূমিকা পালন করতে চাইলেও তার আওয়ামী লীগ-বিরোধী রাজনীতি কেবল ধর্মীয় জাতীয়তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠেনি, তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশে এই রাজনীতি দাঁড় করাতে গিয়ে দলটি ধর্মীয় চরমপন্থী রাজনীতির আশ্রয়দাতা বটবৃক্ষের ভূমিকাও নিয়েছে।
গণতন্ত্রে বহু দল ও বহু মত থাকবে, এটাই স্বাভাবিক এবং কাম্য। কিন্তু সব দলের জন্য ন্যূনতম আদর্শিক চেতনায় ঐকমত্য থাকা জরুরি। সব উন্নত দেশেই এটি আছে, স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য জাতিকে এটি অর্জন করে নিতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের উন্নত দেশগুলো এই জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছাতে দীর্ঘদিন বিস্তর যুদ্ধবিগ্রহ করেছে ও রক্তপাত ঘটিয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধকালীন যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল, তাতেই বুঝি বাংলাদেশের আদর্শিক সহমতের পক্ষে সবার অবস্থানের রায় ঘোষিত হয়ে গেল। আমরা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা, ধর্মীয় গোঁড়ামির চেতনা সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদের ঐতিহ্যকে অঙ্গীকার করেছিলাম। কিন্তু মানুষের অন্তরের বহুমুখী পক্ষপাত, আগ্রহ, অঙ্গীকার কি যুদ্ধের দামামার মধ্যে আদৌ বিবেচনায় এসেছিল? আমরা তো সমাজে, যেসব বিষয়ে দ্বন্দ্ব এবং বিভ্রান্ত ও বিতর্ক চলমান ছিল, যেমন ইসলাম ও বাঙালি সংস্কৃতি, ইসলাম ও বিজ্ঞানচর্চা, ধর্মীয় চেতনা ও যুক্তিবাদ, এসব নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করিনি। এমনকি আমাদের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও তো এসব নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা হয় না। সাধারণত আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে সমাজে যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে পড়ে, তাতে জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশ মোটামুটি গণতন্ত্রচর্চার জন্য মৌলিক বিষয়ে মোটা দাগে ঐকমত্যে পৌঁছে যায়। সমাজ স্থিতিশীল হয়ে ওঠে। আমরা সে জায়গায় পৌঁছাতে পারিনি।
আমাদের বিতর্কটি যুগপৎ ক্ষমতাকেন্দ্রিক এবং আদর্শভিত্তিক। যেহেতু আলোচনা ও বিতর্কচর্চার মাধ্যমে যুক্তির পথে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধারা তৈরি হয়নি, অন্ধ আবেগই বহুলাংশে ঘটনার নিয়ন্তা, তাই বিতর্ক ও দ্বন্দ্ব নিষ্পত্তিহীনভাবে চলমান। আর বিতর্ক এভাবে অমীমাংসিত চলতে থাকলে উভয় পক্ষের তৎপরতার ফলে দ্বন্দ্বের আদিম এক আঁচ ও পরিধি বাড়তে থাকে, ক্ষেত্রবিশেষে বিরোধিতা আদিম রূপেই ফিরে যেতে চাইবে। উদ্বেগের বিষয় হলো, তার কিছু লক্ষণ আমরা সমাজে দেখতে পাচ্ছি।
তথ্যপ্রযুক্তির রথে চেপে যে কালান্তর এসে দুয়ারে কড়া নাড়ছে, তার বারতা যদি আমাদের বুদ্ধিজীবীসমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব বুঝতে না পারেন বা বুঝতে দেরি করেন, তাহলে তাঁরাই তামাদি আর অকেজো হয়ে পড়বেন জাতি যুদ্ধের পরে যুদ্ধসংক্রান্ত মনস্তাত্ত্বিক উত্তরাধিকারের (Legacy) বোঝা নামানোর ফুরসত পায়নি কিংবা এ বিষয়ে নেতৃত্ব তেমন সজাগ ছিল না। বরং দ্রুত প্রত্যাঘাত আমাদের পুনরায় প্রতিরোধ ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ঠেলে দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার কারণে ক্রমেই বাস্তবতা এ রকম হয়ে উঠেছিল যে বাংলাদেশ যেন বায়ান্ন থেকে একাত্তরের চেতনাগত সব অর্জনকে অস্বীকার করে পাকিস্তানকেই অনুকরণ করতে চলেছে। যাঁরা এসব অর্জনের সঙ্গে সম্পৃক্ত আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন, যাঁরা পরবর্তীকালে এই চেতনায় বিশ্বাস করেছেন, স্বপ্ন দেখেছেন এবং যাঁরা রণাঙ্গনের যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছেন, তাঁদের জন্য এ ছিল সম্পূর্ণ উল্টোযাত্রা। তদুপরি ২০ বছর ধরে তা চলমান থাকবে তেমন বাস্তবতা মেনে নেওয়া ছিল কঠিন। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন তাঁদের জন্য পবিত্র দায়িত্ব হয়ে ওঠে। বিরোধ যখন মৌলিক এবং চরম রূপে দেখা দেয়, তখন উভয় দিকেই সম্ভাব্য শক্ত চরম অবস্থান নেওয়ার ঝোঁক বাড়ে। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ যেমন, তেমনি এর মনস্তাত্ত্বিক উত্তরাধিকারের বোঝা বহনও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। অপর পক্ষে ইসলামের যেসব জঙ্গিরূপ বিশ্বের নানা মুসলিম দেশে তৈরি হচ্ছে, তা আমদানি ও প্রয়োগের ঝোঁকও বেড়েছে। এর অনুকূলে আরও অনেক কার্যকারণ কাজ করেছে। যেমন মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম দেশের প্রতি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের আচরণ ও ভূমিকা।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে এ দেশে কোনো সময়ই, কি রাজনৈতিক নেতৃত্ব, কি বুদ্ধিজীবী সমাজ, কেউই এমন কোনো পথ দেখাতে পারেননি বা এমনভাবে পরিকল্পনা করে কাজ করেননি, যাতে নিরস্ত্র গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিংসা-ঘৃণার বৃত্ত থেকে বাইরে থাকে। বরং বিভক্তি ক্রমেই চরম রূপ নিয়েছে এবং যেন দুর্ভাগ্যজনকভাবে জাতি ক্রমেই ঘৃণা-হিংসার ক্ষুদ্র বৃত্তে আটকে পড়ছে। মনে হয় এখন এ বিষয়ে ভাবা জরুরি হয়ে পড়েছে।
ইতিহাসের দায় পালনের পাশাপাশি আইনের দায় মেটানোও জরুরি। এবং সমান জরুরি হিংসা-ঘৃণা ইত্যাদি মনস্তাত্ত্বিক উত্তরাধিকারের বোঝা থেকে জাতিকে মুক্ত করা। এ তিনটি কাজ কীভাবে একসঙ্গে করা সম্ভব, সে প্রজ্ঞাই আজ পথ দেখাতে পারে আমাদের। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায়ের আগে গণমাধ্যমে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ফাঁস লাগানো ছবি প্রকাশ বা রায়ের পর আনন্দ মিছিল বা মিষ্টি খাওয়া নিশ্চয় পরিণত বুদ্ধি বা প্রজ্ঞাপূর্ণ কাজ নয়। প্রতিটি প্রাণই প্রাণ, প্রতিটি মৃত্যুই মৃত্যু। তাকে ন্যায়বিচারের অমোঘ বিধান হিসেবেই দেখতে হবে, এর বেশি কিছু নয়।
কিন্তু আক্রোশ ও উল্লাসের মনস্তত্ত্বটা আমি বুঝি। যুদ্ধাপরাধীরা জীবৎকালে কখনো তাঁদের ভুল স্বীকার করেননি, মুক্তিযুদ্ধকে মেনে নেননি, উল্টো এ মনোভাব নিয়েই ক্ষমতায় বসেছেন, জাতীয় পতাকা উড়িয়ে গাড়িতে চলেছেন এবং সুযোগ পেলে আত্মপক্ষে যে দম্ভোক্তি করেছেন ও অপর পক্ষের প্রতি যেসব বক্রোক্তি করতে ছাড়েননি, তার মধ্যকার প্রতিশোধ চরিতার্থ করার আনন্দ ঢাকা থাকে না। এর মধ্যে অবশ্যই অন্যায় ও উসকানি আছে। এও বুঝি অতীতের অভিজ্ঞতা থেকেই ভাবা স্বাভাবিক যে কোনো কারণে ক্ষমতার রদবদল হলে যুদ্ধাপরাধীরা ছাড়া পেয়ে পুনরায় ক্ষমতাবান হয়ে ফিরে আসবেন। তাঁরা বা তাঁদের দলবল হয়তো প্রতিহিংসার পথে চলবে, এমন আশঙ্কাও কাজ করে। কিন্তু আমরা তো মানুষ এবং যাঁরা জানেন যে তাঁরাই মূলধারা, তাঁরাই এ দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবেন, তাঁদের তো চলমান বর্তমানের পাশাপাশি, বরং তার চেয়েও বেশি গুরুত্বের সঙ্গে ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের অর্জনই যেন ভবিষ্যতের মূলধারা হিসেবে টিকে থাকে সে জন্য কাজ করতে হবে। তাতে ঘাটতি থেকে গেলে অতীতের মহৎ অর্জনকে ডিঙিয়ে এই এক অনভিপ্রেত বর্তমান আমাদের পিছু ছাড়বে না।
আমরা সবাই লক্ষ করছি একবিংশ শতাব্দীতে একটা কালান্তর চলছে। মানুষের বিকাশ ও উন্নতির নানা নতুন পথ ও বিকল্প তৈরি হয়েছে। দেশের সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষ মাঠপর্যায় থেকে চমকপ্রদ সব অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাফল্যের অর্জনে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। শিক্ষার বিষয়ে সরকার ও জনগণ সচেতন হয়েছে, এমনকি শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের পথেও সচেতনতা লক্ষ করা যাচ্ছে। মাদকের সর্বনাশা ছোবল বা জঙ্গিবাদের প্রসার ঘটতে দেখেও বলতে চাই, মানুষের মধ্যে শুভবোধ জাগানোর মতো
আবহ বিরাজ করছে, যা যেকোনো গঠনমূলক ও ভবিষ্যৎমুখী শুভ কার্যক্রমকে বিবেচনায় নিতে সক্ষম। অর্থাৎ নতুন কিছু কথা বলার, নতুনভাবে ভাবার এটাই বোধ হয় সময়।
আমরা জানি, কালান্তরের হাওয়া বইতে শুরু করলে তাকে ঠেকানো যায় না। ইংরেজের সংস্পর্শে আসার পরে ঊনবিংশ শতাব্দীজুড়ে ও বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় যে কালান্তর ঘটেছে বাংলায় ও ভারতে, তাতে মুসলিম ও হিন্দু গোঁড়া সমাজ রক্ষণশীলতার কারণে অংশ নিতে চায়নি, বিলম্বের কারণে তারাও কিন্তু পিছিয়ে পড়েছিল। আমাদের অনেকের অপছন্দ সত্ত্বেও আজকে বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতি ব্যাপক পরিবর্তনের চাপ তৈরি করেছে। তার পিছু পিছু তথ্যপ্রযুক্তির রথে চেপে যে কালান্তর এসে দুয়ারে কড়া নাড়ছে, তার বারতা যদি আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব বুঝতে না পারেন বা বুঝতে দেরি করেন, তাহলে তাঁরাই তামাদি আর অকেজো হয়ে পড়বেন। কেননা, সাধারণ মানুষ পরিবর্তনের সে বারতা পেয়েছে। তারা জেগেও উঠেছে, এগিয়ে চলেছে, নিজেদের সঙ্গে সঙ্গে এরা দেশকেও এগিয়ে নিচ্ছে, এগিয়ে নেবে। কিন্তু তারপরেও রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং বুদ্ধিজীবী সমাজ এগিয়ে না এলে এ অগ্রগতি অসম্পূর্ণ হবে, কাঠামোগতভাবে দুর্বল থাকবে এবং যখন-তখন সমাজ নৈরাজ্যে ডুবে গিয়ে খেটে-খাওয়া মানুষের, যাদের অধিকাংশই তরুণ উদ্যোক্তা-স্বপ্নযাত্রার ভরাডুবি ঘটাবে। এই বিপর্যয়ের জন্য কে হবেন দায়ী?
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম স্বাধীনতার স্বপ্ন বুকে নিয়ে, দেশপ্রেমও ছিল গভীর, এসব নিয়ে অঙ্গীকার ছিল দৃঢ়। সেদিন রূপান্তরিত বাঙালি যেমন অকুতোভয় বীরত্বে যুদ্ধ করেছে, তেমনি নিঃস্বার্থভাবে সর্বোচ্চ ত্যাগেও পিছিয়ে থাকেনি। তবু আমরা জানি যুদ্ধে আক্রমণ, হানাহানি, আঘাত, হত্যা, ধ্বংস, রক্তপাতের মতো অস্বাভাবিকতাও স্বাভাবিক। এর উপজাত হয়ে ব্যক্তি ও সমষ্টির মনস্তত্ত্বে ঘৃণা, আক্রোশ, হিংসা, জিঘাংসার মতো তীব্র নেতিবাচক প্রবণতাও প্রবলভাবে সক্রিয় থাকে। এদিকে যুদ্ধের অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতাগুলো উভয় বা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের ব্যক্তি ও সমষ্টির জন্য তীব্র মানসিক ধকলের (trauma) অভিজ্ঞতা বয়ে আনে। পেছনে যদি ঘৃণা-আক্রোশ ইত্যাদির মনস্তাত্ত্বিক ইন্ধন কার্যকর থাকে, তাহলে মানসিক ধকল থেকে বেরিয়ে আসা হয়ে পড়ে কঠিন।
স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় প্রত্যাঘাতের শিকার হই আমরা। তারপর টানা ২০ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও লক্ষ্য, আদর্শকে সরিয়ে দেশকে পাকিস্তানি ধারায় চালানো হয়েছিল। সেই ২০ বছরে এ ধারার রাজনীতি এবং ধর্মান্ধ রাজনীতি, সংগঠন, সংস্কৃতি সমাজে শিকড় বিস্তার করেছে। এটি ঘটেছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। বিএনপি মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক দলের ভূমিকা পালন করতে চাইলেও তার আওয়ামী লীগ-বিরোধী রাজনীতি কেবল ধর্মীয় জাতীয়তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠেনি, তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশে এই রাজনীতি দাঁড় করাতে গিয়ে দলটি ধর্মীয় চরমপন্থী রাজনীতির আশ্রয়দাতা বটবৃক্ষের ভূমিকাও নিয়েছে।
গণতন্ত্রে বহু দল ও বহু মত থাকবে, এটাই স্বাভাবিক এবং কাম্য। কিন্তু সব দলের জন্য ন্যূনতম আদর্শিক চেতনায় ঐকমত্য থাকা জরুরি। সব উন্নত দেশেই এটি আছে, স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য জাতিকে এটি অর্জন করে নিতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের উন্নত দেশগুলো এই জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছাতে দীর্ঘদিন বিস্তর যুদ্ধবিগ্রহ করেছে ও রক্তপাত ঘটিয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধকালীন যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল, তাতেই বুঝি বাংলাদেশের আদর্শিক সহমতের পক্ষে সবার অবস্থানের রায় ঘোষিত হয়ে গেল। আমরা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা, ধর্মীয় গোঁড়ামির চেতনা সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদের ঐতিহ্যকে অঙ্গীকার করেছিলাম। কিন্তু মানুষের অন্তরের বহুমুখী পক্ষপাত, আগ্রহ, অঙ্গীকার কি যুদ্ধের দামামার মধ্যে আদৌ বিবেচনায় এসেছিল? আমরা তো সমাজে, যেসব বিষয়ে দ্বন্দ্ব এবং বিভ্রান্ত ও বিতর্ক চলমান ছিল, যেমন ইসলাম ও বাঙালি সংস্কৃতি, ইসলাম ও বিজ্ঞানচর্চা, ধর্মীয় চেতনা ও যুক্তিবাদ, এসব নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করিনি। এমনকি আমাদের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও তো এসব নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা হয় না। সাধারণত আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে সমাজে যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে পড়ে, তাতে জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশ মোটামুটি গণতন্ত্রচর্চার জন্য মৌলিক বিষয়ে মোটা দাগে ঐকমত্যে পৌঁছে যায়। সমাজ স্থিতিশীল হয়ে ওঠে। আমরা সে জায়গায় পৌঁছাতে পারিনি।
আমাদের বিতর্কটি যুগপৎ ক্ষমতাকেন্দ্রিক এবং আদর্শভিত্তিক। যেহেতু আলোচনা ও বিতর্কচর্চার মাধ্যমে যুক্তির পথে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধারা তৈরি হয়নি, অন্ধ আবেগই বহুলাংশে ঘটনার নিয়ন্তা, তাই বিতর্ক ও দ্বন্দ্ব নিষ্পত্তিহীনভাবে চলমান। আর বিতর্ক এভাবে অমীমাংসিত চলতে থাকলে উভয় পক্ষের তৎপরতার ফলে দ্বন্দ্বের আদিম এক আঁচ ও পরিধি বাড়তে থাকে, ক্ষেত্রবিশেষে বিরোধিতা আদিম রূপেই ফিরে যেতে চাইবে। উদ্বেগের বিষয় হলো, তার কিছু লক্ষণ আমরা সমাজে দেখতে পাচ্ছি।
তথ্যপ্রযুক্তির রথে চেপে যে কালান্তর এসে দুয়ারে কড়া নাড়ছে, তার বারতা যদি আমাদের বুদ্ধিজীবীসমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব বুঝতে না পারেন বা বুঝতে দেরি করেন, তাহলে তাঁরাই তামাদি আর অকেজো হয়ে পড়বেন জাতি যুদ্ধের পরে যুদ্ধসংক্রান্ত মনস্তাত্ত্বিক উত্তরাধিকারের (Legacy) বোঝা নামানোর ফুরসত পায়নি কিংবা এ বিষয়ে নেতৃত্ব তেমন সজাগ ছিল না। বরং দ্রুত প্রত্যাঘাত আমাদের পুনরায় প্রতিরোধ ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ঠেলে দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার কারণে ক্রমেই বাস্তবতা এ রকম হয়ে উঠেছিল যে বাংলাদেশ যেন বায়ান্ন থেকে একাত্তরের চেতনাগত সব অর্জনকে অস্বীকার করে পাকিস্তানকেই অনুকরণ করতে চলেছে। যাঁরা এসব অর্জনের সঙ্গে সম্পৃক্ত আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন, যাঁরা পরবর্তীকালে এই চেতনায় বিশ্বাস করেছেন, স্বপ্ন দেখেছেন এবং যাঁরা রণাঙ্গনের যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছেন, তাঁদের জন্য এ ছিল সম্পূর্ণ উল্টোযাত্রা। তদুপরি ২০ বছর ধরে তা চলমান থাকবে তেমন বাস্তবতা মেনে নেওয়া ছিল কঠিন। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন তাঁদের জন্য পবিত্র দায়িত্ব হয়ে ওঠে। বিরোধ যখন মৌলিক এবং চরম রূপে দেখা দেয়, তখন উভয় দিকেই সম্ভাব্য শক্ত চরম অবস্থান নেওয়ার ঝোঁক বাড়ে। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ যেমন, তেমনি এর মনস্তাত্ত্বিক উত্তরাধিকারের বোঝা বহনও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। অপর পক্ষে ইসলামের যেসব জঙ্গিরূপ বিশ্বের নানা মুসলিম দেশে তৈরি হচ্ছে, তা আমদানি ও প্রয়োগের ঝোঁকও বেড়েছে। এর অনুকূলে আরও অনেক কার্যকারণ কাজ করেছে। যেমন মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম দেশের প্রতি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের আচরণ ও ভূমিকা।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে এ দেশে কোনো সময়ই, কি রাজনৈতিক নেতৃত্ব, কি বুদ্ধিজীবী সমাজ, কেউই এমন কোনো পথ দেখাতে পারেননি বা এমনভাবে পরিকল্পনা করে কাজ করেননি, যাতে নিরস্ত্র গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিংসা-ঘৃণার বৃত্ত থেকে বাইরে থাকে। বরং বিভক্তি ক্রমেই চরম রূপ নিয়েছে এবং যেন দুর্ভাগ্যজনকভাবে জাতি ক্রমেই ঘৃণা-হিংসার ক্ষুদ্র বৃত্তে আটকে পড়ছে। মনে হয় এখন এ বিষয়ে ভাবা জরুরি হয়ে পড়েছে।
ইতিহাসের দায় পালনের পাশাপাশি আইনের দায় মেটানোও জরুরি। এবং সমান জরুরি হিংসা-ঘৃণা ইত্যাদি মনস্তাত্ত্বিক উত্তরাধিকারের বোঝা থেকে জাতিকে মুক্ত করা। এ তিনটি কাজ কীভাবে একসঙ্গে করা সম্ভব, সে প্রজ্ঞাই আজ পথ দেখাতে পারে আমাদের। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায়ের আগে গণমাধ্যমে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ফাঁস লাগানো ছবি প্রকাশ বা রায়ের পর আনন্দ মিছিল বা মিষ্টি খাওয়া নিশ্চয় পরিণত বুদ্ধি বা প্রজ্ঞাপূর্ণ কাজ নয়। প্রতিটি প্রাণই প্রাণ, প্রতিটি মৃত্যুই মৃত্যু। তাকে ন্যায়বিচারের অমোঘ বিধান হিসেবেই দেখতে হবে, এর বেশি কিছু নয়।
কিন্তু আক্রোশ ও উল্লাসের মনস্তত্ত্বটা আমি বুঝি। যুদ্ধাপরাধীরা জীবৎকালে কখনো তাঁদের ভুল স্বীকার করেননি, মুক্তিযুদ্ধকে মেনে নেননি, উল্টো এ মনোভাব নিয়েই ক্ষমতায় বসেছেন, জাতীয় পতাকা উড়িয়ে গাড়িতে চলেছেন এবং সুযোগ পেলে আত্মপক্ষে যে দম্ভোক্তি করেছেন ও অপর পক্ষের প্রতি যেসব বক্রোক্তি করতে ছাড়েননি, তার মধ্যকার প্রতিশোধ চরিতার্থ করার আনন্দ ঢাকা থাকে না। এর মধ্যে অবশ্যই অন্যায় ও উসকানি আছে। এও বুঝি অতীতের অভিজ্ঞতা থেকেই ভাবা স্বাভাবিক যে কোনো কারণে ক্ষমতার রদবদল হলে যুদ্ধাপরাধীরা ছাড়া পেয়ে পুনরায় ক্ষমতাবান হয়ে ফিরে আসবেন। তাঁরা বা তাঁদের দলবল হয়তো প্রতিহিংসার পথে চলবে, এমন আশঙ্কাও কাজ করে। কিন্তু আমরা তো মানুষ এবং যাঁরা জানেন যে তাঁরাই মূলধারা, তাঁরাই এ দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবেন, তাঁদের তো চলমান বর্তমানের পাশাপাশি, বরং তার চেয়েও বেশি গুরুত্বের সঙ্গে ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের অর্জনই যেন ভবিষ্যতের মূলধারা হিসেবে টিকে থাকে সে জন্য কাজ করতে হবে। তাতে ঘাটতি থেকে গেলে অতীতের মহৎ অর্জনকে ডিঙিয়ে এই এক অনভিপ্রেত বর্তমান আমাদের পিছু ছাড়বে না।
আমরা সবাই লক্ষ করছি একবিংশ শতাব্দীতে একটা কালান্তর চলছে। মানুষের বিকাশ ও উন্নতির নানা নতুন পথ ও বিকল্প তৈরি হয়েছে। দেশের সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষ মাঠপর্যায় থেকে চমকপ্রদ সব অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাফল্যের অর্জনে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। শিক্ষার বিষয়ে সরকার ও জনগণ সচেতন হয়েছে, এমনকি শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের পথেও সচেতনতা লক্ষ করা যাচ্ছে। মাদকের সর্বনাশা ছোবল বা জঙ্গিবাদের প্রসার ঘটতে দেখেও বলতে চাই, মানুষের মধ্যে শুভবোধ জাগানোর মতো
আবহ বিরাজ করছে, যা যেকোনো গঠনমূলক ও ভবিষ্যৎমুখী শুভ কার্যক্রমকে বিবেচনায় নিতে সক্ষম। অর্থাৎ নতুন কিছু কথা বলার, নতুনভাবে ভাবার এটাই বোধ হয় সময়।
আমরা জানি, কালান্তরের হাওয়া বইতে শুরু করলে তাকে ঠেকানো যায় না। ইংরেজের সংস্পর্শে আসার পরে ঊনবিংশ শতাব্দীজুড়ে ও বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় যে কালান্তর ঘটেছে বাংলায় ও ভারতে, তাতে মুসলিম ও হিন্দু গোঁড়া সমাজ রক্ষণশীলতার কারণে অংশ নিতে চায়নি, বিলম্বের কারণে তারাও কিন্তু পিছিয়ে পড়েছিল। আমাদের অনেকের অপছন্দ সত্ত্বেও আজকে বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতি ব্যাপক পরিবর্তনের চাপ তৈরি করেছে। তার পিছু পিছু তথ্যপ্রযুক্তির রথে চেপে যে কালান্তর এসে দুয়ারে কড়া নাড়ছে, তার বারতা যদি আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব বুঝতে না পারেন বা বুঝতে দেরি করেন, তাহলে তাঁরাই তামাদি আর অকেজো হয়ে পড়বেন। কেননা, সাধারণ মানুষ পরিবর্তনের সে বারতা পেয়েছে। তারা জেগেও উঠেছে, এগিয়ে চলেছে, নিজেদের সঙ্গে সঙ্গে এরা দেশকেও এগিয়ে নিচ্ছে, এগিয়ে নেবে। কিন্তু তারপরেও রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং বুদ্ধিজীবী সমাজ এগিয়ে না এলে এ অগ্রগতি অসম্পূর্ণ হবে, কাঠামোগতভাবে দুর্বল থাকবে এবং যখন-তখন সমাজ নৈরাজ্যে ডুবে গিয়ে খেটে-খাওয়া মানুষের, যাদের অধিকাংশই তরুণ উদ্যোক্তা-স্বপ্নযাত্রার ভরাডুবি ঘটাবে। এই বিপর্যয়ের জন্য কে হবেন দায়ী?
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments